বাবুলবোনা | মুর্শিদাবাদ জেলার বাবুলবোনা রেসিডেন্সি

মুর্শিদাবাদ নামটা শুনলেই খালি মনের মধ্যে নবাবদের নবাবীর কাহিনী, প্রেম, যুদ্ধ, দেশপ্রেম, গুপ্তহত্যা, রাজনৈতিক চক্রান্ত, বেইমানি, আত্মত্যাগ এবং বন্ধুত্বের কথা, হাজারদুয়ারীর কথা ভেসে ওঠে।কিন্তু তার পাশেই অবহেলায়, হয়তো অনেকের অজান্তেই অনেক ইতিহাস আমরা জানতে পারি না। এখন মুর্শিদাবাদ জেলার সদর শহর বহরমপুর। ১৭০৪ সালে বাংলা-বিহার-উড়িষ্যার রাজধানী মুর্শিদাবাদ পত্তনের সময় বহরমপুর ছিল রাজধানীর দক্ষিণে ভাগীরথী তীরের একটি গ্রাম।
তখন তার নাম ছিল সাতপুকুরিয়া ব্রহ্মপুর। গ্রামটায় ৭০০ ঘর ব্রাহ্মণ বাস করতো তাই স্থানটির নাম ছিল ব্রহ্মপুর। পলাশির যুদ্ধের পরে ইংরেজ আমলে বহরমপুর শহরের পত্তন ঘটে। এই এলাকাতেই সেনানিবাস তৈরি করে ইংরেজরা। এই শহরের মধ্যেই অবস্থিত ঐতিহাসিক বাবুলবোনা রেসিডেন্সি সমাধি। বহরমপুর বাবুলবোনার এই রেসিডেন্সি সমাধিক্ষেত্রে অনেক গুরুত্বপূর্ণ ব্রিটিশ বাসিন্দাদের এবং সামরিক ব্যক্তিদের কবর রয়েছে, যারা ব্রিটিশ আমলে বহরমপুরে বসবাস করতেন এবং এখানে মারা যান।
বহরমপুর বাসস্ট্যান্ড থেকে কিছুটা পূর্বদিকে গিয়ে ৩৪নং জাতীয় সড়ক বাবুলবোনা রোডের দক্ষিণে ও স্টেট সেরিকালচারের উত্তরে এই সমাধিক্ষেত্রটির অবস্থান। সমাধিক্ষেত্রটি দীর্ঘদিন জঙ্গলাকীর্ণ মুক্ত মাঠের মধ্যেই চরম অবহেলায় প্রায় ধ্বংস হতে বসেছিল। একসময় এই পুরানো কবরগুলির রক্ষণাবেক্ষণেরও কোন ব্যবস্থা না থাকায় কবরের পাথর বা ফলক চুরি হয়ে যায়। পরবর্তী সময়ে এই সমাধিক্ষেত্রটি পশ্চিমবঙ্গ হেরিটেজ আইনে ঐতিহ্যপূর্ণ পুরাকীর্তি হিসাবে ঘোষিত হবার পর সংরক্ষিত হয়েছে।
এই সমাধিক্ষেত্রে যাদের কবর আছে তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন ক্যাপ্টেন স্কিনার (মৃত্যু-১৭৭৩), ক্যাপ্টেন জন ফ্রেন্ড (মৃত্যু-১৭৮৭), ফ্রেডারিক গ্রিফিথস্ (মৃত্যু -১৭৯১) মুরশিদাবাদ দেওয়ানী আদালতের রেজিষ্টার মিঃ ড্যানিয়েল লেকি (মৃত্যু১৭৯২), মিসেস কারোলিন ব্রাউন (মুত্যু১৭৯৮), জন উইলসন (মৃত্যু-১৮০৩), ক্যাপ্টেন ল্যাম্বাট (মৃত্যু১৮০৫), কর্নেল মিচেল (মৃত্যু১৮৩৩) কলিন সেক্সপীয়ার (মৃত্যু১৮৩৫), ক্যাপ্টেন পেমবারটন (মৃত্যু১৮৪০) প্রভৃতি। মিঃ সেক্সপীয়ার ছিলেন সিভিল সার্ভেন্ট, তিনি ৬৪ বছর বয়সে বহরমপুরে মারা যান। এই কবরস্থানের সব চেয়ে পুরনো কবর হলো ক্যাপ্টেন জেমস্ স্কিনারের কবর। তিনি ছিলেন কোম্পানীর আমলের বিখ্যাত অশ্বারোহী সৈন্যদল স্কিনার্স হর্সের প্রতিষ্ঠাতা কর্নেল স্কিনারের কাকা। ১৭৭৩ সালে তিনি বহরমপুরে মারা গেলে এইখানে তাঁকে কবর দেওয়া হয়েছিল।
সেকালের খ্যাতনামা আইরিশ সেনাপতি জর্জ টমাসের কবরও এখানে আছে। জর্জ টমাস ছিলেন বেগম সমরুর একজন জেনারেল এবং পরে হারিয়ানার রাজা হয়েছিলেন। জর্জ টমাস ইংরেজদের নৌ সেনা হয়ে মাদ্রাজে আসেন ১৭৮১ সালে। পরে সে চাকরী ছেড়ে দিয়ে বিশ বছর ধরে ভাগ্যান্বেষী সেনাধ্যক্ষ হয়ে বিভিন্ন যায়গায় কাজ করে শেষ পর্যন্ত বেগম সমরুর একজন সেনাপতি হন। ১৮০২ সালে জর্জ টমাস বজরায় কলকাতা যাওয়ার সময় বহরমপুরে অসুস্থ হয়ে মাত্র ৪৬ বছর বয়সে মারা যান।
এখানেই তার দেহ সমাধিস্থ করা হয়। ভাবতে সত্যিই অবাক লাগে এত অল্প বয়সে একজন অশিক্ষিত শ্রমিক থেকে তিনি শিক্ষিত রণকুশলী রাজায় পরিণত হয়েছিলেন কী ভাবে। এছাড়াও এই সমাধি ক্ষেত্রে আছে গৌড়ের ধ্বংসাবশেষের অন্যতম আবিষ্কর্তা নীলকর সাহেব হেনরী ক্রীঝটনের সমাধি । তাঁর কর্মক্ষেত্র ছিল মালদহ। ১৮ শ শতকের শেষ দিকে মালদা জেলার গোয়ালমাটি নীলকুঠির প্রধান ছিলেন মিঃ হেনরী ক্রীকটন। তিনি গৌড়ের ধ্বংসাবশেষ সম্পর্কে খোঁজখবর নিয়ে একখানি বই লিখেছিলেন।
"Ruins of Gaur" | তাঁর আগে আর কেউ গৌড়ের ধ্বংসাবশেষ নিয়ে এত কাজ করেন নি। মিঃ উইলিয়াম গ্রান্ট ছিলের মালদার চাদনী গ্রামের নীলকুঠির মালিক এবং ক্রীঝটন সাহেবের বন্ধু। তাঁরা দুজনেই বহরমপুরে ১৮০৭ সালের অক্টোবর মাসে মারা যান। তাঁরা দুই বন্ধু অসুস্থ শরীরে কলকাতা যাচ্ছিলেন। সেই দুই কুঠিয়াল সাহেব ক্রীঝটন ও গ্রান্টের কবরও এখানে আছে। বহু সমাধিই আজ নম ফলক হীন তাই আজও যেন রহস্যে মোরা আছে এই সমাধি ক্ষেত্র। সবচেয়ে আশ্চর্য লাগে বিশেষ একটি সমাধি কে নিয়ে । অদ্ভুত দেখতে সেই সমাধি, ঠিক যেন একটি কফিন বসানো আছে এবং তাঁর উপর নরকঙ্কাল ও দুটি হাড়ের চিহ্ন সমস্ত কবরের থেকে যে আলাদা তা আর বুঝতে অসুবিধা হয়না, কিন্তু কেন ? কেন বিশেষ ভাবে নির্মিত হয়েছিল এই সমাধি? উত্তর খুঁজে পাইনি আজও ।
ব্যক্তির সমাধি হলো-
১) ক্যাপ্টেন জেমস স্কিনার (মৃত্যু- ১৭৭৩ সালে)।
২) জর্জ টমাস (মৃত্যু – ১৮০২ সালে)।
৩) হেনরি ক্রেটন (মৃত্যু- ১৮০৭ সালে)। তিনি গৌড়ের ধ্বংসাবশেষের অন্যতম আবিস্কার কর্তা ছিলেন।
৪) ইসাবেলা সেনইড ( মৃত্যু- ১৮৫৬ সাল), লেফটেন্যান্ট এফ.পি. ব্যালি (৭ম রেজিমেন্ট)-এর স্ত্রী।
৫) মেরি গ্রান্ট (জন্ম-১৭৯৬ সাল; মৃত্যু- ১৮৭১সাল) আয়ারল্যান্ডের কার্লোতে জন্মগ্রহণ করেন।
৬) ভ্যালেন্টাইন্স ওয়েন (জন্ম-১৯০৬ সাল; মৃত্যু-১৯০৭ সাল) ব্রার্টাম ওয়েনের পুত্র।
৭) রেভারেন্ড এ. ডব্লিউ. ওয়ালশ (মৃত্যু- ৯ জুলাই, ১৮৭১ সালে) প্রাক্তন জার্জ।
৮) মারিয়া মোলিস (বয়স ৩৬ বছর বয়সে মারা যান), জন মোলিসের স্ত্রী।
৯) মাইকেল ফল (মৃত্যু- ১৮৮৫ সালে)।
১০) চার্লস মেন ওয়ারিঙ স্কোয়ার (মৃত্যু- ১৮২৮ সালে)।
১১) টমাস বেঞ্জামিন রাইস (মৃত্যু- ১৮৮২ সালে)।
১২) মারিয়া এলিজা রাইস (মৃত্যু- ১৮৯৮ সালে)।
১৩) জোসেফ এডুইন (মৃত্যু- ১৮৭০ সালে)।
১৪) জেন অ্যারো (মৃত্যু- ১৮৯১ সালে)।
১৫) স্টিফেন উইলিয়াম ল্যামব্রিক (মৃত্যু – ১৩ অক্টোবর ১৮৪২ সালে ৩৬ বছর বয়সে) রাজা কৃষ্ণনাথ রায়ের ইংরেজি শিক্ষা গুরু ছিলেন।
১৬) সিসিল উইলবারফোর্স (জন্ম- ২০ অক্টোবর ১৮৫৭ সালে এবং মৃত্যু- ২৭ নভেম্বর ১৮৫৭ সালে) জেমস আগস্ট ওয়াটসনের শিশুপুত্র।