বেগম সামরু এর জীবনী

অষ্টাদশ শতাব্দীতে মীরাটের কাছে এক শক্তিশালী ক্ষুদ্র রাজ্য সর্দানার শাসক ছিলেন বেগম সামরু (Begum Samru)। সামান্য এক নৃত্যশিল্পী থেকে তিনি চার হাজার সৈন্যের এক বাহিনীর সর্বেসর্বা অধিপতি হয়ে ওঠেন। ক্যাথলিক ধর্মে দীক্ষিত হলেও বেগম সামরু সর্বদাই মুঘল আদব-কায়দা বজায় রেখেছিলেন। তাঁর সেই বাহিনীতে একশো জন ইউরোপীয় সেনা ছিলেন । অত্যন্ত বিখ্যাত একজন রাজনীতিবিদ ছিলেন বেগম সামরু, মৃত্যুর আগে পর্যন্ত এক প্রবল ঐশ্বর্যপূর্ণ জীবন কাটিয়েছিলেন তিনি। একাই আদালত সামলাতেন তিনি।
মাথায় একটি পাগড়ি আর হাতে একটি বিরাট হুঁকোর নল নেওয়া তাঁর একটি ছবিই খুব বিখ্যাত। ইসলাম ধর্ম থেকে খ্রিস্টধর্মে ধর্মান্তরিত হয়েছিলেন তিনি এবং জোয়ান অফ আর্কের পরে বেগম সামরুই নিজেকে দ্বিতীয় ‘জোয়ান’ নামে ঘোষণা করেন। দিল্লির কাছে ভগীরথ প্রাসাদটিই কেবলমাত্র আজ তাঁর অস্তিত্বের একমাত্র দৃষ্টান্ত হয়ে আছে। ১৭৫০ সালে বেগম সামরুর জন্ম হয়। তাঁর আসল নাম ছিল ফরজানা। কেউ কেউ বলেন তিনি একজন সম্ভ্রান্তবংশীয় মুসলিম ব্যক্তির কন্যা, আবার কোন কোন ঐতিহাসিকের মতে তিনি একজন অনাথিনী হিসেবে একটি কোঠায় বড় হয়েছেন।
এইসব কোঠাবাড়িতে ধনী পুরুষদের সামনে নাচ দেখাতেন মহিলারা। ব্যভিচারের কালিমা লেগে থাকত একেকটি কোঠায়। সপ্তদশ শতাব্দীর শেষ ভাগে মুঘল সাম্রাজ্যে স্থানীয় কিছু সম্প্রদায় প্রতিবাদ আর বিক্ষোভ চালাতে শুরু করলে, আন্দোলন দমনের জন্য মুঘল রাজারা অস্ট্রিয়া থেকে ইউরোপীয় সৈন্যদের নিয়ে এসেছিল। এই সৈন্যদের মধ্যে ছিলেন ওয়াল্টার রেইনহার্ট সোমব্রে যিনি ১৭৬৩ সালে প্রায় ১৫০ জন ইংরেজকে হত্যা করার পরে ‘পাটনার কসাই’ নামে পরিচিত হয়েছিলেন।
৪৫ বছর বয়সী রেইনহার্ট একটি কোঠায় ১৪ বছর বয়সী ফরজানাকে দেখেন এবং এক দেখাতেই অত্যন্ত আকৃষ্ট হন তিনি। পরবর্তীকালে রেইনহার্ট ফরজানাকে বিবাহ করেন। জেমস স্কিনারের মতে রেইনহার্ট সোমব্রে আদপে ছিলেন একজন ছুতোর, পরে তিনি সেনাদলে নাম লিখিয়েছিলেন। ১৭৬০ সালে রেইনহার্ট বাংলার নবাব মীর কাশিমের কাছে কাজ করতে শুরু করেন। পাটনার সেই গণহত্যার পরে তিনি আউধে পালিয়ে যান এবং সেখানেই একজন ভাড়াটে সৈনিক হিসেবে নিজের কর্মজীবন শুরু করেন।
১৭৬৫ সালের একটি সন্ধ্যায় দিল্লির চাউরি বাজারের খানুমজানের কোঠায় কাশ্মীরি নৃত্যশিল্পী ফরজানার সঙ্গে পরিচয় হয় তাঁর। ফরজানার প্রতি আকৃষ্ট হয়ে তাঁকে রেইনহার্ট তুলে নিয়ে রাখেন নিজের হারেমে। তীক্ষ্ণবুদ্ধি ও চতুর ফরজানা ক্রমে রেইনহার্টের সঙ্গী হয়ে ওঠেন। ডিগের জাঠ শাসককে সামরিক পরিষেবা দিয়েছিলেন রেইনহার্ট এবং ফরজানা। ১৭৬১ সালে পানিপথের তৃতীয় যুদ্ধের পর সুরজমল জাঠ খুব শক্তিশালী হয়ে ওঠে। ১৭৭৩ সালে শাহ আলম দ্বিতীয়ের দরবারে একজন উজির নাজাফ খানের অধীনে মুঘল বাহিনী জাঠদের সঙ্গে যুদ্ধ করে এবং তাদের আগ্রা থেকে বিতাড়িত করে।
যদিও জাঠরা এই যুদ্ধে হেরে গিয়েছিল, নাজাফ খান রেইনহার্ট সোমব্রের সৈন্যদের যুদ্ধের পরাক্রম দেখে এতটাই মুগ্ধ হয়েছিলেন যে, তিনি তাঁকে মুঘলদের সঙ্গে যোগ দেওয়ার জন্য আমন্ত্রণ জানান। সেই মতোই মুঘলদের সঙ্গে যোগ দেন রেইনহার্ট ও তাঁর সেনাবাহিনী। দিল্লিতে থাকাকালীন পরবর্তী তিন বছর রেইনহার্ট এবং ফরজানা শাহ আলম দ্বিতীয় এবং নাজাফ খানের অত্যন্ত প্রিয়পাত্র হয়ে ওঠেন। এই দম্পতি ক্রমে এতটাই প্রভাবশালী হয়ে ওঠেন যে তাঁদের সর্দানের ধনী জায়গিরের দায়িত্বও দেওয়া হয়েছিল। সেই সময় ঐ অঞ্চল থেকে বছরে প্রায় ৬ লক্ষ টাকা রাজস্ব আদায় হত। ১৭৭৬ সালে দ্বিতীয় শাহ আলমের সনদের বলে একজন অভিযাত্রী থেকে এই অঞ্চলের শাসক হয়ে ওঠেন রেইনহার্ট এবং ফরজানা।
ক্রমে সোমব্রেকে আগ্রার বেসামরিক ও সামরিক গভর্নরের পদে অধিষ্ঠিত করা হয়। ১৭৭৮ সালে রেইনহার্টের মৃত্যু হলে নীতি অনুযায়ী রেইনহার্টের প্রথম উপপত্নী বারী বিবির পুত্র জাফরইয়াব খান আগ্রার সিংহাসনের উত্তরাধিকারী ছিলেন। যদিও অনেকেই জাফরইয়াব খানকে দুর্বল এবং অস্থিরমতি বলেছেন। কিন্তু বেগম সামরু ওরফে ফরজানা বিনা যুদ্ধে আগ্রার এক কণা জমিও ছেড়ে দিতে রাজি নয়। নিজের দক্ষতায় রেইনহার্টের সেনাবাহিনীর সমর্থন অর্জন করতে সক্ষম হন বেগম সামরু এবং রেইনহার্টের সৈন্যদের নিজের আওতায় আনেন তিনি।
পৃষ্ঠপোষক নাজাফ খানকে ব্যবহার করে সর্দানায় তিনি নিজের অধিকার কায়েম করেন। বেগম সামরুর অর্থেই দিল্লিতে বাকি জীবনটা বিলাস-ব্যসনে কাটছিল জাফরইয়াব খানের। প্রায় চার হাজার সৈন্যের একটি বাহিনীর সর্বোচ্চ কমাণ্ডার হিসেবে নিজের কর্মজীবন শুরু করেছিলেন বেগম সামরু। রেইনহার্ট সোমব্রের কাছ থেকে উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া এই বাহিনীর দায়িত্ব ও কর্তৃত্ব গ্রহণ করেন বেগম। এই বাহিনীর মধ্যে একশো জন ইউরোপীয় অফিসার ছিলেন। একজন পুরুষের মতো পাগড়ি পরে আর হাতে হুঁকো নিয়ে আদালতে বসতেন বেগম। ১৭৮১ সালে ইসলাম ধর্ম থেকে ক্যাথলিক ধর্মে দীক্ষিত হন তিনি। ধর্মান্তরিত হওয়ার পরে তিনি নিজেকে ‘জোয়ান’ নামে ঘোষণা করেন।
কিন্তু তিনি বরাবর মুঘল পোশাক এবং মুঘল আদব-কায়দা বজায় রেখেছিলেন তিনি। তবে মাঝেমধ্যে পর্দা প্রথা অমান্য করে তিনি নিজের ইউরোপীয় অফিসারদের সঙ্গে খাবার খেতেন। নিজের সৈন্যবাহিনীকে নেতৃত্ব দিতেন তিনি এবং কখনো কখনো অসহায় মুঘল সম্রাট শাহ আলমকেও রক্ষা করেছিলেন বেগম সামরু। দ্বিতীয় শাহ আলম তাঁকে ‘জেবুন্নিসা’ অর্থাৎ মহিলাদের মধ্যে অলঙ্কার উপাধিতে ভূষিত হন। একজন দক্ষ কূটনীতিক হিসেবেও তাঁর খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে। ১৭৮৩ সালে শিখ সামরিক নেতা বাঘেল সিং দিল্লি দখল করলে প্রায় তিরিশ হাজার সৈন্য নিয়ে একটি শিবির স্থাপন করেন বাঘেল সিং।
এই সময় বেগম সামরু দিল্লিতে শিখদের আটটি গুরুদ্বার নির্মাণের অনুমতি দেন এবং তাঁদের রাজস্বের পরিমাণ কমিয়ে দেন। এর ফলে সে যাত্রায় সিংহাসন হারাননি দ্বিতীয় শাহ আলম। ১৭৮৮ সালে রোহিলা সর্দার গোলাম কাদের দিল্লি দখল করেন এবং দ্বিতীয় শাহ আলমকে চোখ বিঁধিয়ে অন্ধ করে দেন। ইতিমধ্যে বেগম সামরু মুঘল সম্রাটের সুরক্ষার জন্য দিল্লিতে চলে আসেন সৈন্যবাহিনী নিয়ে এবং তাঁর সেনাবাহিনীর প্রবল বিক্রমের সামনে গোলাম কাদির দিল্লি ছেড়ে পালিয়ে যান। তীক্ষ্ণ ও ক্ষুরধার বুদ্ধির কারণে বেগম সামরুর পরিচিতি থাকলেও তাঁর জীবনে প্রেমের এক অন্য অধ্যায় রয়েছে।
সর্বদাই বিচারবুদ্ধি এবং পূর্বপরিকল্পনা দ্বারা সিদ্ধান্ত নিলেও কোন একটা সময় আবেগের বশবর্তী হয়ে অনেক মাশুল গুণতে হয় তাঁকে। ১৭৮৭ সালে জর্জ থমাস নামে একজন আইরিশ বন্দরকর্মী ভারতীয় ভাড়াটে সৈনিক হিসেবে বেগমের বাহিনীতে যোগ দেন। বেগমের প্রেমিক ছিলেন থমাস, বেগম তাঁকে ‘জাহাজি সাহেব’ বলে ডাকতেন। বেগম এবং থমাস একত্রে বহু যুদ্ধ জয় করেছেন। কিন্তু তাঁদের এই সম্পর্কের মাঝেই এক সুদর্শন ফরাসী সৈনিক ও অভিযাত্রী আর্মাণ্ড লে ভ্যাসল্ট এসে পড়েন।
আর্মাণ্ডের প্রতি তীব্র আকৃষ্ট হয়ে বেগম সামরু গোপনে তাঁকে বিবাহ করেন। এর ফলে ঘৃণায় এবং ঈর্ষায় জ্বলে জর্জ থমাস বেগমের সেনাবাহিনী ছেড়ে নিজের অনুগত কিছু সেনাকে নিয়ে মারাঠাদের দলে যোগ দেন। বেগমের অনুগত সৈন্যদের বিচ্ছিন্ন করে জাফরইয়াব খানকে লে ভ্যাসোল্ট বেগমের বিরুদ্ধে যুদ্ধে অনুপ্রাণিত করেছিলেন। কিন্তু এই দুই প্রেমিক পালিয়ে যান। অবশেষে ধরা পড়ার মুখে লে ভাসোল্ট আত্মহত্যা করতে যান। তাঁর সামনে পালকিতে থাকা বেগম সামরু নিজেকে ছুরিকাঘাত করলে প্রেমাসক্ত ভ্যাসোল্টও নিজেকে ছুরিবিদ্ধ করে হত্যা করেন।
শেক্সপিয়রের রোমিও জুলিয়েটের দৃশ্য সংঘটিত হয় যেন! বেগমের প্রাক্তন প্রেমিক জর্জ থমাস এই বিদ্রোহের কথা শুনে বেগমের উদ্ধার ও সুরক্ষার জন্য ছুটে আসেন এবং তাঁর সাহায্যেই বেগম নিজের রাজ্য ও ক্ষমতা ফিরে পেয়েছিলেন। জর্জ থমাসকে বেগম পুরস্কারস্বরূপ হরিয়ানার ছোট্ট একটি রাজ্য হ্যান্সির শাসনভার অর্পণ করেন। জর্জ থমাসই ছিলেন ভারতের প্রথম ও একমাত্র শ্বেতাঙ্গ রাজা। ১৮৩৬ সালের ২৭ জানুয়ারি সর্দানায় ৮৫ বছর বয়সে বেগম সামরুর মৃত্যু হয়। ২০১৯ সালের জুন মাসে ‘বেকহ্যাম হাউস’ নামে একটি টেলিভিশন ধারাবাহিক প্রথম মুক্তি পায় যেখানে অভিনেত্রী লারা দত্ত বেগম সামরুর চরিত্রে অভিনয় করেন। দিল্লির চাঁদনি চকে বেগম সামরুর প্রাসাদটি বর্তমানে ভগীরথ প্যালেস নামে পরিচিত।
আরো পড়ুন জীবনী মন্দির দর্শন ইতিহাস ধর্ম জেলা শহর শেয়ার বাজার কালীপূজা যোগ ব্যায়াম আজকের রাশিফল পুজা পাঠ দুর্গাপুজো ব্রত কথা মিউচুয়াল ফান্ড বিনিয়োগ জ্যোতিষশাস্ত্র টোটকা লক্ষ্মী পূজা ভ্রমণ বার্ষিক রাশিফল মাসিক রাশিফল সাপ্তাহিক রাশিফল আজ বিশেষ রান্নাঘর প্রাপ্তবয়স্ক বাংলা পঞ্জিকা