পলাশীর যুদ্ধ এর ইতিহাস

পলাশীর যুদ্ধ এর ইতিহাস

পলাশী প্রান্তরে Battle of Plassey পলাশীর যুদ্ধ ১৭৫৭ সালের ২৩ জুন নওয়াব সিরাজউদ্দৌলা ও ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি এর মধ্যে সংঘটিত। এ যুদ্ধ আট ঘণ্টার মতো স্থায়ী ছিল এবং প্রধান সেনাপতি মীরজাফর আলী খানের বিশ্বাসঘাতকতার দরুণ নওয়াব কোম্পানি কর্তৃক পরাজিত হন। এর ফলে বাংলায় ব্রিটিশ শাসনের ভিত্তি প্রতিষ্ঠিত হয়।কলকাতা থেকে ১৭২ কিলোমিটার দুরে পলাশী।

৩৪ নম্বর জাতীয় সড়কের স্টপেজে নেমে পাশের সড়ক ধরে ৩ কিলোমিটার দূরে এই পলাশি প্রান্তরের অবস্থান। জাতীয় সড়কের পলাশি স্টপেজের যে পথ ধরে পলাশি প্রান্তরে যেতে হয়, সেই পথের প্রবেশ মুখে তৈরি হচ্ছে পলাশি তোরণ।১৭৫৭ সালের ১২ জুন কলকাতার ইংরেজ সৈন্যরা চন্দননগরের সেনাবাহিনীর সঙ্গে মিলিত হয়।

সেখানে দুর্গ রক্ষার জন্য অল্প কিছু সৈন্য রেখে তারা ১৩ জন অবশিষ্ট সৈন্য নিয়ে যুদ্ধযাত্রা শুরু করে। কলকাতা থেকে মুর্শিদাবাদের পথে হুগলী, কাটোয়ার দুর্গ, অগ্রদ্বীপ ও পলাশীতে নবাবের সৈন্য থাকা সত্ত্বেও তারা কেউ ইংরেজদের পথ রোধ করে নি। ফলে নবাব সিরাজউদ্দৌলা বুঝতে পারেন, তার সেনাপতিরাও এই ষড়যন্ত্রে শামিল। বিদ্রোহের আভাস পেয়ে সিরাজ মীর জাফরকে বন্দি করার চিন্তা পরিত্যাগ করেন।

তিনি মীর জাফরকে ক্ষমা করে তাকে শপথ নিতে বলেন। মীর জাফর পবিত্র কুরআন স্পর্শ করে অঙ্গীকার করেন যে, তিনি শরীরের একবিন্দু রক্ত থাকতেও বাংলার স্বাধীনতাকে ক্ষুণ্ন হতে দেবেন না। গৃহবিবাদের মীমাংসা করে নবাব রায় দুর্লভ, ইয়ার লুৎফ খান, মীর জাফর, মীর মদন, মোহন লাল ও ফরাসি সেনাপতি সিনফ্রেঁকে সৈন্য চালানোর দায়িত্ব দিয়ে তাদের সঙ্গে যুদ্ধযাত্রা করেন।

ইংরেজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির জন্য বাংলা অনেকটা স্প্রিং বোর্ডের মতো কাজ করে, যেখান থেকে ক্রমান্বয়ে ব্রিটিশ শক্তি আধিপত্য বিস্তার করে করে অবশেষে সাম্রাজ্য স্থাপনে সক্ষম হয়। ব্রিটিশ সাম্রাজ্য প্রায় সমগ্র ভারতবর্ষ গ্রাস করে এবং চূড়ান্ত পর্যায়ে এশিয়ার অন্যান্য অনেক অংশও এর অধীনস্থ হয়। পটভূমি পলাশী যুদ্ধের এক সুদীর্ঘ পটভূমি আছে।

১৬৫০ এর দশকের প্রথম থেকে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি যখন বাংলায় স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করে তখন, থেকে এ পটভূমির সূচনা হয় বললে বেশি বলা হবে না।বাংলার মুগল শাসকগণ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিকে বাংলায় বসবাসের অনুমতি দেন এবং বছরে মাত্র তিন হাজার টাকা প্রদানের বিনিময়ে তারা শুল্কমুক্ত বাণিজ্য করার অধিকার পায়। হুগলি ও কাসিমবাজারে বাণিজ্যকেন্দ্র গড়ে তোলার কয়েক বছরের মধ্যেই আকারে এবং মূলধন নিয়োগে কোম্পানির ব্যবসা-বাণিজ্য দ্রুত বাড়তে থাকে।

কিন্তু সপ্তদশ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধে বাংলার অভ্যন্তরীণ বাণিজ্যে তাদের অনুপ্রবেশ বাংলার সুবাহদার শায়েস্তা খান ও ইংরেজদের মধ্যে দ্বন্দ্বের কারণ হয়ে দাঁড়ায়।শায়েস্তা খান পরবর্তীসময়ে ইংরেজরা কলকাতায় বসবাস করার অধিকার পায় এবং কলকাতা, গোবিন্দপুর ও সুতানটি নামে তিনটি গ্রাম কিনে তারা প্রথম জমিদারি প্রতিষ্ঠিত করে। ইংরেজরা কলকাতায় ফোর্ট উইলিয়ম নামে একটি দুর্গও নির্মাণ করে।

জমিদারি ক্রয় ও ফোর্ট উইলিয়ম প্রতিষ্ঠা ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির জন্য খুবই সুবিধাজনক বলে প্রমাণিত হয় এবং এগুলির মাধ্যমে যে কায়েমি স্বার্থের জন্ম নেয় তা কোম্পানিকে কলকাতার আশেপাশে আরও জমিদারি (৩৮ টি গ্রাম) কিনতে উৎসাহিত করে।ইতোমধ্যে বাণিজ্যিক সুবিধার অপব্যবহারের দরুণ বাংলার নওয়াবদের সঙ্গে তাদের সম্পর্কের দ্রুত অবনতি ঘটে।

কলকাতার কোম্পানি কর্তৃপক্ষ এ সকল অন্যায় কাজ বন্ধের জন্য পরিচালক সভার নির্দেশাবলির প্রতি কোন গুরুত্বই প্রায় দিচ্ছিল না এবং দস্তক এর সুবিধাদি আমদানি রপ্তানি বাণিজ্য ক্ষেত্রের বাইরে অভ্যন্তরীণ বাণিজ্যেও অবৈধভাবে তারা ব্যবহার করতে থাকে। একই সঙ্গে কোম্পানির কর্মচারীগণ বাণিজ্যের ছাড়পত্র তাদের ব্যক্তিগত ব্যবসার ক্ষেত্রে ব্যবহার শুরু করে। কোম্পানি আরও অধিক সুযোগ-সুবিধা আদায়ের প্রচেষ্টায় মুগল সম্রাট ফররুখ সিয়ারএর নিকট ধর্ণা দেয়।

তিনি এক ফরমান এর মাধ্যমে (১৭১৭) ইংরেজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিকে কিছু গুরুত্বপূর্ণ সুবিধা প্রদান করেন। এ সকল সুবিধার মধ্যে ছিল শুল্কমুক্ত বাণিজ্য, কলকাতায় টাকশাল স্থাপন এবং কিছু শর্ত সাপেক্ষে ৩৮টি গ্রাম ক্রয় করার অধিকার। যেহেতু অন্যান্য ব্যবসায়ীদের নির্দিষ্ট হারে শুল্ক দিতে হতো, আর ইংরেজ ও তাদের সহযোগীরা শুল্কমুক্ত বাণিজ্য করত, তাই স্থানীয় ব্যবসায়ীদের অভ্যন্তরীণ বাণিজ্য থেকে উৎখাত হওয়ার ভয় দেখা দেয়।

নওয়াব মুর্শিদকুলী খান ফরমানের বাস্তবায়নে বাধা দেন।তিনি অনুভব করেন যে, কোম্পানির আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্য বহুগুণে বৃদ্ধি পেলেও এ ব্যবস্থায় কোম্পানি নামমাত্র বার্ষিক তিন হাজার টাকা সরকারকে দিবে এবং কোম্পানির এ বিশেষ সুবিধার ফলে সরকার তার আইনানুগ বাণিজ্য শুল্ক ও টাকশালের উপর প্রাপ্য কর থেকে বঞ্চিত হবে। ১৭৫৬ সালের এপ্রিল মাসে সিরাজউদ্দৌলার ক্ষমতা গ্রহণের সঙ্গে সঙ্গে নওয়াব এবং ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির মধ্যে বিরোধ অনিবার্য হয়ে পড়ে। নবীন নওয়াব প্রথম বারের মত বাংলায় কোম্পানির অবৈধ কার্যক্রমের তীব্র প্রতিবাদ জানান।

ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে তাঁর তিনটি প্রধান অভিযোগ ছিল: অনুমতি ব্যতীত ফোর্ট উইলিয়মে প্রাচীর নির্মাণ ও সংস্কার, ব্যক্তিগত অবৈধ ব্যবসা এবং কোম্পানির কর্মচারীদের দ্বারা দস্তকের নির্লজ্জ অপব্যবহার এবং নওয়াবের অবাধ্য প্রজাদের বেআইনিভাবে আশ্রয় প্রদান। উল্লিখিত অভিযোগসমূহের মীমাংসার জন্য পদক্ষেপ নিতে নওয়াব ব্রিটিশদের আহবান জানান এবং শান্তিপূর্ণ আলোচনার মাধ্যমে বিরোধ নিরসনের জন্য কলকাতায় অনেক প্রতিনিধিদল পাঠান।

নওয়াব কোম্পানির নিকট কৃষ্ণদাসকে তাঁর হাতে সমর্পণের দাবি করেন এবং নতুন প্রাচীর ভেঙে ফেলতে ও কলকাতার চারদিকের পরিখা ভরাট করতে নির্দেশ দেন।নওয়াবের যে বিশেষ দূত এ সকল দাবি সম্বলিত চিঠি নিয়ে কলকাতায় যান ইংরেজরা তাকে অপমানিত করে। কলকাতার ইংরেজ গভর্নর রজার ড্রেক যে চরম অপমানজনকভাবে নওয়াবের প্রতিনিধি নারায়ণ সিংহকে বিতাড়িত করে তা সবিস্তার শুনে নওয়াব অত্যন্ত রাগান্বিত হন।

নওয়াব তৎক্ষণাৎ কাসিমবাজার কুঠি অবরোধের আদেশ দেন। কুঠির প্রধান আত্মসমর্পণ করে কিন্তু কলকাতার ইংরেজ গভর্নর অবাধ্যতা ও একগুঁয়েমি প্রদর্শন করেন। ফলে নওয়াব কলকাতা অভিযান করে তা দখল করে নেন।এ পরাজয়ের পর বাংলায় কোম্পানির পুনঃপ্রতিষ্ঠা দুই উপায়ে করা সম্ভবপর ছিল, হয় নবাবের নিকট আত্মসমর্পণ নচেৎ পরাজয়ের প্রতিশোধ নিতে বল প্রয়োগ।

বাংলায় যে সকল ব্রিটিশ ছিল তারা অতিরিক্ত সেনা পাঠানোর জন্য মাদ্রাজের ফোর্ট সেন্ট জর্জে জরুরি খবর পাঠায়। সেখান হতে রবার্ট  ক্লাইভ ও এডমিরাল  ওয়াটসনের অধীনে একদল ব্রিটিশ সৈন্য বাংলায় পাঠানো হয়। তারা ১৭৫৭ সালের জানুয়ারি মাসে কলকাতা পুনরুদ্ধার করে এবং নওয়াবের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে। সিরাজউদ্দৌলা ইংরেজদের সঙ্গে আলীনগরের সন্ধি স্বাক্ষর করতে বাধ্য হন।ষড়যন্ত্র কিন্তু ইংরেজরা সন্ধির শর্তাদি অগ্রাহ্য করতে থাকায় যুদ্ধের চাপা উত্তেজনা চলতে থাকে।

তারা নওয়াবের প্রতি বিরূপ পারিষদদের নিয়ে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়। মুর্শিদাবাদ দরবারে কিছু প্রভাবশালী অমাত্য নওয়াব সিরাজউদ্দৌলার প্রতি যে অসন্তুষ্ট ছিল তা অস্বীকার করা যায় না। নওয়াবকে উৎখাত করার উদ্দেশ্যে তারা ষড়যন্ত্র শুরু করে। তবে ব্রিটিশগণ সক্রিয়ভাবে এ ষড়যন্ত্রে জড়িত না হলে আদৌ কোন পলাশী ‘বিপ্লব’ সংঘটিত হওয়া সম্ভব হতো কিনা তা বিশেষভাবে খতিয়ে দেখা দরকার। নওয়াবকে ক্ষমতাচ্যুত করার ষড়যন্ত্র চূড়ান্তকরণে অন্যান্য ষড়যন্ত্রকারীর তুলনায় ব্রিটিশেরাই তাদের পরিকল্পনা বাস্তবায়নে বেশি উদগ্রীব ও অগ্রণী ছিল।

লন্ডনে কোম্পানির পরিচালকমন্ডলী তেমন উদ্যোগী না হলেও ভারতে কোম্পানির কর্মচারী এবং ব্রিটিশ বাণিজ্যের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে সম্পৃক্ত ফটকাবাজ ব্যবসায়ীগণ সময়ে সময়ে ভারতে ভূ-খন্ডগত অধিকার প্রতিষ্ঠার অনুকূলে সুস্পষ্ট মতামত রাখে। আঠারো শতকের মধ্যভাগে কোম্পানির কর্মচারীদের ব্যক্তিগত ব্যবসা নিদারুণ সমস্যার সম্মুখীন হয় এবং তারা তাদের নিজস্ব ব্যবসার উন্নতি পুনরুদ্ধার কল্পে আধা-সাম্রাজ্যবাদী নীতি গ্রহণ করে। বাস্তবিক পক্ষে ফোর্ট সেন্ট জর্জ কাউন্সিলের নির্দেশনামায় (অক্টোবর ১৩, ১৭৫৬) ‘পলাশী ষড়যন্ত্রের’ বীজ বপন করা হয়।

নির্দেশ নামার পরামর্শ মতো ‘শুধু কলকাতা পুনরুদ্ধার’ ও ‘বিপুল ক্ষতিপূরণ’ আদায় করলে চলবে না, বরং ‘বাংলা প্রদেশে নওয়াবের উগ্রতায় বিক্ষুব্ধ ব্যক্তিবর্গ বা যারা নওয়াব হতে অভিলাষী তাদের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপনের জন্য প্ররোচিত করা হয়’।উপদেশমালার শেষাংশের অভিব্যক্তি এত স্পষ্ট যে, আর বেশি কিছু খুলে বলার প্রয়োজন পড়ে না। এমনকি, ক্লাইভও মাদ্রাজ থেকে যাত্রার পূর্বে লিখেন যে, সিরাজউদ্দৌলা দুর্বল শাসক এবং নওয়াবের বেশিরভাগ পারিষদই তাঁর প্রতি বিরূপমনোভাবাপন্ন।

ক্লাইভের পরবর্তী মন্তব্যে প্রতীয়মান হয় যে, নওয়াব দরবারের বিরূপ মনোভাবই ইংরেজদেরকে গুরুত্বপূর্ণ কূটচালে (ক্লাইভের ভাষায় ‘nice important game’) লিপ্ত হতে উৎসাহিত করে এবং এতে করে পলাশীতে চরম আঘাত হানার ষড়যন্ত্র ত্বরান্বিত হয়। ক্লাইভ এবং  ওর্ম (ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির দরবারি ঐতিহাসিক), যিনি ১৭৫০-এর দশকের প্রথম ভাগ পর্যন্ত বাংলায় অবস্থান করেন, উভয়ে কর্নেল স্কটের বাংলা দখল করার পরিকল্পনা বিষয়ে অভিহিত ছিলেন।

স্কট ১৭৫২ সালে কলকাতায় পরিকল্পনাটি প্রণয়ন করেন এবং তা তখন ফোর্ট সেন্ট জর্জের কাউন্সিলে সংরক্ষিত ছিল। ইতঃপূর্বে ১৭৪৯-৫০-এর শীতকালে ক্লাইভ কলকাতা দেখতে আসেন। ১৭৪০-এর দশকের শেষ পর্যায়ে এবং ১৭৫০-এর দশকের প্রথম দিকে ব্রিটিশদের ব্যক্তিগত বাণিজ্য ভীষণ সমস্যায় পড়ে। এর কারণ হিসেবে ফরাসিদের ব্যক্তিগত এবং আরমেনিয়ান ব্যবসায়ী খাজা ওয়াজেদের সামুদ্রিক বাণিজ্যের হঠাৎ বৃদ্ধিকে দায়ী করা হয়। ডাচ দলিল পত্রে প্রাপ্ত সমুদ্রপথে মাল চলাচলের হিসাব থেকে এর সমর্থন মেলে।

তাই  ফরাসি- বাঙালি মৈত্রী প্রতিরোধকল্পে ফরাসিদের ধ্বংস এবং ব্যক্তিগত ব্যবসার মাধ্যমে ব্রিটিশদের ভাগ্যগড়ার অপরিহার্য উপাদান ব্যক্তি বিশেষের অবৈধ ব্যবসা ও দস্তক এর অপব্যবহার রোধে সংকল্পবদ্ধ সিরাজের পতন ঘটানো আধা-সাম্রাজ্যবাদী কোম্পানির কর্মচারীদের মূল লক্ষ্য হয়ে দাঁড়ায়। অনেক ঐতিহাসিক যদিও দৃঢ়ভাবে মত পোষণ করেন যে, ভারতীয় ষড়যন্ত্রকারীগণই সহযোগিতা লাভের আশায় পরিকল্পিত ‘বিপ্লব’ ঘটানোর জন্য ব্রিটিশদের সঙ্গে যোগাযোগ করে, তবুও দলিলাদির সঠিক ও সতর্ক বিশ্লেষণে সন্দেহাতীত ভাবে প্রতীয়মান হয় যে, ব্রিটিশরাই তাদের পরিকল্পিত ‘বিদ্রোহ’ বাস্তবায়নের জন্য নওয়াব দরবারের বিরুদ্ধবাদীদের সমর্থন আদায়ের জন্য যোগাযোগ করার ব্যাপারে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে।

কাসিমবাজার থেকে ১৭৫৭ সালের ৯ এপ্রিল তারিখে লুক স্ক্রেফটন ক্লাইভের বিশ্বাসভাজন জন ওয়ালশকে লেখা পত্রে এ ধারণার অনুকূলে ইঙ্গিত পাওয়া যায়। তিনি লিখেন, ‘ঈশ্বর আমাদের নির্দিষ্ট কিছু পরিকল্পনা মতো অগ্রসর হওয়া দরকার... কোম্পানির প্রতি অনুরক্ত নওয়াব পাওয়া কোম্পানির জন্য কতই না গৌরবজনক হবে’। ইয়ার লতিফকে নতুন নওয়াব হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার পরিকল্পনা সম্পর্কে তিনি ১৮ এপ্রিল আবারও ওয়ালশকে লিখেন। ইতোমধ্যে ২৩ এপ্রিল সিলেক্ট কমিটি বৈপ্লবিক পরিবর্তনকে সরকারি নীতি বলে গ্রহণ করে।

একই দিন ক্লাইভ স্ক্রেফটনকে মুর্শিদাবাদে থাকার অনুমতি দিতে কমিটিকে অনুরোধ জানায় কেননা, ‘গুরুত্বপূর্ণ বিষয়াদিতে ব্যস্ত থাকার মতো কাজ তার জন্য সেখানে ছিল’। পরিকল্পনার পক্ষে সমর্থন যোগানোর জন্য ওয়াটস এবং স্ক্রেফটন মুর্শিদাবাদে সক্রিয়ভাবে ব্যস্ত ছিলেন। রবার্ট ওর্ম এর কাছ থেকে জানা যায় যে, নওয়াবের প্রতি মীরজাফরের অসন্তুষ্টির বিষয়ে জানতে পেরে ক্লাইভ ওয়াটসকে মীরজাফরের সঙ্গে বন্ধুত্ব প্রতিষ্ঠার পরামর্শ দেয়। ওয়াটস এবং স্ক্রেফটন কলকাতার বিখ্যাত ব্যবসায়ী উমিচাঁদ এর সঙ্গে যোগাযোগ করেন এবং নওয়াব দরবারের প্রধান প্রধান কর্মকর্তাদের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তোলেন।

ওয়াটস কর্তৃক প্রেরিত প্রতিনিধি উমিচাঁদের নিকট ইয়ার লতিফের নওয়াব হওয়ার ইচ্ছা সংগোপনে প্রকাশ করেন এবং আরও জানান যে  দীউয়ান রায় দুর্লভরাম ও প্রভাবশালী ব্যাংক মালিক জগৎ শেঠ তাকে সমর্থন করবেন। ওয়াটস সঙ্গে সঙ্গে পরিকল্পনাটি লুফে নেয় এবং তা ক্লাইভকে জানায়। এটি ক্লাইভের অনুমোদন লাভ করে। কিন্তু শীঘ্রই আর এক দাবিদার রঙ্গমঞ্চে উপস্থিত হয়। ওর্মের বর্ণনা অনুসারে কলকাতায় বসবাসকারী খাজা পেট্রস নামে জনৈক আর্মেনীয় ব্যবসায়ীর মাধ্যমে মীরজাফর নওয়াব হওয়ার ইচ্ছা ইংরেজদের নিকট প্রকাশ করেন।

অবশ্য পরবর্তী সময়ে পিতার নিকট লেখা ওয়াটসের চিঠিতে অন্য ধারণা পাওয়া যায়। এতে বলা হয় যে, ওয়াটস স্বয়ং নওয়াব করার পরিকল্পনাটি মীরজাফরকে জানায়। ওয়াটস আরও লিখেন, মীরজাফর ‘সাগ্রহে আমার পরিকল্পনা গ্রহণ করেন এবং আমাদের সহযোগিতায় তাকে নওয়াব করার বিনিময়ে যে কোন রকমের যুক্তিপূর্ণ চুক্তি করতে সম্মত হয়’। কলকাতার সিলেক্ট কমিটি মীরজাফরের অনুকূলে সর্বসম্মত প্রস্তাব গ্রহণ করে এবং ওয়াটসকে মীরজাফরের সঙ্গে চুক্তির শর্তাদির বিষয়ে আলোচনার দায়িত্ব দেওয়া হয়। কিন্তু ষড়যন্ত্র তখনও প্রাথমিক পর্যায়ে ছিল এবং মীরজাফরকে সম্পূর্ণরূপে বিশ্বাস করা যাচ্ছিল না।

এ কারণে ২ মে মীরজাফরকে নিশ্চয়তা দেওয়ার জন্য ক্লাইভ ওয়াটসকে জানান, ‘ভয়ের কোন কারণ নেই, ব্রিটিশরা নওয়াবকে দেশছাড়া করার জন্য ‘যথেষ্ট শক্তিধর’ এবং প্রতিশ্রুতি দেন যে শেষ শক্তিটুকু দিয়ে হলেও ইংরেজরা মীরজাফরের জন্য কাজ করে যাবে’। ৩০ মে পর্যন্ত মীরজাফর মুর্শিদাবাদে অবস্থান করছিলেন। কিন্তু ওয়াটস তার সঙ্গে কোন প্রকার চুক্তি স্বাক্ষরে ব্যর্থ হন।

অবশেষে ৫ জুন ওয়াটস লাল (উমিচাঁদকে ধোকা দেওয়ার জন্য মিথ্যা চুক্তি) ও সাদা চুক্তিনামায় মীরজাফরের স্বাক্ষর আদায়ে সক্ষম হন। যুদ্ধের বিবরণ চুক্তিস্বাক্ষর সত্ত্বেও পরিকল্পিত ‘বিপ্লব’ বাস্তবায়নের জন্য সিলেক্ট কমিটি ভীষণ অস্থির হয়ে পড়ে। সরাসরি মুর্শিদাবাদের দিকে অগ্রসর হওয়া সর্বোত্তম হবে, না মীরজাফরের নিকট থেকে আরও পরামর্শ এবং অভিযান পরিচালনার কৌশল বিষয়ে জানার জন্য অপেক্ষা করবে এ নিয়ে ১১ জুন সিলেক্ট কমিটি ধীর ও সতর্ক চিন্তাভাবনা করতে থাকে।

সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত হয় ‘বর্তমান সন্ধিক্ষণে সর্বোত্তম সুবিধাজনক কাজ হবে মীরজাফরের পক্ষে বিপ্লব বাস্তবায়িত করার জন্য পদক্ষেপ গ্রহণ,’ কেননা আরও বিলম্ব হলে নওয়াবের নিকট ষড়যন্ত্র প্রকাশ হয়ে যাবে এবং মীরজাফরকে সরিয়ে দেওয়া হবে, ফলে ‘আমাদের গোটা পরিকল্পনা’ ‘ভন্ডুল’ হবে এবং ব্রিটিশেরা একা ‘সম্মিলিত দেশিয় শক্তির বিরুদ্ধে লড়ার জন্য মাঠে থাকবে’। তদনুসারে ১৩ জুন ক্লাইভ মুর্শিদাবাদ অভিমুখে যাত্রা শুরু করেন। ১৯ জুন ক্লাইভ কাটোয়া পৌঁছেন। স্থানটি পূর্বদিন কর্নেল কুট দখল করে নেয়।

২১ জুন ক্লাইভ ‘সমর পরিষদের’ সভা ডাকেন এবং ‘তাৎক্ষণিক পদক্ষেপ’ না নেওয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। কিন্তু ক্লাইভ পরে সিদ্ধান্ত পাল্টান এবং পরদিন অগ্রসর হওয়ার জন্য মনস্থ করেন।২২ জুন সকালে ব্রিটিশ বাহিনী ক্লাইভের নেতৃত্বে পলাশীর পথে যাত্রা করে। অবশ্য ২২ তারিখ দুপুরের পর পরই ক্লাইভ মীরজাফরের কাছ থেকে দীর্ঘ প্রতীক্ষিত বার্তা পান এবং পলাশীর পথে তার যাত্রা অব্যাহত রেখে দুপুর রাতের পর সেখানে পৌঁছেন। ইতোমধ্যে নওয়াব মুর্শিদাবাদ থেকে রওয়ানা দেন এবং শত্রুকে মোকাবিলা করার জন্য পলাশীতে শিবির স্থাপন করেন। ১৭৫৭ সালের ২৩ জুন সকাল ৮টার দিকে যুদ্ধ আরম্ভ হয়।

মীর মর্দান, মোহন লাল, খাজা আব্দুল হাদী খান, নব সিং হাজারী প্রমুখের অধীন নওয়াব সেনা বীরত্বের সঙ্গে যুদ্ধ চালায়, অন্যদিকে মীরজাফর, ইয়ার লতিফ এবং রায় দুর্লভরামের অধীন নওয়াবের প্রায় দুই তৃতীয়াংশ সেনা নিষ্ক্রিয়ভাবে দাঁড়িয়ে থাকে ও পরিস্থিতি অবলোকন করে। এমনকি বেশ কয়েক ঘণ্টা যুদ্ধের পরও চূড়ান্ত কিছু ঘটে নি। ক্লাইভ এমন প্রতিরোধ পাবেন আশা করেন নি এবং এই মর্মে জানা যায় যে, ‘দিনে যথাসম্ভব তীব্র যুদ্ধ চালিয়ে’ ক্লাইভ রাতের অন্ধকারে কলকাতা পালিয়ে যাওয়ার চিন্তা করছিলেন।

কিন্তু বেলা তিনটার দিকে কামানের গোলা মীর মর্দানকে আঘাত হানে এবং এতে তাঁর মৃত্যু হয়। মীর মর্দানের মৃত্যুতে হতভম্ব নওয়াব মীরজাফরকে ডেকে পাঠান এবং তাঁর জীবন ও সম্মান রক্ষার জন্য তাকে সনির্বন্ধ অনুরোধ করেন। মীরজাফর নওয়াবকে ঐ দিনের মতো যুদ্ধ বন্ধ করতে এবং পরদিন সকালে নতুন উদ্যমে যুদ্ধ শুরু করার পরামর্শ দেয়, আর এ খবর শীঘ্র ক্লাইভের নিকট পৌঁছানো হয়। পরামর্শমত নওয়াবের সেনানায়কেরা পিছুতে থাকলে ইংরেজ সেনারা নতুন করে প্রচন্ড আক্রমণ চালায় এবং ফলে নওয়াব বাহিনী বিশৃঙ্খলভাবে যত্রতত্র পালিয়ে যায়।

অপরাহ্ণ ৫টার দিকে যুদ্ধ শেষ হয়ে যায় এবং বিজয়ী ক্লাইভ বীরদর্পে তখনই মুর্শিদাবাদ যাত্রা করেন। জন উড নামে জনৈক ব্রিটিশ সৈন্য পলাশীর যুদ্ধক্ষেত্রে উপস্থিত ছিল, তার মতে ‘এটাই ছিল সেই বিশিষ্ট ও চূড়ান্ত যুদ্ধ যেখানে কোন ব্যাপক আক্রমণ ছাড়াই রাজ্য জয় করা হয়’। ষড়যন্ত্র এবং পরবর্তীকালে ‘পলাশী-বিপ্লব’ ইংরেজদের দ্বারা শুধু উদ্ভাবিত ও উৎসাহিতই হয় নি, বরং যুদ্ধের পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্ত তারা দেশিয় ষড়যন্ত্রকারীদের ব্রিটিশ পরিকল্পনা সমর্থন করতে প্রলুব্ধ করে।কলকাতা থেকে ১৭২ কিলোমিটার দূরে পলাশী।

বহরমপুরগামী এক্সপ্রেস বাসে করে মীরা পলাশী স্টপেজ। সেখান থেকে ব্যাটারিচালিত টোটো গাড়িতে চেপে সোজা পলাশী স্মৃতিস্তম্ভের পাশ দিয়ে টোটোটি বাঁ দিকের পথ ধরে চলে গেল ভাগীরথীর তীরে রামনগর নদীঘাটে। পলাশীর সেই আম্রকানন আর নেই। গাছ কেটে তৈরি করা হয়েছে ফসলের খেত। সেখানে ফলে তিল, পাটসহ নানা ফসল। সেদিনের সেই ঐতিহাসিক মুহূর্তের কোনো চিহ্নই কি আর অবশিষ্ট নেই? রাস্তায় দাঁড়িয়ে থেকে চোখে পড়ল একটু দূরে একটি স্মৃতিস্তম্ভ।

পলাশী যুদ্ধের স্মৃতিবাহী মনুমেন্ট। ১৫ মিটার উঁচু স্মৃতিস্তম্ভের গায়ে লেখা: ‘ব্যাটল ফিল্ড অব পলাশী, জুন ২৩, ১৭৫৭’। এ স্তম্ভ ইংরেজরা তৈরি করেছে পলাশীর যুদ্ধের বিজয়ের স্মারক হিসেবে। এটি এখন দেশবাসীর কাছে ‘বিশ্বাসঘাতকতার স্তম্ভ’। পলাশী যুদ্ধের ২৫০ বছর পূর্তিতে এই স্মৃতিস্তম্ভের পাশে ছোট্ট আরেকটি স্মৃতিস্তম্ভ তৈরি করা হয়।তাতে লেখা: ‘পরদেশগ্রাসীদের বিজয়স্তম্ভ নয়; সিরাজ, মীর মদন, মোহনলালের নাম হোক অক্ষয়।’

এই স্মৃতিস্তম্ভ তৈরি করেছে বাংলাদেশ-ভারত-পাকিস্তান পিপলস ফোরাম। একটু দূরে স্মৃতিস্তম্ভে ঢোকার বাঁ পাশে দাঁড়িয়ে আছে নবাব সিরাজের আবক্ষ মূর্তি। এই মূর্তির নিচে লেখা ‘বিদেশী বেনিয়া বশ্যতা বিরোধী জোহাদি নায়ক সিরাজদৌল্লা’। মনুমেন্টটির চারদিকে অযত্নের ছাপ। চারদিকে জঙ্গল জন্মেছে। পশ্চিমবঙ্গ সরকারের রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বে রয়েছে এই স্মৃতিস্তম্ভ।