জাতপাত নয়, উত্তরপ্রদেশে হিন্দুদের বিপুল ভোটে জয়ী বিজেপি

প্রভাকর রায় চার রাজ্য উত্তরপ্রদেশ (Uttar Pradesh), উত্তরাখণ্ড (Uttarakhand), গোয়া (Goa), মণিপুরে (Manipur) জয়জয়কার গেরুয়া শিবিরের। যার পর সন্ধ্যায় দিল্লিতে বিজেপির সদর দপ্তরে বক্তব্য রাখেন নরেন্দ্র মোদি। শুরুতেই উত্তরপ্রদেশ-সহ চার রাজ্যের ভোটারদের ধন্যবাদ জ্ঞাপন করেন তিনি। বলেন, “আজ গণতন্ত্রের উৎসবের দিন। আজ থেকেই শুরু হোক আগাম হোলি।”যোগীর বুলডোজারের নীচে ভাঙা পড়েছে অখিলেশ যাদবের সাইকেল। পিষ্ট হয়েছে মায়াবতীর হাতি। কাটা পড়েছে প্রিয়ঙ্কা গাঁধীর হাত।
সাত দফা ভোট পর্বের শেষ দিনে বুথফেরত জরিপ জনপ্রিয় ধারণায় প্রথম যে ধাক্কা দিয়েছিল, বৃহস্পতিবার তা বিস্ময়করভাবে সত্য হলো। প্রতিশ্রুতি পালনে অন্যথা না হলে দীর্ঘ ৬২ বছর পর দেখা যাবে, টানা পাঁচ বছর শাসনের পর কেউ উপর্যুপরি দ্বিতীয়বার উত্তর প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী পদে শপথ নেবে ‘হিন্দু হৃদয়সম্রাট’ যোগী আদিত্যনাথ। যোগী আদিত্যনাথ হতে চলেছেন সেই বিরল রাজনীতিক, উত্তর প্রদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে গোবিন্দবল্লভ পন্থ ও সম্পূর্ণানন্দর পর যিনি পরপর দুবার মুখ্যমন্ত্রিত্ব লাভ করবেন।
১৯৫০ থেকে ১৯৫৪ সালের মধ্যে পন্থ দুবার মুখ্যমন্ত্রী হয়েছিলেন। আর সম্পূর্ণানন্দ ১৯৫৪ থেকে ১৯৬০ মধ্যে। দুজনই ছিলেন কংগ্রেসের অবিসংবাদিত নেতা। যোগীর ব্যক্তিগত সততা। দাপুটে মুখ্যমন্ত্রী হওয়া সত্ত্বেও তাঁর পাঁচ বছরের শাসনকালে যোগীর বিরুদ্ধে কোনও ভাবে কখনও স্বজনপোষণ বা দুনীতির অভিযোগ ওঠেনি। যোগী-পূর্ব আমলে যে সমস্ত মুখ্যমন্ত্রী এসেছেন, তাঁদের অনেকের বিরুদ্ধে যেমন দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে, তেমনই উঠেছে নিজেদের ‘ভাই-ভাতিজা’-দের সরকারি উচ্চপদে বসিয়ে দেওয়ার অভিযোগও।
যোগী প্রথম থেকেই গেরুয়াধারী সন্ন্যাসী। গোরক্ষপুরের মঠই তাঁর আবাস। তিনি পূর্বাশ্রমের সঙ্গে কোনও যোগাযোগ রাখেন না। করোনার সময় তাঁর বাবার মৃত্যু হয়েছিল। কিন্তু তিনি যাননি। জাগতিক সমস্ত আত্মীয়তার বন্ধন ছিন্ন করে তিনি স্বজনপোষণের রাস্তা বন্ধ করার বার্তা দিয়েছেন এবং ফলিত স্তরে তা করে দেখিয়েছেন, এমনই বলেন তাঁর ভক্তেরা। রসিকতা করে তাঁরা আরও বলেন, ‘‘যোগীবাবার তো আত্মীয় বলতে মঠের গোশালার গরুরা।
ওদের তো আর সরকারি চাকরি দেওয়া যায় না!’’ বিরোধীরা বলবেন, উত্তরপ্রদেশে মেরুকরণের রাজনীতি করেছেন যোগী। ভোটের ময়দানেও সেই মেরুকরণই ছিল তাঁর হাতিয়ার। একথা অনস্বীকার্য যে, ভোটের আগে তাঁর আশি-বিশের ফর্মুলা (উত্তরপ্রদেশের ২৫ কোটি লোকসংখ্যার ৮০ শতাংশ হিন্দু এবং ২০ শতাংশ মুসলিম) ধর্মীয় মেরুকরণকে যে প্রকট করেছিল, তাতে সন্দেহ নেই।
উত্তরপ্রদেশে ৪০৩টি আসনের মধ্যে ২৫৫টি আসন গিয়েছে BJP -র ঝুলিতে। অখিলেশ যাদবের সমাজবাদী পার্টি ১০০-র গণ্ডি টপকালেও প্রত্যাশার থেকে অনেকটাই পিছনে রয়েছে। আর কংগ্রেসের ফলও খুবই খারাপ। রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের একাংশ বলছেন, এই ফলাফলের অন্যতম কারণ গো-বলয়ের জাতপাতের রাজনীতি। হিন্দুত্বের ধ্বজাধারী এই রাজ্যে অযোধ্যায় রামমন্দির নির্মাণ ও মোদীর বারাণসী ‘মেকওভার’ যে হিন্দু ভোট ব্যাঙ্কের পালে হাওয়া দিয়েছে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
আবার ভোটের প্রাক্কালে একের পর এক দলিত নেতা গেরুয়া শিবির ছেড়ে অখিলেশের দলে যোগ দিলেও জাঠ, দলিত ও ক্ষত্রিয়দের প্রতি BJP-র বিশেষ সমীকরণ পদ্ম শিবিরের ভোটব্যাঙ্ক ধরে রেখেছে। পাশাপাশি কৃষক আন্দোলন, মন্ত্রীর চাকায় আন্দোলনরত কৃষকের পিষ্ট হওয়া, ধর্ষণের মতো ঘটনা ঘটলেও যোগী সরকারের উন্নয়ন ও জনমুখী প্রকল্পের কাছে সব চাপা পড়ে গিয়েছে। আরেক অংশের মতে, যোগী আদিত্যনাথ পুলিশকে অবাধ স্বাধীনতা দিয়েছিলেন এবং অপরাধীদের শাস্তি দেওয়ার পরিমাণ বেড়েছিল।
এটা জনমানসে বিশেষ প্রভাব ফেলেছে। আবার করোনা মহামারী ও লকডাউনের সময় রাজ্যবাসীকে টানা তিনবছর মাথাপিছু ১০ কেজি করে চাল দিয়েছিল যোগী সরকার। এছাড়া রাস্তাঘাটের উন্নয়ন, প্রধানমন্ত্রী কৃষক যোজনার আওতায় কৃষকদের টাকা দেওয়া, শিক্ষামিত্র নিয়োগ, চুক্তিভিত্তিক সরকারি কর্মীদের নিয়মিতকরণ সহ নানান জনমুখী প্রকল্পও ছিল।
এসবেরই সুফল উঠেছে ভোটবাক্সে। উল্লেখ্য, মোদি যে উত্তরপ্রদেশকেই মিশন ২০২৪ রাস্তা হিসেবে দেখছে হিন্দুত্বের ধ্বজা। অন্যতম কারণ, যোগীর নেতৃত্বে উত্তরপ্রদেশের (Uttar Pradesh) ইতিহাস বদলে দিয়েছে বিজেপি (BJP)। কংগ্রেসমুক্ত ভারত গঠনের কথা মোদি প্রথম দিন থেকেই বলে আসছেন। নেহরুবাদী রাজনীতির অবসান ঘটিয়ে হিন্দুত্ববাদী জাতীয়তাবাদের প্রতিষ্ঠায় তিনি কাজ করছেন সাড়ে সাত বছর ধরে। এবারের ভোট সেই লক্ষ্যে আরও এক বিরাট পদক্ষেপ। মোদির কাছে এই সাফল্য আরও গরিমার কারণ। ক্ষমতায় থাকার যাবতীয় প্রাতিষ্ঠানিক বিড়ম্বনা পাশ কাটিয়ে জয়ের ধ্বজা কীভাবে পতপত করে উড়িয়ে রাখা যায়, তার প্রমাণ তিনি রাখলেন।