বেগম সুফিয়া কামাল এর জীবনী

বেগম সুফিয়া কামাল এর জীবনী

বেগম সুফিয়া কামাল (Begum Sufia Kamal) বাংলাদেশের একজন প্রথিতযশা মহিলা সাহিত্যিক। মূলত কবি হিসেবে বিখ্যাত হলেও তিনি শিক্ষিকা, নেত্রী এবং সংগঠক হিসেবেও তিনি তাঁর অবদান রেখেছেন। তাঁর লেখা ‘সাঁঝের মায়া’ কাব্যগ্রন্থের মাধ্যমে তিনি সাহিত্য মহলে পরিচিতি পান। এই কাব্যগ্রন্থটির ভূমিকা লিখেছিলেন কাজী নজরুল ইসলাম। ১৯৪৬ সালে হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গার সময় দাঙ্গাপীড়িতদের সাহায্যের ক্ষেত্রে তিনি বিশেষ ভূমিকা পালন করেন।

১৯১১ সালের ২০ জুন বরিশালের শায়েস্তাবাদ জমিদার পরিবারে সুফিয়া কামালের জন্ম হয়। বাবা সৈয়দ আবদুল বারি পেশায় ছিলেন উকিল। মা সৈয়দা সাবেরা খাতুন ছিলেন গৃহিণী। সুফিয়ার ঠাকুরদা খান বাহাদুর নবাব সৈয়দ মীর মোয়াজ্জেম হোসেন শায়েস্তাবাদের জমিদার ছিলেন। সুফিয়ার যখন সাত বছর বয়স তখন তাঁর বাবা পরিবার ত্যাগ করে সুফি সাধক হয়ে যান। 

  সুফিয়া কামালের প্রথম স্বামী সৈয়দ নেহাল হোসেন সম্পর্কে তাঁর মামাতো ভাই ছিলেন। সুফিয়া কামালের শিক্ষা, সাহিত্যচর্চা এবং কর্মজীবনে বিশেষ অবদান ছিল তাঁর স্বামীর।  তাঁদের এক মেয়ে আমেনা আক্তার। প্রথম স্বামী সৈয়দ নেহালের মৃত্যু হলে দ্বিতীয় বিয়ে করেন সুফিয়া কামাল। দ্বিতীয় স্বামীর নাম কামালউদ্দিন আহমেদ।  তাঁদের চার সন্তান – সুলতানা কামাল, সাঈদা কামাল, শাহেদ কামাল ও সাজেদ কামাল।   

  গোঁড়া মুসলমান পরিবারে বড় হওয়ার কারণে প্রতিষ্ঠানিক শিক্ষা লাভের সুযোগ থেকে বঞ্চিত থেকে যান তিনি।  তাঁদের পরিবারের ভাষা ছিল উর্দু। পরিবারের মেয়েদের আরবি, ফারসি ভাষা শিক্ষার ব্যবস্থা থাকলেও বাংলা শেখার কোন ব্যবস্থা ছিল না। বেগম সুফিয়া কামাল মূলত  তাঁর মায়ের কাছেই বাংলা শিখেছেন।   ১৯২৩ সালে মাত্র বারো বছর বয়স থেকে বেগম সুফিয়া কামালের সাহিত্যচর্চায় হাতে খড়ি হয়। তাঁর প্রথম গল্প ‘সৈনিক বধু’ বরিশালের ‘তরুণ’ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়।  

১৯২৫ সালে বরিশালে মহাত্মা গান্ধী এলে তাঁর সাথে বেগম সুফিয়া কামাল দেখা করেন।  সুফিয়া জানতেন গান্ধীজী চরকাকে পরাধীনতা থেকে মুক্তির একটি অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ হাতিয়ার হিসেবে দেখতেন। গান্ধীজীর হাতে তিনি তাই নিজের হাতে চরকায় কাটা সুতো তুলে দিয়েছিলেন। ১৯২৬ সালে সুফিয়া তাঁর প্রথম স্বামী সৈয়দ নেহাল হোসেনের সঙ্গে কলকাতায় এসে বেশ কয়েকজন বিশিষ্ট বাঙালি ব্যক্তিত্বের সঙ্গে তাঁর সাক্ষাৎ হয় যাঁদের মধ্যে কাজী নজরুল ইসলাম, রবীন্দ্রনাথ, বেগম রোকেয়া ছিলেন অন্যতম।

কাজী নজরুল সুফিয়ার কবিতা পড়ে এতটাই মুগ্ধ হয়েছিলেন যে তিনি সুফিয়াকে তাঁর কবিতাগুলি পত্রিকায় প্রকাশের জন্য তাঁকে উৎসাহ দেন। ১৯২৬ সালে ‘সওগাত’ পত্রিকায় বেগম সুফিয়া কামালের প্রথম কবিতা ‘বাসন্তী’ প্রকাশিত হয়। ১৯২৯ সালে সুফিয়া কামাল বেগম রোকেয়া প্রতিষ্ঠিত মুসলিম মহিলা সংগঠন ‘আঞ্জুমান-ই-খাওয়াতিন-ই-ইসলাম’-এ যোগ দেন। এই সংগঠনটি মূলত কলকাতার বস্তি অঞ্চলের নারীদের শিক্ষা ও সামাজিক সংস্কারের বিষয় নিয়ে কাজ করত।  ১৯৩৭ সালে প্রকাশিত হয় তাঁর উল্লেখযোগ্য গল্প গ্রন্থ ‘কেয়ার কাঁটা’।

  বেগম সুফিয়া কামাল ‘একালে আমাদের কাল’ নামে একটি আত্মজীবনী রচনা করেছেন। তাতে তাঁর ছোটবেলার কথা তিনি তুলে ধরেন। ১৯৩৮ সালে প্রকাশিত হয় তাঁর ‘সাঁঝের মায়া’ কাব্যগ্রন্থটি যার ভূমিকা লিখেছিলেন কাজী নজরুল ইসলাম। গ্রন্থটি পড়ে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রশংসা সূচক একটি চিঠি লেখেন সুফিয়া কামালকে যেখানে তিনি লিখেছিলেন – ‘’তোমার কবিত্ব আমাকে বিস্মিত করে। বাংলা সাহিত্যে তোমার স্থান উচ্চে এবং ধ্রুব তোমার প্রতিষ্ঠা।’’ ১৯৪৭ সালে তাঁর সম্পাদনায় ‘বেগম’ পত্রিকা প্রকাশিত হয়।

এই পত্রিকাটি মহিলাদের বিভিন্ন সমস্যাকে তুলে ধরত। ১৯৪৭ সালে ঢাকায় এসে মহিলা সমিতি প্রতিষ্ঠিত করেন এবং এই সমিতির মাধ্যমেই হিন্দু মুসলমান সম্প্রীতির জন্য বিভিন্ন সেবামূলক কাজ শুরু করেন। ১৯৪৮ সালে সুফিয়া কামাল সমাজসেবামূলক কাজের সাথে আরও গভীর ভাবে যুক্ত হয়ে পড়েন। হিন্দু মুসলিম সম্প্রীতি রক্ষার জন্য গঠিত শান্তি কমিটিতে যোগ দেন তিনি। এই বছরেই ‘পূর্ব পাকিস্তান মহিলা সমিতি’ গঠিত হলে তিনি সেই সমিতির সভানেত্রী নির্বাচিত হন। ১৯৪৯ সালে তাঁর সম্পাদনায় প্রকাশিত হয় ‘সুলতানা’ পত্রিকা। 

১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনে সুফিয়া কামাল প্রত্যক্ষভাবে অংশগ্রহণ করেন। এরপর ক্রমশ গণআন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধেও অংশগ্রহণ করেন তিনি। ১৯৬৯ সালে নারীদের জন্য ‘মহিলা সংগ্রাম পরিষদ’ গঠন করেন এবং  সংগঠনের সভাপতি নির্বাচিত হন তিনি। বর্তমানে এর নাম ‘বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ’। ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থানেও অংশগ্রহণ করেন বেগম সুফিয়া কামাল। 

মুক্তিযুদ্ধের সময় ধানমণ্ডির বাড়ি থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের সহায়তা দিতেন সুফিয়া কামাল।  ১৯৯০ সালে স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনেও তিনি সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন।    সুফিয়া কামালের মোট প্রকাশিত গদ্যগ্রন্থের সংখ্যা চার যথা – ১৯৩৭ সালে প্রকাশিত ‘কেয়ার কাঁটা’, ১৯৬৮ সালে প্রকাশিত ভ্রমণ বিষয়ক গ্রন্থ ‘সোভিয়েটের দিনগুলি’, ১৯৮৮ সালে প্রকাশিত আত্মজীবনীমূলক রচনা ‘একালে আমাদের কাল’ এবং ১৯৮৯ সালে প্রকাশিত ‘একাত্তরের ডায়েরী’। তাঁর রচিত একটি ছোট্ট উপন্যাস (Novella) হল  ‘জনক’। 

সোভিয়েত ইউনিয়নের ক্রিমিয়ায় মাত্র পনেরো দিনে তিনি এই জনক উপন্যাসটি রচনা করেন। এছাড়া তাঁর রচিত উল্লেখযোগ্য গ্রন্থগুলির মধ্যে রয়েছে ‘মায়া কাজল’, ‘মন ও জীবন’, ‘উত্তপ্ত পৃথিবী’, ‘অভিযাত্রিক’ ইত্যাদি। বিশ্বের একাধিক ভাষায় তাঁর কবিতা অনূদিত হয়েছে। ১৯৮৪ সালে রুশ ভাষায় তাঁর ‘সাঁঝের মায়া’ গ্রন্থটি সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে প্রকাশিত হয়। এছাড়া মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বেশ কিছু পত্র-পত্রিকাতেও তাঁর বেশ কিছু কবিতা প্রকাশিত হয়েছে। ২০০১ সালে বাংলা একাডেমি বেগম সুফিয়া কামালের কিছু কবিতার ইংরেজি অনুবাদ সংকলন ‘Mother of Pears and other poem’ নামক একটি গ্রন্থ প্রকাশ করে।

২০০২ সালে বাংলা একাডেমি থেকেই সুফিয়া কামালের রচনা সমগ্র প্রকাশ পেয়েছে।   বেগম সুফিয়া কামাল সাহিত্যে তাঁর বিশেষ অবদানের স্বীকৃতি স্বরূপ অসংখ্য পুরস্কার ও সম্মাননা লাভ করেছেন। ১৯৬১ সালে তাঁকে পাকিস্তান সরকার ‘তঘমা-ই-ইমতিয়াজ’ পুরস্কারে সম্মানিত করে।  কিন্তু ১৯৬৯ সালে বাঙালিদের ওপর অত্যাচারের প্রতিবাদে তিনি এই পুরস্কার বর্জন করেন।  ১৯৬২ সালে বাংলা একাডেমি পুরস্কার, ১৯৭৬ সালে একুশে পদক, ১৯৯৫ সালে জাতীয় কবিতা পরিষদ পুরস্কার, এছাড়া Women’s Federation for World Peace Crest, বেগম রোকেয়া পদক,

দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ স্বর্ণপদক, স্বাধীনতা দিবস পুরস্কার, সোভিয়েত ইউনিয়নের লেনিন সেন্তেনারি জুবিলী পুরস্কার এবং চেকোস্লোভাকিয়া মেডেল সহ একাধিক পুরস্কার লাভ করেন।  ১৯৯৯ সালের ২০ নভেম্বর ঢাকায় মৃত্যু হয় বেগম সুফিয়া কামালের । বেগম সুফিয়া কামালের মৃত্যুর পর তাঁকে পূর্ণ রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় সমাহিত করা হয়।  বাংলাদেশি নারীদের মধ্যে তিনিই প্রথম এই সম্মান লাভ করেন। এ ছাড়া ২০১৯ সালের ২০ জুন তাঁর ১০৮তম জন্মদিন উপলক্ষে গুগল ডুডল তৈরি করে সম্মাননা প্রদান করে। এছাড়া ঢাকায় অবস্থিত বাংলাদেশের জাতীয় গ্রন্থাগারের নাম তাঁর স্মরণে ‘সুফিয়া কামাল জাতীয় সাধারণ গ্রন্থাগার’ রাখা হয়।

আরো পড়ুন      জীবনী  মন্দির দর্শন  ইতিহাস  ধর্ম  জেলা শহর   শেয়ার বাজার  কালীপূজা  যোগ ব্যায়াম  আজকের রাশিফল  পুজা পাঠ  দুর্গাপুজো ব্রত কথা   মিউচুয়াল ফান্ড  বিনিয়োগ  জ্যোতিষশাস্ত্র  টোটকা  লক্ষ্মী পূজা  ভ্রমণ  বার্ষিক রাশিফল  মাসিক রাশিফল  সাপ্তাহিক রাশিফল  আজ বিশেষ  রান্নাঘর  প্রাপ্তবয়স্ক  বাংলা পঞ্জিকা