ববি ফিশার এর জীবনী

ববি ফিশার এর জীবনী

ববি ফিশার (Bobby Fischer) একজন আমেরিকান কিংবদন্তি দাবাড়ু যিনি দাবার জগতে তাঁর অসামান্য প্রতিভা প্রদর্শনের কারণে বিশ্বে বিখ্যাত হয়ে আছেন। তাঁকে দাবার ইতিহাসে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ দাবাড়ু বলে মনে করা হয়ে থাকে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এই দাবাড়ু মাত্র তেরো বছর বয়সে জিতেছিলেন “গেম অব দ্য সেঞ্চুরি” নামে খ্যাত দাবা টুর্নামেন্ট, চোদ্দ বছরে আমেরিকার সর্বকনিষ্ঠ দাবা চ্যাম্পিয়ন হন এবং পনেরো বছর বয়সে তৎকালীন সময়ের পৃথিবীর সর্বকনিষ্ঠ গ্র্যান্ড মাস্টার হন।

১৯৭২ সালে আইসল্যাণ্ডের প্রখ্যাত দাবাড়ু বরিস স্পাস্কিকে হারিয়ে সোভিয়েত রাশিয়ার প্রতিবারের বিশ্ব চ্যাম্পিয়নের মুকুট ছিনিয়ে এনেছিলেন তরুণ ববি ফিশার৷ দাবা খেলায় অসামান্য প্রতিভার অধিকারী হলেও ব্যক্তিগত ঔদ্ধত্য আচরণ এবং বারংবার বিতর্কিত মন্তব্যের জেরে সমালোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে উঠে এসেছেন কিংবদন্তী এই দাবাড়ু৷ কিংবদন্তী দাবাড়ু ববি ফিশারের জীবনকে কেন্দ্র করে ২০১৪ সালে হলিউডে তৈরি হয় ‘পন স্যাক্রিফাইস’ চলচ্চিত্রটি৷ ১৯৪৩ সালের ৯ মার্চ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগো শহরের ইলিনয়েসে জন্ম হয় ববি ফিশারের৷

তাঁর আসল নাম রবার্ট জেমস ববি ফিশার। তাঁর মা রেজিনা ওয়েন্ডার ফিশার পেশায় ছিলেন মেডিসিন বিভাগের একজন চিকিৎসক এবং শিক্ষক। ঔষধশাস্ত্রে পি.এইচ.ডি ডিগ্রিধারী অসম্ভব শিক্ষিত এই মহিলা ছয়টি ভাষায় পারদর্শী ছিলেন। ফিশারের প্রকৃত বাবা কে, তা নিয়ে অবশ্য গবেষকদের মধ্যে মতান্তর রয়েছে৷ সরকারি নথি অনুযায়ী, ববির বাবা গণিতবিদ ও পদার্থবিজ্ঞানী হান্স গেরহার্ড।

পরবর্তীকালে প্রমাণিত হয়, ববি ফিশারের জন্মদাতা বাবা (Biological Father) হাঙ্গেরির গণিতবিদ ও ইহুদি পদার্থবিজ্ঞানী পল নেমেন্‌য়ি।ইলিনয়েসে জন্ম হলেও নিউ ইয়র্কের ব্রুকলিন শহরে বড়ো হন ববি। ছ’বছর বয়সে দাবার বোর্ডের সঙ্গে থাকা নির্দেশিকা দেখে দাবার চালগুলি রপ্ত করার মধ্যে দিয়ে খেলার হাতে খড়ি তাঁর৷ তাঁর দাবা খেলার সঙ্গী ছিলেন বোন জোয়ান এবং পরবর্তীকালে তাঁর মা রেজিনা৷ ববি ফিশারের শিক্ষাজীবন শুরু হয় ব্রুকলিনের ইরাসমাস হল হাই স্কুলে। কিন্তু ষোলো বছর বয়সে অতিরিক্ত দাবায় মনোযোগের কারণে স্কুল থেকে বিতাড়িত হন তিনি।

ফলে তাঁর প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা অসম্পূর্ণই থেকে যায়। প্রথাগত শিক্ষা অপূর্ণ থাকলেও নিজ চেষ্টায় অনেকগুলি ভাষা শেখেন ববি ফিশার যাতে তিনি দাবা সংক্রান্ত সম সাময়িক বিদেশী পত্রিকাগুলি পড়তে পারেন। ববি ফিশারের কর্মজীবনের পুরোটা জুড়েই শুধু দাবা। বিশ্বসেরা দাবাড়ু হিসেবেই তিনি নিজের পরিচিতি গড়ে তুলেছেন।

সেই প্রেক্ষিতে বলা যায়, মাত্র ৯ বছর বয়সে শিকাগো শহরের স্থানীয় দাবা টুর্নামেন্টে অংশগ্রহণের মাধ্যমেই তাঁর প্রতিভার বিকাশ ও পরিচিতির সূত্রপাত।শিকাগো শহরের একটি প্রদর্শনীতে দাবা খেলার সময় আমেরিকার জনৈক দাবা বিশেষজ্ঞ এবং ব্রুকলিন দাবা ক্লাবের সভাপতি কারমাইন নিগ্রো ১১ বছর বয়সী ববিকে দাবা ক্লাবের সদস্যপদ দেন এবং নিজ দায়িত্বে দাবার প্রশিক্ষণ দিতে থাকেন৷ ১৯৫৬ সালে ববি ফিশার যোগ দেন হথ্রোন দাবা ক্লাবে (Hawthrone Chess Club)।

আর আশ্চর্যজনকভাবে ঐ বছরই মাত্র তেরো বছর বয়সে ফিলাডেলফিয়া শহরে অনুষ্ঠিত একটি দাবা টুর্নামেন্টে আমেরিকার কনিষ্ঠ দাবা চ্যাম্পিয়নের খেতাব জেতেন ববি ফিশার৷ এরপর একে একে ওকলাহোমা, ওয়াশিংটন ডি.সি শহরে অনুষ্ঠিত দাবা চ্যাম্পিয়নশিপে ববি যোগ দিতে থাকেন এবং একের পর এক সাফল্য অর্জন করতে থাকেন। ১৯৫৬ সালেই নিউ ইয়র্কে লেসিং.জে.রোসেনওয়াল্ড ট্রফি টুর্নামেন্টে বিখ্যাত আন্তর্জাতিক দাবাড়ু ডোনাল্ড বায়ার্ন কে পরাজিত করেন।

এই ম্যাচটিকে বলা হয় ‘গেম অফ দ্য সেঞ্চুরি’ কারণ এই ম্যাচটিতে ববি তাঁর মন্ত্রীকে বিসর্জন দেন প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে অপ্রতিরোধ্য আক্রমণ হানার জন্য। ১৯৫৭-’৫৮ সালে আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র চ্যাম্পিয়নশিপে তিনি মাত্র এক পয়েন্টের ব্যবধানে যুক্তরাষ্ট্রের যুব শিরোপা ছিনিয়ে নেন। তাঁর এই জয় আন্তর্জাতিক স্তরে তাঁকে পরিচিত করে তোলে এবং তখন থেকেই ববি ফিশার আন্তর্জাতিক মাস্টার হিসেবে খ্যাত হন। এরপর ১৯৫৭ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নে পা রাখেন ববি ফিশার।

প্রথমে তাঁর মা রেজিনা ফিশারের অনুরোধে তৎকালীন সোভিয়েত নেতা নিকিতা ক্রুশ্চেভ ‘বিশ্ব যুব দাবা উৎসব’-এ আমন্ত্রণ জানান ববি ফিশারকে। যদিও সেই বছর আমন্ত্রণপত্র দেরিতে পৌঁছনোর কারণে এবং বিমানের খরচ না দিতে পারায় ববির সোভিয়েত-যাত্রা স্থগিত হয়। কিন্তু পরের বছর মস্কোতে এসে স্থানীয় একাধিক দাবা প্রতিযোগিতায় অনূর্ধ্ব মাস্টারদের পরাজিত করে ক্রমেই অপ্রতিরোধ্যভাবে খ্যাতির শিখরে উঠতে থাকেন তিনি৷ এই সময় ববি তৎকালীন বিশ্বখ্যাত চ্যাম্পিয়ন মিখাইল বটভিনিকের সঙ্গে খেলতে চাইলে তা নাকচ করে দেওয়া হয়।

এখানেই একটি বিতর্কিত ঘটনা ঘটান ববি। সোভিয়েত ইউনিয়ন পরপর ববির সমস্ত প্রস্তাব নাকচ করে দেওয়ায়, ক্ষুব্ধ হয়ে জনসমক্ষেই ববি রাশিয়ানদের ‘শুকর’-এর সঙ্গে তুলনা করেন যা নিয়ে প্রবল সমালোচনার মুখেও পড়তে হয় তাঁকে৷ সোভিয়েতবাসীরাও তাঁর উপর অত্যন্ত রুষ্ট হন। ১৯৫৯ সালে যুগোস্লোভিয়ায় ক্যাণ্ডিডেট টুর্নামেন্টে আটটির মধ্যে পাঁচটি ম্যাচে জয়লাভ করেন তিনি। ১৯৫৭ সাল থেকে শুরু করে ১৯৬৭ সাল পর্যন্ত তিনি মোট আটবার আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র চ্যাম্পিয়নশিপ খেলেন যার প্রতিটিতেই তিনি জয়লাভ করে তাঁর অবিশ্বাস্য প্রতিভার নিদর্শন রাখেন!

মূলত এই সময় থেকেই মানসিক অস্থিরতা বাড়তে থাকে তাঁর। স্কুল থেকে বিতাড়িত হয়ে ষোলো বছর বয়স থেকে মায়ের সঙ্গে থাকতে অস্বীকৃত হন ববি। শুধুই দাবাকে জীবনে গুরুত্ব দেওয়ায় মায়ের সঙ্গে অশান্তি শুরু হলে তিনি আদালতে ‘অনধিকার চর্চা ও মতের ভিন্নতা’র অভিযোগ আনেন মায়ের বিরুদ্ধে৷ শেষমেশ ববির জেদের কাছে হার মেনে তাঁর মা রেজিনা পৃথকভাবে ওয়াশিংটন ডি.সিতে বসবাস করা শুরু করেন আর নিউইয়র্কে একাকী থাকা শুরু করেন ববি৷

১৯৬৮ সালে সোভিয়েত গ্র্যান্ডমাস্টার মার্ক তাইমোনোভের আহ্বানে খেলায় নেমে তাঁকে চূড়ান্তভাবে পরাজিত করেন ববি ফিশার। কিন্তু এরপর ববিরও পরাজয় লুকিয়ে ছিল। দুর্দমনীয় দাবাড়ু ববি প্রথমবার পরাজিত হন জার্মানিতে অনুষ্ঠিত ১৯তম দাবা অলিম্পিয়াডে সোভিয়েত ইউনিয়নের তৎকালীন শ্রেষ্ঠ দাবাড়ু বরিস স্পাস্কির কাছে। প্রথম ম্যাচে হারার পর অদ্ভুত কিছু শর্ত আরোপ করেন ববি যার মধ্যে দর্শকাসনের প্রথম সারি ফাঁকা রাখা, নিজের জন্য বিশেষ আরাম কেদারা, বর্ধিত পুরস্কারমূল্য, ক্যামেরা ও সংবাদমাধ্যমের অনুপস্থিতি এবং দাবার বোর্ড পরিবর্তন ছিল সত্যই আশ্চর্য।

আরো আশ্চর্যের বিষয় হল প্রথমদিকে কিছু শর্ত মানতে নারাজ ছিলেন সোভিয়েত কর্তৃপক্ষ, ফলে তিনটি ম্যাচে পরাজিত হন ববি ফিশার। কিন্তু তার পর থেকে সমস্ত শর্ত মানা হলে পরপর মোট আটটি ম্যাচের মধ্যে ৬টিতে জয়লাভ করে বরিস স্প্যাস্কিকে পরাজিত করেন তিনি। এই ম্যাচ তৎকালীন বিশ্ব পরিস্থিতির নিরিখেও খুবই গুরুত্বপূর্ণ ছিল কারণ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সোভিয়েত ইউনিয়নের সেসময় ঠাণ্ডা লড়াই চলছিল, ফলে দু পক্ষেই উত্তেজনা ছিল চরমে।

এই ম্যাচ জিতে সোভিয়েত ইউনিয়নের বহুদিনের দাবা চ্যাম্পিয়নশিপ জয়ের রেকর্ড ভেঙে ববি ফিশার প্রথমবার বিশ্ব দাবা চ্যাম্পিয়নের খেতাব পান। এর পর দীর্ঘ ২০ বছর আর তিনি কোনো দাবার ম্যাচ খেলেননি। ১৯৭৫ সালে যুগোস্লোভিয়ার দাবাড়ু আনাতোলি কারপভের সঙ্গে খেলতে নেমে ১৭৯টি অদ্ভূত শর্ত জুড়ে দিয়েছিলেন ববি এবং সেইজন্য তাঁর ওপর নেমে এসেছিল যুক্তরাষ্ট্রীয় নিষেধাজ্ঞা৷ ১৯৯২ সালে যুক্তরাষ্ট্রের সেই নিষেধাজ্ঞা উড়িয়ে ফিশার আবার বরিস স্পাস্কির মুখোমুখি হন সার্বিয়ায়।

ফলশ্রুতিতে তাঁর বিরুদ্ধে জারি হয়েছিল গ্রেফতারি পরোয়ানা৷ নানা সময় বিতর্কিত মন্তব্য করে সমালোচনার মুখে পড়েছেন ববি ফিশার। কখনো ইহুদী-বিরোধী মন্তব্য, কখনো নারীবিদ্বেষী মনোভাব পোষণ করে তিনি প্রবল নিন্দিত হয়েছেন। আবার ৯/১১-র হামলার পরে আমেরিকার ধ্বংসকামনা করে মন্তব্য করলে সমগ্র মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ক্ষোভের সঞ্চার হয়। মনোরোগ বিশেষজ্ঞ রুবেন ফাইবেনের মতে, তাঁর মধ্যে অ্যাসপারগাস সিণ্ড্রোম এবং ব্যক্তিত্ব-সংকটের মতো জটিল মানসিক ব্যাধি ছিল।

দাবার জগতে ববি ফিশারের অবদান ছড়িয়ে আছে তাঁর লেখা বইগুলির মধ্যে। ১৯৫৯ সালে তাঁর খেলার সংকলনের প্রথম বই প্রকাশ পায় ‘ববি ফিশার’স গেমস অফ চেস্‌’ (Bobby Fischer’s Games of Chess)। এরপর একে একে ‘দ্য রাশিয়ানস হ্যাভ ফিক্সড ওয়ার্ল্ড চেস’ (১৯৬২), ‘দ্য টেন গ্রেটেস্ট মাস্টার্স ইন হিস্টরি’ (১৯৬৪), ‘ববি ফিশার টিচেস চেস’ (১৯৬৬), ‘মাই সিক্সটি মেমোরেব্‌ল গেমস’ (১৯৬৯) বইগুলি প্রকাশিত হয়। এছাড়া খেলায় তাঁর বিশেষ ওপেনিং থিওরি এবং এণ্ড গেম থিওরি এখন বিশ্বের সর্বত্র কিংবদন্তীতে পরিণত হয়েছে।

দাবা খেলার জন্য এক বিশেষ প্রকারের ঘড়ি তৈরির পেটেন্ট ফাইল করেন ববি ফিশার ১৯৮৮ সালে। এই ফিশার ক্লক প্রথম ব্যবহৃত হয় বরিস স্প্যাস্কির সঙ্গে দ্বিতীয় ম্যাচে। এছাড়া ফিশারাণ্ডম্‌ (Fischerandom) নামে এক নতুন ধরনের দাবার ম্যাচের প্রচলন করেছিলেন তিনি। তাঁকে নিয়ে ২০১৪ সালে হলিউডে তৈরি হয় ‘পন স্যাক্রিফাইস’ চলচ্চিত্রটি৷ আরো আগে ১৯৯৩ সালে ‘সার্চিং ফর ববি ফিশার’ নামে প্রথম তাঁর জীবনকে ঘিরে একটি চলচ্চিত্র নির্মিত হয়েছিল। এছাড়াও বহু তথ্যচিত্র নির্মিত হয়েছে তাঁকে কেন্দ্র করে।     ২০০৮ সালের ১৭ জানুয়ারি কিডনির জটিল অসুখে ৬৪ বছর বয়সে ববি ফিশারের মৃত্যু হয়।