বর্ধমান | মুঘল শরিফাবাদ থেকে বর্তমানের Burdwan

বর্ধমান | মুঘল শরিফাবাদ থেকে বর্তমানের Burdwan

পশ্চিমবঙ্গ অন্যতম জেলা পূর্ব বর্ধমান জেলার সদর শহর হল বর্ধমান, পশ্চিমবঙ্গের দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর ও একটি প্রাচীন শহর বর্ধমান৷ বর্ধমান নামটির উৎপত্তি প্রসঙ্গে বিভিন্ন মত প্রচলিত আছে।বার্ডওয়ান নামটি সংস্কৃত বর্ধমান থেকে ইংরেজ কর্তৃক প্রদত্ত। মার্কন্ডেয় পুরাণে বর্ধমানের উল্লেখ আছে। একাধিক প্রাচীন সংস্কৃত, বৌদ্ধ ,জৈন ধর্মগ্রন্থে বর্ধমান শহরের নাম উল্লিখিত হয়েছে।

গলসি থানা সংলগ্ন মল্লসরুল গ্রাম থেকে পাওয়া  ষষ্ঠ শতকের একটি তাম্রলিপিতে প্রথম নামটির উল্লেখ পাওয়া যায়।বর্ধমান  নামের উৎপত্তি নিয়ে দুটি মত রয়েছে। প্রথম মতানুযায়ী, নামটি ২৪ তম জৈন তীর্থাঙ্কর বা বর্ধমানস্বামী'র নামানুসারে এই শহরের নামকরণ হয়েছে। মহাবীর জৈন কিছুসময় অস্তিকগ্রামে কাটিয়েছিলেন, যা পরে বর্ধমান নামে পরিচিত হয়। অন্য মতানুযায়ী, বর্ধমান অর্থ সম্পন্ন কেন্দ্র। 

গাঙ্গেয় উপত্যকায় আর্য সভ্যতার বিকাশের সময়ে, উন্নতি এবং সম্পনতার প্রতীক হিসেবে স্থানটি পরিচিত ছিল। রাজস্ব আদায়ের সুবিধার জন্য মুঘল সম্রাট আকবর বাংলা সুবাকে উনিশটি সরকারে ভাগ করেন । মুঘল যুগে এই শহরটি ছিল মুঘল বর্ধমান জেলার রাজধানী। তখন শহরের নাম রাখা হয়েছিল শরিফাবাদ। শরিফ শব্দের অর্থ সম্ভ্রান্ত।

সেই অর্থে এলাকাটি ছিল অপেক্ষাকৃত সম্ভ্রান্ত অঞ্চল। পরে বর্ধমানের নাম হয় শরিফাবাদ। রাজা তিলকচাঁদ ছিলেন বর্ধমানের প্রথম মহারাজধিরাজ। তাদের বংশের অন্যতম রাজারা হলেন প্রতাপচাঁদ ও মহতাবচাঁদ। ব্রিটিশ আমলে রানী বেনদেয়ী তার দেওয়ান বনবিহারীর পুত্র বিজনবিহারীকে দত্তক নিয়ে বিজয়চাঁদ নাম দিয়ে বর্ধমানের সিংহাসনে বসান।  ১৯৫৫ সালে জমিদারি উচ্ছেদ হলে বর্ধমান রাজের অবলুপ্তি ঘটে।

বর্তমানে বর্ধমান পশ্চিমবঙ্গের একটি দ্রুত উন্নয়নশীল বাণিজ্যকেন্দ্র। বর্ধমান শহরটি সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ৪০ মিটার উচ্চতায় অবস্থিত। ২০১১ সালের আদমশুমারি অনুসারে বর্ধমান শহরের জনসংখ্যা হল ৩১৪,২৬৫ জন।এর মধ্যে পুরুষ ৫২% এবং নারী ৪৮%।  সাক্ষরতার হার ৮৮.৩১%, পুরুষদের মধ্যে সাক্ষরতার হার ৯১.৭৭% এবং নারীদের মধ্যে এই হার ৮৪.৭৪%।বর্ধমান পৌরসভা ও পশ্চিমবঙ্গ সরকারের  একাধিক বিভাগ এই শহরের প্রশাসনের দায়িত্বপ্রাপ্ত। শহরের উন্নয়নে রাজ্য সরকার স্থাপিত বর্ধমান উন্নয়ন পর্ষদ একাধিক গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্পর দায়িত্বপ্রাপ্ত। 

বর্তমানে বর্ধমান পশ্চিমবঙ্গের একটি দ্রুত উন্নয়নশীল বাণিজ্যকেন্দ্র।  এবং বর্তমানে পশ্চিমবঙ্গের একটি গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষাকেন্দ্র বর্ধমান। বিবেকানন্দ মহাবিদ্যালয় , রাজ কলেজ , বর্ধমান মহিলা মহাবিদ্যালয় ,  বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয় , M.B.C. প্রকৌশল প্রযুক্তি ইনস্টিটিউট , ইউনিভার্সিটি ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজি (University of Burdwan), বর্ধমান ডেন্টাল কলেজ হাসপাতাল , বর্ধমান হোমিওপ্যাথিক মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল , বর্ধমান মেডিকেল কলেজ সহ বিভিন্ন বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বর্ধমান শহরকে এক বিশিষ্ঠ শিক্ষাকেন্দ্রে পরিনত করেছে।

 বর্ধমান জেলায়  বাস নেটওয়ার্কও খুব বিস্তৃত শহরে দুটি বাস টার্মিনাল রয়েছে আলিশা বাসস্ট্যান্ড ও নবাবহাট বাসস্ট্যান্ড ।  রায়না, খন্ডঘোষ , জামালপুর এবং বাঁকুড়া জেলার মতো দক্ষিণ বর্ধমান অঞ্চলের বাস আলিশা বাসস্ট্যান্ড থেকে চলাচল করে. এবং কাটোয়া, কালনা, ভাতার, আউসগ্রাম এবং পশ্চিম বর্ধমানের বাসগুলি নবাবহাট বাসস্ট্যান্ড থেকে চলাচল করে। এছাড়াও বর্ধমান শহরের মধ্যে যাতয়াতের জন্য টাউন সার্ভিস এবং রিক্সা , টোটোর  ব্যবস্থা রয়েছে ।এছাড়াও বর্ধমান জেলায় বিস্তৃত রেল নেটওয়ার্কও রয়েছে।

যা ভারতীয় রেলওয়ে মালিকানাধীন পূর্ব রেলওয়ে দ্বারা পরিচালিত। ১৮৫৫ সালে চালু হয় এই রেলপথ , যার বৈদ্যুতীকরণ হয় ১৯৫৮ সালে । বর্ধমান রেল স্টেশানে প্ল্যাটফর্ম সংখ্যা রয়েছে ৮ টি। রয়েছে পার্কিং এর ব্যবস্থা। বর্ধমান জংশন হল হাওড়া - দিল্লি  মূল লাইনের একটি রেলওয়ে স্টেশন। হাওড়া থেকে হাওড়া-বর্ধমানের প্রধান লাইন এবং হাওড়া-বর্ধমানের কর্ড লাইনে ইএমইউ ট্রেন সার্ভিস চালু রয়েছে বর্ধমান স্টেশন পর্যন্ত। এছাড়াও রয়েছে হাওড়া-এলাহাবাদ-মুম্বাই রেলপথ ,হাওড়া-গয়া-দিল্লি রেলপথ ,হাওড়া-নিউ জলপাইগুড়ি রেলপথ , বর্ধমান-আসানসোল বিভাগ ,বর্ধমান-কাটোয়া রেলপথ । 

দর্শনীয় স্থান

কার্জন গেট - বর্ধমান শহরের একটি বিখ্যাত দর্শনীয় স্থাপত্ত্ব হল কার্জন গেট। ১৯০২ /১৯০৩  সালে মহারাজা বিজয় চাঁদ মাহাতাবের রাজ্যাভিষেকের জন্য নির্মিত  হয়েছিল। সাবেক রাজপ্রাসাদটি গেট থেকে ১ কিমি দূরে অবস্থিত। লর্ড কার্জনের বর্ধমান সফরের আড়ম্বর তাঁর সম্মানার্থে লর্ড কার্জনের  নামানুসারে এই গেটের নাম নামকরন করা হয় । এটি বিজয় তোরণ নামেও পরিচিত 

সর্বমঙ্গলা মন্দির -  বর্ধমান শহরের অন্যতম দর্শনীয় স্থান হল  সর্বমঙ্গলা মন্দির । বর্ধমানের সর্বমঙ্গলা মন্দির অবিভক্ত বাংলার প্রথম নবরত্ন মন্দির। প্রাচীন এই মন্দির বর্ধমানের মানুষের কাছে পবিত্র তীর্থস্থান। দেশ-বিদেশের লক্ষ লক্ষ পুণ্যার্থী ও পর্যটকদের সমাগম হয় এই মন্দিরে।  এখানে সর্বমঙ্গলা দেবীর মূর্তি কষ্টি পাথরের অষ্টাদশভূজা সিংহবাহিনী ‘মহিষমর্দিনী’ মহালক্ষীরূপিণী। এছাড়াও বর্ধমান শহরের অন্যতম মন্দির গুলির মধ্যে রয়েছে ১০৮ শিব মন্দির , কঙ্কালেশরি মন্দির , বীরহাটা কালী মন্দির ইত্যাদি।   

গোলাপবাগ, রমনা বাগান - গোলাপবাগ উনবিংশ শতাব্দীতে উদ্ভিদ প্রাণিবিদ্যা উদ্যান হিসাবে গড়ে উঠেছিল। এতে নৌকা ভ্রমণের জন্য হ্রদ এবং হাওয়া মহল ছিল।বর্তমানে যেখানে বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ের বেশ কয়েকটি একাডেমিক বিভাগ গড়ে উঠেছে। রমনাবাগান বন্যপ্রাণ অভয়ারণ্য  অবস্থিত একটি বন্যপ্রাণ অভয়ারণ্য। এই অভয়ারণ্যের মোট আয়তন ১৪ হেক্টর। ১৯৮১ সালের সেপ্টেম্বর মাসে এটি অভয়ারণ্য হিসেবে স্বীকৃতি পায়। এখানে নানান প্রজাতির হরিনের দেখা মেলে , হরিন ছাড়াও এখানে বিভিন্ন প্রজাতির পাখি , কুমির , ভাল্লুকেরদেখা মেলে।   

 রাজবাড়ী - বর্ধমান রাজ পরিবারের প্রাসাদ হচ্ছে বর্ধমান রাজবাড়ী, উনিশ শতকে মহাতাবচাঁদ নির্মাণ করেছিলেন, এমন একটি স্থানে যেখানে পূর্বে মুঘল দুর্গ ছিল বলে মনে করা হয়। এটি এখন বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক কার্যালয়।

 শের আফগান এবং কুতুবুদ্দিন খান কোকা -  সমাধি-মেহের-উন-নিসা, তখন বর্ধমানের জায়গিরদার শের আফগানের স্ত্রী, একসময় বর্ধমানের বাসিন্দা ছিলেন। কথিত আছে যে, মুঘল সম্রাট জাহাঙ্গীর তার প্রেমে পড়েছিলেন এবং তাকে বিয়ে করার জন্য দৃ়প্রতিজ্ঞ ছিলেন। তিনি তার পালক-ভাই এবং বাংলার সুবাহদার কুতুবউদ্দিন খান কোকার সাহায্যে তাকে পাওয়ার চেষ্টা করেছিলেন। শের আফগান কুতুবউদ্দিন খান কোকার সাথে লড়াইয়ের সময় মারা যান।  পারসিয়ান সুফি সাধক পীর বাহরাম সিক্কার মতো একই স্থানে ১৬০৭ সালে উভয়কেই বর্ধমানে পাশাপাশি কবর দেওয়া হয় ।যা শের আফগানের সমাধি বলে পরিচিত।  

মেঘনাদ সাহা প্ল্যানেটারিয়াম- ১৯৯৪ সালে উদ্বোধন করা হয় এটি, প্রধান যন্ত্র ছিল জাপান সরকারের বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়কে দেওয়া এক উপহার। রাজ্যের দ্বিতীয় প্ল্যানেটারিয়াম, যা আন্তর্জাতিক মানদণ্ডে  নির্মিত, এটি ভারতীয় বিজ্ঞানী মেঘনাদ সাহার নামে নামকরণ করা হয়েছে। এছাড়াও বর্ধমানের গোলাপবাগে রয়েছে সায়েন্স সেন্টার , কৃষ্ণসায়ের পার্ক , বর্ধমান টাউন হল, বর্ধমানেশ্বর শিব মন্দির ,বর্ধমান বিগ বাজার , বর্ধমান চার্চ , বর্ধমান গুরুদুয়ারের মতো নানান দর্শনীয় স্থান।