আব্রাহামিক ধর্ম | Abrahamic

আব্রাহামিক ধর্ম  | Abrahamic

অনেক ভাঙাগড়ার মধ্য দিয়ে এসেও ধর্ম আজও পৃথিবীতে মানুষের জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ। তথাপি, বর্তমান পৃথিবীতে বিদ্যমান ৪৩০০ ধর্মের বাইরেও একটি ‘ধর্ম’ রয়েছে যার অনুসারী প্রধান ৪টি ধর্মের মতোই অনেক বেশি। সেটি হলো ধর্মনিরপেক্ষ ও নাস্তিক মানুষজন, যাদের সংখ্যা ১২০ কোটিরও বেশি। এর বাইরে বিভিন্ন ধর্মের আকার নির্ধারণ করা হয় সেই ধর্মের অনুসারীর সংখ্যার বিবেচনায়।

ইব্রাহিমীয় ধর্ম বা আব্রাহামীয় ধর্ম ইংরেজিতে Abrahamic Religion), যাকে সেমেটিক ধর্ম বা সেমিটিক ধর্মও বলা হয়, এটি দ্বারা দূরপ্রাচ্য এলাকার একেশ্বরবাদী ধর্মগুলোকে বোঝানো হয়, যাদের মধ্যে আব্রাহাম বা ইব্রাহিমের সাথে সম্পর্কিত ধর্মীয় উৎপত্তি অথবা ধর্মীয় ইতিহাসগত ধারাবাহিকতা বিদ্যমান।  এইসব ধর্ম তিনি বা তার বংশধর প্রচার করেছেন। ভারত, চীন, জাপান ইত্যাদি দেশের উপজাতীয় অঞ্চল বাদ দিয়ে সারা বিশ্বে এই মতবাদের আধিপত্য। আব্রাহামিক ধর্ম (আব্রাহামিক ধর্ম ৩টি, খ্রিস্টধর্ম, ইসলাম ধর্ম এবং ইহুদী ধর্ম)।

আব্রাহামিক ধর্মকে বর্তমানে একটি ধর্মীয় প্রকল্প হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে, যার অধীনে ইসলাম, খ্রিস্টান এবং ইহুদি ধর্মের মিলের কথা মাথায় রেখে হযরত ইব্রাহিমের নামে একটি নতুন ধর্ম তৈরির কথা বলা হচ্ছে। এই ধর্ম আনার পিছনে উদ্দেশ্য এই তিন ধর্মের মধ্যে পার্থক্য দূর করা। আব্রাহামিক ধর্ম নিয়ে আলোচনা হয়তো আজ থেকে শুরু হয়েছে, কিন্তু প্রায় এক বছর ধরে আলোচনা হচ্ছে। এ নিয়ে অনেক বিতর্ক হয়েছে। যদিও আরব দেশগুলোতে বর্তমানে এই ধর্ম নিয়ে বিভ্রান্তির অবস্থা বিরাজ করছে। 

আব্রাহামিক ধর্ম বলতে ইব্রাহিম এর সাথে সম্পর্কিত একেশ্বরবাদী ধর্মগুলিকে বোঝানো হয়। এজন্য একে ইব্রাহিমীয় ধর্মও বলা হয়। আব্রাহামিক ধর্মের অনুসারীরা নবী ইব্রাহিমকে তাদের পূর্বপুরুষ হিসেবে মানে। এই ধর্মগুলির মাঝে উৎপত্তিগত ধারাবাহিকতাও বিদ্যমান। বর্তমান পৃথিবীর অর্ধেকেরও বেশি মানুষ আব্রাহামিক ধর্মের অনুসারী। প্রভাব বিস্তারকারী প্রধান তিনটি আব্রাহামিক ধর্ম হচ্ছে – ইহুদীধর্ম, খ্রিস্টধর্ম এবং ইসলামধর্ম। এছাড়া বাহাই, ইয়াজিদি এবং দ্রুজ প্রচলিত কয়েকটি আব্রাহামিক ধর্ম। উৎপত্তি অনুযায়ী আব্রাহামিক ধর্মগুলোর মাঝে সবচেয়ে প্রাচীন হচ্ছে ইহুদী ধর্ম।

আজ থেকে চার হাজার বছরেরও বেশি সময় পূর্বে আরবের উত্তরে ইজরাইল অঞ্চলে পৃথিবীর প্রথম একেশ্বরবাদী ধর্ম ইহুদীধর্মের সূচনা হয়। তখনকার আরবের নানা শাসকগোষ্ঠীর মাঝে রাজ্য ও ক্ষমতা দখলের রক্তাক্ত লড়াই চলতো। এইরকম পরিবেশে ইহুদীদের নানা ধর্মীয় অনুশাসনের স্রষ্টা মোজেস শক্তির অধিষ্ঠাতা দেবতা হিসেবে “ইয়াহুয়া” প্রতিষ্ঠা করেন। পরবর্তীতে ইজরায়েলের যাযা বর ইহুদিরা প্যালেস্টাইনের কৃষি অঞ্চল দখল করে ব্যাপক আধিপত্য বিস্তার করে এবং ইহুদী ধর্মের পরিধি বৃদ্ধি পায়।

খ্রিস্টপূর্বাব্দ ৫৩৮ এর দিকে কঠোর একেশ্বরবাদ এবং ধর্মীয় গ্রন্থগুলিকে সুসংহত করে ইহুদিধর্ম পরিপূর্ণ রূপ লাভ করে।  ইহুদী ধর্মের ধারাবাহিতায় খ্রিস্ট ধর্মের উৎপত্তি হয় এবং সবচেয়ে বড় আব্রাহামিক ধর্ম হিসেবে প্রতিষ্ঠা পায়। বিংশ খ্রিস্টাব্দের পরে প্যালেস্টাইনে খ্রিস্ট ধর্মের গোড়াপত্তন হয়। রোম সম্রাজের আগ্রাসন খ্রিস্ট ধর্মের উৎপত্তিতে প্রভাবক হিসেবে কাজ করে। রোম সম্রাজ্যের আগ্রাসনে ইউরোপ, এশিয়া ও আফ্রিকার বিশাল অঞ্চলের অনেক মানুষ দাস হিসেবে নিপীড়িত জীবন কাটাতে বাধ্য হয়।

এই বিপুল সংখ্যক মানুষের কাছে এমন একটি ধর্মমতের প্রয়োজন হয় যা তাদের শাসকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে সাহসী করে তুলবে। খ্রিস্ট ধর্মের প্রতিষ্ঠাতা যিশু সাধারণ মানুষের মধ্যে ঈশ্বরের কথা প্রচার করেন, তিনি সমাজের উঁচুনিচু ভেদ না করে সবাইকে ঈশ্বরের সন্তান হিসেবে অভিহিত করেন। যা শোষিত সাধারণ মানুষের মাঝে অনেক জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। খ্রিষ্ট ধর্মের প্রধান ধর্মগ্রন্থ নিউ টেস্টামেন্ট। বিভিন্ন সংস্কারক আন্দোলন ও ধর্মীয় মতপার্থক্যের কারণে খ্রিস্টধর্মাবলম্বীরা কয়েকভাগে বিভক্ত।

যেমন : রোমান ক্যাথলিক, প্রোটেস্ট্যান্ট, অর্থোডক্স। অনুসারীর সংখ্যা হিসেবে খ্রিস্টধর্ম হচ্ছে বর্তমান পৃথিবীর সবচেয়ে বৃহত্তম ধর্ম। প্রায় ৩৩ ভাগ এর বেশি মানুষ এই ধর্মে বিশ্বাসী।  আব্রাহামিক ধর্মগুলোর মাঝে অন্যতম ইসলাম ধর্মের গোড়াপত্তন ঘটে আরব অঞ্চলে খ্রিস্টীয় সপ্তম শতকে। তখন আরবের গোষ্ঠীগত ও ব্যবসায়িক অন্তর্দ্বন্দ্ব প্রবল আকার ধারণ করে। সমাজের অধিকাংশ মানুষ ছিল হতদরিদ্র, সম্পদ ছিল কিছু মুষ্টিমেয় মানুষের হাতে। সামাজিক অনাচার ও অমানবিক পরিবেশ চরম এক আকার ধারণ করে।

আরবের এইরকম পরিবেশে ইসলাম ধর্মের প্রবর্তক মুহাম্মদ মানুষের মাঝে সাম্য, সমতার আর ঈশ্বরের আরাধনার বাণী প্রচার শুরু করেন। প্রথম দিকে আরবের শাসকগোষ্ঠীর নানা বাধার সম্মুখীন হন। একসময় অনুসারীদের নিয়ে মক্কা ছেড়ে মদিনায় চলে যেতে বাধ্য হন। মক্কার মানুষের মাঝে মুহাম্মদের জনপ্রিয়তা এবং মদিনা জয়ের পর সম্পূর্ণ আরব আঞ্চলে ইসলাম ধর্ম ব্যাপক প্রসার লাভ করে। বর্তমানে পৃথিবীর দ্বিতীয় বৃহত্তম ধর্ম হচ্ছে ইসলাম। বর্তমান পৃথিবীর অর্ধেকেরও বেশি মানুষ আব্রাহামিক ধর্মের অনুসারী।

পৃথিবীর সব অঞ্চলে রয়েছে এই ধর্মগুলোর অনুসারী।  সম্প্রতি মিশরের আল-আজহারের সর্বোচ্চ ইমাম আহমেদ আল তাইয়েব এই নতুন ধর্ম নিয়ে মন্তব্য করেছেন। তিনি বলেন, যারা খ্রিস্টান, ইহুদি ও ইসলামকে একত্রিত করার আহ্বান জানাচ্ছে, তারা এসে বলবে সব অপশক্তি থেকে মুক্তি পাবে। তবে এই জিনিসটি জেনে রাখুন যে অন্য ধর্মকে সম্মান করা এবং অনুসরণ করা দুটি ভিন্ন জিনিস। তার মতে, সব ধর্মের মানুষকে একত্র করা সম্ভব নয়। কিছু মিশরীয় পাদ্রীও আব্রাহামিক ধর্মের অস্তিত্ব নিয়ে আপত্তি জানিয়েছেন।

এটাও বলা হচ্ছে যে, আব্রাহামিক ধর্ম প্রতারণা ও শোষণের আড়ালে একটি রাজনৈতিক আহ্বান। খবরে বলা হয়েছে, ইউএই অর্থাত্‍ সংযুক্ত আরব আমিরাত ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নে একটি চুক্তি করেছে। একে আব্রাহামিক চুক্তি বলা হয়। এখন সংযুক্ত আরব আমিরাতের বিরুদ্ধে ধর্ম প্রচারের অভিযোগ আনা হচ্ছে। যারা আব্রাহামিক ধর্মের বিরোধিতা করেছে তারা একটি অজুহাত খুঁজে পেয়েছে কারণ ইসরায়েলের পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে আসছে। নতুন ধর্মের বিরোধিতা করার অজুহাতে সংযুক্ত আরব আমিরাতে পরিস্থিতি স্বাভাবিক করার বিরুদ্ধে বিক্ষোভ শুরু করেছে মানুষ।