আঁটপুর | ইতিহাস বিজড়িত জনপদ Antpur

আঁটপুর | ইতিহাস বিজড়িত জনপদ Antpur

পশ্চিমবঙ্গের অন্তর্গত হুগলী জেলার শ্রীরামপুর মহকুমার অন্তর্গত জাঙ্গিপাড়া ব্লকের একটি ইতিহাস বিজড়িত জনপদ আঁটপুর(Antpur)। কলকাতা থেকে মাত্র কয়েক ঘণ্টার দূরত্বে হাওড়া-তারকেশ্বর (মেইন) শাখার স্টেশন হরিপালে নেমে সড়কপথে বাসে প্রায় ১৩ কিমি দূরে অবস্থিত এই জনপদ। আঁটপুরের ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যায় প্রাচীন রাঢ়বাংলার দক্ষিণভাগে আজকের হাওড়া জেলা ও হুগলী জেলার বেশ কিছু অংশ নিয়ে গড়ে একদা গড়ে উঠেছিল ভূরিশ্রেষ্ঠ রাজ্য—যার তৎকালীন রাজধানী রাজবলহাট বর্তমানে আঁটপুর থেকে উত্তরে ৫-৬ কিলোমিটার দূরেই অবস্থিত।

জনশ্রুতি অনুযায়ী ভূরিশ্রেষ্ঠ রাজ্যের আট সেনাপতির বাসস্থল হিসেবেই অতীতের বিশখালা জনপদ আজ আঁটপুর নামে পরিচিত। আবার মতান্তরে ইসলাম শাসনকালে ঐ অঞ্চলের দুই জমিদার আঁটোর খাঁ ও আনোর খাঁ’র নামানুসারে যথাক্রমে আঁটপুর ও তার দক্ষিণ-পশ্চিমে আনারবাটি গ্রামের নামকরণ হয়েছে। বর্তমানে এই এলাকার মানুষ মূলত কৃষি কাজ ও তন্তু শিল্পের সঙ্গেই যুক্ত রয়েছেন।

হুগলীর আঁটপুরের ঘোষ পরিবার এখানকার অন্যতম প্রাচীন পরিবার। ২৫০ বছরেরও বেশী প্রাচীন এই বংশের দুর্গাপুজো এখানকার অন্যতম ঐতিহ্যশালী পূজা। কিংবদন্তী সুরকার নচিকেতা ঘোষ এই পরিবারেরই সন্তান। তবে এই পরিবারের গৃহে স্বয়ং শ্রী রামকৃষ্ণদেব ও মা সারদার পদধূলি পড়েছিল।

এই পরিবারের সন্তান বাবুরাম ঘোষ আঁটপুরের এই বাড়িতেই নরেন্দ্রনাথ দত্ত (স্বামী বিবেকানন্দ), শরৎচন্দ্র চক্রবর্তী(স্বামী সারদানন্দ) , শশীভূষণ চক্রবর্তী (স্বামী রামকৃষ্ণানন্দ), তারকনাথ ঘোষাল(স্বামী শিবানন্দ), কালীপ্রসাদ চন্দ্র (স্বামী অভেদানন্দ), নিত্য নিরঞ্জন ঘোষ(স্বামী নিরঞ্জনানন্দ), গঙ্গাধর ঘটক(স্বামী অখণ্ডানন্দ) ও সারদাপ্রসন্ন মিত্রের (স্বামী ত্রিগুনানন্দ) সঙ্গে ১৮৮৬ সালের ২৪শে ডিসেম্বর সন্ন্যাসধর্ম গ্রহণ করে স্বামী প্রেমানন্দ নামে পরিচিত হন।

বর্তমানে ঘোষবাড়ি আঁটপুর রামকৃষ্ণ মিশন বা মঠ রূপে গৃহীত। তাঁদের ঐতিহ্যবাহী শারদোৎসবও রামকৃষ্ণ মিশনের পুজো বলেই অধিক পরিচিত। আঁটপুরের ইতিহাসকে ঘোষ পরিবারের সঙ্গে সঙ্গেই সমৃদ্ধ করে মিত্র পরিবার। কান্যকুব্জ বা কনৌজ থেকে যখন পাঁচ কুলীন ব্রাহ্মণ গৌড়দেশে আসেন; সঙ্গে আসেন পাঁচ কায়স্হ যার মধ্যে অন্যতম ছিলেন কালীদাস মিত্র।

তাঁরই পরবর্তী প্রজন্মরা ছড়িয়ে পড়েছিল ২৪ পরগণা, হুগলীর নানা অংশে। যার মধ্যে কন্দর্প মিত্র কোন্নগর থেকে প্রথম আঁটপুরে এসে বসতি গড়েন ও ১৬৮৩ সালে তৈরি করেন কাঁঠাল কাঠের খড় দিয়ে ছাওয়া দোচালা চণ্ডীমণ্ডপ, যেখানে আজও দেবী মহামায়া পূজিত হন। পরবর্তীকালে তাঁর পৌত্র কৃষ্ণরাম মিত্র বর্ধমানরাজ তিলকচন্দ্র বাহাদুরের দেওয়ান রূপে কার্যকালে বিপুল ধনসম্পদ সঞ্চয় করেন ও অনেকগুলি দেবালয় ও জলাশয় নির্মাণ করেন।

যার মধ্যে রাধাগোবিন্দ মন্দির, দোলমঞ্চ, রাসমঞ্চ এবং শিবমন্দিরগুলি আজও বিরাজমান।লোকমুখে শোনা যায়, রাধাগোবিন্দ মন্দিরের পোড়ামাটির কাজের দ্বারা তৎকালীন সমাজ সংস্কৃতির খণ্ডচিত্রগুলি ফুটিয়ে তোলার জন্য বৈদ্যবাটি থেকে গঙ্গামাটি নিয়ে এসেছিলেন কৃষ্ণরাম মিত্র। ১৭৮৬ সালে তৈরি ১০০ফুট লম্বা এই আটচালার মন্দিরের অসাধারণ টেরাকোটার কাজ আঁটপুর বাংলার মন্দির নগরী বিষ্ণুপুরের কথা মনে করিয়ে দেয়।

ঘোষ বাড়ির ইতিহাসের স্মৃতি বুকে মিত্রদের মন্দির প্রাঙ্গণের মূল ফটক পেরিয়ে ফেরার পথে এক বকুল গাছের দেখা মেলে যার বেদীতে লিখিত সাক্ষ্য অনুযায়ী গাছটির বয়স পাঁচশোরও বেশী! দুঃখের বিষয়, বর্তমানে এইসকল মন্দিরই পশ্চিমবঙ্গ সরকারের প্রত্নতত্ত্ব অধিকার দ্বারা সংরক্ষিত হলেও, টেরাকোটা শিল্পের সৌন্দর্য, ঐতিহ্য ও ঐতিহাসিক গুরুত্ব সম্পর্কে স্থানীয় বাসিন্দা ও প্রশাসনের ঔদাসিন্যজনিত কারণে এইসব অমূল্য শিল্পের চোরাচালান হচ্ছে।

চুরি যাওয়া পোড়ামাটির পরিবর্তে সিমেন্টের প্রলেপ দিয়ে মন্দির রক্ষা করতে গিয়ে বাংলার ইতিহাসের যে বিপুল ক্ষতি হয়ে যাচ্ছে, সে সম্পর্কে জনসাধারণকে অবিলম্বে সচেতন করে তোলার প্রত্যাশা আর আবেদন বুকে নিয়েই বোধহয় দাঁড়িয়ে আছে বাংলার ইতিহাসের এক অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় আঁটপুর! আঁটপুরের বলতেই রাধাগোবিন্দজিউয়ের মন্দিরের কথা চলে আসে।

বর্ধমান রাজার দেওয়ান কৃষ্ণরাম মিত্র প্রায় ১০০ ফুট উঁচু এই মন্দিরটি গঠন করান। মন্দিরটি বিখ্যাত মূলত অসাধারণ টেরাকোটা বা পোড়ামাটির কাজের জন্য। টেরাকোটার বিষয় হিসেবে পুরান, রামায়ণ, মহাভারত, ভারতের ইতিহাস অগ্রাধিকার পেয়েছে। বিবেকানন্দ শিকাগো বক্তৃতার আগে এই মন্দির দর্শন করে গেছিলেন বলে শোনা যায়। এখানকার কৃতী সন্তানদের মধ্যে প্যারীচরণ সরকার, ক্যাপ্টেন রসিকলাল দত্ত, পণ্ডিত শ্যামাপদ ভট্টাচার্যের নাম উল্লেখযোগ্য।