ধুমধাম করেই দুর্গাপুজো করতেন বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়

তিনি Bankim Chandra Chatterjee বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। বন্দেমাতরম মন্ত্রের স্রষ্টা। যা হয়ে উঠেছিল অগ্নিযুগের বিপ্লবীদের মহামন্ত্র। 'আনন্দমঠ' রচনা তাঁর স্বদেশচেতনার আরও এক উদাহরণ। তাঁর লেখায় যে স্বদেশভাব, তার সঙ্গে সম্পর্ক রয়েছে পরিবারিক দুর্গাপুজোর। এমনটাই মনে করেন গবেষকরা। বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের হুগলির কাঁঠালপা়ড়ার বাড়িতে ধুমধাম করেই দুর্গাপুজো হত। পিতা রায়বাহাদুর যাদবচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় বয়সকালে যখন দানপত্র লিখেছিলেন, তখন পুজোর দায়িত্ব দিয়েছিলেন বঙ্কিমকেই। ১৮৬৫ সালে যাদবচন্দ্র ২৮ দফা দানপত্র করেন।
বাড়ির পুজোর ব্যয়ভারের দায়িত্ব দেন সেজোছেলেকে। বাঙালি যাঁকে সাহিত্যসম্রাট বলে চেনে। আর পুজো আয়োজনের দায়িত্ব ছিল মেজো ছেলের উপর। যিনি পালামৌ-এর লেখক সঞ্জীবচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। কেমন ছিল সেই পুজোর আয়োজন? বঙ্কিমের বন্ধু সাহিত্যিক অক্ষয়চন্দ্র সরকারের লেখায় তার হদিশ মেলে। তিনি লিখছেন, "দুর্গোত্সবে কৃষ্ণনগর ঘূর্ণির উত্কৃষ্ট কুম্ভকার শশীপাল ঠাকুর গড়িবেন, উত্কৃষ্ট চিত্রকর চুঁচুড়ার মহেশ ও বীরচাঁদ সূত্রধর চিত্র করিবে।" আর ছিল বিখ্যাত গাইয়েদের আসর।
যাত্রাপালা ও পালাগানের আয়োজনও হত। চণ্ডী গান, রামায়ণী গান, ফরাসডাঙার ঢপ, কীর্তনের আসর বসত। সেকালের সবার বাড়িতে ঘড়ি ছিল না। তাই মহাষ্টমীর রাতে সন্ধিপুজোর শুরু হলে বন্দুক ছোড়া হত। রাতে ঠাকুরদালান তো বটেই, চট্টোপাধ্যায়দের গোটা বাড়ি আলোকিত হত দীপের আলোয়। পুজো উপলক্ষে গরিবদের বস্ত্রদানও করা হত। বিজয় দশমীতে প্রতিমা নিরঞ্জন হত গঙ্গায়। নৌকো ভাড়া করে মাঝনদীতে হত বিসর্জন। পুজোর খরচখরচাও ছিল তাক লাগানোর মতোই।
১২৯০ বঙ্গাব্দে, অর্থাত্ কিনা ইংরেজি ১৮৮৩ সালের পুজোতে মোট খরচ হয়েছিল ৪০৯ টাকা ৬ আনা ৩ পয়সা। এর মধ্যে প্রতিমা গড়তে খরচ পড়েছিল ৫১ টাকা ৬ আনা, মূল পুজোর খরচ হয় ৬২ টাকা ১২ আনা, খয়রাতি খরচ হয়েছিল ৩৩ টাকা ১২ আনা ৫ গণ্ডা। আর নৌকা ভাড়া করে প্রতিমা নিরঞ্জনে খরচ ছিল ৩ টাকা। বাবার মতোই এলাহি পুজোর আয়োজন তো বঙ্কিম করতেন, কিন্তু কতটা ভক্তিভাব ছিল তাঁর? বঙ্কিমের ভাইপো শচীশচন্দ্রের লেখা থেকে সে কথা জানা যায়।
তাঁর কথায়, অতিভক্তি ছিল না কাকার। আর পাঁচজনের মতোই প্রতিদিন ঠাকুরদালানে এসে প্রণাম করতেন। কিন্তু, একদিন প্রতিমার সামনে 'বাহ্যজ্ঞান বিরহিত' সাহিত্যসম্রাটকে চাক্ষুষ করেন শচীশ। ১২৮১-র আশ্বিন মাস। ইংরেজির ১৮৭৪ সাল। তখন মালদহের ডেপুটি কালেক্টর বঙ্কিম। পুজোর ছুটিতে বাড়িতে আসেন। এই সময়ই লেখেন 'আমার দুর্গোত্সব', যা কমলাকান্তের দপ্তরের একটি অংশ। যেখানে কমলাকান্তের চোখে দেবী দুর্গা তথা বঙ্গজননীর রূপকল্পনা রয়েছে।
এরই কিছুদিন পরের রচনা ঐতিহাসিক বন্দেমাতরম সংগীত। আরও শুনুন: '১০০০ বছরের পুরনো ডিম' রবীন্দ্রনাথের পাতে, তারপর. পুজো আয়োজনে গাফিলতি অপছন্দ করতেন বঙ্কিম। কর্মস্থল থেকে পুজো সংক্রান্ত চিঠি লিখতেন আত্মীয়দের। সেখানে রয়েছে মান-অভিমানের গন্ধও। একটি চিঠিতে লিখছেন- "শ্রীচরণেষু, উমাচরণ বলিয়াছেন পূজা আপনার। বস্তুত পূজা আপনারও নহে, আমারও নহে, বা অপর কাহারও নহে। পূজা পিতৃঠাকুরের।
আমরা কেহ অর্থের দ্বারা, কেহ শারীরিক পরিশ্রমের দ্বারা, যাহার যেরূপ সাধ্য, তাহা নির্বাহ করিয়া থাকি। ইতি Bankim Chandra Chatterjee বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়।" বোঝাই যাচ্ছে দুর্গাপুজো নিয়ে ঠিক কতটা আবেগপ্রবণ ছিলেন বঙ্কিম। হয়তো এই মাতৃপূজার চেতনাই সঞ্চারিত হয়েছিল তাঁর সাহিত্যভাবনায়। আর তাই তাঁর কলমেই উঠে এসেছিল দেশমাতৃকা পূজার অবিস্মরণীয় মন্ত্র- বন্দেমাতরম। মাতৃবন্দনার সেই বীজ নিহিত ছিল এই দুর্গাপুজোতেই।