পাঠানী সামন্ত এর জীবনী

পাঠানী সামন্ত Pathani Samanta একজন ভারতীয় জ্যোতির্বিদ যিনি প্রথম পৃথিবী থেকে সূর্যের দূরত্ব একটি বাঁশের কঞ্চি এবং অন্যান্য সনাতন পদ্ধতির দ্বারা পরিমাপ করেন। তাঁর গবেষণা এবং পর্যবেক্ষণ তিনি ‘সিদ্ধান্ত দর্পণ’ নামক গ্রন্থে লিখে গেছেন। ১৮৩৫ সালের ১৩ ডিসেম্বর ওড়িশার নয়াগড় জেলার খন্ডাপাড়া গ্রামে একটি রাজপরিবারে পাঠানী সামন্তের জন্ম হয়।
তাঁর পুরো নাম ছিল মহামহোপাধ্যায় চন্দ্রশেখর সিংহ হরিচন্দন মহাপাত্র সামন্ত। তাঁর বাবার নাম ছিল শ্যামবন্ধু সিংহ সামন্ত এবং তাঁর মায়ের নাম ছিল বিষ্ণুমালি দেবী। তিনি ছোট থেকে গ্রামের এক পণ্ডিতের কাছ থেকে সংস্কৃত শিক্ষা লাভ করেন এবং তারপর ঐতিহ্যবাহী জ্যোতিষ বিদ্যা নিয়ে পড়াশোনা করেন। এছাড়াও তিনি দর্শন শাস্ত্র, সাহিত্য, পুরাণ এবং তর্কবিজ্ঞান (logic) বিষয়ে পড়াশোনা করেন।
সেই সময় তিনি আর্যভট্ট, ভাস্করাচার্য, ব্রহ্মগুপ্ত, বরাহমিহির এবং অন্যান্য জ্যোতির্বিদদের লেখা পড়তে শুরু করেন। ছোট থেকেই তাঁর তারা দেখা এবং পর্যবেক্ষণ করার নেশা ছিল। অল্প বয়স থেকেই পাঠানী সামন্ত বাঁশের কঞ্চির সাহায্যে দিনের বিভিন্ন সময় মানুষের ছায়া মাপতেন। সেই বাঁশের কঞ্চিকে তিনি ‘মান যন্ত্র’ নাম দেন। সংস্কৃতে তিনি ছিলেন অসাধারণ পারদর্শী।
তাঁর জ্ঞান আহরণের উৎস ছিল রাজপরিবারের পুঁথিঘরে রক্ষিত তালপাতায় লেখা পুরোনো সব পুঁথি। রাতের পর রাত জেগে তিনি বাঁশের চোঙা দিয়ে তৈরি দূরবীনের সাহায্যে এক একটি নক্ষত্র পর্যবেক্ষণ করতেন এবং তার নোট রাখতেন তালপাতার খাতায়। যখন তাঁর পনেরো বছর বয়স, তিনি লক্ষ্য করেন যে প্রাচীন জ্যোতির্বিদদের রচিত সিদ্ধান্ত গ্রন্থগুলিতে দেওয়া কিছু নিয়ম অনুযায়ী তারার অবস্থান তাঁর নিজের পর্যবেক্ষণের সাথে মিলছে না। একটি লম্বা বাঁশের লাঠির সাহায্যে তিনি বারবার নির্দিষ্ট তারাদের আপেক্ষিক দূরত্ব মাপতে শুরু করেন।
রাতের পর রাত জেগে পরীক্ষা করেও প্রতিবারেই অসফল হন। অন্য জ্যোতির্বিদদের সিদ্ধান্তগুলি তিনি নিজের পর্যবেক্ষণের ফলের সাথে মেলাতে পারছিলেন না। এই বিভ্রান্তি তাঁকে অস্থির করে তোলে। তাঁর মনে নানান প্রশ্ন উঁকি দিতে থাকে। দ্বাদশ শতাব্দীতে দ্বিতীয় ভাস্করাচার্যের পরের দীর্ঘ সময়ের মধ্যে ভারতে জ্যোতির্বিজ্ঞানে এই বিষয়ে তেমন কোনো পরীক্ষা নিরীক্ষা হয়নি।
সেই কারণে হয়তো প্রায় হাজার বছরের পুরোনো সিদ্ধান্তের সঙ্গে তাঁর পর্যবেক্ষণের ফল মেলেনি। কিংবা সেইসব সিদ্ধান্তে কোনো ত্রুটি ছিল। ভাস্করাচার্যের দ্বারা বর্ণিত কিছু যন্ত্রপাতির কথা তিনি পুঁথিতে পড়েন। তার সাথে নিজের উদ্ভাবনী এবং কল্পনা শক্তি প্রয়োগ করে তিনি বেশকিছু যন্ত্র তৈরি করেন। বাঁশ, কাঠের টুকরো, মোটা কাঠি, তার, লাউয়ের খোলা, ধাতুর বাটি এইসব দিয়ে তিনি যন্ত্রগুলি তৈরি করেন। সেইসব যন্ত্রের অনেকগুলিই কার্যকারিতায় পশ্চিমি জ্যোতির্বিজ্ঞানচর্চায় ব্যবহৃত যন্ত্রগুলির সমান উপযোগী ছিল।
তিনি নিজের তৈরি যন্ত্রপাতি দিয়ে মহাজাগতিক জ্যোতিঃপদার্থগুলিকে ধারাবাহিকভাবে পর্যবেক্ষণ আর বারংবার নিখুঁতভাবে মাপামাপি করতে থাকেন এবং সেই ব্যাপারে নিশ্চিত হবার পরে দৈনন্দিন পর্যবেক্ষণের ফলাফল নথিবদ্ধ করতে থাকেন। মাত্র ১৭ বছর বয়স থেকে শুরু করে ২৩ বছর বয়স পর্যন্ত তিনি এই কাজ করে যান।
পরীক্ষার ফলাফলে অগ্রজদের যে সব সিদ্ধান্তগুলি তাঁর ভ্রান্ত বলে মনে হয় সেগুলি সংশোধন করেন এবং নতুন তথ্যের সংযোজন করেন। এরপর তিনি তার পরীক্ষা-নিরীক্ষার ফলাফল পুঁথিবদ্ধ করতে শুরু করেন। ১৮৬৯ সালে ৩৪ বছর বয়সে তিনি সেই কাজ শেষ করেন। ২৫০০০ সংস্কৃত শ্লোক দিয়ে তৈরি হয় তাঁর রচিত জ্যোতির্বিজ্ঞানের পুথি ‘সিদ্ধান্ত দর্পণ’ দেন। উড়িয়া হরফে এবং কবিতার ছন্দে তিনি সেই পথে রচনা করেন। দুটি খণ্ডে তিনি সেই পুঁথিটি লেখেন তিনি। এরপর তাঁর খ্যাতি সারা ভারতবর্ষে ছড়িয়ে পড়ে।
তাঁর পান্ডিত্যের পরিচয় আধুনিক সমাজের সামনে আসার পরে পুরীর রাজা এবং কটকের ব্রিটিশ কমিশনার তাঁর পান্ডিত্যের পরীক্ষা নেওয়ার জন্য তাঁকে অনুরোধ করেন সপ্তশয্যা নামক একটি পাহাড়ের উচ্চতা মেপে দেখাতে। তিনি তাঁর মান যন্ত্রটির সাহায্যে সেই পাহাড়ের উচ্চতা নিখুঁতভাবে মেপে দেন। সামন্তরাজ্যের রাজার অনুরোধে তিনি মহেন্দ্রগিরি নামক একটি পর্বতের উচ্চতাও সঠিক নির্ণয় করে দেন। এই মাপের ফলাফল সঠিক ও যুক্তিযুক্ত কিনা তা মাদ্রাজ সরকার মেপে দেখে।
সমুদ্রে জাহাজের অবস্থান নির্ণয়ের জন্য পশ্চিমের নাবিকরা যে ‘নটিকাল আলম্যানাক’ (nautical almanac) ব্যবহার করতো তাতে বিভিন্ন নির্দেশক নক্ষত্রের অবস্থান দেওয়া থাকতো। তাঁর গোলার্ধ যন্ত্র দিয়ে নক্ষত্রের যে স্থান তিনি নির্দেশ করেন তা আধুনিক বিজ্ঞানীদের দ্বারা নির্মিত নটিকাল আলম্যানাকের সঙ্গে মিলে যায়। তাঁর কাজের মধ্যে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ ছিল চন্দ্র ও সূর্যের কৌণিক প্যারালাক্সের (parallax) পরিমাপ সঠিকভাবে নির্ধারণ করা। এই পরিমাপের উপর নির্ভর করে গ্রহণের সঠিক সময় নির্ধারণ করা সহজ হয়।
এছাড়াও তিনি কল্পিত মহাজাগতিক গোলকের (celestial sphere) নিজ নিজ কক্ষপথে গ্রহনক্ষত্রদের অবনমনের মানও নির্ণয় করেন। গ্রহণ নিয়ে তাঁর গণিতভিত্তিক অনেক ভবিষ্যৎবাণী ছিল এবং তা প্রতিবারেই মিলে গিয়েছিল। ১৮৭৪ সালে একটি সূর্য গ্রহণ নিয়ে সারা ভারতে বিজ্ঞানীদের মধ্যে হইহই পড়ে যায়। নানান যন্ত্রপাতির সাহায্যে ভারতের নানা জায়গায় সেই গ্রহণ দেখার ব্যবস্থা করা হয়।
এই গ্রহণটি যে ১৮৭৪ সালের ৯ই মার্চ ঘটবে সেটি তিনি তাঁর গাণিতিক জ্ঞানের সাহায্যে গণনা করে অনেক আগেই লিখে রাখেন এবং নিজেও সেই সূর্য গ্রহণ প্রত্যক্ষ করেন। চন্দ্রের গতি এবং বিভিন্ন সময়ের গতির গড় পার্থক্য নিয়ে কিছু ভ্রান্তি ছিল এবং চন্দ্রের সঠিক দ্রাঘিমা নির্ণয় করা যাচ্ছিল না। তিনি সেগুলি সংশোধন করেন এবং তার সঠিক দ্রাঘিমা নির্ণয় করেন। সেই কাজটি তিনি করেন নিজের আবিষ্কৃত ‘তুঙ্গভদ্র’, ‘পাক্ষিক’ এবং ‘দিগংশ’ নামে তিনটি সূত্রের সাহায্যে।
ভারতীয় জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের মধ্যে তিনিই একমাত্র ছিলেন যিনি সেই কাজটি সঠিকভাবে করতে সক্ষম হন। তার সেই কাজের ফলে ভারতীয় পঞ্জিকা খুব উপকৃত হয়েছিল। তাঁর গণিতনির্ভর পদ্ধতিতে নির্ণীত তিথি-নক্ষত্রের অবস্থানের সঠিক ফলের ভিত্তিতে তৈরি পঞ্জিকা ব্যবহৃত হত পুরীর মন্দিরে। ‘কৌতুকপঞ্জী’ নামক সেই পঞ্জিকা তাঁর রচিত ‘সিদ্ধান্ত দর্পণ’এর শেষভাগে পাওয়া যায়।
১৮৮৯ সালে, কটকের র্যাভেনশ কলেজের অধ্যাপক যোগেশচন্দ্র রায় তাঁর লেখা পুঁথিটির বিষয়বস্তুর বিশালতা দেখে বিস্মিত হন এবং তাঁর কাজের যোগ্য মর্যাদা দিতে বদ্ধপরিকর হন। যোগেশচন্দ্রের একান্ত প্রচেষ্টা আর তত্ত্বাবধানে পাঠানী সামন্ত’র অমূল্য পুঁথিটি মুদ্রিত হয়। অধ্যাপক যোগেশচন্দ্র রায় প্রথমে পুঁথিটির সংস্কৃত হরফে তর্জমা করান। তারপরে ১৮৯৫ সালে সেটি ইংরেজিতে অনুবাদ করতে শুরু করেন। ১৮৯৯ সানে কলকাতার একটি মুদ্রণ সংস্থা থেকে পুঁথিটি বই হিসেবে প্রকাশিত হয়।
বইটির শুরুতে ষাট পাতা জুড়ে যোগেশচন্দ্র ভূমিকা লেখেন। সেখানে তিনি পাঠানী সামন্ত’র জীবনী ও কৃতিত্বের বর্ণনা করেন। এই পুঁথি প্রকাশের জন্য উড়িষ্যার ময়ূরভঞ্জের এবং আত্তমালিকের রাজারা সম্পূর্ণ অর্থ সাহায্য করেন। পঞ্জিকা সংস্কার করার জন্য তাঁর নাম ইউরোপীয় বিজ্ঞানীরা জানতে পারেন। ব্রিটিশ সরকার তাঁকে তাঁর কাজের জন্য সম্মানিত করতে চায়।
১৮৯৩ সালে কটকে একটি বিশেষ কনভোকেশন (convocation) সভার আয়োজন করা হয় যেখানে তাঁকে ‘মহামহোপাধ্যায়’ উপাধি দান করা হয়। ১৮৯৯ সালে বিখ্যাত ব্রিটিশ ‘নেচার’ (Nature) পত্রিকায় এবং আমেরিকার ‘নলেজ’ (Knowledge) পত্রিকায় তাঁর কাজের ভূয়সী প্রংশসা করা হয়। ভারত সরকার তাঁর নামে ডাকটিকিট প্রকাশ করেছে। ভুবনেশ্বরে অবস্থিত উড়িষ্যার একমাত্র তারামন্ডল তাঁরই নামে নামাঙ্কিত।
এছাড়াও তাঁর নামে ‘সামন্ত চন্দ্রশেখর অ্যামেচার অ্যাস্ট্রোনমার্স অ্যাসোসিয়েশন’ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে এবং খন্ডপাড়া ও ভুবনেশ্বরে তাঁর নামে স্মৃতিপরিষদ স্থাপিত হয়েছে। এছাড়াও উড়িষ্যা সরকার পুরীতে তাঁর নামে ‘সামন্ত চন্দ্রশেখর অটোনমাস কলেজ’ নামে একটি কলেজ তৈরি করেছে। তাঁর নামে উড়িষ্যার সরকারী ও সরকারী সাহায্যপ্রাপ্ত স্কুলের ছাত্র ছাত্রীদের জন্য ‘পাঠানী সামন্ত গণিত প্রতিভা বৃত্তি’(Pathani Samanta Mathematics Talent Scholarship Scheme) রয়েছে ছাত্র ছাত্রীদের মধ্যে গণিতের প্রতি উৎসাহ বাড়ানোর জন্য।
উড়িষ্যার নানান জায়গায় তাঁর মূর্তি দেখা যায়। আগামী প্রজন্ম তাঁকে একজন মহান জ্যোতির্বিজ্ঞানী হিসেবে মনে রাখবে। পারিবারিক সূত্রে জানা যায় যে, তিনি গণনা করে নিজের মৃত্যুর তারিখ ও সময়টি জানতে পারেন। তাঁর শেষ ইচ্ছে ছিল মৃত্যুর সময় পুরীতে থাকার। সেই নির্দিষ্ট দিনের ১৬দিন আগে, তাঁর ছেলে গদাধরের সঙ্গে তিনি পুরীতে চলে যান। সেখানে সপ্তাহখানেকের মধ্যেই তাঁর জ্বর হয়। কবিরাজের কোনও ওষুধই তাকে সুস্থ করতে পারেনি। ১৯০৪ সালে ১১ জুন সাতষট্টি বছর বয়সে পাঠানী সামন্ত’র মৃত্যু হয়।