দ্রোণ বধ নিয়ে অর্জুন যুধিষ্ঠিরের ঝগড়া

মহাভারতের দ্রোণপর্বের ১৯৭তম অধ্যায় থেকে ২০২তম অধ্যায় জুড়ে দ্রোণ বধ নিয়ে অর্জুন ও যুধিষ্ঠিরের ঝগড়ার কথা বর্ণিত আছে। ছেলে অশ্বত্থামার মৃত্যুর মিথ্যা খবর যুধিষ্ঠিরের মুখে শুনে দ্রোণাচার্য অস্ত্রত্যাগ করেন। নিরস্ত্র অবস্থায় পাঞ্চালরাজ দ্রুপদের ছেলে ধৃষ্টদ্যুম্ন দ্রোণকে বধ করেছিলেন। এই অন্যায় মানতে না পেরে অর্জুন প্রতিবাদ করেছিলেন, তখনই যুধিষ্ঠিরের সঙ্গে তাঁর কথা-কাটাকাটি হয়েছিল।
দ্রোণ বধ এর পর কৌরবপক্ষের সৈন্যরা সবাই প্রাণের ভয়ে যুদ্ধক্ষেত্র থেকে পালিয়ে যেতে লাগলেন। কর্ণ, শল্য, কৃপ, দুর্যোধন, দুঃশাসন প্রভৃতি যোদ্ধারাও সেখান থেকে চলে গেলেন। অশ্বত্থামা এসবের কিছুই জানতেন না। তিনি যুদ্ধক্ষেত্রের অন্যদিকে যুদ্ধ করছিলেন। সৈন্যদের পালাতে দেখে তিনি ভীষণ অবাক হয়ে দুর্যোধনকে এর কারণ জিজ্ঞাসা করলেন।
অশ্বত্থামাকে দেখে দুর্যোধনের চোখে জল এল, তিনি কথা বলতে পারলেন না। তখন কৃপ দ্রোণ বধ এর খবর ও কীভাবে তাঁর মৃত্যু হয়েছে সেকথা অশ্বত্থামাকে জানালেন। বাবার মৃত্যুর খবর পেয়ে অশ্বত্থামা প্রথমে দুঃখে ভেঙে পড়লেন। তারপর দুঃখ সামলে উঠে ভীষণ রাগের সঙ্গে দুর্যোধনকে বললেন, “মহারাজ! যে পাপী পান্ডব মিথ্যা কথা বলে আমার বাবাকে অস্ত্রত্যাগ করতে বাধ্য করেছে, আজ নিশ্চয়ই সেই যুধিষ্ঠিরকে আমি হত্যা করব।
আমার কাছে ‘নারায়ণাস্ত্র’নামে এক মহা ভয়ঙ্কর অস্ত্র আছে, ভগবান বিষ্ণু নিজে তা আমার বাবাকে দিয়েছিলেন। শ্রীবিষ্ণু নিজে ছাড়া এই অস্ত্রকে কেউ আটকাতে পারে না। মহারাজ! আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন। আমি আজ সমস্ত পান্ডবসৈন্য বধ করে বাবার মৃত্যুর প্রতিশোধ নেব।” এই কথা বলে অশ্বত্থামা জল ছুঁয়ে মন্ত্র পড়তে পড়তে নারায়ণাস্ত্রকে স্মরণ করলেন।
অশ্বত্থামার ধনুকে নারায়ণাস্ত্র এসে উপস্থিত হতেই পৃথিবী কাঁপতে লাগল, ঝড় বইতে লাগল, সূর্য মেঘের আড়ালে ঢাকা পড়ে গেল, নদীগুলির স্রোত বিপরীত দিকে বয়ে যেতে লাগল। অশ্বত্থামা পান্ডবপক্ষের মহাযোদ্ধাদের নাম মনে করে সেই ভয়ঙ্কর অস্ত্রকে তাঁদের হত্যা করতে আদেশ করলেন। ভীষণ শব্দে নারায়ণাস্ত্র তাঁর ধনুক থেকে বেরিয়ে পান্ডবদের দিকে ছুটে চলল।
কৌরব শিবিরে তখন দামামা ও শঙ্খ বাজতে লাগল। অশ্বত্থামাও সিংহনাদ করতে লাগলেন। কৌরবদের শিবির থেকে আসা তুমুল শব্দ শুনে ও হঠাৎ করে প্রকৃতিকে ক্ষুব্ধ হতে দেখে চিন্তিত যুধিষ্ঠির অর্জুনকে জিজ্ঞাসা করলেন, “অর্জুন! দ্রোণ বধ এর পর সৈন্যরা তো পালিয়ে গিয়েছিল। তাহলে এখন আবার তাদের ফিরিয়ে আনলো কে? কৌরবশিবিরেই বা এখন দামামার শব্দ হচ্ছে কেন?” অর্জুন বললেন, “মহারাজ!
দামামার শব্দ নয়, ও অশ্বত্থামার গর্জন। আপনি ধর্মজ্ঞানী হয়েও রাজ্যের লোভে মহাপাপ করেছেন। বালিবধের জন্য শ্রীরামচন্দ্রের যেমন অকীর্তি হয়েছিল, মিথ্যা কথা বলে দ্রোণকে হত্যা করার জন্য তেমনি আপনার অকীর্তি হবে। দ্রোণ আপনার সত্যবাদিতার কথা জানতেন বলে আপনার উপর বিশ্বাস করেছিলেন, কিন্তু আপনি সে বিশ্বাস ভেঙে দিয়েছেন।
অশ্বত্থামা বাবার মৃত্যুর প্রতিশোধ নিতে নারায়ণাস্ত্র প্রয়োগ করেছেন। এখন আপনারা যদি পারেন তো ধৃষ্টদ্যুম্নকে রক্ষা করুন। আমরা রাজ্যলাভের জন্য মিথ্যা কথা বলে আমাদের গুরুকে হত্যা করেছি। হায়! আমরা মহাপাপ করেছি।” অর্জুনের মুখে একথা শুনে ভীম রেগে গিয়ে বললেন, “অর্জুন! তুমি বনবাসী ব্রতধারী ব্রাহ্মণদের মত ধর্মকথা কেন বলছ?
কৌরবরা ছলনা করে আমাদের রাজ্য কেড়ে নিয়েছিল, ভরা রাজসভায় পাঞ্চালীর চুল ধরে টেনে এনেছিল, তাঁকে বিবস্ত্রা করার চেষ্টাও করেছিল। তাদের চক্রান্তেই আমরা নিজেদের রাজ্য হারিয়ে তেরো বছর ধরে বনবাসে গিয়েছিলাম। এসব কথা কি তুমি ভুলে গেছ? তুমি ক্ষত্রিয়ধর্ম না বুঝে কেন দাদাকে অপমান করছো? তোমার যদি ইচ্ছা না থাকে তো যুদ্ধ কোরো না।
আমি একাই গদা নিয়ে নারায়ণাস্ত্রকে আটকে দেব।” এইভাবে কথায় কথায় পান্ডব যোদ্ধাদের মধ্যে ভীষণ ঝগড়া বেঁধে গেল। ওদিকে নারায়ণাস্ত্র থেকে হাজার হাজার উজ্জ্বল সাপের মত মুখ বাণ এবং লোহার গোলকের মত শতঘ্নী, শূল, গদা, চক্রের সঙ্গে আরো নানারকম ভয়ানক অস্ত্র ও আগুন বেরিয়ে এসে পান্ডবসৈন্যদের হত্যা করতে লাগল।
সৈন্যরা সবাই প্রাণভয়ে যুদ্ধক্ষেত্র থেকে পালাচ্ছে কিন্তু তা দেখেও অর্জুন চুপ করে আছেন দেখে ভীষণ দুঃখের সঙ্গে যুধিষ্ঠির ধৃষ্টদ্যুম্ন ও সাত্যকিকে ডেকে বললেন, “তোমরা নিজের নিজের সৈন্য নিয়ে দেশে ফিরে যাও। আমি ভাইদের সঙ্গে আগুনে ঝাঁপ দেব। ভীষ্ম ও দ্রোণরূপ বিশাল সাগর পেরিয়ে এসে এখন আমি অশ্বত্থামারূপ গোষ্পদে ডুবে মরব। অর্জুনের মতে, আমিই গুরু দ্রোণকে হত্যা করিয়েছি। তাই অর্জুনের ইচ্ছাই পূরণ হোক।
এই দ্রোণই বালক অভিমন্যুকে হত্যা করার জন্য চক্রব্যূহ তৈরি করেছিলেন, দ্যূতসভায় লাঞ্ছিতা দ্রৌপদীর প্রশ্ন শুনেও চুপ করে ছিলেন, ক্লান্ত অর্জুনকে মারবার জন্য যখন দুর্যোধন যুদ্ধ করতে যান তখন ইনিই তার দেহে অক্ষয় কবচ বেঁধে দিয়েছিলেন, পাঞ্চাল রাজ্যের সৈন্যরা ব্রহ্মাস্ত্রের সঙ্কেত জানেনা অথচ ব্রহ্মাস্ত্র দিয়েই দ্রোণ তাদের হত্যা করেছিলেন, কৌরবেরা যখন আমাদের তাড়িয়ে দিয়েছিল তখন ইনিই আমাদের যুদ্ধ করতে দেননি, আমাদের সঙ্গে বনেও যাননি।
আমাদের এই পরম বন্ধু দ্রোণাচার্যকে আমি হত্যা করিয়েছি, তাই আমিও ভাইদের সঙ্গে প্রাণত্যাগ করব।” একথা বলে যুধিষ্ঠির চোখ ভরা জল নিয়ে চুপ করলেন। কৃষ্ণ তখন অর্জুনের রথ থেকে নেমে এসে সৈন্যদের বললেন, “তোমরা সবাই অস্ত্র ফেলে দিয়ে হাত তুলে নিজের নিজের রথ থেকে নেমে এসে মাটিতে দাঁড়াও। অস্ত্রত্যাগ করলে নারায়ণাস্ত্র তোমাদের কোনো ক্ষতি করতে পারবে না।”
একথা শুনে সব যোদ্ধারা তাই করলেন। কিন্তু ভীম অস্ত্র ও রথ ত্যাগ করতে রাজি না হওয়ায় নারায়ণাস্ত্রের আগুন এসে তাঁকে ঘিরে ফেলল। তা দেখে কৃষ্ণ ছুটে গিয়ে ভীমকে টেনে রথ থেকে নামালেন ও তাঁর হাত থেকে অস্ত্র কেড়ে মাটিতে ফেলে দিলেন। সবাইকে নিরস্ত্র দেখে নারায়ণাস্ত্রও নিবৃত্ত হয়ে গেল। বাকি পান্ডবসৈন্যরা আবার যুদ্ধের জন্য তৈরি হচ্ছে দেখে দুর্যোধন দ্বিতীয়বার নারায়ণাস্ত্র প্রয়োগ করার জন্য অশ্বত্থামাকে অনুরোধ করলেন।
অশ্বত্থামা দুঃখের সঙ্গে বললেন, “মহারাজ! তা সম্ভব নয়। কারণ দ্বিতীয়বার প্রয়োগ করলে এই অস্ত্র আমাকেই হত্যা করবে।” এই বলে তিনি অর্জুনের দিকে ভয়ানক আগ্নেয়াস্ত্র ছুঁড়ে মারলে অর্জুন ব্রহ্মাস্ত্র দিয়ে তা আটকে দিলেন। তখন অশ্বত্থামা সব আশা হারিয়ে মাথা নিচু করে যুদ্ধক্ষেত্র থেকে চলে গেলেন। সেদিনের যুদ্ধ শেষ হল।