আরামবাগ | অতীতের জাহানাবাদ থেকে বর্তমানের Arambag

আরামবাগ | অতীতের জাহানাবাদ থেকে বর্তমানের  Arambag

হুগলি জেলার একটি প্রশাসনিক মহুকুমা হল আরামবাগ । আরামবাগ পুরসভা সমগ্র মহুকুমার একমাত্র শহরাঞ্চল। ২০১১ সালের জনগননা অনুযায়ী আরামবাগের জনসংখ্যা ভারতের ২০১১ সালের আদমশুমারি অনুসারে আরামবাগ শহরের জনসংখ্যা হল ৬৬,১৭৫ জন।এই শহরের জনসংখ্যার ১২% হল ৬ বছর বা তার কম বয়সী। এর মধ্যে পুরুষ ৫১% এবং নারী ৪৯%।এখানে সাক্ষরতার হার ৬৬%। পুরুষদের মধ্যে সাক্ষরতার হার ৭৩% এবং নারীদের মধ্যে এই হার ৫৮%। আরামবাগের মোট আয়তন ১,০৫৮.৮৭ বর্গকিমি।এই মহকুমার মোট জনসংখ্যার ৯৪.৭৭ শতাংশই গ্রামের অধিবাসী, মাত্র ৫.২৩ শতাংশ মানুষ বাস করেন শহরাঞ্চলে।

১৭৯৫ সালে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বর্ধমান জেলাকে বিভাজিত করে উক্ত জেলার দক্ষিণাংশ নিয়ে হুগলি জেলা গঠিত হয়। ১৮৭৯ সালের আগে এই জেলা সদর ও শ্রীরামপুর নামে দুটি মহকুমায় বিভক্ত ছিল যা ১৮৭৯ সালে জাহানাবাদ নামে একটি পৃথক মহুকুমা গঠিত হয়। গয়া জেলায় (অধুনা বিহার রাজ্যে অবস্থিত) একটি জাহানাবাদ থাকার জন্য  ১৯০০ সালে জাহানাবাদ মহকুমার নাম পরিবর্তন করে আরামবাগ মহুকুমা রাখা হয়। ১৮৮৬ সালে  আরামবাগ পুরসভা গঠিত হয়।

আরামবাগ মহকুমা চারটি থানা, ছয়টি সমষ্টি উন্নয়ন ব্লক, ছয়টি পঞ্চায়েত সমিতি, ৬৩টি গ্রাম পঞ্চায়েত, ৫৬৭টি মৌজা, ৫৫৪টি জনবসতিপূর্ণ গ্রাম ও একটি পৌরসভা নিয়ে গঠিত। মহকুমার সদর হল আরামবাগ। আরামবাগ মহকুমার অন্তর্গত চারটি থানা হল আরামবাগ , পুড়শুড়া,  খানাকুল, গোঘাট। আরামবাগ মহকুমার সমষ্টি উন্নয়ন ব্লকগুলি হল গোঘাট ১ (সদর গোঘাট) ,

গোঘাট ২ (সদর কামারপুকুর),আরামবাগ(সদর আরামবাগ),পুরশুড়া (সদর পুরশুড়া), খানাকুল ১ (সদর খানাকুল) খানাকুল ২(সদর খানাকুল)। আরামবাগ মহকুমার ছয়টি সমষ্টি উন্নয়ন ব্লকের অধীনে মোট ৬৩টি গ্রাম পঞ্চায়েত রয়েছে। সেগুলি হল গোঘাট ১ সমষ্টি উন্নয়ন ব্লকটি  গোঘাট, নাকুন্দা,  ভাদুর , কুমারসা , রঘুবাটি,  সাওড়া,  বালি-দেওয়ানগঞ্জ, সাতটি গ্রাম পঞ্চায়েত নিয়ে গঠিত।

গোঘাট ২ সমষ্টি উন্নয়ন ব্লকটি বদনগঞ্জ ফুলুই ১,  বদনগঞ্জ ফুলুই ২ , হাজিপুর, পশ্চিমপাড়া, বেঙ্গাই, মান্দারণ,  কুমারগঞ্জ , শ্যামবাজার  কামারপুকুর এই  নয়টি গ্রাম পঞ্চায়েত নিয়ে গঠিত।  আরামবাগ সমষ্টি উন্নয়ন ব্লকটি  আরান্ডি ১, আরান্ডি ২, মলয়পুর ১, মলয়পুর ২, সালেপুর ১,  সালেপুর ২, বাতানল, হরিণখোলা ১,  হরিণখোলা ২, মায়াপুর ১, মায়াপুর ২, তিরোল, গৌরহাটি ১,গৌরহাটি ২,  মাধবপুর এই ১৫টি গ্রাম পঞ্চায়েত নিয়ে গঠিত।  পুরশুড়া সমষ্টি উন্নয়ন ব্লকটি  ভাঙামোড়া, ডিহি বাদপুর, পুরশুড়া ১, পুরশুড়া ২ ,

শ্রীরামপুর, চিলাডাঙি,  শ্যামপুর, কেলেপাড়া  এই আটটি গ্রাম পঞ্চায়েত নিয়ে গঠিত।  খানাকুল ১ সমষ্টি উন্নয়ন ব্লকটি  খানাকুল ১ খানাকুল ২, পোলে ১,  পোলে ২, ঠাকুরানিচক, বালিপুর, কিশোরপুর ১, আরুন্দা, রামমোহন ১,  রামমোহন ২, ঘোষপুর, কিশোরপুর  , ও তাঁতিশাল এই ব্লকটি ১৩টি গ্রাম পঞ্চায়েত নিয়ে গঠিত।  খানাকুল ২ সমষ্টি উন্নয়ন ব্লকটি  ধান্যগোড়ি, নতিবপুর ১,নতিবপুর ২ , পলাশপাই ১,  পলাশপাই ২,চিংড়া, মাড়োখানা, রাজহাটি ১ , রাজহাটি ২,  সবলসিংহপুর, জগৎপুর, এই ১১টি গ্রাম পঞ্চায়েত নিয়ে গঠিত।

শিক্ষা ও স্বস্থ্যগত ক্ষেত্রেও বেশ উন্নত আরামবাগ। এই মহুকুমার অধীনে রয়েছে বেশ কিছু স্কুল কলেজ।যেমন অঘোরকামিনী প্রকাশচন্দ্র মহাবিদ্যালয়, রাজা রামমোহন রায় মহাবিদ্যালয়, আরামবাগ গার্লস কলেজ, শ্রীরামকৃষ্ণ সারদা বিদ্যামহাপীঠ, কবিকঙ্কন মুকুন্দরাম মহাবিদ্যালয় , নেতাজি মহাবিদ্যালয় আরও সহ বেশ কিছু  সরকারি ও বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান।

রয়েছে কম্পিউটার প্রশিক্ষণ কেন্দ্র।আরামবাগ মহুকুমার অধীনে রয়েছে বেশ কিছু স্বাস্থ্য পরিষেবা কেন্দ্র।আরামবাগ শহরে রয়েছে ২৫০টি শয্যা বিশিষ্ঠ আরামবাগ মহকুমা হাসপাতাল।এবং আরামবাগ শহরে রয়েছে বেশ কিছু বেসরকারি নার্সিংহোম। এছাড়াও রয়েছে এই মহুকুমার অধীনে রয়েছে  গ্রামীণ হাসপাতাল ও প্রাথমিক স্বাস্থ্য কেন্দ্র।   

আরামবাগের কাছে বদনগঞ্জ গ্রামে ছিল তাঁর বাড়ি। ঊনবিংশ শতাব্দীর সমাজ , ধর্মসংস্কারক ও ব্রাহ্মসমাজের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা রাজা রামমোহন রায়ের পৈতৃক নিবাস ও জন্মস্থান আরামবাগ মহকুমার অন্তর্গত রাধানগর গ্রামে।আরামবাগের কয়েকজন বিশিষ্ট ব্যক্তিত্ব হলেন ধর্মমঙ্গল কাব্যের আদি কবি খেলারাম চক্রবর্তী।  ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রখ্যাত বাঙালি যোগসাধক রামকৃষ্ণ পরমহংসদেব জন্মগ্রহন করেন আরামবাগ মহকুমার কামারপুকুরে জন্ম।সেখানেই তিনি তাঁর শৈশব ও কৈশোর অতিবাহিত করেন।

বর্তমানে কামারপুকুর একটি হিন্দু তীর্থস্থান হিসেবে প্রসিদ্ধ। বাঙালি কথাসাহিত্যিক বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ছিলেন আরামবাগ মহকুমার প্রাক্তন মহকুমা-শাসক। তাঁর দুর্গেশনন্দিনী উপন্যাসের প্রেক্ষাপটও ছিল এই মহকুমার গড় মান্দারন , যা ১৮৬৫ সালে প্রকাশিত হয়েছিল এই  'দুর্গেশনন্দিনী' উপন্যাসটি। এছাড়াওকয়েকজন বিশিষ্ট ব্যক্তিত্ব হলেন মুহাম্মদ শফী (বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে নিহত মুক্তিযোদ্ধা ও শল্যচিকিৎসক) আরামবাগ মহকুমার দিঘড়ে গ্রামে জন্মেছিলেন । দ্বিজ শ্রীরামজীবন (সুভদামঙ্গল কাব্যের কবি) আরামবাগ মহকুমার আরান্ডি গ্রামের নিবাসি ছিলেন। 

আরামবাগ মহুকুমার কতকগুলি ধর্মীয় স্থান হল কামারপুকুর। এই গ্রামেই জন্ম গ্রহন করেছিলেন  ঊনবিংশ শতাব্দীর হিন্দু ধর্মগুরু রামকৃষ্ণ পরমহংসদেব। যা বর্তমানে হিন্দুদের পবিত্র তীর্থস্থান।বর্তমানে আরামবাগ পুরসভার অধীনস্থ পারুলে ১৮৫৯ সালে ডিহি বায়ড়ার রাজপরিবারের বংশধর রণজিৎ রায় একটি বিশালাক্ষী মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন।

দৈর্ঘ্যে ও প্রস্থে সাড়ে উনিশ ফুট, দক্ষিণমুখী ও তিনটি খিলানযুক্ত প্রবেশপথ-বিশিষ্ট এই মন্দিরটির সম্মুখভাগে মৃৎফলকের উপর দেবদেবী, পশুপাখি ও ফুলপাতার অলংকরণ লক্ষিত হয়। পারুলের দ্বিতীয় মন্দিরটি ১৭৬৮ সালে স্থানীয় চক্রবর্তী বংশ কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত রঘুনন্দন মন্দির। দৈর্ঘ্যে ২৩ ফুট ও প্রস্থে ২১ ফুট এই মন্দিরটি বর্তমানে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের প্রত্নতত্ত্ব অধিকার কর্তৃক সুসংরক্ষিত। পূর্বমুখী ও তিনটি খিলানযুক্ত প্রবেশপথ-বিশিষ্ট এই মন্দিরেরও সম্মুখভাগে মৃৎফলকে দেবদেবীর মূর্তি, রামায়ণের কাহিনি, রাজদরবারের চিত্র, পশুপাখি ও গাছপালার অলংকরণ দেখা যায়।

পারুলের বিশালাক্ষী ও রঘুনন্দন উভয় মন্দিরই আটচালা মন্দির। আরামবাগ সন্নিহিত বাসুদেবপুরে শিব ও রঘুনন্দনের দুটি মন্দির এবং একটি পরিত্যক্ত মন্দির রয়েছে। মাধবপুর গ্রাম পঞ্চায়েত এলাকার কানপুর গ্রামে কণকেশ্বর শিবমন্দির একটি এই মহুকুমার একটি বিখ্যাত মন্দির। কণকেশ্বর শিবমন্দিরটি ঊনবিংশ শতাব্দীতে নির্মিত হলেও মন্দিরটির স্থাপত্যগত কিছু বৈশিষ্ট্য রয়েছে।

এটি একটি একরত্ন মন্দির। চূড়াটি রেখশৈলীর এবং সেটির উপরিভাগ গম্বুজসদৃশ। গর্ভগৃহের চারিদিকে প্রশস্ত বারান্দা এবং বারান্দার চারিদিকে খিলানের সারি বর্তমান।মাধবপুর গ্রাম পঞ্চায়েত এলাকার হামিরবাটী গ্রামে ১৭০৪ সালে স্থানীয় রায় পরিবার প্রতিষ্ঠিত দামোদর মন্দিরটি উল্লেখযোগ্য এই মহুকুমার পুরাকীর্তি।আরামবাগ শহর থেকে চার কিলোমিটার দূরে অবস্থিত মায়াপুর গ্রাম পঞ্চায়েত এলাকার ডিহি বায়ড়া একটি ইতিহাসপ্রসিদ্ধ জায়গা।

এখানকার রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা নরেন্দ্রনারায়ণ বুন্দেলখণ্ড থেকে এখানে এসেছিলেন। ডিহি বায়ড়ায় স্থানীয় পালবংশ ১৮৫৮ সালে স্বরূপনারায়ণ ধর্মঠাকুরের একটি ছোটো আটচালা মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন। দৈর্ঘ্যে প্রায় ১৬ ফুট ও প্রস্থে সাড়ে চোদ্দো ফুটের এই মন্দিরটি পূর্বমুখী এবং তিনটি খিলানযুক্ত প্রবেশদ্বার-বিশিষ্ট। মায়াপুর পঞ্চায়েত এলাকার হাটবসন্তপুরে তিনটি মন্দির এখানকার উল্লেখযোগ্য স্থাপনা। মন্দির তিনটি হল জয়চণ্ডী মন্দির, একটি জোড়া শিবমন্দির ও একটি পৃথক শিবমন্দির। বাতানল গ্রাম পঞ্চায়েত এলাকার অন্তর্গত ভালিয়া গ্রামে ১৭৭২ সালে স্থানীয় সরকার বংশ কর্তৃক রঘুনাথ মন্দির প্রতিষ্ঠিত হয়।

এই আটচালা মন্দিরটি দক্ষিণমুখী, দৈর্ঘ্যে ২৪ ফুট ও প্রস্থে ২৩ ফুট এবং তিনটি খিলানযুক্ত প্রবেশপথ-বিশিষ্ট।সালেপুর ১ গ্রাম পঞ্চায়েত এলাকার সালেপুর গ্রামে ধর্মঠাকুরের দু’টি মন্দির রয়েছে। আরামবাগ থানা এলাকার শ্রীরামপুর গ্রামে স্থানীয় ঘোষবংশ প্রতিষ্ঠিত বিষ্ণুমন্দিরটি একটি উল্লেখযোগ্য স্থাপনা। বেঙ্গাই পঞ্চায়েত এলাকার ইদলবাটি গ্রামে ১৭২৭ সালে স্থানীয় কোঙার বংশ প্রতিষ্ঠিত  একটি পরিত্যক্ত আটচালা মন্দির রয়েছে।এই মন্দিরটি দক্ষিণমুখী এবং এটির সম্মুখভাগে মৃৎফলকের উপর বিভিন্ন দেবদেবী, পশুপাখি ও লতাপাতার অলংকরণ দেখা যায়।এছাড়াও আরামবাগ মহুকুমার বিভিন্ন গ্রামে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে উল্লেখযোগ্য সব পুরাকীর্তি।