অ্যারিস্টটল এর জীবনী

বিখ্যাত গ্রিক দার্শনিক প্লেটোর অন্যতম যোগ্য শিষ্য অ্যারিস্টটল (Aristotle)। তিনি নিজেও একজন অবিস্মরণীয় দার্শনিক হিসেবে বিখ্যাত। ‘কাব্যতত্ত্ব’ বিষয়ে তাঁর গুরুত্বপূর্ণ বক্তৃতাগুলি আজও বৌদ্ধিক চর্চার জগতে সুবিদিত। বিখ্যাত দিগ্বিজয়ী বীর আলেকজাণ্ডার দ্য গ্রেটের শিক্ষক ছিলেন অ্যারিস্টটল। পদার্থবিজ্ঞান, অধিবিজ্ঞান, দর্শন, জীববিজ্ঞান, রাষ্ট্রবিজ্ঞান, রাজনীতি, উদ্ভিদবিজ্ঞান, রসায়ন, জ্যোতির্বিজ্ঞান ইত্যাদি জ্ঞানচর্চার বিভিন্ন অঙ্গনে তাঁর অনায়াস যাতায়াত ছিল। দুই দশকেরও বেশি সময় ধরে তিনি প্লেটোর প্রতিষ্ঠিত এথেন্সের ‘অ্যাকাডেমি’র সদস্য ছিলেন তিনি।
গ্রিসের অর্থনীতি ও রাজনীতি বিষয়ক তাঁর লেখা ‘পলিটিক্স’ বইটি সর্বাগ্রে উল্লেখযোগ্য এবং এই বইতেই তাঁর গুরু প্লেটোর লেখা ‘রিপাবলিক’ গ্রন্থের বিরূপ সমালোচনা করেন অ্যারিস্টটল। প্লেটো যেখানে নগররাষ্ট্রের সমস্যা বিষয়ে ভাববাদী দৃষ্টিভঙ্গির আশ্রয় নিয়েছিলেন, তেমনি অন্যদিকে অ্যারিস্টটল ছিলেন সম্পূর্ণ বাস্তববাদী দর্শনে বিশ্বাসী। আলেকজাণ্ডার সম্রাট থাকাকালীন তিনি এথেন্সে ‘লাইসিয়াম’ নামে এক শিক্ষাকেন্দ্র স্থাপন করেন। সমস্ত পাশ্চাত্য দর্শনের চিন্তাধারার বিকাশে অ্যারিস্টটলের দর্শন যথেষ্ট প্রভাব বিস্তার করতে পেরেছিল।
প্রাথমিকভাবে একজন গণিতবিদ হলেও অবরোহী তর্কশাস্ত্রের ক্ষেত্রেও তাঁর অবদান যথেষ্ট স্মরণীয়। অ্যারিস্টটলের লেখা শারীরবিদ্যা বিষয়ক বই ‘অ্যানালিটিকা পোস্টেরোরা’ও জ্ঞানচর্চার জগতে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আনুমানিক ৩৮৪ খ্রিস্টপূর্বাব্দে প্রাচীন গ্রিসের উত্তরে এক সমুদ্র-উপকূলবর্তী স্টাগিরা নামক অঞ্চলে অ্যারিস্টটলের জন্ম হয়। তাঁর বাবা নিকোম্যাকাস ম্যাসিডোনিয়ার রাজা তৃতীয় অ্যামিন্টাসের গৃহ-চিকিৎসক ছিলেন এবং তাঁর মা ফায়েস্তা ছিলেন এক সম্ভ্রান্ত পরিবারের কন্যা। শৈশবে যথেষ্ট স্বাচ্ছন্দ্যেই দিন অতিবাহিত করেছেন অ্যারিস্টটল।
তাঁর মায়ের পৈতৃক নিবাস ছিল ইউবোয়ার চালসিসে, সেখানেও তাঁদের একটি পারিবারিক সম্পত্তি ছিল। নিকোম্যাকাস চাইতেন বড়ো হয়ে অ্যারিস্টটল ডাক্তার হবেন কারণ সেকালে রীতি ছিল চিকিৎসাবিজ্ঞানের বিবিধ কৌশল ও জ্ঞান বংশপরম্পরায় বাহিত হতো এবং তা সর্বদা গোপন রাখতে হতো। সেই সময় চিকিৎসকের কাছে রোগীরা আসতো না, বরং চিকিৎসকরাই ঘুরে ঘুরে ভ্রমণ করতেন রোগীর সন্ধানে। সম্ভবত বাবার সঙ্গে সঙ্গে অ্যারিস্টটলও শৈশবে নানা জায়গায় ঘুরতেন।
রাজা অ্যামিন্টাসের পুত্র ফিলিপের সঙ্গে অ্যারিস্টটলের সখ্যতা গড়ে ওঠে। মাত্র দশ বছর বয়সে বাবাকে হারান তিনি। এমনকি কিছুদিনের মধ্যে তাঁর মায়েরও মৃত্যু হয়। তাঁর এক কাকা প্রক্সেনাস আটর্নিয়াসের কাছেই তিনি মানুষ হয়েছেন। এই কাকার কাছেই শৈশবে তিনি গ্রিক ভাষা, অলঙ্কারশাস্ত্র এবং কাব্যতত্ত্ব বিষয়ে জ্ঞানার্জন করেন। পরবর্তীকালে তিনি যে গ্রিক ভাষায় সুন্দর গদ্য লিখবেন তাঁর ভিত্তি স্থাপিত হয়েছিল এই পর্বেই। পরবর্তীকালে হারমিয়াসের ভাইয়ের কন্যা পিথিয়াসকে বিয়ে করেন অ্যারিস্টটল।
৩৬৭ খ্রিস্টপূর্বাব্দে সতেরো বছর বয়সে অ্যারিস্টটল এথেন্সে প্লেটোর অ্যাকাডেমিতে ভর্তি হন। ততদিনে অ্যাকাডেমির কুড়ি বছর অতিক্রান্ত। প্লেটোও সেই সময় এথেন্সে ছিলেন না, সিরাকিউজে তিনি প্রথমবারের জন্য রওনা দিয়েছিলেন। তবে প্লেটোর এই অ্যাকাডেমি কখনোই একটি অরাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান ছিল না। এই রাজনীতি সচেতনতাই অ্যারিস্টটলের জীবকে গভীরভাবে প্রাণিত করেছিল। প্লেটোর অনুপস্থিতিতে সেই সময় অ্যাকাডেমির পরিচালনায় ছিলেন সিনিডোসের ইক্সোডাস। প্লেটোর ভাইপো স্পিওসিপ্পাসও সেখানে পড়াতেন। ছাত্রাবস্থা সম্পূর্ণ করে অ্যারিস্টটল সেই অ্যাকাডেমির একজন শিক্ষক হয়ে ওঠেন তিনি এবং দীর্ঘ কুড়ি বছর সেখানে অধ্যাপনা করেন তিনি।
প্লেটোর সঙ্গে অ্যারিস্টটলের খুব সখ্যতা থাকলেও, তাঁর মতের সঙ্গে অনেকক্ষেত্রেই বনিবনা হতো না অ্যারিস্টটলের। প্লেটোর মৃত্যুর পরে মাইসিয়ার রাজা এবং অ্যারিস্টটলের বন্ধু হারমিয়াসের আমন্ত্রণে তাঁর রাজসভায় কাজ করতে শুরু করেন অ্যারিস্টটল। তিন বছর তিনি এই রাজসভায় কাটান। ৩৩৮ খ্রিস্টপূর্বাব্দে ম্যাসিডোনিয়ায় ফিরে যান তিনি এবং সেখানে রাজা ফিলিপের পুত্র সম্রাট আলেকজাণ্ডারের গৃহশিক্ষক হিসেবে যোগ দেন তিনি।
অল্পসময়ের মধ্যেই তিনি আলেকজাণ্ডারের অতি প্রিয় হয়ে ওঠেন। চিকিৎসাশাস্ত্র, নীতিবিদ্যা এবং আরো নানা বিষয়ে শিক্ষা দিতেন অ্যারিস্টটল। যদিও জানা যায় যে ফিলিপের পুত্র আলেকজাণ্ডারকে ছাত্র হিসেবে গ্রহণ করার সময় রাজা ফিলিপকে অ্যারিস্টটল তিনটি শর্ত দিয়েছিলেন যার মধ্যে প্রথম হল ম্যাসিডোনিয়া অধিকারের সময় স্টাগিরা শহরের যে ক্ষতি করেছে ফিলিপের সেনারা তার যথাযোগ্য ক্ষতিপূরণ দাবি করেন তিনি, দ্বিতীয়ত স্টাগিরার যে মানুষেরা নির্বাসিত হয়েছিলেন তাদের ফিরিয়ে আনতে হবে স্বগৃহে এবং সর্বশেষ ছিল যুদ্ধবন্দী ও ক্রীতদাস হিসেবে নিযুক্ত স্টাগিরাবাসীদের মুক্ত করতে হবে। ফিলিপ তাঁর সকল শর্তই মেনে নিয়েছিলেন।
রাজা ফিলিপের মৃত্যু হলে ম্যাসিডোনিয়ার সম্রাট হন আলেকজাণ্ডার এবং তিনি এথেন্সে অ্যারিস্টটলের একটি পৃথক স্কুল খোলার উদ্যোগ নেন। সেই সময় এথেন্সে ‘লাইসিয়াম’ নামে একটি স্কুল খুলে সেখানেই শিক্ষাদান করতে শুরু করেন অ্যারিস্টটল। কিন্তু আলেকজাণ্ডার মারা গেলে এথেন্সের বিচারালয় তাঁর বিরুদ্ধে ধর্মদ্রোহীতার অভিযোগ আনে এবং সেই কারণে প্রাণরক্ষার তাগিদে ইউবোয়া দ্বীপে পালিয়ে আত্মগোপন করেন তিনি। সেই সময় থেকেই এথেন্সে অরাজকতা শুরু হয় আর অ্যারিস্টটলের থাকাও সেখানে সম্ভব হয় না। রসায়ন, জীববিজ্ঞান, ভূতত্ত্ব, জ্যোতির্বিদ্যা, দর্শন প্রভৃতি বিভিন্ন বিষয়ে তাঁর চর্চার উত্তুঙ্গ শীর্ষ অর্জন করেন অ্যারিস্টটল এই সময়ে।
এম্পেডোক্লিসের প্রকৃতিতত্ত্বে জল, মাটি, বায়ু ও আগুন এইরকম যে চারটি মৌলিক উপাদানের কথা রয়েছে, এর সঙ্গে অ্যারিস্টটল আরো একটি উপাদান যোগ করেন যার নাম দেন তিনি ফার্স্ট এলিমেন্ট। তাঁর মতে চাঁদ, সূর্য ও অন্যান্য গ্রহে এই উপাদানটি থাকায় সেগুলি বৃত্তাকারে আবর্তিত হয়। তবে অ্যারিস্টটলের এই কল্পিত ধারণায় বিশ্বাস করে অ্যালকেমিস্টরা ভেবেছিলেন এর সাহায্যে মানুষের রোগ নির্ণয়ও সম্ভব হবে। রসায়নবিদ্যার পাশাপাশি তিনি জীববিদ্যার উপরেও অনেক বই লিখেছেন। বিভিন্ন প্রাণীকে তিনি মোট এগারোটি শ্রেণিতে ভাগ করেছিলেন এবং প্রতিটি শ্রেণির নাম দিয়েছিলেন জেনাস।
বিখ্যাত শ্রেণিবিন্যাসকারক ক্যারোলাস লিনিয়াসের আগে তিনিই প্রথম প্রাণীদের পৃথক পৃথক বৈশিষ্ট্যের ভিত্তিতে তাদের শনাক্ত করেন। ডলফিন যে মাছ নয়, স্তন্যপায়ী প্রাণী সে কথা তিনিই প্রথম ঘোষণা করেন। পরীক্ষা বা পরিমাপের উপর ভরসা না করে পর্যবেক্ষণের উপর বিশ্বাস রাখতেন অ্যারিস্টটল। তবে তাঁর বৈজ্ঞানিক তত্ত্বগুলি প্রমাণিত নয়, তা কেবলই তাত্ত্বিক প্রকল্পমাত্র এবং দর্শনের পর্যায়ে পড়ে। বৈজ্ঞানিক বস্তুনিষ্ঠতা তাঁর ছিল না। তিনিও বিশ্বাস করতেন যে সূর্যই পৃথিবীর চারপাশে ঘোরে।
এছাড়া অ্যারিস্টটল বলেছিলেন যে ভারী বস্তু হালকা বস্তুর থেকে অনেক তাড়াতাড়ি মাটিতে পড়ে। কিন্তু অনেক পরে গ্যালিলিও এই ধারণার ভ্রান্তি পরীক্ষার সাহায্যে প্রমাণ করেন। দর্শনের ক্ষেত্রে ব্যবকলন এবং অনুমানের মাধ্যমে সিদ্ধান্ত গ্রহণের পক্ষপাতী ছিলেন তিনি। তাঁর এই পদ্ধতিকে বলা হয় ‘সিলোগিজম’। ‘নিকোম্যাসিয়ান এথিকস’ এবং ‘প্রায়োর অ্যানালিটিক্স’ নামে তাঁর দুটি বিখ্যাত দর্শনের বই লিখেছিলেন তিনি। অ্যারিস্টটল নানা সময়ে নানা বিষয়ে গবেষণা প্রবন্ধ লিখেছেন, বক্তৃতা দিয়েছেন।
তাঁর অন্যতম ছাত্র থিওফ্রাস্টাস তাঁর মৃত্যুর পরে অ্যারিস্টটলের সব কাজ একত্রিত করেন এবং সংরক্ষণ করেন। তর্কশাস্ত্র বিষয়ে তাঁর লেখা ‘ক্যাটাগরিস’, ‘অন ইন্টারপ্রিটেশন’, পোস্টেরিয়র অ্যানালিটিক্স’ ইত্যাদি বইগুলি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ‘মেটাফিজিক্স’ নামে তাঁর লেখা বইয়ের মূল বিষয় ছিল বস্তুর আকার ও গঠন। এছাড়া ‘অন দ্য হেভেনস’, ‘অন দ্য সোল’ এবং ‘রেটোরিক’ তাঁর অন্যতম উল্লেখযোগ্য কাজ। এছাড়া কাব্য, ট্র্যাজেডি ইত্যাদি বিষয়ে নানা সময় তিনি যে বক্তৃতা দিয়েছিলেন তাঁর নোটস জাতীয় লেখা পরে ‘পোয়েটিক্স’ তথা কাব্যতত্ত্ব নামে পরে প্রকাশিত হয়।
মূলত বাস্তব পরিবেশের উপর ভিত্তি করেই বস্তুবাদী দর্শ্ন আলোচনায় অভ্যস্ত ছিলেন তিনি। তাঁর লেখা ‘পলিটিক্স’ বইটি রাজনীতি সংক্রান্ত এক অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ। কাব্যতত্ত্ব বিষয়েও প্লেটোর সঙ্গে অ্যারিস্টটলের মতপার্থক্য ছিল। প্লেটো যেমন কাব্য বা সাহিত্যচর্চাকে অপ্রয়োজনীয় এবং সমাজের পক্ষে হানিকর বলে মনে করেছিলেন, তেমনি অ্যারিস্টটল সমাজের এবং ব্যক্তির সামগ্রিক বিকাশের এক অন্যতম উপাদান হিসেবে সাহিত্য তথা কাব্যকে স্বীকৃতি দিয়েছিলেন।
রাষ্ট্র সংগঠনের ক্ষেত্রে তিনি মনে করতেন যে ব্যক্তি নিজের কল্যাণের জন্য রাষ্ট্র গঠন করে। মানুষই সর্বপ্রথম নিজের বুদ্ধিবৃত্তি দিয়ে অনুভব করেছিল রাষ্ট্রের প্রয়োজনীয়তা আর তাই তারা রাষ্ট্রগঠনে উদ্যোগী হয়। তবে তিনি মোট কতগুলি গ্রন্থ রচনা করেছিলেন সে কথা সঠিক করে কেউ বলতে পারে না। ৩২২ খ্রিস্টপূর্বাব্দে আনুমানিক ৬১-৬২ বছর বয়সে ইউবোয়া দ্বীপে অ্যারিস্টটলের মৃত্যু হয়।
আরো পড়ুন জীবনী মন্দির দর্শন ইতিহাস ধর্ম জেলা শহর শেয়ার বাজার কালীপূজা যোগ ব্যায়াম আজকের রাশিফল পুজা পাঠ দুর্গাপুজো ব্রত কথা মিউচুয়াল ফান্ড বিনিয়োগ জ্যোতিষশাস্ত্র টোটকা লক্ষ্মী পূজা ভ্রমণ বার্ষিক রাশিফল মাসিক রাশিফল সাপ্তাহিক রাশিফল আজ বিশেষ রান্নাঘর প্রাপ্তবয়স্ক বাংলা পঞ্জিকা