বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামী

বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামী

ব্রাহ্মসমাজের আচার্য এবং নব্যবৈষ্ণববাদের প্রবক্তা ও নদীয়ার কৃতি সন্তান বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামী  Bijoy Krishna Goswami। ১৮৪১ খ্রিষ্টাব্দের ২ আগস্ট নদিয়া জেলার শিকারপুরের নিকট দহকুল গ্রামে বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামী জন্মগ্রহণ করেন। কৃষ্ণনগর গভর্ণমেন্ট কলেজের ভিত্তিস্থাপন, বিধবাদের পুনরায় বিবাহের ব্যবস্থা, শিক্ষার বিস্তার, একাধিক সমাজ সংস্কার আন্দোলনে নদিয়া জেলার ব্রাহ্মসমাজ নিজেদের ছড়িয়ে দিতে পেরেছিলেন কৃষ্ণনগরে, শান্তিপুরে, কুমারখালিতে (বর্তমানে বাংলাদেশে), তেহট্টে, চাকদহে, শিবনিবাসে।

শান্তিপুর অঞ্চলে ব্রাহ্মসমাজের সামাজিক সংস্কারমূলক আন্দোলনের ধারা অনুকূল পরিবেশ পেয়েছিল ভিন্ন একটি কারণে। যাঁকে কেন্দ্র করে শান্তিপুরের এই কর্মকাণ্ড ফলদায়ী হয়ে উঠতে পেরেছিল, তিনি শিক্ষিত ও উদারমনা ব্যক্তিত্ব শ্রীবিজয়কৃষ্ণ গোস্বামী।  বনেদিয়ানায় বিজয়কৃষ্ণ ছিলেন শান্তিপুরের শ্রী অদ্বৈত আচার্যের বংশধর। নিষ্ঠাবান বৈষ্ণব পরিবারে জন্ম। উচ্চশিক্ষার জন্য এক সময়ে তিনি চলে এসেছিলেন কলকাতায়।

সাহিত্য বেদান্ত দর্শন নিয়ে তন্বিষ্ট পড়াশোনা করার পর বিজয়কৃষ্ণের মনে হয়েছিল, আচারনিষ্ঠ পৌত্তলিক হিন্দুধর্মের মধ্যে সারবত্তা আদৌ কিছু নেই। জাতপাতের কুসংস্কার থেকে মুক্তি চাই। আর তার আশ্রয় মিলতে পারে একমাত্র ব্রাহ্মধর্মে। অসম বিরোধিতা করেই তিনি সদস্য হয়ে গেলেন ব্রাহ্মসমাজের। দায়িত্ব পেলেন ব্রাহ্মধর্মের অন্যতম প্রচারকের।

শান্তিপুরে ব্রাহ্মসমাজের প্রতিষ্ঠা ও সমাজ সংস্কারমূলক কাজগুলিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়াকেই পাখির চোখ করে তুললেন তিনি। যাত্রা হল শুরু। বিজয়কৃষ্ণের মতো উচ্চশিক্ষিত মানুষকে ব্রাহ্মধর্মে যুক্ত হতে দেখে সাহস করে একে একে এগিয়ে এলেন শান্তিপুরের একাধিক কৃতবিদ্য মানুষ। দীর্ঘ তালিকার কয়েক জন, ক্ষেত্রমোহন বন্দ্যোপাধ্যায়, অঘোরনাথ গুপ্ত, ভুবনমোহন গুপ্ত, রামচন্দ্র মুখোপাধ্যায়, ডাক্তার অভয়চরণ বাগচী, রামচন্দ্র বিদ্যাবাগীশ, বীরেশ্বর প্রামাণিক, হরেন্দ্রনাথ মৈত্র, পুণ্ডরীকাক্ষ মুখোপাধ্যায়, প্রাণনাথ মল্লিক, যোগানন্দ প্রামাণিক প্রমুখ।

১৩০৪ বঙ্গাব্দে শান্তিপুর মতিগঞ্জের কাছে ব্রাহ্মসমাজ প্রতিষ্ঠার সময় প্রথম আচার্যের দায়িত্ব দেওয়া হল রামচন্দ্র বিদ্যাবাগীশকে। এক ঝাঁক শিক্ষিত মুক্তমনা যুবাপুরুষ ঝাঁপিয়ে পড়লেন ঘুণধরা সমাজকে অশিক্ষা, কুসংস্কার ও জাতপাতের সঙ্কীর্ণতা থেকে তুলে আনার কাজে। বিচলন উঠল শান্তিপুরের ভক্তি রসসাগরে, ভরা কোটালের মতো।সাহায্য ও প্রতিরোধ দুই-ই লক্ষ করা গেল ব্রাহ্মদের এই সমাজ সংস্কার আন্দোলনে। শান্তিপুরের একটা বড় অংশের মানুষ ব্রাহ্মদের এই আন্দোলনকে খুব উদারতার সঙ্গে মেনে নিতে পারলেন না।

কথাটা ঐতিহাসিক ভাবে সত্য। প্রথম আঘাতটা এসেছিল নব্য ব্রাহ্মদের নিজের পরিবার থেকে। আত্মীয় পরিজন থেকে অনেকেই বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়লেন। কালীকৃষ্ণ ভট্টাচার্যের লেখা 'শান্তিপুর পরিচয় ' গ্রন্থে তার সম্যক বিবরণ রয়েছে। সে কালের দু'একটি পত্রপত্রিকাতেও ব্রাহ্মদের নিয়ে নানা অকথা কুকথা বেরিয়েছিল। ব্রাহ্মদের বিরুদ্ধে এই ক্ষোভ শেষ পর্যন্ত আইন আদালত পর্যন্ত গড়িয়েছিল বলে জানা যায়। পাহাড়প্রমাণ প্রতিরোধ সত্ত্বেও পিছু হঠার পাত্র ছিলেন না বিজয়কৃষ্ণ।

প্রিয় বন্ধু প্রাণকৃষ্ণ মল্লিকের সঙ্গে তর্কাতর্কি করতে গিয়ে এক হ্যাঁচকা টানে ছিঁড়ে ফেললেন কাঁধে ঝোলানো উপবীত। ব্রাহ্মণ্য সংস্কারের শেষ চিহ্নটুকু নিশ্চিহ্ন করে ১২৬৮ বঙ্গাব্দের এক ক্রোধী যুবক নিজেই হয়ে উঠলেন নিজের ভাগ্যদেবতা।অবশ্য সে সাহস আগেই দেখিয়ে ছিলেন কৃষ্ণনগরের আরেক সুসন্তান রামতনু লাহিড়ী। বন্ধন গেল টুটে। শান্তিপুরের সমাজ বিজয়কৃষ্ণের এই উদ্ধত ব্রাহ্মণ্য বিরোধিতা ভাল ভাবে মেনে নেয়নি সে দিন। অবশ্য তা নিয়ে বিজয়কৃষ্ণের তেমন কোনও হেলদোল ছিল না।

বৈষ্ণবীয় ঘরাণায় কীর্তন গানের আঙ্গিকে ব্রাহ্মধর্মের মূল কথাগুলি পরিবেশনে একটা স্বতন্ত্র ধারা এনেছিলেন বিজয়কৃষ্ণ। আসলে শান্তিপুরের মাটিতে বৈষ্ণব ধর্মের প্রচার ও প্রসারে কীর্তনগানের যে জনমোহিনী শক্তি আছে, তা বিজয়কৃষ্ণের অজানা ছিল না। শ্রুতপূর্ব সেই অভিজ্ঞতাকে ব্রাহ্মধর্ম প্রসারের কাজে লাগালেন তিনি। ভালই চলছিল ধর্মপ্রচার ও সমাজ সংস্কারের কাজ। একটানা প্রায় বারো বছর এই কাজে যুক্ত থেকে শান্তিপুরের ব্রাহ্মসমাজের সদস্য সংখ্যা তিনি অনেকটাই বাড়িয়ে দিলেন।

কিন্তু হঠকারিতার একটা প্রবণতা হয়তো ফের বিজয়কৃষ্ণকে ভিন্ন নক্ষত্রগামী করে তুলল। ব্রাহ্মসমাজের শিরোমণি কেশবচন্দ্র সেনকে যে দিন ব্রাহ্মরা অবতার জ্ঞানে পুজোআর্চা শুরু করে দিল, সে দিন তার তীব্র বিরোধিতা করলেন বিজয়কৃষ্ণ। বিরোধ এতটাই চরমে উঠেছিল যে, শেষপর্যন্ত ব্রাহ্মসমাজের সঙ্গে সব রকম সংস্রব ত্যাগ করলেন তিনি।

১২৮৯ বঙ্গাব্দে পুনরায় ফিরে এলেন স্বভূমিতে বৈষ্ণবীয় ভক্তিরসের পরিচিত স্রোতে। শান্তিপুরে ব্রাহ্মসমাজ গড়ে ওঠার পর থেকে যে সমাজসংস্কার মূলক কাজগুলি মানুষ শ্রদ্ধার সঙ্গে মনে রেখেছে, সেগুলি হল অনাথ আশ্রম স্থাপন, ব্রাহ্মমিশন বিদ্যালয় স্থাপন, ডায়মন্ড জুবিলি ইনস্টিটিউশন (আজকের শান্তিপুর ওরিয়েন্টাল একাডেমি), শান্তিপুর শিক্ষয়িত্রী বিদ্যালয়, আত্মোৎকর্ষ বিধায়িনী সভা, বালবিদ্যোৎসাহিনী সভা ইত্যাদি। প্রসঙ্গত মনে পড়বে, বিদ্যাসাগর যখন বিধবা বিবাহ আন্দোলনে নেমেছেন, তখন সেই আন্দোলনের সমর্থনে ব্রাহ্মদের সহযোগিতায় সবচেয়ে বেশি সই সংগ্রহ করা গিয়েছিল এই শান্তিপুর থেকেই।

মোট স্বাক্ষরকারীর সংখ্যা ছিল ৫৩১।সংখ্যাটি খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। শান্তিপুরের তাঁতিরাও এগিয়ে এসেছিলেন সমাজ সংস্কারের সেই জোয়ারে। কাপড়ের পাড়ে তাঁরা বুনে দিলেন 'বেঁচে থাক বিদ্যাসাগর চিরজীবী হয়ে'। জানা যায়, ব্রাহ্মদের উদ্যোগে সে কালে বেশ ক'টি বিধবাবিবাহ অনুষ্ঠিত হয়েছিল শান্তিপুরে। আর সে বিষয়ে সবচেয়ে বেশি উদ্যোগী হয়েছিলেন কৃতবিদ্য বিজয়কৃষ্ণ। তাঁর ডাকেই কুমারখালি থেকে ছুটে এসেছিলেন 'গ্রামবার্তা প্রকাশিকা' পত্রিকার সম্পাদক হরিনাথ মজুমদার ওরফে কাঙাল হরিনাথ।

তাঁকে সঙ্গে নিয়েই বিজয়কৃষ্ণ ব্রাহ্ম গান পরিবেশনের জন্য ছুটে গিয়েছিলেন ঢাকা, রাজশাহী ও কলকাতায়। বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামী গয়াতে সাধুদের সংস্পর্শে এসে বৈষ্ণবধর্মের প্রতি আকৃষ্ট হন। ফলে তার সঙ্গে ব্রাহ্মসমাজের মতবিরোধ হয় এবং তিনি ১৮৮৮ খ্রিষ্টাব্দে ব্রাহ্মসমাজ ত্যাগ করে বৈষ্ণব সাধনায় মগ্ন হন। তিনি যে বৈষ্ণবধর্ম প্রচার করেন তা নব্যবৈষ্ণবধর্ম নামে পরিচিত। তিনি ছিলেন নব্যবৈষ্ণব আন্দোলনের প্রধান ব্যক্তিত্ব। নারীর উন্নতি ও স্ত্রীশিক্ষার পক্ষপাতী আধুনিক মানুষ ছিলেন তিনি।অশ্বিনীকুমার দত্ত, বিপিনচন্দ্র পাল, সতীশচন্দ্র মুখোপাধ‍্যায় প্রমুখ ব‍্যক্তি এই আন্দোলনের সাথে যুক্ত ছিলেন।

একদিন বিজয়কৃষ্ণ কলকাতার মেছোবাজার স্ট্রিট দিয়ে আপনমনে হাঁটছেন হঠাৎই তার জুতোটা ছিঁড়ে গেল। বিজয়কৃষ্ণ রাস্তার ধারে একজন মুচির কাছে জুতোটা সারাতে দিলেন। জুতো সেলাই হয়ে গেলে মুচিকে পয়সা দিতে সে অর্ধেক পয়সা ফেরত দিয়ে তার যন্ত্রপাতি নিয়ে চলে গেল। বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামী অবাক হয়ে গেলেন। লোকটার সম্পর্কে কৌতূহলী হয়েই তিনি লোকটির পিছু নিলেন। বেশ খানিকটা হেঁটে লোকটি বাবুঘাটের গঙ্গার ধারে পৌঁছল। সেখানে একটা ভাঙা খিলানের ভিতর যন্ত্রপাতির বাক্সটাকে রেখে, গঙ্গাস্নান করে সে খিদিরপুরের দিকে হাঁটতে শুরু করল। বিজয়কৃষ্ণও পিছু ছাড়লেন না। বেশ কিছুটা গিয়ে সে একটা বাড়ির সামনে দাঁড়াল।

সেখানে বেশ কিছু লোক তাঁকে অভ্যর্থনা করে ভিতরে নিয়ে চলে গেল। লোকটাকে অনুসরণ করে বিজয়কৃষ্ণও বাড়ির ভিতরে ঢুকলেন। ভিতরে পৌঁছে বিজয়কৃষ্ণ বিস্ময়ে হতবাক... তিনি দেখলেন সেই মুচি আসলে একজন মহন্ত। তাঁকে ঘিরে অজস্র ভক্ত, শিষ্যের ভিড়, যারা এতক্ষণ ধরে ওই মুচির জন্যই অপেক্ষা করে বসে আছে। লোকটি তাঁর নির্দিষ্ট আসনে বসে ভক্তদের একাগ্র চিত্তে ঈশ্বর কথা শোনাতে লাগলেন। বিস্মিত বিজয়কৃষ্ণ মহন্তের কাছে এগিয়ে গিয়ে বললেন, ‘আপনি এত জ্ঞানী, আপনার এত শিষ্য ভক্ত তবুও আপনি কেন রাস্তার ধারে বসে জুতো সেলাই করেন?

কীসের অভাব আপনার?’ মহন্তর চোখে জল, তিনি হাত জোড় করে বললেন, ‘ভাবের অভাব বাবা...। আমার গুরুর নির্দেশে আমি ওই কাজ করি। মানুষের চরণ সেবা করে আমি শান্তি পাই, ভাবের সন্ধান পাই। জানো, একদিন আমি আমার অতিথির আগে খেয়ে নিয়েছিলাম, খুব খিদে পেয়েছিল বলেই আমি সেটা করেছিলাম, কিন্তু আমার গুরু প্রচণ্ড রেগে গেলেন, আমাকে তীব্রভাবে তিরস্কার করে বললেন, তুই সাধু নয় তুই একটা আস্ত চামার। গুরুর নির্দেশে সেইদিন থেকেই আমি চামারী করে জীবিকা নির্বাহ করি।

ওই কাজের মধ্যে দিয়েই আমার ঈশ্বর দর্শন এবং ঈশ্বরসেবার পুণ্য লাভ হয়। প্রতিদিন চারআনা পয়সা হলেই আমি কাজ বন্ধ করে দিয়ে চলে আসি। জীবন চালানোর জন্য প্রতিদিন আমার চার আনাই যথেষ্ট’। সেই দিন থেকে গোস্বামী বিজয়কৃষ্ণের জীবনে, জীবনবোধ ও ঈশ্বরসাধনার এক নতুন দিক উন্মোচিত হয়েছিল। মানুষকে খোঁজার মধ্যে দিয়ে ঈশ্বরকে খুঁজতে খুঁজতেই বিজয়কৃষ্ণ হয়ে উঠেছিলেন ভারতের মহাসাধক বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামী । সন্ন‍্যাস গ্রহণের পর তাঁর নাম হয় অচ‍্যুতানন্দ সরস্বতী।

বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামীর উল্লেখযোগ্য শিষ্যরা কুলদানন্দ ব্রহ্মচারী, কিরণ চাঁদ দরবেশ, বিপিনচন্দ্র পাল, অশ্বিনীকুমার দত্ত, সতীশচন্দ্র মুখোপাধ্যায় প্রমুখ। উল্লেখ্য যে, ব্রাহ্মধর্মে কেশবচন্দ্র সেনের পূর্বেই বিজয়কৃষ্ণ ভক্তিধারার প্রচলন করেন। তিনি ব্রাহ্মসমাজে আধ্যাত্মিকতার ভাব অনেকটা বজায় রেখেছিলেন। কিন্তু তাঁর ব্রাহ্মসমাজ পরিত্যাগের পর থেকে ব্রাহ্মসমাজে আধ্যাত্মিক ধর্মভাবের অনুশীলন হ্রাস পেতে থাকে এবং সমাজের সদস্যগণ প্রধানত সমাজসংস্কার ও দেশহিতকর কাজে আত্মনিয়োগ করেন।

বিজয়কৃষ্ণ শেষজীবন কাটান হরিভক্ত বৈষ্ণব হিসেবে। কলকাতা, পুরী প্রভৃতি অঞ্চলে তাঁর অনেক শিষ্য ছিল। নারীজাতির উন্নতি ও স্ত্রীশিক্ষার প্রতি তিনি ছিলেন বিশেষ শ্রদ্ধাশীল এবং এ উদ্দেশ্যে কেশবচন্দ্রের উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত বিদ্যালয়ে তিনি শিক্ষাকাজে যোগদান করেন। যোগসাধনাবিষয়ে তিনি প্রশ্নোত্তর নামে একটি গ্রন্থ রচনা করেন।  ১৩০৬ বঙ্গাব্দের ২২জ্যেষ্ঠ (১৮৯৯খ্রি:) বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামী পুরীতে মারা যান।