বুনো রামনাথ| বাংলার প্রখ্যাত পন্ডিত রামনাথ তর্কসিদ্ধান্ত
প্রাচীন ভারতের তক্ষশীলা, কাশী, মথুরা, মিথিলা, নবদ্বীপকে বলাহতো পাশ্চাত্যের অক্সফোর্ড । এই সব শহরই বিশ্ববিদ্যালয় নগরী হিসেবে খ্যাতিও লাভ করে। নবদ্বীপে সেই খ্যাতির অঙ্গ ছিলেন রামনাথ তর্কসিদ্ধান্ত। যাঁর কাছে নানা জায়গা থেকে ছাত্রেরা পড়তে আসতেন। তিনি পাঠদানের মধ্যে দিয়েই নতুন পাঠ তৈরি করতেন। এই ছিল এক গৌরবের কথা। সমাজের জন্য সুনাগরিক তৈরি করে দেওয়া।রামনাথ তর্কসিদ্ধান্ত, যিনি বুনো রামনাথ হিসেবেই অধিক প্রসিদ্ধ, অষ্টাদশ শতাব্দীর নবদ্বীপের বিশিষ্ট নৈয়ায়িক, পণ্ডিত ও এবং আদর্শ শিক্ষক।
তিনি নবদ্বীপে একটি বনে চতুষ্পাঠী স্থাপন করেছিলেন। তাঁর চতুষ্পাঠী বনের মধ্যে অবস্থিত হওয়ায় তাঁকে 'বুনো' বলা হতো।রামনাথ তর্কসিদ্ধান্তের Ramnath Tarkasiddhanta জন্ম হয় ১৭৭০ সালে। তাঁর জন্মস্থান সম্পর্কে ইতিহাসবিদদের মধ্যে মতভেদ দেখা যায়। ডঃ অলোক কুমার চক্রবর্তীর মতে তিনি ধাত্রিগ্রামের ভট্টাচার্যবংশীয় অভয়রাম তর্কভূষণের পুত্র ছিলেন। যজ্ঞেশ্বর চৌধুরী সমুদ্রগড়ে রামনাথের জন্মস্থান হিসেবে বলেছেন। তাঁর বাবার নাম ছিল অভয়রাম তর্কভূষণ। রামনাথের জন্ম খুবই সাধারণ পরিবারে হয়েছিল।
তাঁর ভাইয়ের নাম ছিল চন্দ্রনাথ। তাঁর পিতা তাঁকে নবদ্বীপের সর্বপ্রধান নৈয়ায়িক রামনারায়ণ তর্কপঞ্চাননের গুরুকুল চতুষ্পাঠীতে ভর্তি করে দেন। তিনি গুরুকুলের অত্যন্ত মেধাবী ছাত্র ছিলেন এবং পাঠ শেষে ‘তর্কসিদ্ধান্ত’ উপাধি লাভ করেন। সেই সময়ের নিয়ম ছিল পড়াশোনা শেষ হয়ে গেলে রাজার দরবারে গিয়ে নিজের বিদ্যার পরিচয় দিয়ে রাজাকে সন্তুষ্ট করে টোল খোলার জন্য জমি জমা এবং অর্থ সাহায্য নেওয়া। কিন্তু রামনাথ রাজার অনুগ্রহ নিতে চাননি। তাই তিনি নবদ্বীপের কাছে একটি জঙ্গলে নিজের টোল খোলেন।নিজের স্ত্রী ও কতিপয় ছাত্রকে নিয়ে তাঁর বনচারী জীবন চলত। এই বনে টোল খুলেছিলেন বলেই সম্ভবত তাঁর নাম হয়েছিল ‘বুনো রামনাথ’। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য সেই সময় আরেকজন রামনাথ পন্ডিত ছিলেন যিনি গ্রামে থাকতেন বলে নাম হয়েছিল ‘গেঁয়ো রামনাথ’।
তবে কোনো কোনো গবেষক মনে করেন যে তাঁর বাড়ি সহজপুর গ্রামে ছিল এবং তাঁর বাড়ির পাশে বুনো নামক একটি পুকুর ছিল। সেই পুকুরের নামে নিজেকে তিনি বুনো রামনাথ বলে আখ্যা দিয়েছেন। আজও সেই পুকুরটি সহজপুর গ্রামে বর্তমান। বুনো রামনাথ নিজের জ্ঞান চর্চা এবং ছাত্রদের পড়ানো নিয়েই থাকতেন। সেই সময়ের নিয়ম অনুযায়ী টোলে যেসব ছাত্ররা পড়াশোনা করতে আসত তাদের ভরণ পোষণের দায়িত্ব শিক্ষকদের নিতে হত, কিন্তু তাঁর সেই সামর্থ্য না থাকায় তিনি কয়েকটি শিষ্যের মধ্যে তাঁর শিষ্য সংখ্যা সীমায়িত রাখতে চাইতেন।কিন্তু তাঁর বিদ্যাদানের পদ্ধতি এত সুন্দর ছিল যে সহজেই তাঁর কথা দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে ও অনেকেই তাঁর শিষ্যত্ব নিতে চায়।
তাঁদের বিরত করতে চাইলে সেই সব ছাত্ররা নিজেদের আহারের ব্যবস্থা নিজেরা করত এবং তাঁর কাছে শিক্ষাগ্রহণ করত। তিনি অতি অল্প সময়ের মধ্যেই আদর্শ শিক্ষকের আসন লাভ করেন। বুনো রামনাথ চার খণ্ডে চিন্তামণি শাস্ত্র রচনা করেছিলেন। রামনাথ নিঃসন্তান থাকলেও তাঁর ছাত্রদেরই তিনি সন্তান জ্ঞানে পালন করতেন। রামনাথ সারাদিন জ্ঞানার্জনেই মগ্ন থাকতেন এবং সংসারের দিকে তাঁর কোন খেয়াল থাকত না। কেউ কোন দান ধ্যান করতে চাইলেও তিনি তা সহজে গ্রহণ করতে চাইতেন না।ফলে তাঁকে বেশ কষ্টে দিন কাটাতে হয়েছে। তাঁর সম্পর্কে অনেক গল্প ছড়িয়ে আছে। তার কোনোটা সত্যি আবার কোনোটা হয়ত মন গড়া।
একবার কলকাতায় রাজা নবকৃষ্ণদেবের বাড়িতে এক দিগ্বিজয়ী পন্ডিত আসেন ও সেই উপলক্ষ্যে একটি তর্ক সভার আয়োজন করা হয়। সেই সভায় ত্ৰিবেণীর জগন্নাথ তর্কপঞ্চানন, নবদ্বীপের নৈয়ায়িকশ্ৰেষ্ঠ শিবনাথ বাচস্পতি প্রমুখ পণ্ডিতগণ উপস্থিত ছিলেন; কিন্তু দিগ্বিজয়ীর প্রশ্নের উত্তর দিতে সকলে অক্ষম হন। সেই সময় রামনাথ তর্কসিদ্ধান্ত সেই সভায় গিয়ে দিগ্বিজয়ী পন্ডিতের বিরুদ্ধে এমন সব যুক্তি পেশ করেন যাতে সেই পন্ডিত পরাজয় স্বীকার করেন। ফলত নবদ্বীপ তথা বাংলার মান রক্ষা পায়। এরপর রাজা নবকৃষ্ণদেব তাঁকে প্রচুর ধন-সম্পদ দিতে চাইলে তিনি তা তাচ্ছিল্যের সঙ্গে প্রত্যাখ্যান করেন। তাঁদের সংসারে অভাব লেগেই থাকত। একদিন তিনি টোলে যাওয়ার সময় তাঁর স্ত্রী তাঁকে বলেন যে ঘরে খাওয়ার মতন ভাত ছাড়া আর কিছুই নেই। তিনি অন্যমনস্কভাবে ঘরের বাইরে তেঁতুল গাছের দিকে একবার তাকিয়ে অন্য কথা ভাবতে ভাবতে টোলে চলে যান।
এরপর দুপুরে যখন তিনি বাড়ি ফিরে আসেন তখন তাঁর স্ত্রী তাঁকে ভাতের সাথে তেঁতুল পাতার ঝোল খেতে দেন। তিনি সেই খাবার খেয়ে তাঁর স্ত্রীকে জিজ্ঞেস করেন সেই অপূর্ব খাবার তিনি কী দিয়ে বানিয়েছেন। তাঁর স্ত্রী তখন অবাক হয়ে তাঁকে বলেন যে তিনি বেরোবার আগে তেঁতুল গাছের দিকে ইশারা করে গেছিলেন, তাই তিনি তেঁতুল পাতার ঝোল বানিয়েছেন। রামনাথ তখন আনন্দে আত্মহারা হয়ে তাঁর স্ত্রীকে বলেন যে এরপর থেকে তিনি তেঁতুল পাতার ঝোলই খাবেন। যেহেতু তেঁতুল গাছের পাতার অভাব নেই তাই তাঁদের আর খাদ্যের অভাব হবে না। এই ধরনের অনেক কিংবদন্তি বুনো রামনাথকে নিয়ে জড়িয়ে রয়েছে। তাঁর শাস্তিদানের পদ্ধতিও অন্যরকম ছিল। যেমন তাঁর ছাত্র গোবিন্দচন্দ্র ন্যায়তীর্থ কেমন শাস্তি পেয়েছিলেন তা জানিয়েছিলেন। কৃষ্ণনগরের বারো দোলের মেলা উপলক্ষ্যে তিনদিন ছুটি থাকত।
ছুটির পর পাঠ না করে যাওয়ায় গোবিন্দের শাস্তি প্রাপ্য হয়। তিনি তাঁর গৃহিণীকে জানান তাঁর ছাত্র পড়া না করায় পাপের প্রায়শ্চিত্ত হিসেবে উপবাসে থাকবেন যতক্ষণ না গোবিন্দ পাঠ রপ্ত করে আসে। গৃহিণী আবাসিক তিন ছাত্রকে জানতে চান তারা কাঁচা ফলার করবে কিনা কারণ রামনাথের উপবাস হলে পত্নী হিসেবে তাঁরও উপবাস। আবাসিক ছাত্ররাও বলল, গুরু এবং গুরুপত্নী উপবাস করলে তাঁরা খাবে কী করে, তারাও উপবাস করবে। গোবিন্দ কাঁদতে কাঁদতে বাড়ি ফিরে যায় এবং তিনদিনের পাঠ সন্ধ্যের মধ্যেই রপ্ত করে টোলে ফিরে আসে। এই চতুষ্পাঠীতে বেত্রদন্ডের প্রয়োজন হয়নি কখনো। শোনা যায় একবার রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের ছেলে শিবচন্দ্র তাঁকে সাহায্য করতে চেয়ে ছিলেন কিন্তু তিনি সেই সাহায্য গ্রহণ করেননি।
রামনাথ চিরকালই নির্লোভ ছিলেন। তাঁর কাছে শিক্ষা গ্রহণ করে অনেকেই ভবিষ্যতে বড় পন্ডিত হয়েছেন, তাঁর মধ্যে অন্যতম হলেন প্রসন্ন চন্দ্র তর্করত্ন। তাঁর ছাত্র কৃষ্ণানন্দ বিদ্যা বাচস্পতি সরস্বতী মহারাজ ভবিষ্যতে ‘অন্তরব্যাকরণ নাট্যপরিষৎ’ লিখে বিখ্যাত হন। বাংলা সাহিত্যের অনেক লেখক রামনাথ তর্কসিদ্ধান্ত সম্পর্কে অনেক গল্প লিখেছেন যার মধ্যে অন্যতম হলেন দীনবন্ধু মিত্র। ২০১৯ সালে পশ্চিমবঙ্গ সরকার রামনাথ তর্কসিদ্ধান্তের টোলকে নবদ্বীপের অন্যতম ঐতিহ্যশালী স্থান (Heritage place) হিসাবে ঘোষণা করে।নবদ্বীপে সংস্কৃত চর্চার ইতিহাস’ গ্রন্থে পণ্ডিত গোপেন্দুভূষণ সাংখ্যতীর্থ লিখেছেন, “নবদ্বীপের বিশ্ববিদ্যালয় এখনকারই মতো আবাসিক এবং পরীক্ষানিয়ামক থাকিলেও বিশ্ববিদ্যালয় বলিতে এখনকার যেরূপ ধারণা নবদ্বীপ বিশ্ববিদ্যালয় কিন্তু সে ধরনের ছিল না।
নবদ্বীপ বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বাপেক্ষা বড় বৈশিষ্ট্য ছিল এই যে এখানে ছাত্রগণ কোনও না কোন নির্দিষ্ট অধ্যাপকের অন্তেবাসী হইয়া থাকিত এবং অধ্যাপক গৃহেই অপত্যনির্বিশেষে প্রতিপালিত হইত।” তাঁর কথা মতো, “ছাত্রেরা শুধু গ্রন্থপাঠই করিত না, সন্ধ্যাবন্দনা পূজাহোম প্রভৃতি অনুষ্ঠান দ্বারা সংযম ও শিষ্টাচার শিক্ষায় আদর্শস্থানীয় হইতে পারিত। ছাত্র যত বুদ্ধিমানই হউক, ধর্ম পরায়ণ না হইলে তাঁর সমাদর হইত না।” সেকালের নবদ্বীপে আর একটি বৈশিষ্ট ছিল শিক্ষা সমাপ্তির কোন নির্দিষ্ট কাল ছিল না। যতদিন খুশি গুরুগৃহে থেকে শিক্ষালাভ করতে পারত। চূড়ান্ত পরীক্ষা হত নবদ্বীপের ‘বিদগ্ধজননী’ বা পোড়ামা তলায় সমবেত অধ্যাপকদের সামনে।