অক্ষয় কুমার দত্ত এর জীবনী

অক্ষয় কুমার দত্ত এর জীবনী

উনিশ শতকের নবজাগরণের বাহকদের মধ্যে অন্যতম অক্ষয় কুমার দত্ত (Akshay Kumar Dutta) একাধারে সাংবাদিক, প্রাবন্ধিক এবং লেখক। বাংলা ভাষায় বিজ্ঞানের চর্চা এবং স্কুলপাঠ্য বইতে অতি সহজ-সরল ভাষায় বিজ্ঞানের ধারণা দানের প্রয়াসে তিনিই ছিলেন পথপ্রদর্শক। বাঙালি যুক্তিবাদী সংস্কারপন্থী চিন্তাবিদদের মধ্যে অক্ষয় কুমার দত্তই প্রথম পাশ্চাত্য শিক্ষার অনুপ্রেরণায় মাতৃভাষায় শিক্ষাবিস্তারের চেষ্টা করেন।

‘তত্ত্ববোধিনী পাঠশালা’য় ভূগোল ও পদার্থবিদ্যার শিক্ষকতা করে বাংলা ভাষায় সেকালের পাঠ্যপুস্তকের অভাব মেটাতে নিজেই গ্রন্থ প্রণয়ন করেন তিনি। ব্রাহ্ম ধর্মে দীক্ষিত অক্ষয় কুমার দত্ত একদিকে যেমন তত্ত্ববোধিনী পত্রিকার সম্পাদনা করেছেন, তেমনি অন্যদিকে তাঁর লেখা ‘পদার্থবিদ্যা’, ‘চারুপাঠ’, ‘ভারতবর্ষীয় উপাসক সম্প্রদায়’ ইত্যাদি বইগুলি আজ কালের নিয়মে বিস্মৃতপ্রায়।

১৮২০ সালের ১৫ জুলাই বর্ধমান জেলার অন্তর্গত নবদ্বীপের কাছে চুপী গ্রামে অক্ষয় কুমার দত্তের জন্ম হয়। তাঁর বাবা পীতাম্বর দত্ত কলকাতা পুলিশে চাকরি করতেন এবং তাঁর মায়ের নাম ছিল দয়াময়ী দেবী। অক্ষয়কুমার দত্ত ছিলেন তাঁদের কনিষ্ঠ সন্তান। রবীন্দ্র-পরবর্তী যুগের বিখ্যাত কবি সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত সম্পর্কে ছিলেন অক্ষয় কুমার দত্তের পৌত্র।

কলকাতায় ওরিয়েন্টাল সেমিনারি স্কুলে প্রাথমিক শিক্ষা লাভ করেন অক্ষয় কুমার দত্ত । কিন্তু খুব অল্প বয়সে তাঁর বাবা মারা যাওয়ায় তাঁর প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষালাভ সম্পূর্ণ হয়নি। তাঁর শিশুকাল অত্যন্ত দারিদ্র্যের মধ্যে অতিবাহিত হয়েছিল। কিন্তু তাঁর জ্ঞান অর্জনের অদম্য ইচ্ছার কারণে তিনি বাড়িতেই গণিত, ভূগোল, পদার্থবিদ্যা, উদ্ভিদবিদ্যা প্রভৃতি বিষয়ে অধ্যয়ন করেন।

পরে কাজের খোঁজে কলকাতায় এসে তিনি ইংরেজ শিক্ষক বহুভাষাবিদ পন্ডিত জেফ্রেয়ের পৃষ্ঠপোষকতায় গ্রিক, ল্যাটিন, জার্মান, ফরাসি, ও হিব্রু ভাষা রপ্ত করেন এবং আমীরউদ্দিন মুন্সির কাছে তিনি শেখেন আরবি ও ফারসি ভাষা। পরে মেডিক্যাল কলেজে অতিরিক্ত ছাত্র হিসেবে উদ্ভিদবিদ্যা, প্রাণীবিদ্যা, রসায়ন শাস্ত্র ও প্রকৃতিবিজ্ঞান পড়েন অক্ষয় কুমার দত্ত। মাত্র উনিশ বছর বয়সে বাবার মৃত্যুর পরে কবি ঈশ্বর গুপ্তের ‘সংবাদ প্রভাকর’ পত্রিকায় চাকরির মাধ্যমেই অক্ষয় কুমার দত্ত -এর কর্মজীবন শুরু হয়।

এখানে তিনি বিদেশি ভাষা থেকে বাংলা ভাষায় অনুবাদের কাজ করতেন এবং নিজস্ব প্রবন্ধ রচনা করতেন। এই সময় দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর ব্রাহ্মসমাজের কার্যকলাপ প্রচারের উদ্দেশ্যে ‘তত্ত্ববোধিনী’ পত্রিকা প্রকাশ করেন। এই পত্রিকার সম্পাদনার জন্য তিনি যোগ্য ব্যক্তির সন্ধান করছিলেন এবং ‘সংবাদ প্রভাকর’ থেকেই তিনি অক্ষয় কুমার দত্তকে আবিষ্কার করেন।

তাঁকে দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর ‘তত্ত্ববোধিনী’ পত্রিকার সম্পাদক নিযুক্ত করেন। ১৮৪০ সালে শিক্ষার প্রসারে ‘তত্ত্ববোধিনী পাঠশালা’ স্হাপিত হলে অক্ষয়কুমার মাসিক আট টাকা পারিশ্রমিকের বিনিময়ে ভূগোল ও পর্দাথবিদ্যার শিক্ষক নিযুক্ত হন। স্হির হয়, ‘তত্ত্ববোধিনী পাঠশালা’য় বাংলায় শিক্ষাদান করা হবে। কিন্তু বাংলায় পাঠ্যপুস্তকের অভাব থাকায় তিনি ১৮৪১ সালে ‘ভূগোল’ নামে একটি গ্রন্থ রচনা করেন যা তাঁর প্রথম গদ্যগ্রন্থ।

যদিও ‘তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা’ ব্রাহ্মধর্ম প্রচারের উদ্দেশ্যে সম্পাদিত হত কিন্তু অক্ষয় কুমার ও তাঁর বন্ধু বিদ্যাসাগরের সহযোগিতায় পত্রিকাটিতে সাহিত্য, বিজ্ঞান, দর্শন, ইতিহাস ও সমাজ সংস্কারের বিভিন্ন বিষয়গুলিও প্রকাশ পেত। বিদ্যাসাগরের বিধবা বিবাহের প্রস্তাবটিও এই পত্রিকায় প্রথম প্রকাশিত হয়। অক্ষয়কুমার নিজেও জমিদার প্রথা, নীলচাষ ইত্যাদি সম্পর্কিত মতামত ব্যক্ত করেন এই ‘তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা’য় এবং ক্রমেই সম্পাদক হিসেবে অক্ষয়কুমার খ্যাতি অর্জন করেন। ১৮৫৫ সাল পর্যন্ত দীর্ঘ বারো বছর তিনি এই পত্রিকার সম্পাদক নিযুক্ত ছিলেন।

তাঁর পরিচালনায় ও লেখনীতে ‘তত্ত্ববোধিনী’ শ্রেষ্ঠ পত্রিকায় পরিণত হয় যার গ্রাহক সংখ্যা বিস্ময়করভাবে সাতশোতে পৌঁছায়। অক্ষয়কুমার দত্ত সারাজীবন ধরে বঙ্গবাসী মানুষদের মধ্যে বিজ্ঞানমনস্কতার প্রসারের উদ্দেশ্যে নিজেকে নিযুক্ত করেছিলেন। ইউরোপীয় উৎস থেকে জ্ঞানার্জন করে বাংলা ভাষায় বিজ্ঞানধর্মী সাহিত্য গড়ে তোলার কাজে ব্রতী হয়েছিলেন তিনি।

জ্ঞানার্জনের প্রবল উৎসাহ নিয়ে অক্ষয়কুমার যেমন বহু ভাষা রপ্ত করেছেন, তেমনিই জ্ঞানের অভাব দূর করার জন্য উপযোগী বই লিখেছেন, বিজ্ঞানচর্চার জগতে পরিভাষা নির্মাণের কাজে তিনিই প্রথম পথ দেখান যার মাধ্যমে বিজ্ঞানের জটিল তত্ত্বও মাতৃভাষায় সহজ হয়ে ওঠে। কুসংস্কারমুক্ত বিজ্ঞানমনস্ক সমাজ গড়ে তোলার কাজে তিনি অগ্রণী ভূমিকা নিয়েছিলেন।

দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের সংস্পর্শে এসেই অক্ষয়কুমার ব্রাহ্মধর্মে দীক্ষিত হলেও পাশ্চাত্যের বিজ্ঞান ও শিল্পকলার প্রাধান্যকে তিনি স্বাগত জানিয়েছিলেন এবং বন্ধু বিদ্যাসাগরের সঙ্গে মিলিত হয়ে সমাজসংস্কারকের কাজেও যুক্ত হয়েছিলেন অক্ষয় কুমার দত্ত। মাত্র ১৪ বছর বয়সে তিনি ‘অনঙ্গ মোহন’ কাব্যগ্রন্থ রচনা করেন। তাঁর লেখা ‘পদার্থবিদ্যা’ গ্রন্থটি বাংলা ভাষায় লেখা প্রথম পূর্ণাঙ্গ বিজ্ঞানের বই।

বিজ্ঞানের, সাধারণ জ্ঞানের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে ছোটদের জন্য ১৮৫৩ সালে তাঁর লেখা ‘চারুপাঠ’ (১ম খণ্ড) পাঠ্যপুস্তক হিসেবে জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিল। এই বইতে মাধ্যাকষর্ণ, আহ্নিক গতি, বিষুবরেখা অক্ষাংশ, দ্রাঘিমাংশ, চুম্বক, বিকিরণ, তড়িৎ, সুমেরু-কুমেরু, স্হিতিস্হাপকতা, আপেক্ষিক গতি, ভরকেন্দ্র, দূরবীন, অণুবীক্ষণ ইত্যাদি পরিভাষাগুলি প্রথমবার অর্ন্তভূক্ত করেছিলেন তিনি যা প্রতিনিয়ত আমরা এখনও ব্যবহার করে চলেছি। এই বইতেই ছেদ ও যতি চিহ্ন প্রথমবার ব্যবহার করেন অক্ষয়কুমার দত্ত।

বাংলা ভাষায় সুখপাঠ্য বিজ্ঞানের গ্রন্থ রচনার দ্বারা তিনি বাংলা ভাষাকে এক নতুন মাত্রায় উন্নীত করে পাশ্চাত্য জ্ঞান-বিজ্ঞানের চর্চায় আপামর বাঙালিকে উৎসাহিত করেন তিনি। তাঁর রচিত গ্রন্থগুলিতে ইংরেজি গ্রন্থের প্রভাব লক্ষ্য করা যায়। ১৮৪৫ সালে তাঁর প্রবন্ধ প্রকাশিত হয় ‘ডেভিড হেয়ার সাহেবের স্মরণার্থে তৃতীয় সাম্ব্ৎসরিক সভার বক্তৃতা’। আবার ১৮৪৮ সালে ব্রিটিশ লেখক জর্জ কুম্বের লেখা ‘দ্য কনস্টিটিউন অফ ম্যান কনসিডার ইন এ রিলেশনস অফ এক্সটারনাল অবজেক্ট’ বইটির ভাবধারায় বাংলায় অক্ষয় কুমার দত্ত লেখেন ‘বাহ্যবস্তুর সহিত মানব প্রকৃতির সম্বন্ধ বিচার’ এবং দুটি খণ্ডে প্রকাশিত এই বইয়ের বিষয় ছিল সমাজে নারী-পুরুষের সমান অধিকারবোধ।

হয় যা তৎকালীন যুব সম্প্রদায়কে উদ্বুদ্ধ করেছিল। এই গ্রন্থটিই তাঁকে তাঁর সময়ের থেকে এগিয়ে থাকার পরিচয় দেয়। ১৮৫৫ সালে ‘বাষ্পীয় রথারোহীদিগের প্রতি উপদেশ’ ও ‘ধর্মোন্নতি সংসাধন বিষয়ক প্রস্তাব’ নামে অক্ষয় কুমারের দুটি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়। ঠিক এর পরের বছর ১৮৫৬ সালে বিজ্ঞানের পাঠ্যপুস্তক হিসেবে তিনি লেখেন ‘পদার্থবিদ্যা’ এবং ১৮৭০ সালে ভারতবর্ষের নানা ধর্মের উপাসক সম্প্রদায়কে নিয়ে রচিত গ্রন্থ ‘ভারতবর্ষীয় উপাসক সম্প্রদায়’ (১ম খণ্ড)প্রকাশিত হয়।

এই গ্রন্থে ভারতের উপাসক সম্প্রদায় সম্পর্কে তাঁর নিজস্ব উপলব্ধ জ্ঞান ও পর্যবেক্ষণ ব্যক্ত করেছেন। বৈষ্ণব, রামানুজ, রামানন্দী, কবীরপন্থী, বল্লভচারী, মীরাবাঈ, বৈরাগী এইরূপ ১৮২ টি সম্প্রদায়ের কথা আলোচিত হয়েছে এই বইতে যা কিনা এইচ.এইচ.উইলসন দ্বারা রচিত ‘রিলিজিয়াস সেটস অফ হিন্দু’ গ্রন্থ অবলম্বনে রচিত। বিখ্যাত জার্মান ভারতবিদ ম্যাক্সমুলার এই গ্রন্থটি পড়ে অক্ষয় কুমারকে চিঠি লিখেছিলেন। দীর্ঘদিন ‘তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা’র সম্পাদক হয়ে কাজ করার ফলে তাঁর শরীর অসুস্থ হয়ে পড়ে।

এছাড়াও ঊনবিংশ শতাব্দীতে ফরাসি দর্শন দ্বারা প্রভাবিত অক্ষয় কুমার দত্ত হিন্দুদের পবিত্র ধর্মগ্রন্থ ‘বেদ’-এ বর্ণিত আত্মা ও বিশ্বব্রহ্মান্ড সম্পর্কে প্রচলিত সমস্ত ব্রাহ্ম ধারণাকে তিনি চ্যালেঞ্জ করেন। ফলে তাঁর মানসিকতার সঙ্গে দূরত্ব তৈরি হয় ব্রাহ্মসমাজের। ফলস্বরূপ ব্রাহ্মধর্ম ও তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা ত্যাগ করে তিনি ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের সমাজ সংস্কারের কাজে নিজেকে নিয়োজিত করেন।

বিদ্যাসাগরের দ্বারা পরিচালিত ‘নর্ম্যাল স্কুল’-এর মাসিক একশো চল্লিশ টাকা বেতনে প্রধান শিক্ষক হিসেবে নিয়োজিত হলেও শারীরিক অসুস্থতার কারণে সেই কাজটিও ছেড়ে দিতে বাধ্য হন। সেই সময় ‘তত্ত্ববোধিনী’ পত্রিকার পক্ষ থেকে বৃত্তি প্রদান করা হয় তাঁকে। কিন্তু পুস্তক রচনা থেকে অর্থাগম হওয়ায় তিনি সেই বৃত্তি নেওয়া বন্ধ করে দেন।

দেশকে কুসংস্কারের অন্ধকার থেকে মুক্ত করে বৈজ্ঞানিক শিক্ষায় শিক্ষিত করতে চেয়েছিলেন অক্ষয় কুমার দত্ত। বিভিন্ন ধর্ম, জাত-পাতের ভেদাভেদ ঘোচানোর জন্য তিনি গ্রামগঞ্জে ঘুরে বেড়াতেন, গরীর-দুঃখী মানুষের কষ্টের শরিক হতেন। জাহাজযাত্রাকালে অক্ষয় কুমার নাবিকের কাছ থেকে জেনে নিতেন জোয়ার ভাঁটা, দিক পরিবর্তন সম্পর্কে।

নিজের উর্পাজনের সবটুকুই তিনি দান করেছিলেন বাংলায় এক বিজ্ঞানমনষ্ক সমাজ গড়ে তোলার লক্ষ্যে। তাঁর অকৃত্রিম দান ও উদ্যোগেই গড়ে উঠেছিল আজকের ‘ইণ্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন ফর দ্য কালটিভেশন অব সায়েন্স’। বাঙালি জাতির বৈজ্ঞানিক চেতনা জাগ্রত করার লক্ষ্যে তিনি ‘বিদ্যাদর্শন’ নামে একটি পত্রিকা নিজেই সম্পাদনা করতেন, তাঁর বৈজ্ঞানিক প্রবন্ধগুলি প্রকাশ করতেন এই পত্রিকায়।

কিন্তু ‘বিদ্যাদর্শন’-এর ছয়টি সংখ্যা প্রকাশিত হওয়ার পরেই পত্রিকাটি বন্ধ হয়ে যায়। শেষজীবনে তিনি বালিগ্রামের বাড়িতে উদ্ভিদচর্চার উদ্দেশ্যে আটত্রিশ প্রকারের বৃক্ষ, পনেরো রকমের ফুল ও নানান মশলার গাছ লাগান। বাড়ির ভেতরে তিনি সংরক্ষণ করেছিলেন বিভিন্ন যুগের প্রস্তরখণ্ডের নমুনা ও ফসিল এবং বাড়ির নামকরণ করেন তিনি ‘শোভনোদ্যান’। এই সময়টা বৈজ্ঞানিক যুক্তিবাদে বিশ্বাসী হয়ে একজন অজ্ঞেয়বাদীতে পরিণত হন অক্ষয় কুমার দত্ত এবং বাকি জীবনটা একাকিত্বেই কাটিয়ে দেন। পরিবারের সঙ্গেও বিশেষ সুসম্পর্ক ছিল না তাঁর। ১৮৮৬ সালের ১৮ মে নিজ বাসভবন ‘শোভন্যাদান’-এ অক্ষয় কুমার দত্তের মৃত্যু হয়।