আবু সাদাত মোহাম্মদ সায়েম এর জীবনী

আবু সাদাত মোহাম্মদ সায়েম এর জীবনী

স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম প্রধান বিচারপতি এবং ষষ্ঠ রাষ্ট্রপতি ছিলেন আবু সাদাত মোহাম্মদ সায়েম (Abu Sadat Mohammad Sayem)। ১৯৭৫ সালের নভেম্বর মাসে বাংলাদেশের পাল্টা অভ্যুত্থানের পরে তিনি রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হয়েছিলেন। ৬ নভেম্বর ১৯৭৫ থেকে ২১ এপ্রিল ১৯৭৭ পর্যন্ত পর্বকাল বাংলাদেশের ইতিহাসের এক অনিশ্চিত সময়। এই পর্বকালেই তিনি ছিলেন বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি।

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের হত্যাকাণ্ডের পরে সামরিক বাহিনীর ভিতর সৃষ্ট অস্থিরতা, নেতৃত্বহীন রাজনৈতিক বিশৃঙ্খলা, প্রাসাদ ষড়যন্ত্র, সেনা অভ্যুত্থান – পাল্টা অভ্যুত্থানে দেশ যখন ক্ষতবিক্ষত সেই সময়েই বিচারপতি সায়েম রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ ক্ষমতা গ্রহণ করেন। আবু সাদাত মোহাম্মদ সায়েম প্রধান সামরিক আইন প্রশাসকের (Chief Martial Law Administrator) পদেও অভিষিক্ত হয়েছিলেন।

সায়েম সশস্ত্র বাহিনীর তিনজন প্রধানের নেতৃত্বে একটি মন্ত্রীসভার সভাপতিত্ব করেন। সেই মন্ত্রীসভায় বেসামরিক টেকনোক্র্যাট (Technocrat) এবং বহু রাজনীতিবিদ্‌ও ছিলেন। তিনি আরেকটি কারণে স্মরণীয় যে তিনি প্রধান বিচারপতি হিসেবে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের রাষ্ট্রপতি পদে অভিষেকের শপথবাক্য পাঠ করিয়েছিলেন। স্বাধীনতার আগে এবং পরেও বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিবেশ স্থিতিশীল হতে পারেনি সেভাবে। সেই বিশৃঙ্খল অনিশ্চিত অধ্যায়ের সাক্ষী ছিলেন তিনি।  

১৯১৬ সালের ২৯ মার্চ অধুনা বাংলাদেশের রংপুর জেলায় আবু সাদাত মোহাম্মদ সায়েমের জন্ম হয়। তাঁর বাবা-মা কিংবা পারিবারিক ইতিহাস সম্পর্কে বিশেষ কিছু জানা যায় না। আবু সাদাত মোহাম্মদ সায়েমের প্রাথমিক শিক্ষালাভ ঘটেছিল রংপুর জেলা হাই স্কুলে। সেখান থেকে কারমাইকেল কলেজে ভর্তি হন তিনি। এরপরে কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজে কিছুকাল পড়াশোনা করেন এবং ইউনিভার্সিটি ল’ কলেজ থেকে আইন বিষয়ে ডিগ্রি অর্জন করেন। আবু সাদাত মোহাম্মদ সায়েমের কর্মজীবন শুরু হয় ১৯৪৪ সালে কলকাতা হাইকোর্টের আইনজীবী হিসেবে।

পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পরে ১৯৪৭ সালে তিনি স্থায়ীভাবে ঢাকায় চলে আসেন। সেখানে ‘শের-ই-বাংলা’ এ.কে.ফজলুল হকের জুনিয়র হিসেবে ঢাকা হাইকোর্টে আইনজীবীর কাজ শুরু করেন। পরে তিনি পাকিস্তানের ফেডারেল কোর্ট এবং পাকিস্তান সুপ্রিম কোর্টের উকিল হিসেবে যোগ্যতার পরিচয় দেন। ১৯৬২ সালে তিনি ঢাকা হাইকোর্টের বিচারক নিযুক্ত হন।

১৯৭০ সালে তিনি ঢাকার নির্বাচন কমিশনের সদস্য ছিলেন। বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পরে বিচারপতি আবু সাদাত মোহাম্মদ সায়েম বাংলাদেশ হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতির দায়িত্ব গ্রহণ করেন ১৯৭২ সালের জানুয়ারি মাসে। দেশের সংবিধান গৃহীত হলে তিনি ঐ একই বছরে বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের প্রথম প্রধান বিচারপতি হিসেবে শপথ গ্রহণ করেন ডিসেম্বর মাসে। এই পদে থাকাকালীন বিখ্যাত ভারত ও বাংলাদেশের সীমানা সংক্রান্ত ‘বেরুবাড়ি কেস’-এর চূড়ান্ত রায় ঘোষণা করেছিলেন তিনি।

মেজর জেনারেল খালেদ মোশার্‌রফের নেতৃত্বে সেনা-অভ্যুত্থানের সময় ১৯৭৫ সালের ৬ নভেম্বর থেকে ১৯৭৭ সালের ২১ এপ্রিল পর্যন্ত কালপর্বে রাষ্ট্রপতি হিসেবে বিচারপতি সায়েম কাজ করে গেছেন। তাঁর আগে রাষ্ট্রপতি ছিলেন আওয়ামী লীগ নেতা খোন্দকার মোশ্‌তাক আহমেদ। মাত্র ৮১ দিনের মধ্যেই তাঁর অবৈধ শাসনপর্বের অবসান হয়েছিল।

তাঁর পর রাষ্ট্রপতির পদে অভিষিক্ত হন মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান। পূর্ব পাকিস্তান আইনজীবী এসোসিয়েশন, পূর্ব পাকিস্তান বার কাউন্সিল এবং ঢাকা বোর্ড অফ দ্য স্টেট ব্যাঙ্ক অফ পাকিস্তান –এর সদস্য ছিলেন আবু সায়েম। ১৯৭২ সালে তিনি যে বঙ্গবন্ধুর শপথবাক্য পাঠ করান, সেই ঘটনার প্রামাণ্য ছবিটি প্রথমে জাজেস লাউঞ্জে রাখা হয়েছিল। পরে এর ঐতিহাসিক গুরুত্ব বিবেচনা করে বিচারপতি এ.বি.এম খয়রুল হকের নির্দেশে তা সুপ্রিমকোর্টের বিচারপতিদের সম্মেলনকক্ষে টাঙানো হয়।

আবু সায়েমের রাষ্ট্রপতি থাকাকালীনই বাংলাদেশে সামরিক শাসন জারি হয়। তাঁর মন্ত্রীসভার তিনজন সদস্য তথা উপপ্রধান সামরিক আইনপ্রশাসক যথাক্রমে মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান, এয়ার ভাইস মার্শাল মুহাম্মাদ গোলাম তাওয়াব ও রিয়ার অ্যাডমিরাল মোশার্‌রফ হোসেন খান প্রমুখদের সিদ্ধান্তে সামরিক আইন চালু হয় বাংলাদেশে।

এই সামরিক শাসন তিন বছর সাত মাস একুশ দিন স্থায়ী হয়েছিল। বিচারপতি সায়েম মনে করেন যে পাকিস্তানিদের কাছ থেকে যে বিরূপ আচরণ বাংলাদেশের মানুষ পেয়েছে তাতে পাকিস্তান থেকে পৃথক হওয়াই ছিল স্বাভাবিক ঘটনা। বিরাট ব্যক্তিত্ব শেখ মুজিবর রহমানের নেতৃত্বে সেই স্বাধীনতা সংগ্রাম সূচিত হয়েছিল এবং তার পরিণতি হয়েছিল ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর। বাংলাদেশের মুক্তি ঘটে।

১৯৭২ সালে সংবিধান রচনাকালে হাইকোর্টের গঠন সম্পর্কে শেখ মুজিবর রহমান বিচারপতি আবু সায়েমের মতামত চেয়েছিলেন। আবু সায়েম তাঁকে দ্রুত সংবিধান রচনায় উৎসাহ দেন। এই সংবিধান প্রণয়নকালে মূলত একটি বিষয় নিয়ে শেখ মুজিবের সঙ্গে আবু সায়েমের বাদানুবাদ হয়েছিল। সেটি হল সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনী, একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অংশ। এই সংশোধনী রাষ্ট্রপতিকে এইরূপ ক্ষমতা দেয় যে তিনি তাঁর নিজের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী এমন ব্যক্তিদেরও মন্ত্রীপদে নিয়োগ করতে পারবেন যারা জনগণের ভোটে নির্বাচিত নন।

এর ফলে দেশ পরিচালনার বিষয়ে জনগণের কোনো বক্তব্যই দেশনায়কদের কাছে পৌঁছবে না। এই চতুর্থ সংশোধনী শেখ মুজিবর রহমানকে ‘বঙ্গবন্ধু’ এবং ‘জাতির পিতা’ হিসেবে বর্ণনা করে। তাছাড়া চতুর্থ সংশোধনী কার্যত রাষ্ট্রপতির অপসারণ অসম্ভব করে দেয়। যদিও আবু সায়েম জানাচ্ছেন যে, শেখ মুজিব তাঁকে আশ্বাস দিয়েছিলেন এই চতুর্থ সংশোধনীর সাময়িকতা নিয়ে। কিন্তু আবু সায়েম চেয়েছিলেন এই সংশোধনী যাতে দূরীভূত হয়। তার জন্য সংসদের দুই-তৃতীয়াংশ সদস্যের সমর্থন দরকার ছিল।

কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয় সেসময় কোনোপ্রকার সমর্থনই তিনি পাননি।    বাংলাদেশের ইতিহাসের এক গুরুত্বপূর্ণ সন্ধিক্ষণ ১৯৭৫ সালের ৬ নভেম্বর রাষ্ট্রের দায়িত্বভার গ্রহণ করেছিলেন আবু সাদাত মোহাম্মদ সায়েম। দুর্বল স্বাস্থ্য এবং আরো নানাবিধ কারণে আবু সায়েম পদত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছিলেন ১৯৭৭ সালের ২১ এপ্রিল। পদত্যাগের শেষ দিনগুলোর স্মৃতি নিয়ে ছোট্ট একটি বই লিখেন ‘আ্যাট বঙ্গভবন : লাস্ট ফেজ’ (At Bangabhawan : Last Phase) শিরোনামে। ‘দৈনিক ভোরের কাগজ’-এ ধারাবাহিকভাবে বইটির বঙ্গানুবাদ করেন মশিউল আলম।

পরে ১৯৮৮ সালে বইটি ‘বঙ্গভবনে শেষ দিনগুলি’ শিরোনামে প্রকাশ করে ঢাকার প্রকাশক মাওলা ব্রাদার্স। আনিসুজ্জামানের সুখপাঠ্য ও বিশ্লেষণধর্মী ভূমিকা বইটিকে আরো সমৃদ্ধ করেছে। সামরিক শাসনে বেসামরিক রাষ্ট্রপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে তাঁকে যেসব অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হতে হয়, তারই বিবরণ, বিশ্লেষণ এবং মূল্যায়ণ এই বইটি। তিনি তাঁর স্মৃতিকথায় বঙ্গবন্ধুর হত্যা, খোন্দকার মোশ্‌তাক আহমেদের সামরিক আইন প্রবর্তন, ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে দেশের উপরাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম, প্রধানমন্ত্রী মনসুর আলী এবং প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমেদের হত্যাকাণ্ডের উল্লেখ করেছেন।

তিনি সামরিক সরকারের রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব নিতে সম্মত হয়েছিলেন দেশ শাসনের ভার জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের হাতে হস্তান্তরের আশায়। কিন্তু কোনো নির্বাচন অনুষ্ঠিত করতে না পেরেই বঙ্গভবন থেকে তাঁকে পদত্যাগ নিতে হল কেন তারও জবানবন্দী রয়েছে এই বইতে। নির্বাচন অনুষ্ঠিত করতে না পারার জন্য আবু সায়েম দায়ী করেছেন মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমানের উচ্চাকাঙ্ক্ষা এবং বিচারপতি আব্‌দুস সাত্তারের বিরূপ-অস্বচ্ছ আচরণকে।

আবু সায়েম এই বইতে জানাচ্ছেন যে তিনি বারবার চেয়েছিলেন যাতে নির্বাচনের মাধ্যমে জনপ্রতিনিধি উঠে আসে আর এই লক্ষ্যে আব্‌দুস সাত্তারকে তিনি সহযোগী হিসেবে পান। সরকারে সর্বপ্রথম গৃহীত বেসামরিক ব্যক্তিত্ব তিনি। কিন্তু আব্‌দুস সাত্তার কোনোভাবেই নির্বাচন নিয়ে মাথা ঘামাননি। তাছাড়াও তাঁর উপদেষ্টা-পরিষদের বেশিরভাগ সদস্যের অনিচ্ছা, বাংলাদেশের রাজনৈতিক নেতাদের চারিত্রিক দূর্বলতাও এর পিছনে দায়ী ছিল বলে মনে করেছেন আবু সায়েম।

রাষ্ট্রপতি হিসেবে নিজের শেষের সময়গুলোতে কোণঠাসা হয়ে পড়েছিলেন চারদিক থেকে। উপদেষ্টাদের সবাই বিরূপ মনোভাব পোষণ করতে থাকে। তবে একজনের প্রতি নিজের অসন্তুষ্টির কথা গোপন করেননি তিনি। ভাষায়, ‘বঙ্গভবনে আমার দিনগুলোর শেষ দিকে আমার মনে হতে থাকে, আমি ক্রমশ অক্ষম হয়ে পড়ছি।

সেটা রাজনীতিক, স্থায়ী সিভিল প্রশাসনের কর্মকর্তা এবং অধিকাংশ উপদেষ্টার (বিশেষ সহযোগী বিচারপতি আবদুস সাত্তারসহ, যাঁকে আমি সবচেয়ে বেশি বিশ্বাস করতাম) আচার-আচরণের জন্য।’ বাংলাদেশের উত্তাল সময়ে প্রাসাদ রাজনীতির অন্দরমহলের কথা আবু সায়েমের লেখায় উঠে এসেছে। যদিও তা যে সম্পূর্ণ নিরপেক্ষ তা বলা যায় না। ১৯৯৭ সালের ৮ জুলাই প্রস্টেট ক্যানসার রোগে আক্রান্ত হয়ে ৮১ বছর বয়সে বিচারপতি আবু সায়েমের মৃত্যু হয়।