অজয় মুখোপাধ্যায়ঃ বাংলার প্রথম অ-কংগ্রেসি মুখ্যমন্ত্রী অজয় মুখোপাধ্যায়

পশ্চিমবঙ্গে প্রথম অকংগ্রেসি সরকারের মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার সৌভাগ্য বা সুযোগ জ্যোতি বসুর হয়নি। ১৯৬৭ সালে রাজ্য বিধানসভায় নির্বাচনের পরে যে যুক্তফ্রন্ট সরকার গড়ে উঠেছিল সেই সরকারের শীর্ষে ছিলেন তখন সদ্য কংগ্রেস ছেড়ে আসা গান্ধীবাদী নেতা অজয় মুখোপাধ্যায়৷ ১৫ এপ্রিল, ১৯০১ ছিলেন ভারতীয় বাঙালি স্বাধীনতা সংগ্রামী তথা পশ্চিমবঙ্গের চতুর্থ ও ষষ্ঠ মুখ্যমন্ত্রী। প্রেসিডেন্সি কলেজে পড়াকালীন অসহযোগ আন্দোলনে যোগদান করে পড়া ছেড়ে দেন তিনি।
জীবনের দীর্ঘ সময় জেলে বা অন্তরীন অবস্থায় কাটে। ১৯৪২ ভারত ছাড় আন্দোলেনর সময় তার তৈরী বিদ্যুৎবাহিনী তাম্রলিপ্ত জাতীয় সরকার গঠনে ভূমিকা রেখেছিল। সেই সময় ব্রিটিশ সরকারকে যথেষ্ট বেগ পেতে হয়েছিল এই বিদ্যুৎ বাহিনী দমন করতে। অজয় মুখোপাধ্যায়ের বাড়ি ছিল তমলুকের মালিজঙ্গলে। সাবেকি বনেদিয়ানার ছাপ মাখা বাড়ি। তবে তাঁরা তমলুকের আদি বাসিন্দা নন। আদতে তাঁরা হুগলির বাসিন্দা ছিলেন। বাবা শরৎ মুখোপাধ্যায় ছিলেন আইনজীবী।
আইন ব্যবসার কারণেই শরৎ মুখোপাধ্যায় তমলুকে আসেন। তিনি তমলুক বার অ্যাসোসিয়েশনের সম্পাদকও হয়েছিলেন। তরুণ অজয় স্বাধীনতা আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন। মোহনদাস কর্মচন্দ গাঁধীর ডাকে অসহযোগ, আইন অমান্য এবং ভারত ছাড়ো আন্দোলনে ব্যাপক ভাবে সাড়া দিয়েছিল তমলুক। সেই আন্দোলনের যাঁরা নেতৃত্ব দিয়েছিলেন তাঁদের একজন ছিলেন অজয় মুখোপাধ্যায়। ১৯৪২ সালের ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন তমলুকে চরম পর্যায়ে পৌঁছেছিল।
কারণ ওই বছরের ১৭ ডিসেম্বর স্বাধীন‘মহাভারতীয় যুক্তরাষ্ট্র তাম্রলিপ্ত জাতীয় সরকার’ ঘোষণা হয়েছিল। স্বাধীন সরকার গঠনের অন্যতম কান্ডারি ছিলেন তিনি। সরকারের সর্বাধিনায়ক সতীশচন্দ্র সামন্ত ব্রিটিশ পুলিশের হাতে গ্রেফতার হলে তিনি দ্বিতীয় সর্বাধিনায়কের দায়িত্ব নেন। পরে তিনিও গ্রেফতার হন। মুক্তি পেয়েছিলেন প্রফুল্লচন্দ্র ঘোষের নেতৃত্বে ছায়া মন্ত্রিসভার চেষ্টায়। তার পর দেশ স্বাধীন হল। ১৯৫২ সালে দেশের প্রথম সাধারণ উপনির্বাচনে তমলুক বিধানসভা কেন্দ্র থেকে কংগ্রেস প্রার্থী হলেন।
দাঁড়াতে হল নিজের ভাই বিশ্বনাথ মুখোপাধ্যায়ের বিরুদ্ধে। বিশ্বনাথ ছিলেন ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টির প্রার্থী। অজয় মুখোপাধ্যায় হলেন মুখ্যমন্ত্রী বিধানচন্দ্র রায়ের মন্ত্রিসভার সেচ ও জলপথ বিভাগের মন্ত্রী। গ্রাম বাংলার নদী-নালা সংস্কারের কাজ শুরু করেছিলেন। তমলুক মহকুমার জগন্নাথখালি, সোয়াদিঘি, প্রতাপখালি, গঙ্গাখালি, পায়রাটুঙ্গি, বাঁপুর খাল সংস্কার করেন।
তাতে অবিভক্ত মেদিনীপুর জেলায় কৃষিক্ষেত্রে উন্নতিতে সহায়ক হয়। অজয় মুখোপাধ্যায়ের প্রচেষ্টাতেই তমলুকে ১৯৬২ সালে ১২ লক্ষ টাকা ব্যয়ে ১২৫ শয্যার মহকুমা হাসপাতাল তৈরি হয়। বিধানচন্দ্রের মৃত্যুর পরে প্রফুল্লচন্দ্র সেনের মন্ত্রিসভাতেও তিনি সেচ এবং জলপথের দায়িত্বে ছিলেন। কিন্তু এই সময়ে দুর্নীতি-সহ নানা কারণে কংগ্রেসের জনপ্রিয়তা হ্রাস পায়।
১৯৬৪ সালে প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি হন। তখন জাতীয় কংগ্রেসের সঙ্গে যুক্ত থাকলেও কিছুদিন পরে কংগ্রেস ত্যাগ করে আলাদা নতুন দল বাংলা কংগ্রেস গঠন করেন নলিনাক্ষ সান্যাল এর সঙ্গে৷ ১৯৬৭ সালের নির্বাচনে আরামবাগ থেকে কংগ্রেস প্রার্থী গান্ধীবাদী নেতা প্রফুল্ল সেনের বিরুদ্ধে ভোটে লড়তে নামেন আর এক গান্ধীবাদী নেতা বাংলা কংগ্রেসের প্রার্থী অজয় মুখোপাধ্যায়৷ সেই ভোটে অজয় মুখোপাধ্যায় কাছে মাত্র ৮২০ ভোটে পরাজিত হল প্রফুল্ল সেন৷
১৯৬৭ বিধানসভা ভোটের ফল বেরোবার পর দেখা যায় ২৮০ আসনের মধ্যে কংগ্রেস পেয়েছে ১২৭ আসন। ফলে বিবদমান দুই বিরোধী জোটের নেতারা অনুভব করেন ওই অবস্থায় কংগ্রেসের বিকল্প হিসেবে তারা একত্রে মিলে সরকার গড়া উচিত৷ কিন্তু দুই জোটের দলগুলির মধ্যে সর্বাধিক আসন পাওয়ায় সিপিএম তাঁদের নেতা জ্যোতি বসুকেই মুখ্যমন্ত্রী করার দাবি তোলে। কিন্তু তা মানতে নারাজ বাংলা কংগ্রেস নেতা অজয় মুখোপাধ্যায় বরং বয়েসের নিরীখে মুখ্যমন্ত্রী দাবি তোলেন।
সিপিএমও আশংকা করে এই টানাপোড়েনে অজয়বাবু যদি কোনও কারণে দলবল নিয়ে ফের কংগ্রেসের দিকে চলে যান তাহলে আসল লড়াইটাই ভেস্তে যাবে৷ কারণ সেবারে জনগণের রায় ছিল কংগ্রেস দলকে ক্ষমতাচ্যুত করা৷ সেক্ষেত্রে মুখ্যমন্ত্রিত্বের দাবীতে অনড় থাকলে সেই রায়কে উপেক্ষা করা হবে।তাছাড়া এই নিয়ে অযথা গোয়ারতুমি করলে অকংগ্রেসি সরকার গঠনের সুযোগ একবার হাতছাড়া হলে ভবিষ্যতে এমন সুযোগ ফের কবে আসবে বলা শক্ত । ফলে শেষ পর্যন্ত সিপিএম নেতৃত্ব অজয়বাবুকেই মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে মেনে নেয়।
সমাধান সূত্রে হিসেবে ঠিক হয় জ্যোতি বসু উপ-মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার পাশাপাশি তাঁর সঙ্গে অর্থ ও পরিবহণ দফতরের দায়িত্বে পাবেন।অবশেষে ১৯৬৭ সালের ১৫ মার্চ অজয় মুখোপাধ্যায় রাজ্যে যুক্তফ্রন্ট সরকারের মুখ্যমন্ত্রী হন এবং ২ নভেম্বর পর্যন্ত সেই পদে থাকেন৷ এরপর ফের ১৯৬৯ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি থেকে ১৯৭০ সালের ১৯ মার্চ পর্যন্ত তিনি যুক্তফ্রন্টের মুখ্যমন্ত্রী পদে আসীন ছিলেন। কিন্তু সংসদীয় রাজনীতির জীবন বারবারই বাধা পেয়েছে। একসময় প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিলেন নিজের মন্ত্রিসভার উপমুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসুর বিরুদ্ধে।
তবে বরানগর কেন্দ্রে তিনি জ্যোতি বসুর কাছে পরাজিত হন। তমলুকে জয় আসে। ১৯৭১ সালে তৃতীয়বার মুখ্যমন্ত্রী হলেও সরকারের পতন হয় দ্রুত। মাত্র ৮৩ দিনে। ফিরেছিলেন কংগ্রেসে। ’৭২ সালে তমলুক থেকে কংগ্রেসের প্রার্থী হিসেবে জয়ী হয়েছিলেন। কিন্তু রাজনৈতিক কাজকর্ম থেকে সরে যাচ্ছিলেন। ’৭৭ সালে লোকসভা নির্বাচনে স্বাধীনতা আন্দোলনের সহযোদ্ধা সতীশ সামন্ত সুশীলকুমার ধাড়ার কাছে পরাজিত হলে তিনি রাজনীতি থেকে অবসর নেন।
তমলুক ছেড়ে কলকাতায় এক আত্মীয়ের বাড়ি চলে যান। সরল ছিল জীবনযাপন। নিরামিষ খেতেন। পরনে চটি জুতো। হাঁটুর উপর পর্যন্ত খদ্দরের কাপড় আর হাতকাটা জামা পরতেন। ভাই বিশ্বনাথ মুখোপাধ্যায় ছিলেন বামপন্থী মনোভাবাপন্ন। তাঁর স্ত্রী গীতা মুখোপাধ্যায়ও রাজ্য রাজনীতির নামী মুখ। ১৯৭৭ সালে তাঁকে ভারতের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ অসামরিক সম্মান পদ্মবিভূষণ প্রদান করা হয়। শেষ জীবনে রাজনীতি থেকে নিজেকে সরিয়ে নেন তিনি। অকৃতদার ছিলেন। ফলে একপ্রকার লোকচক্ষুর অন্তরালে চলে গিয়েছিলেন তিনি৷ ১৯৮৬ সালের ২৭ মে নিতান্তই অবহেলায় মারা যান প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী অজয় মুখোপাধ্যায়।