বীরভূম | পশ্চিমবঙ্গের অন্যতম একটি জেলা হল Birbhum

বীরভূম  |  পশ্চিমবঙ্গের অন্যতম একটি জেলা হল Birbhum

পশ্চিমবঙ্গের অন্যতম একটি জেলা হল বীরভূম Birbhum। বাগদী রাজা বীর মল্লের নামানুসারে এই জেলার নামকরণ করা হয়েছে।   ইতিহাসে বীরভূম জেলায় একাধিকবার ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক আন্দোলন হয়েছে। শান্তিনিকেতনে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয় এই জেলার আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন একটি প্রতিষ্ঠান। সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যে সুসমৃদ্ধ এই জেলায় একাধিক উৎসব ও মেলা অনুষ্ঠিত হয়।

শান্তিনিকেতনের পৌষমেলা ও জয়দেব কেন্দুলির বাউল মেলা সেগুলির মধ্যে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ।বীরভূমের অর্থনীতি মূলত কৃষিভিত্তিক। জেলার প্রধান কৃষিকাজ হল তুলা চাষ ও রেশম চাষ এবং শিল্পগুলি হল তাঁত বয়ন, চালকল, তৈলবীজের কল, লাক্ষা উৎপাদন, পাথর খনি, ধাতুশিল্প ও মৃৎশিল্প।  বক্রেশ্বর তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র এই জেলার একমাত্র ভারী শিল্পকেন্দ্র।বীরভূম জেলার মোট আয়তন ৪৫৪৫ বর্গকিলোমিটার। ত্রিকোণাকার এই জেলার নিচের দিকে রয়েছে অজয় নদ এবং এর শীর্ষবিন্দু স্থাপিত হয়েছে উত্তরে।

ঝাড়খণ্ড রাজ্য জেলার পশ্চিম ও উত্তর সীমান্ত বরাবর প্রসারিত। পূর্বদিকে অবস্থিত মুর্শিদাবাদ ও পূর্ব বর্ধমান জেলার কিয়দংশ। জেলাটির পশ্চিম দিকে প্রাকৃতিকভাবে তৈরী হয়েছে একমাত্র মামা ভাগ্নে পাহাড় যা দুবরাজপুর শহরের সন্নিকটে অবস্থিত। বর্তমানে এটি একটি সুপরিচিত পর্যটন স্থল। বোলপুর, রামপুরহাট ও সাঁইথিয়া এই জেলার  প্রধান শহর।  বীরভূম জেলায় অসংখ্য নদনদী প্রবাহিত হয়। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য অজয়, ময়ূরাক্ষী (মোর), কোপাই, বক্রেশ্বর, ব্রাহ্মণী, দ্বারকা, হিংলো, চপলা, বাঁশলৈ, পাগলা নদী ইত্যাদি। সিউড়ির নিকট ময়ূরাক্ষী নদীতে তিলপাড়া বাঁধ প্রকল্পের মাধ্যমে জেলার ২৪২৮ বর্গকিলোমিটার অঞ্চলে জলসেচের ব্যবস্থা করা হয়েছে।

২০০১ সালের জনগণনা তথ্য অনুসারে জেলার মোট জনসংখ্যার ৬৫ শতাংশ হিন্দু। অবশিষ্ট (৩৩.০৬ শতাংশ) মূলত মুসলমান। অন্যান্য ধর্মাবলম্বীরা জনসংখ্যার মধ্যে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছেন। ২০০১ সালের জনগণনা তথ্য অনুযায়ী, মোট জনসংখ্যার ২৯.৫ শতাংশ তফসিলি জাতি ও ৬.৭ শতাংশ তফসিলি উপজাতি। ২০১১ খ্রিস্টাব্দে ভারতের জনগণনা অনুসারে জেলাটির ৬২ শতাংশ হিন্দু ধর্মাবলম্বী এবং ৩৭ শতাংশ মুসলিম ধর্মাবলম্বী মানুষ বাস করেন৷ অন্যান্য ধর্মীয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায় জেলার জনসংখ্যার ১ শতাংশ৷ ২০১১ খ্রিস্টাব্দে ভারতের জনগণনা অনুসারে বীরভূম জেলার মোট জনসংখ্যা ৩৫,০২,৩৮৭ জন, ২০০১ থেকে ২০১১ খ্রিস্টাব্দ অবধি এই জেলার জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার ছিলো ১৬.১৫ শতাংশ৷ বীরভূম জেলার প্রতি হাজার পুরুষে ৯৫৬ জন নারী বাস করেন৷

জেলাটির সর্বমোট সাক্ষরতার হার ৭০.৯০ শতাংশ৷বাংলা এই জেলার সর্বাধিক প্রচলিত ভাষা৷ সাঁওতাল ও আরও দশটি উপজাতি এই জেলায় বাস করে। এদের মধ্যে কোড়া, মহালি ও ওঁরাও উল্লেখযোগ্য।  ২০১১ সালের সর্বশেষ জনগণনা অনুযায়ী, বীরভূম জেলার সাক্ষরতার হার ৭০.৯%। জেলায় সরকারি সাহায্যপ্রাপ্ত ১২৭টি গ্রন্থাগার, একটি বেসরকারি গ্রন্থাগার ও একটি জেলা গ্রন্থাগার রয়েছে। বীরভূম জেলা জুড়ে সরকারি , বেসরকারি মিলিয়ে বেশ অনেকগুলি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান রয়েছে।

বীরভূম জেলা জুড়ে মাধ্যমিক বিদ্যালয় রয়েছে ২৫৬ টি , উচ্চমাধ্যমিক বিদ্যালয় রয়েছে ১১০ টি, নিম্নমাধ্যমিক বিদ্যালয় রয়েছে ৯৫ টি , প্রাথমিক বিদ্যালয় ২৩৭ টি , অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্র রয়েছে ২৪০৭ টি , জুনিয়র হাই মাদ্রাসা রয়েছে ১০ টি, সিনিয়র মাদ্রাসা–৪ টি। কলেজ রয়েছে রয়েছে ১২টি , বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে ১টি , ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ রয়েছে ২ টি, পলিটেকনিক কলেজ ১টি। বীরভূমের বাউলদের গান  এই জেলার লোকসংস্কৃতির একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য।

এছাড়াও বীরভূমে অনেক কবিয়াল, কীর্তনীয়া ও অন্যান্য লোকসংস্কৃতি গোষ্ঠীর বসবাস।বীরভূমে অসংখ্য মেলা অনুষ্ঠিত হয়। এরমধ্যে সর্বাধিক প্রসিদ্ধ শান্তিনিকেতনের পৌষমেলা।  জয়দেব কেন্দুলির মেলাও এই জেলার অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি মেলা।বীরভূমে অনেক কবির জন্ম হয়েছে তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য জয়দেব, চণ্ডীদাস ও জ্ঞানদাস। বৈষ্ণব, শাক্ত ও শৈবধর্মের ত্রিবেণীসংগম বীরভূমের গ্রামগুলিতে নানান গ্রামদেবতা পূজার প্রাগৈতিহাসিক প্রথা আজও বিদ্যমান। বীরভূমের প্রধান দ্রষ্টব্যস্থলগুলির মধ্যে অন্যতম বক্রেশ্বর, তারাপীঠ ও পাথরচাপুরি।

জয়দেব কেন্দুলি, সুরুল ও নানুরের পুরনো মন্দিরগুলি তাদের টেরাকোটা  ভাস্কর্যের জন্য বিখ্যাত। বীরভূমে অনেক বিশিষ্ট মানুষ জন্মগ্রহণ করেছেন বা তাঁর কর্মজীবন অতিবাহিত করেছেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এই জেলাকে তার বাসস্থানে পরিণত করেন।নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন জন্মগ্রহন করেছেন বীরভূমে শান্তিনিকেতনে। অজয় নদের তীরে জয়দেব কেন্দুলিতে দ্বাদশ শতাব্দীর বিশিষ্ট সংস্কৃত কবি জয়দেব জন্মগ্রহণ করেছিলেন।নানুরে জন্মগ্রহণ করেন চতুর্দশ শতাব্দীর বিশিষ্ট কবি পদাবলিকার চণ্ডীদাস।

বৈষ্ণবধর্মের প্রতিষ্ঠাতা চৈতন্য মহাপ্রভুর প্রধান পার্ষদ নিত্যানন্দ স্বামী (বিখ্যাত গৌর-নিতাই যুগলের নিতাই) জন্মগ্রহণ করেন এই জেলার একচক্রা গ্রামে। আধুনিক বাংলা সাহিত্যের স্বনামধন্য কথাসাহিত্যিক তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়  এই জেলার লাভপুরে জন্মগ্রহণ করেন।বীরভূমে আটলা গ্রামে জন্মগ্রহন করেছিলেন বিখ্যাত সাধক বামাখ্যাপা। চৈতন্য গবেষক জয়দেব মুখোপাধ্যায় বীরভূম জেলার বোলপুরে জন্মগ্রহন করেন। বাংলাদেশের বৈজ্ঞানিক তথা পাকিস্তান একাডেমী অব সায়েন্সেস-এর এককালীন অধ্যক্ষ মুহম্মদ কুদরাত-এ-খুদা ১৯০০ খ্রিস্টাব্দে বীরভূম জেলাতেই জন্মগ্রহণ করেছিলেন৷

বাংলাদেশের প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি এবং পাকিস্তানের মুখ্য নির্বাচন কমিশনার আবদুস সাত্তার ১৯০৬ খ্রিস্টাব্দে এই বীরভূম জেলাতেই জন্মগ্রহণ করেন৷  শান্তিনিকেতনের  পৌষমেলা , জয়দেব কেন্দুলি মেলা বীরভূম জেলার ঐতিহ্যবাহী বিখ্যাত দুটি মেলা। এছাড়াও বীরভূম জেলায় রয়েছে বক্রেশ্বরের উষ্ণ প্রস্রবণ , বক্রেশ্বর তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র , তারাপীঠের মতো বেশ কিছু দর্শনীয় স্থান । এর মধ্যে কিছু এখানে উল্লেখ করা হল , এছাড়াও এই জেলায় রয়েছে পাহাড় ,ও অসংখ্য নদনদী । 

শান্তিনিকেতনের  পৌষমেলা : পৌষমেলা হল বীরভূম জেলার শান্তিনিকেতনে অনুষ্ঠিত একটি বার্ষিক মেলা ও উৎসব। প্রতি বছর ৭ পৌষ এই মেলা শুরু হয় এবং চলে তিন দিন ধরে। এই মেলার অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য হল বাংলা লোকসংগীতের (বিশেষত বাউল গান) অনুষ্ঠান।১৮৪৩ সালের ২১ ডিসেম্বর  দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর কুড়ি জন অনুগামীকে নিয়ে রামচন্দ্র বিদ্যাবাগীশের থেকে ব্রাহ্মধর্ম গ্রহণ করেন। এটিই শান্তিনিকেতনের পৌষ উৎসবের মূল ভিত্তি।১৮৯৪ সাল থেকে ধারাবাহিক ভাবে আয়োজিত হয়ে আসছে পৌষমেলা।

১২৬ বছরের ইতিহাসে মোট দুবার বন্ধ থেকেছে পৌষমেলা। ১৯৪৩ সালে দেবেন্দ্রনাথের দীক্ষাগ্রহণের শতবর্ষে মন্বন্তরের কারণে এবং ১৯৪৬-এ সাম্প্রদায়িক অশান্তির কারণে মেলা আয়োজন সম্ভব হয়নি। আগের বছর কোভিড পরিস্থিতির জন্য পৌষমেলা বন্ধ ছিল। পৌষ মেলা শুরু হয় ৭ পৌষ। ভোরবেলায় সানাই বাদনের আয়োজন করা হয়। বৈতালিক দল গান গাইতে গাইতে আশ্রম পরিক্রমা করে।

এরপর ছাতিমতলায় উপাসনার আয়োজন করা হয়। এরপর উপস্থিত সবাই গান গাইতে গাইতে উত্তরায়নে উপস্থিত হন। মেলা উপলক্ষে শান্তিনিকেতনে প্রায় ১০,০০০ পর্যটক সমাবেশ হয় । কেন্দুলি মেলা : বীরভূম জেলার জয়দেব কেন্দুলি গ্রামের একটি ঐতিহ্যবাহী মেলা হল জয়দেব মেলা বা জয়দেব-কেন্দুলি মেলা ।প্রতি বছর মকর সংক্রান্তির দিন পুণ্যস্নানের মাধ্যমে এই  মেলা শুরু হয়। এই মেলা মূলত বীরভূমের সংস্কৃত পণ্ডিত জয়দেবের স্মৃতি তর্পণ উদ্দেশ্যে উদযাপিত হয়।অজয় নদের পাড়ে ছোট্ট গ্রাম জয়দেব কেন্দুলি।

নদীর পাড়ে বাউল আখড়ায় বসে  জমজমাট গানের আসর। মকরস্নানের দিন থেকেই শুরু হয়ে যায় গান-বাজনা, মেলা, উৎব। কেন্দুলি গ্রামে গীতগোবিন্দের রচয়িতা কবি জয়দেবের জন্মস্থান।লক্ষ্মণসেনের সভাকবি ছিলেন তিনি। লক্ষ্মণসেনই এখানে রাধামাধব মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন।রাধাগোবিন্দের মন্দির সহ কেন্দুলিতে জয়দেবের স্মৃতিধন্য বহু দ্রষ্টব্য থাকলেও কেন্দুলির সব চেয়ে বড় পরিচয় পৌষ সংক্রান্তির মেলা, যাকে কেন্দ্র করে কেন্দুলির কথা আজ দেশের সীমানা ছাড়িয়েছে। আজ দেশের অন্যতম প্রধান মেলা হিসেবে পরিগণিত হয় এই মেলা। জয়দেব মেলা মানেই বাউল গানের আসর। প্রতিবছর এই মেলায় তৈরি করা হয় কীর্তনীয়াদের জন্য কীর্তনের আখড়া এবং বাউলদের জন্য বাউলের আখড়া। প্রায় ৩০০ টি আখড়া তৈরি করা হয় এই মেলাতে।

বক্রেশ্বর:  বীরভূম জেলায় অবস্থিত চিনপাই ও ভুরকুনা গ্রাম পঞ্চায়েতে বক্রেশ্বর তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রটি অবস্থিত।  পশ্চিমবঙ্গ বিদ্যুৎ উন্নয়ন সমবায় লিমিটেডের বক্রেশ্বর তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র হল ১,০৫০ মেগাওয়াট (৫X২১০ উৎপাদনক্ষমতা-সম্পন্ন একটি তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র। প্রতিক্ষেত্রে ২১০ মেগাওয়াট উৎপাদনক্ষমতা সম্পন্ন তিনটি ইউনিট স্থাপিত হয় ১৯৯৯ ও ২০০১ সালে।

বক্রেশ্বর বিদ্যুৎ প্রকল্প স্টেজ ২-এর অন্তর্গত নির্মীয়মান দুটি ইউনিটের প্রতিটির উৎপাদন ক্ষমতা ২১০ মেগাওয়াট এবং নির্মাণের আনুমানিক ব্যয় ধার্য হয়েছে ২,০০০ কোটি টাকা।বক্রেশ্বর নদীতে বাঁধ দিয়ে একটি জলাধার গড়ে তোলা হয়েছে। এই জলাধারটির নাম নীল নির্জন। এই জলাধার থেকে তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রের প্রয়োজনীয় জল সরবরাহ করা হয়। এছাড়া এটি পর্যটকদের কাছেও বিশেষ আকর্ষণীয় স্থান। বক্রেশ্বরের উষ্ণ প্রস্রবণ ও অজস্র মন্দিরকে ঘিরে পর্যটন শিল্প গড়ে উঠেছে।

তারাপীঠ : বীরভূম জেলার রামপুরহাট শহরের কাছে অবস্থিত একটি ক্ষুদ্র মন্দির নগরী। এই শহর তান্ত্রিক দেবী  মা তারার মন্দির ও মন্দির-সংলগ্ন শ্মশানক্ষেত্রের জন্য বিখ্যাত। এই মন্দির ও শ্মশান একটি পবিত্র তীর্থক্ষেত্র। তারাপীঠ এখানকার বামাক্ষ্যাপার জন্যও প্রসিদ্ধ।বামাক্ষেপা এই মন্দিরে পূজা করতেন এবং মন্দির-সংলগ্ন শ্মশানক্ষেত্রে কৈলাসপতি বাবা নামে এক তান্ত্রিকের কাছে তন্ত্রসাধনা করতেন। বামাক্ষ্যাপা তারা দেবীর পূজাতেই জীবন উৎসর্গ করেছিলেন। মন্দিরের অদূরেই আটলা গ্রামে তাঁর আশ্রম অবস্থিত।

উত্তরমুখী আটচালা তারা মায়ের মন্দিরটি লাল ইটে নির্মিত। উপরিভাগে শিখর পর্যন্ত একাধিক ধনুকাকৃতি খিলান উঠেছে। চারচালার ওপরে চার কোণে চারটি ছোট ছোট চূড়া অবস্থিত। মন্দিরের চূড়ায় একটি তামার পত্তাকাসহ ত্রিশীল তিনটি পদ্ম ভেদ করে উঠেছে। মন্দিরের প্রবেশপথের মধ্য খিলানেরদুর্গার প্রতিকৃতি রয়েছে। উত্তরদিকে বামপাশের খিলানের ওপর কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের ঘটনা, ভীষ্মের শরশয্যা, অশ্বত্থমা হত প্রভৃতি মহাভারতের কাহিনী উৎকীর্ণ রয়েছে।

মন্দিরের উত্তর ভিতের পূর্বদিকে সীতাহরণ, অকালবোধন, রাম ও রাবণের যুদ্ধের দৃশ্য এবং পশ্চিমদিকে কৃষ্ণলীলার চিত্র খোদিত। শিশু শিবকে স্তন্যপানরতা তারার মূল প্রস্তরমূর্তিটি একটি তিন ফুট উঁচু ধাতব মূর্তির মধ্যে রাখা থাকে। দর্শনার্থীরা সাধারণত ধাতব মূর্তিটিই দর্শন করে থাকেন। এই মূর্তিটি তারা দেবীর ভীষণা চতুর্ভূজা, মুণ্ডমালাধারিণী এবং লোলজিহ্বা মূর্তি। এলোকেশী দেবীর মস্তকে রৌপ্যমুকুট থাকে। বহির্মূর্তিটি সাধারণট শাড়ি-জড়ানো অবস্থায় গাঁদা ফুলের মালায় ঢাকা অবস্থায় থাকে। মূর্তির মাথার উপরে থাকে একটি রূপোর ছাতা। মূর্তিটির কপালে সিঁদুর লেপা থাকে। পুরোহিতেরা সেই সিঁদুরের টিকা পরিয়ে দেন দর্শনার্থীদের।

বীরভূম জেলার বোলপুর মহকুমার একটি ছোট শহর লভপুর, তারাশঙ্কর বন্দোপাধ্যায়ের আদি স্থান হিসাবে বহির্বিশ্বের কাছে পরিচিত, এই জায়গার মূল আকর্ষণ ফুল্লারা মাতার সুন্দর মন্দির। পৌরাণিক কাহিনীটি হ'ল, ফুলারার দিকে সতীর ঠোঁট কেটে দেওয়া হয়েছিল। এটি ৫১ টি পিঠা বা পবিত্র স্থানগুলির মধ্যে একটি যেখানে সতীর মৃতদেহ পড়েছিল। মন্দিরটি প্রায় ১০০ বছর পুরানো। লভপুর ফুল্লরাতলা দেবী ফুল্লারা ও ডালডালি নামে লেকের মন্দিরের জন্য বিখ্যাত। বিকল্প হিসাবে শিষ্যদের দ্বারা প্রশংসিত কচ্ছপের আকারের একটি টুকরো রয়েছে। প্রতি বছর মাঘ পূর্ণিমা চলাকালীন সময়ে ফুল্লারা মন্দিরে ১০ দিনের মেলা বসে।

কঙ্কালীতলা সতীপীঠ বোলপুরের নিকটবর্তী কঙ্কালীতলা মন্দির, বীরভূম যা শক্তি পীঠের একটি হিসাবে বিখ্যাত (এখানে মা এর কঙ্কাল / স্কেলটন মাটিতে পড়েছিল)। জায়গাটি ‘কোপাই’ নদীর তীরে অবস্থিত। কাঙ্কালীতলা বোলপুর এর লাবপুর রোডে অবস্থিত। কঙ্কালীতলা নবানী দাস বাউলের স্থান, এটি "ক্ষেপা  বাউল" নামে পরিচিত। তিনি এই অঞ্চলের অবধূতা নামে সুপরিচিত ছিলেন যেখানে তিনি তাঁর সাধনা করেছিলেন। দক্ষিণেগের পুরাণকথার গল্প এবং সতীদাহ আত্মোসরণ শক্তি পীঠগুলির পিছনে উত্সর্গের গল্প। শক্তি পীঠগুলি সতী দেবীর মৃতদেহের দেহের অংশ পড়ার কারণে গঠিত দেবীর পবিত্র বাসস্থান, যখন শিব এটি বহন করেছিলেন এবং সেখান দিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছিলেন।

সংস্কৃতের ৫১ টি বর্ণমালার সাথে সংযুক্ত রয়েছে ৫১ শক্তিপীঠ। প্রতিটি মন্দিরে শক্তি এবং কালভৈরবের মন্দির রয়েছে। মন্দিরের শক্তিটিকে "দেবগর্ভ" এবং ভৈরবকে "রুরু" হিসাবে সম্বোধন করা হয়। মনে করা হয় এখানে সতী দেবীর হাড় পড়েছে। একচক্র ধাম শ্রী নিত্যানন্দ প্রভু একচক্রে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। তাঁর পিতা-মাতা ছিলেন পদ্মাবতী এবং হদাই পণ্ডিতা। শৈশবকালে তিনি এই গ্রামে বলরামার মতো ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন। তিনি সন্ন্যাসীর সাথে কিছুকাল মথুরায় অবস্থান করেছিলেন এবং সেখানেই তিনি নবদ্বীপে শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর অতীতকাল সম্পর্কে শুনেছিলেন।

এই বিষয়টি জানতে পেরে তিনি প্রভুকে দেখতে বাংলায় এসেছিলেন। নিত্যানন্দ এসেছেন তা জেনে, চৈতন্য তাঁর ভক্তদের তাঁর কাছে প্রেরণ করলেন, এবং তাঁদের দুজনের মধ্যে বৈঠক হয়েছিল। মহাভারতে এটিও সেই জায়গা বলে বিশ্বাস করা হয় যেখানে ডেমন বকাসুরা থাকতেন যাকে পরে ভীমের দ্বারা হত্যা করা হয়েছিল। তবে পুরো ভারত জুড়ে বেশ কয়েকটি জায়গা রয়েছে যা প্রাচীন একচক্র হিসাবে প্রতিযোগিতা করে।

পাথরচপুরী গ্রাম শাহ মেহেবুব নামে পরিচিত কিন্তু সাধারনত দাদা সাহেব নামে পরিচিত একজন মুসলিম সাধককে অলৌকিক ক্ষমতা প্রদান করা হয়েছিল এবং ছাই প্রয়োগ করে তিনি বিপজ্জনক রোগ নিরাময় করতেন। তিনি বাংলা ক্যালেন্ডার অনুসারে ১০ চৈত্র ১২৯৮ এ মারা যান। সেকদদার জমিদার খান বাহাদুর পাথরছাপুরিতে মেলার সংগঠনের সূচনা করেছিলেন। জে.সি. দত্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট কর্তৃক ১৯১৮ সালে গঠিত মাজার রক্ষণাবেক্ষণ কমিটির প্রথম সভাপতি ছিলেন তিনি। ১৯৩৩ সালে, বর্ধমান রাজের বিজয়চাঁদ মাহতাব জমিটি উপহার দিয়েছিলেন।

প্রতিকৃতি বিগ্রহের নিচে গোল্কার বেদীতে দুটি রূপোর পাদপদ্ম থাকে। বীরভূম জেলা তিনটি মহকুমায় বিভক্ত:  সিউড়ি সদর, বোলপুর ও রামপুরহাট। সিউড়ি বীরভূমের জেলাসদর। জেলায় ২ টি মহিলা থানা ও একটি সাইবার থানা সহ মোট ২৭ টি থানা, ১৯টি সমষ্টি উন্নয়ন ব্লক, ৬টি পুরসভা ও ১৬৯টি গ্রামপঞ্চায়েত রয়েছে। পৌরসভা এলাকা ছাড়াও প্রত্যেকটি মহকুমা সমষ্টি উন্নয়ন ব্লকে বিভক্ত; যেগুলি আবার গ্রামীণ অঞ্চল ও সেন্সাস টাউনে বিভক্ত। সামগ্রিকভাবে এই অঞ্চলে সাতটি নগরাঞ্চল দেখা যায়: ছয়টিপৌরসভা ও একটি সেন্সাস টাউন।২০০০ সালে পৌরসভার মর্যাদা পাওয়া নলহাটি এই জেলার সাম্প্রতিকতম শহর।

২০০৬ সালের বিধানসভা নির্বাচন পর্যন্ত বীরভূম জেলা ১২টি বিধানসভা কেন্দ্রে বিভক্ত ছিল। নানুর (বিধানসভা কেন্দ্র ২৮৩), বোলপুর (বিধানসভা কেন্দ্র ২৮৪), লাভপুর (বিধানসভা কেন্দ্র ২৮৫), দুবরাজপুর (বিধানসভা কেন্দ্র ২৮৬), রাজনগর (বিধানসভা কেন্দ্র ২৮৭), সিউড়ি (বিধানসভা কেন্দ্র ২৮৮), মহম্মদবাজার (বিধানসভা কেন্দ্র ২৮৯), ময়ূরেশ্বর (বিধানসভা কেন্দ্র ২৯০), রামপুরহাট (বিধানসভা কেন্দ্র ২৯১), হাঁসন (বিধানসভা কেন্দ্র ২৯২), নলহাটি (বিধানসভা কেন্দ্র ২৯৩) ও মুরারই (বিধানসভা কেন্দ্র ২৯৪)। নানুর, রাজনগর, ময়ূরেশ্বর ও হাঁসন কেন্দ্রগুলি তফসিলি জাতির প্রার্থীদের জন্য সংরক্ষিত। উক্ত নির্বাচনটি পশ্চিমবঙ্গে সংসদীয় ক্ষেত্রগুলির সীমানা পুনর্নিধারণের আগে অনুষ্ঠিত হয়।

২০০৮ সালের ১৯ ফেব্রুয়ারি ও তার পরবর্তী সময়ে অনুষ্ঠিত নির্বাচনগুলির ক্ষেত্রে সীমানা নির্ধারণ কমিশনের সিদ্ধান্ত বলবৎ হয়েছিল। ভারতের সাধারণ নির্বাচন, ২০০৯ নবগঠিত সংসদীয় ক্ষেত্রগুলির ভিত্তিতে অনুষ্ঠিত হয়। নবগঠিত বিধানসভা কেন্দ্রগুলির নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় ২০১১ সালে। সীমানা নির্ধারণ কমিটির সুপারিশ অনুসারে এই জেলাকে বর্তমানে ১১টি বিধানসভা কেন্দ্রে বিভক্ত করা হয়েছে

দুবরাজপুর (বিধানসভা কেন্দ্র ২৮৪), সিউড়ি (বিধানসভা কেন্দ্র ২৮৫), বোলপুর (বিধানসভা কেন্দ্র ২৮৬), নানুর (বিধানসভা কেন্দ্র ২৮৭), লাভপুর (বিধানসভা কেন্দ্র ২৮৮), সাঁইথিয়া (বিধানসভা কেন্দ্র ২৮৯), ময়ূরেশ্বর (বিধানসভা কেন্দ্র ২৯০), রামপুরহাট (বিধানসভা কেন্দ্র ২৯১), হাঁসন (বিধানসভা কেন্দ্র ২৯২), নলহাটি (বিধানসভা কেন্দ্র ২৯৩) ও মুরারই (বিধানসভা কেন্দ্র ২৯৪)।

দুবরাজপুর, নানুর ও সাঁইথিয়া তফসিলি জাতি প্রার্থীদের জন্য সংরক্ষিত।পূর্বতন রাজনগর বিধানসভা কেন্দ্রটি বিলুপ্ত হয়েছে। দুবরাজপুর, সিউড়ি, সাঁইথিয়া, রামপুরহাট, হাঁসন, নলহাটি ও মুরারই বীরভূম লোকসভা কেন্দ্রের অংশ।বিশিষ্ট চলচ্চিত্রা অভিনেত্রী শতাব্দী রায় ২০০৯ সালে এই লোকসভা কেন্দ্র থেকে ভারতীয় সংসদে নির্বাচিত হয়েছেন। অন্যদিকে বোলপুর, ময়ূরেশ্বর, লাভপুর ও সাঁইথিয়া বোলপুর লোকসভা কেন্দ্রের অন্তর্গত। বর্ধমান জেলার তিনটি বিধানসভা কেন্দ্রও এই সংসদীয় কেন্দ্রের অন্তর্গত।লোকসভার প্রাক্তন অধ্যক্ষ সোমনাথ চট্টোপাধ্যায় বোলপুর লোকসভা কেন্দ্রের দীর্ঘকালের সাংসদ ছিলেন।

পানাগড়—মোরগ্রাম সড়ক এই জেলার উপর দিয়ে প্রসারিত। সকল গ্রাম ও শহর সড়কপথের দ্বারা সংযুক্ত। জেলার মোট পাকা সড়কপথের দৈর্ঘ্য ২৪১৩ কিলোমিটার ও কাঁচা রাস্তার দৈর্ঘ্য ৪৬৭৪ কিলোমিটার। এর বিপরীতে জেলার মোট রেলপথের দৈর্ঘ্য ২০১.৩২ কিলোমিটার। এর মধ্যে রয়েছে ২৬.৫৫ কিলোমিটার দীর্ঘ আহমেদপুর-কাটোয়া ন্যারো (অধুনা ব্রড গেজ)গেজ ট্র্যাক, যার সূচনা ঘটে ১৯১৭ সালে। ১৮৬০ সালে স্থাপিত পূর্ব রেলের হাওড়া-সাহিবগঞ্জ লুপ লাইনটিও এই জেলার উপর দিয়ে প্রসারিত। নলহাটি জংশনের মাধ্যমে মুর্শিদাবাদ জেলার জিয়াগঞ্জ-আজিমগঞ্জের সঙ্গে সংযোগ রক্ষা করা হয়। অন্ডাল-সাঁইথিয়া লাইনটি অন্ডালে হাওড়া-দিল্লি মেন লাইনের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে।