অ্যালেক্স ফার্গুসন এর জীবনী

অ্যালেক্স ফার্গুসন (Alex Ferguson) একজন প্রবাদ প্রতিম ফুটবল কোচ যিনি বিশ্ব ফুটবলে বিখ্যাত হয়ে আছেন ম্যাঞ্চেস্টার ইউনাইটেড ক্লাবের ফুটবল ম্যানেজার হিসেবে। ১৯৮৬ থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত মোট ২৭ বছর ম্যাঞ্চেস্টার ইউনাইটেড ক্লাবের কর্মকর্তা ছিলেন তিনি। কোচ হিসেবে ফুটবল দুনিয়ায় সবথেকে বেশি ট্রফি জয় করেছেন তিনি।
স্কটল্যান্ডের অসংখ্য ফুটবল ক্লাবের হয়ে ফরোয়ার্ড পজিশনে ফুটবল খেলেছেন ফার্গুসন। ১৯৬৫-৬৬ সালে স্কটিশ লিগে ডানফার্মলাইন স্কটিশ ক্লাবের হয়ে খেলে সবথেকে বেশি গোল করার রেকর্ড করেন তিনি। ‘অ্যাবারডিন’ ক্লাবের কর্মকর্তা হিসেবে তিনি তিনটি স্কটিশ লিগ চ্যাম্পিয়নশিপ, চারটি স্কটিশ কাপ এবং ১৯৮৩ সালে ইউইএফএ কাপ (UEFA) জয় করেন।
২০১৩ সালে ওয়ার্ল্ড সকার পত্রিকার অধীনে করা একটি সমীক্ষায় শ্রেষ্ঠ কর্মকর্তা হিসেবে মোট ৪৯ জনের ভোট পেয়ে প্রথম স্থানে নির্বাচিত হন অ্যালেক্স ফার্গুসন। ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগের শ্রেষ্ঠ কর্মকর্তা হিসেবে মোট চারবার তিনি জিতেছেন ‘দ্য লিগ ম্যানেজারস অ্যাসোসিয়েশন অ্যাওয়ার্ড’। এছাড়াও মোট ১১ বার ‘প্রিমিয়ার লিগ ম্যানেজার অফ দ্য সিজন’ এবং মোট ২৭ বার প্রিমিয়ার লিগ ম্যানেজার অফ দ্য মান্থ’ পুরস্কারও রয়েছে তাঁর ঝুলিতে।
১৯৯৯ সালে ফুটবলে তাঁর অবিস্মরণীয় অবদানকে মনে রেখে ‘নাইট’ উপাধিতে ভূষিত করা হয় তাঁকে। ১৯৪১ সালের ৩১ ডিসেম্বর গ্লাগোর গোভান জেলার শিল্ডহল রোডে ঠাকুমার বাড়িতে অ্যালেক্স ফার্গুসনের জন্ম হয়। তাঁর প্রকৃত নাম আলেকজাণ্ডার চ্যাপম্যান ফার্গুসন। তাঁর বাবার নাম অ্যালেকজাণ্ডার বিটেন ফার্গুসন এবং তাঁর মায়ের নাম এলিজাবেথ ফার্গুসন। তাঁর বাবা একটি বাড়ি নির্মাণ শিল্পের সহকারীর কাজ করতেন। ১৯৬৬ সালে ক্যাথি হোল্ডিংয়ের সঙ্গে তাঁর বিবাহ হয়।
তাঁদের তিন সন্তানের মধ্যে বড় ছেলে মার্ক এবং বাকি দুই পুত্র ড্যারেন ও জ্যাসন যমজ সন্তান। ড্যারেন বর্তমানে পিটার্সবার্গ ইউনাইটেড ক্লাবের কর্মকর্তা হিসেবে কাজ করছেন। অ্যালেক্স ফার্গুসনের প্রাথমিক শিক্ষা শুরু হয় ব্রুমলোন রোড প্রাইমারি স্কুলে এবং পরে তিনি ভর্তি হন গোভান হাই স্কুলে। গোভানে থাকাকালীনই সেখানকার ‘হারমোনি রো বয়েজ ক্লাব’-এর মধ্য দিয়ে তিনি তাঁর ফুটবল জীবন শুরু করেন। এর কিছুদিন পরেই তিনি যোগ দেন ‘ড্রামচ্যাপেল অ্যামেচারস’ নামের একটি যুব ক্লাবে।
হিলিংটনে একটি কারখানায় যন্ত্র প্রস্তুতকারক হিসেবে শিক্ষানবিশী শুরু করেন। সেই সঙ্গেই তাঁর ফুটবল প্রশিক্ষণও চলতে থাকে। ‘কুইনস পার্ক’ ক্লাবে একজন অ্যামেচার ফুটবলার হিসেবে ফার্গুসন খেলা শুরু করেন। সে সময় মাত্র ১৬ বছর বয়সে স্ট্রাইকার পজিশনে খেলতে শুরু করেন তিনি। ১৯৫৭ থেকে ১৯৬০ সাল পর্যন্ত মোট তিন বছর এই ক্লাবে খেলে ৩১টি ম্যাচে মোট ২০টি গোল করেন তিনি।
১৯৬০ সালে এই ক্লাব ছেড়ে ফার্গুসন যোগ দেন সেন্ট জন্সটন ক্লাবে। সেখানে কিছুতেই প্রথম একাদশের মধ্যে জায়গা করে নিতে পারছিলেন না তিনি। অবশেষে সেন্ট জন্সটনের হয়ে রেঞ্জার্স ক্লাবের বিরুদ্ধে মাঠে নেমে একটি ম্যাচে একাই পরপর তিনটি গোল করে ফুটবল প্রতিভার পরিচয় রাখেন ফার্গুসন।
এই ম্যাচের সাফল্যের পরই স্কটল্যাণ্ডের ডামফার্মলাইন ক্লাবে যোগ দেন ফার্গুসন এবং এই ক্লাবের মধ্য দিয়েই পেশাদার ফুটবলার হিসেবে তাঁর ক্রীড়াজীবন শুরু হয়। ১৯৬৪ সালে স্কটিশ লিগে মাত্র এক পয়েন্টের ব্যবধানে লিগ জিততে পারেনি ডানফার্মলাইন। আবার স্কটিশ কাপ ফাইনালে কেল্টিক ক্লাবের কাছেও পরাজিত হয় ডানফার্মলাইন। ম্যাচে হারলেও এই সিজনে ৩১টি গোল করে সর্বোচ্চ গোলদাতা হিসেবে জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন তিনি। কিছুদিনের মধ্যেই রেঞ্জার্স ক্লাবে যোগ দেন ফার্গুসন যার বিনিময়ে মোট ৬৫ হাজার পাউন্ড পেয়েছিলেন তিনি।
দুটি সিজনে মোট ৪১টি ম্যাচে খেলে ২৫টি গোল করেছিলেন তিনি। কিন্তু এখানেও ঠিক মন বসছিলনা তাঁর। ‘ফলকার্ক’ ক্লাবে যোগ দিয়ে এরপরে ফার্গুসন প্রশিক্ষকের পদে উন্নীত হন। ১৯৭৪ সালে আয়ার ইউনাইটেড ক্লাবে খেলে ফার্গুসন ফুটবলার জীবনে ছেদ টানেন। মাত্র ৩২ বছর বয়সে আংশিক সময়ের প্রশিক্ষক হিসেবে স্টার্লিংশায়ার ফুটবল ক্লাবের দায়িত্ব পান ফার্গুসন। ফার্গুসনের দক্ষ প্রশিক্ষণের ফলেই এই ক্লাব ১৯৭৭ সালে প্রথম বিভাগে চ্যাম্পিয়নশিপ অর্জন করে।
কিন্তু কিছু অযৌক্তিক কারণে তাঁকে এই ক্লাব থেকে বহিষ্কার করা হয়। এরপরে স্কটিশ ‘অ্যাবারডিন’ ক্লাবের কর্মকর্তা নিযুক্ত হন তিনি। ১৯৫৫ সালের পর যেখানে কোন ক্লাবই সেভাবে স্কটিশ লিগ জিততে পারছিল না, সেখানে ফার্গুসনের প্রশিক্ষণে ‘অ্যাবার্ডিন’ এই লিগ জিতে নতুন রেকর্ড করে। ১৯৮২ সালে প্রথম স্কটিশ কাপ জিতে নেয় ‘অ্যাবার্ডিন’। এরই মধ্যে আর্সেনাল, টটেনহাম, লিভারপুল প্রভৃতি ক্লাবের পক্ষ থেকে আসা প্রশিক্ষণের প্রস্তাব ফিরিয়ে দেন অ্যালেক্স ফার্গুসন।
অ্যাবার্ডিনের প্রশিক্ষক হিসেবে তাঁর নেতৃত্বেই রিয়াল মাদ্রিদকে হারিয়ে অ্যাবার্ডিন ইউরোপিয়ান ক্লাব চ্যাম্পিয়নশিপ জিততে সমর্থ হয়। এর মধ্যে স্কটল্যাণ্ডের প্রশিক্ষক হিসেবেও বেশ কিছুদিন কাজ করেছেন তিনি। পরে অ্যাবার্ডিন এবং স্কটিশ ক্লাবের দায়িত্ব ছেড়ে দিয়ে ইংলিশ লিগে ম্যাঞ্চেস্টার ইউনাইটেডের প্রশিক্ষক হিসেবে কাজ শুরু করেন তিনি। ফার্গুসন বরাবরই শৃঙ্খলাপরায়ণ ছিলেন, তাই এই ক্লাবেও সেই শৃঙ্খলা বজায় রাখার চেষ্টা করেন তিনি।
১৯৯২-৯৩ সালে ফরাসি ফরোয়ার্ড এরিক ক্যান্টোনাকে নিয়ে আসেন ম্যাঞ্চেস্টার ইউনাইটেডে এবং তার ফলেই ২৬ বছর পরে প্রিমিয়ার লিগ টাইটেলে জয়লাভ করে ম্যাঞ্চেস্টার ইউনাইটেড। ১৯৯৮-৯৯ সিজনে ম্যাঞ্চেস্টার ইউনাইটেড ফার্গুসনের অভিভাবকত্বেই প্রিমিয়ার লিগ, এফ.এ কাপ এবং চ্যাম্পিয়ন্স লিগ জিতে নেয়। এর ফলে রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথ অ্যালেক্স ফার্গুসন কে ‘নাইট’ উপাধিতে ভূষিত করেন এবং সেই থেকে ফার্গুসন পরিচিত হন স্যার অ্যালেক্স ফার্গুসন নামে।
১৯৯৯ সাল থেকে ২০০২ সাল পর্যন্ত পরপর তিন বার লিগ চ্যাম্পিয়নশিপ জেতে ম্যাঞ্চেস্টার ইউনাইটেড কেবলমাত্র ফার্গুসনের প্রশিক্ষণে। ২০০২ সাল থেকে ২০০৬ সালের মধ্যে বহু পুরনো প্রবীণ খেলোয়াড়েরা দল থেকে অবসর নেওয়ার কারণে একেবারে তরুণ প্রজন্মের খেলোয়াড় হিসেবে তিনি দলে নিযুক্ত করেন ক্রিস্টিয়ানো রোনাল্ডো, রিও ফার্ডিনান্দ, ওয়েইন রুনি, এডউইন ভ্যান, মাইকেল ক্যারিক, পার্ক জি সুং প্রমুখ ফুটবলারদের। এই তরুণদের সঙ্গে নিয়েই ফার্গুসন নবম লিগ টাইটেল জিততে সমর্থ হন।
২০০৭-০৮ সিজনে তাঁর প্রশিক্ষণে ম্যাঞ্চেস্টার ইউনাইটেড দ্বিতীয়বার চ্যাম্পিয়নস লিগ জেতে। ঠিক এর পরের সিজনে দ্বিতীয়বার প্রিমিয়ার লিগ জেতে ম্যাঞ্চেস্টার ইউনাইটেড। ২০১৩ সালে অবসর নেন অ্যালেক্স ফার্গুসন, কিন্তু অবসর নেওয়ার আগে তাঁর প্রশিক্ষক জীবনের ২০তম লিগ টাইটেল জেতেন তিনি ম্যাঞ্চেস্টার ইউনাইটেডের হয়েই। ম্যাঞ্চেস্টার ইউনাইটেড ক্লাবে দীর্ঘ ২৬ বছর প্রশিক্ষক হিসেবে এবং কর্মকর্তা হিসেবে ক্লাবকে মোট ৩৮টি ট্রফি এনে দেন অ্যালেক্স ফার্গুসন।
ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগের শ্রেষ্ঠ কর্মকর্তা হিসেবে মোট চারবার তিনি জিতেছেন ‘দ্য লিগ ম্যানেজারস অ্যাসোসিয়েশন অ্যাওয়ার্ড’। এছাড়াও মোট ১১ বার ‘প্রিমিয়ার লিগ ম্যানেজার অফ দ্য সিজন’ এবং মোট ২৭ বার প্রিমিয়ার লিগ ম্যানেজার অফ দ্য মান্থ’ পুরস্কারও রয়েছে তাঁর ঝুলিতে। ২০০৯ সালে ম্যাঞ্চেস্টার বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে বাণিজ্য প্রশাসন বিষয়ে সম্মানীয় ডক্টরেট দেওয়া হগয় অ্যালেক্স ফার্গুসনকে।
২০১৩ সালে ওয়ার্ল্ড সকার পত্রিকার অধীনে করা একটি সমীক্ষায় শ্রেষ্ঠ কর্মকর্তা হিসেবে মোট ৪৯ জনের ভোট পেয়ে প্রথম স্থানে নির্বাচিত হন অ্যালেক্স ফার্গুসন। তাঁর নামেই আন্তর্জাতিক ফুটবল খেলায় ২০০৪ সাল থেকে ইনজুরি টাইমের নাম হয় ‘ফার্গি টাইম’। সম্প্রতি ২০২১ সালের ২৭ মে মার্কিন চলচ্চিত্র দুনিয়ায় এবং ওটিটি প্ল্যাটফর্মে তাঁর ক্রীড়াজীবন নিয়ে একটি তথ্যচিত্র মুক্তি পেয়েছে ‘ফার্গুসন : নেভার গিভ ইন’ নামে।