বীরনগর | নদিয়া জেলার একটি পৌর শহর Birnagar

বীরনগর  |  নদিয়া জেলার একটি পৌর শহর Birnagar

বীরনগর নদিয়া জেলার একটি পৌর শহর।  ২০০১ সালের আদমশুমারি অনুসারে বীরনগর শহরের জনসংখ্যা হল ২৬,৫৯৬ জন।  এর মধ্যে পুরুষ ৫১% এবং নারী ৪৯%। এখানে সাক্ষরতার হার ৭০%। পুরুষদের মধ্যে সাক্ষরতার হার ৭৬% এবং নারীদের মধ্যে এই হার ৬৫%। সারা ভারতের সাক্ষরতার হার ৫৯.৫%, তার চাইতে বীরনগর এর সাক্ষরতার হার বেশি। এই শহরের জনসংখ্যার ১১% হল ৬ বছর বা তার কম বয়সী। ব্রিটিশ শাসনামলের আগে গঙ্গাতীরবর্তী বীরনগরের নাম ছিল উলা। দস্যু দমনে স্থানীয় বাঙালী যুবকদের বীরত্ব দেখে ইংরেজরা এর নামকরণ করেছিল বীরনগর বা উলা বীরনগর। এটি নদীয়ার একটি পুরোনো জনপদ ও অন্যতম প্রাচীন পৌরসভা।

এই পৌরসভার প্রথম পৌরপিতা ছিলেন কবি নবীনচন্দ্র সেন। বর্তমানে বীরনগর, রাণাঘাট মহকুমার অন্তর্গত। এখানে জোড়বাংলা মন্দির, দ্বাদশ শিবমন্দির ও আরো কিছু সুপ্রাচীন মন্দির আছে। বীরনগরে প্রখ্যাত সাহিত্যিক রাজশেখর বসুর জন্ম হয়। উলা বা বীরনগরের ইতিহাস জানতে হলে আমাদের পেছোতে হবে মোটামুটি ৩৬০ বছর। সালটা ১৬৫৭ যখন শান্তিপুরের ‘গুরুমহাশয়’ মোহন মিত্র এবং তার আরও চার ভাই টেকা থেকে উলাতে এসে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন। তখন উলা ছিল হুগলী নদীর পূর্ব তীরের এক ছোট্ট ও অপরিচিত গ্রাম।

উলাতে সব থেকে পুরনো যে মন্দিরের খোঁজ পাওয়া যায় সেটা হল মিত্র-মুস্তাফি বাড়ির উত্তর-পূর্ব দিকে অবস্থিত বিষ্ণু মন্দির। এই বিষ্ণু মন্দিরটি নির্মাণ করিয়েছিলেন “ছোট মিত্র” বা পণ্ডিত মোহন মিত্রের ছোট ভাই কাশীশ্বর মিত্র। যদিও মন্দিরের হাল এখন খুবই খারাপ।  মিত্র বংশের খ্যাতি ও মর্যাদা চরম পর্বে পৌঁছায় রামেশ্বর মিত্রের সময়ে। রামেশ্বর মিত্র ছিলেন পণ্ডিত মোহন মিত্রের ছেলে। এক কথায় খুব শিক্ষিত ও সম্মানীয় ব্যক্তি। তখন ভারতে রাজ করছেন মুঘল সম্রাট ঔরঙ্গজেব। বাংলার গভর্নর পদে ঔরঙ্গজেবের মামা শাইস্তা খান।

রামেশ্বর মিত্র বাংলার নবাব মুর্শিদকুলী খাঁ ও শাইস্তা খানের কোষাধ্যক্ষ আবার হিসাবরক্ষকও ছিলেন। ১৭০৪ সালে নিজের কাজের পারদর্শিতার জন্যে সরাসরি মুঘল সম্রাট ঔরঙ্গজেবের কাছ থেকে ‘মুস্তাফি’ উপাধি লাভ করেন সাথে সাথে স্মারকচিহ্ন হিসাবে একটা সোনার পাঞ্জাও উপাহার পান। বর্তমানে ‘মুস্তাফি’ উপাধিটা থেকে গেলেও স্মারকচিহ্নটি কার কাছে বা কোথায় আছে সেটা জানা যায়না। বাংলার সমতলভূমির মধ্যে পাথরের যোগান সবসময়ই কম ছিল।

সুতরাং স্থাপত্যশিল্প নির্মাণের অন্য কোন মাধ্যমের সাহায্য নেওয়াই বাধ্যতামূলক হয়ে ওঠে আর তা হলো কাদামাটি যা পুড়িয়ে পোড়ামাটি তৈরি করা হতো। এটা মন্দির স্থাপত্যের নতুন উপাদান। এই উপাদানে তৈরি মন্দির অবশ্যই মন্দির স্থাপত্যেশৈলীর নতুন উন্নয়ন ও স্বতন্ত্র গড়নের। ১৬৮৪ তে এক অপরূপ চণ্ডীমণ্ডপ তৈরি করেন রামেশ্বর মিত্র মুস্তাফি। শোনা যায় যে এই চণ্ডীমণ্ডপের সৌন্দর্য দেখতে অনেক দূর দূর থেকে লোকে আসত। দৃষ্টি আকর্ষক জোড়া-বাংলা মন্দির পুরানো দিনের দ্যুতিময় ঐতিহ্যের নীরব সাক্ষী হয়ে আজও দাঁড়িয়ে আছে। ধনুকাকৃতি একটা গেটের ভেতর দিয়ে প্রথমেই পাওয়া যাবে মিত্র-মুস্তাফির বাড়ী।

ডানহাতে পড়বে চন্ডীমন্ডপ যেখানে আজও দুর্গাপুজো হয়। সেই সৌন্দর্যের নজির এখনও পাওয়া যায় নবনির্মিত চণ্ডীমণ্ডপের ভেতরে রাখা সেই সময়ের তৈরি বিনষ্ট প্রায় কাঠের স্থাপত্য দেখে। আগে চন্ডীমন্ডপের ছাদ কাঠের ছিল কিন্তু বর্তমানে টিনের শীট লাগিয়ে ছাওয়া হয়েছে। খানিকটা গিয়েই দেখা যাবে জোড়া-বাংলা মন্দির যেখানে তিনটি ধনুকাকৃতি প্রবেশদ্বার আছে ও সামনের দিকে অনেক টেরাকোটার প্যানেল আছে যার মধ্যে কৃষ্ণলীলা, রামায়ন, দেবদেবীর সামাজিক জীবনের ছবি উল্লেখযোগ্য। রামেশ্বর মিত্র মুস্তাফির আর এক সৃষ্টি হল মিত্র-মুস্তাফি বাড়ির রাধা-কৃষ্ণ মন্দির। তখন বাংলায় ‘একবাংলা’ বা ‘দোচালা’ মন্দিরের চল ছিল।

১৬৯৪ সালে রামেশ্বর তৈরি করান জোড়া বাংলা স্টাইলের রাধা-কৃষ্ণ মন্দির যা শুধু তখনকার দিনেই নয় এখনও খুব কম দেখা যায় বাংলাতে। মুস্তাফিদের এই রাধা-কৃষ্ণের মন্দির ছাড়া পশ্চিমবঙ্গের একমাত্র বিষ্ণুপুরে এই জোড়া বাংলা স্টাইলের মন্দির দেখা যায় যা ১৬৫৫ সালে তৈরি করেন মল্লভুমের রাজা রঘুনাথ সিংহ দেব। সাধারণত দুটি দোচালা ঘর পাশাপাশি তৈরি করে এই শৈলীর মন্দির নির্মাণ করা হত। সামনের দোচালা ঘরটি হল নাটমন্দির আর পেছনের দোচালা ঘরটি হল মন্দিরের গর্ভগৃহ। এক কথায় বাংলার এক অনন্য নির্মাণকৌশল। পরবর্তী কালে মিত্র-মুস্তাফি পরিবার ভেঙ্গে যায় তিনভাগে।

রামেশ্বরের জ্যেষ্ঠ পুত্র বা রঘুনন্দন মিত্র মুস্তাফি ১৭০৮ সালে চলে আসেন হুগলী নদীর পশ্চিম পারের শ্রীপুরে, চতুর্থ পুত্র বা অনন্তরাম মিত্র মুস্তাফি ১৭১২ সালে চলে আসেন হুগলী নদীর পশ্চিম পারেরই সুখরিয়াতে আর বাকি পরিবার থাকতে লাগেন উলা বা বিরনগরেই। পরবর্তীকালে ১৭৪৪ সালে মিত্র-মুস্তাফি বংশের শিবরাম মুস্তাফি বীরনগরে তৈরি করান দ্বাদশ শিব মন্দির।  এই উলা নামের সাথে মনসামঙ্গল কাব্যের যোগ আছে। চাঁদ সওদাগর যখন বাণিজ্য তরী নিয়ে বাণিজ্যে বের হন তখন উলার কাছে এসে তাঁর বজ্রা একটি ছোট পাথরে আটকে যায় তখন তিনি দেবী চন্ডীর দৈব্যাদেশ পান এবং নদীর তীরেই ছোট একটি পাথরে দেবী চন্ডীর পূজা করেন। তারপর থেকেই উলা গ্রামের দেবী চন্ডী উলাই চন্ডী নামে পরিচিত হন।

অনেকের মতে অষ্টাদশ শতকের মাঝামাঝি সময় বৈদ্যনাথ এবং বিশ্বনাথ নামে দুই কুখ্যাত ডাকাত ও তাদের দলবল হামলা করে উলার মহাদেব মুখার্জী নামে এক সম্ভ্রান্ত ব্যক্তির বাড়িতে। কিন্তু মহাদেব মুখার্জীর পরিকল্পনা ও বীর বিক্রমের কাছে তারা হেরে যায়। দুই ডাকাত সর্দার বৈদ্যনাথ এবং বিশ্বনাথের মৃত্যু হয়। বাকি ডাকতদের জেল হয় ও পরবর্তীকালে মৃত্যুদণ্ড হয়। আবার নদীয়া জেলা গেজেট অনুযায়ী ১৮৩৫ সালে মিত্র-মুস্তাফি বংশের আনন্দীনাথ মিত্র মুস্তাফি কুখ্যাত ডাকাত শিবেশানীকে হত করেন। মহাদেব মুখার্জীর বীরত্বের কারণেই হোক বা আনন্দীনাথ মিত্র মুস্তাফির বীরত্বের কারণেই হোক তৎকালীন ইংরেজ কর্তারা উলার নাম রাখেন বীরনগর।

বাংলা সাহিত্যেও এই স্থানের উল্লেখযোগ্য গুরুত্ব রয়েছে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ছোট গল্প “পোস্টমাস্টার” গল্পে এই জায়গার উল্লেখ রয়েছে। তাছাড়াও প্রখ্যাত সাহিত্যিক রাজশেখর বসুরও (পরশুরাম) জন্মস্থান এই জায়গাটি। মিত্র-মিস্তাফিরা শীঘ্রই বড় বড় অট্টালিকা ও মন্দির স্থাপন করতে শুরু করেন ফলে গ্রাম্য উলা ছোট হলেও বর্ধিষ্ণু জনপদে পরিণত হয়। হুগলী নদীর গতিপথ পরিবর্তন হওয়ার সাথে সাথে উলা তার শ্রী হারায়। উলার পতনের আরও অগ্রগতি হয় যখন মিত্র-মুস্তাফি পরিবার তাঁদের বাসস্থান হুগলীর সুখারিয়া ও শ্রীপুরে নিয়ে আসেন।

উলার সোনালী দিনগুলো একেবারে শেষ হয়ে গেল 1857 সালের মহামারীর প্রাদুর্ভাবে। আজ এই একবিংশ শতাব্দীর আধুনিকতার ধাক্কায় বীরনগর অনেকটাই ম্লান।বীরনগর কোলকাতা থেকে ৯০ কিলোমিটার এবং জেলা সদর কৃষ্ণনগর থেকে ২২ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত একটি প্রাচীন গ্রাম বা আধাশহর। নদীয়া জেলার সবথেকে পুরনো পৌরসভার বীরনগর পৌরসভা ।  বীরনগর পৌরসভার প্রথম চেয়ারম্যান ছিলেন কবি নবীনচন্দ্র সেন। বীরনগর পৌরসভার ১৪ টি ওয়ার্ড রয়েছে।

বীরনগর পৌরসভার মোট প্রশাসন 6,2০২ টিরও বেশি বাড়ি রয়েছে যেখানে এটি জল এবং নিকাশী জাতীয় মৌলিক সুযোগ-সুবিধা সরবরাহ করে। এটি পৌরসভা সীমার মধ্যে রাস্তা তৈরি এবং এর অধীনে আসা সম্পত্তিগুলিতে শুল্ক আরোপ করার জন্য অনুমোদিত। রানাঘাট উত্তর পশ্চিম (বিধানসভা কেন্দ্র) ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের নদিয়া জেলার একটি বিধানসভা কেন্দ্র। বীরনগর পৌরসভা। বীরনগরে (এম), বেশিরভাগ (এম) আরএসের তফসিলি বর্ণ (এসসি) থেকে। তফসিলি জাতি (এসসি) হ'ল ৩৫.৪০%, তফসিল উপজাতি (এসটি) বীরনগর (এম) এর মোট জনসংখ্যার ০..6৫%। পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য গড় 956 এর তুলনায় বীরনগরে শিশু লিঙ্গের অনুপাত ৯৪৩ এর কাছাকাছি।