চাকদহ | নদীয়ার প্রাচীন জনপদ Chakdaha

চাকদহ  | নদীয়ার প্রাচীন জনপদ Chakdaha

 নদীয়ার একটি প্রাচীন জনপদ চাকদাহ বা চাকদা। পুরাণে কথিত আছে ভাগীরথী নদী (গঙ্গা) আনয়নকালে প্রচন্ড বর্ষনের কারণে ভগীরথের রথের চাকা এখানে বসে যায়। তিনি সেই চাকা টেনে তোলেন ও প্রকান্ড দহের সৃষ্টি হয়। সেই থেকে নাম হয় 'চক্রদহ' কালক্রমে তা চাকদহ বা চাকদা'তে পরিনত হয়েছে।  ১৮৮৫ সালে এটি ৫০০০ জনসংখ্যার একটি গ্রাম ছিল । ১৮৮৬ সালে মে মাসে চাকদহ কে পৌরসভা ঘোষনা করে ব্রিটিশ স্থাপত্য প্রকৌশলী “জন বেগলার ” । শহরটির অবস্থানের অক্ষাংশ ও দ্রাঘিমাংশ হল ২৩.০৮° উত্তর ৮৮.৫২° পূর্ব। 

সমুদ্র সমতল হতে এর গড় উচ্চতা হল ১১ মিটার (৩৬ ফুট)। ভারতের ২০০১ সালের আদমশুমারি অনুসারে চাকদহ শহরের জনসংখ্যা হল ৮৬,৯৬৫ জন। এর মধ্যে পুরুষ ৫১% এবং নারী ৪৯%। এখানে সাক্ষরতার হার ৭৯%। পুরুষদের মধ্যে সাক্ষরতার হার ৮৪% এবং নারীদের মধ্যে এই হার ৭৫%। সারা ভারতের সাক্ষরতার হার ৫৯.৫%, তার চাইতে চাকদহ এর সাক্ষরতার হার বেশি। এই শহরের জনসংখ্যার ৯% হল ৬ বছর বা তার কম বয়সী। চাকদহে সুদীর্ঘ ইতিহাসে অনেকদিন ধরেই ঢুকে রয়েছে লোকআবেগ। 

গৌহাটির বাসিন্দা জগদীশ পণ্ডিত নবদ্বীপে বসবাস শুরু করেছেন। পণ্ডিত নীলাচলে হরিনাম সংকীর্তন প্রচারে যান। সেখানে জগন্নাথ-দর্শন করে আপ্লুত হয়ে পড়েন। ফেরার সময়ে জগন্নাথের ইচ্ছায়, তাঁর সমাধিস্থ বিগ্রহ পণ্ডিতের সঙ্গে আসে। লোককথা, বয়ে আনার সুবিধার জন্য জগন্নাথ নিজেই নাকি ভারী বিগ্রহ থেকে শোলার মতো হালকা হয়ে যান। একটাই শর্ত, তাঁকে মাটিতে নামানো চলবে না।

নবদ্বীপের উদ্দেশে যাত্রা করা পণ্ডিত মাঝপথে, যশড়ার কাছে অন্য এক ব্যক্তির কাছে ঝোলাটি দিয়ে নদীতে স্নানে নামেন। স্নান ও তর্পন সেরে ফিরে দেখেন, ওই ব্যক্তি জগন্নাথের মূর্তি মাটিতে নামিয়ে ফেলেছেন। আর মূর্তিও আবার আগের মতো ভারী! তার পর কৃষ্ণনগরের রাজা কৃষ্ণচন্দ্র একদিন খবর পান, জগন্নাথের মূর্তি তাঁর রাজ্যে উপস্থিত হয়েছে। কিন্তু তা নাকি এত ভারী হয়ে যায়, যে সরানো সম্ভব হয় না।

শেষমেষ চাকদহেই জগন্নাথের জন্য পাঁচশ বিঘা জমি দান করেন রাজা কৃষ্ণচন্দ্র। মন্দিরের সেবায়েত বলরাম দাস ব্রহ্মচারী  মুখে শোনা যায়, এখানে বকুল গাছে আম, অশ্বথগাছে কাঁঠাল এবং কুয়োয় দুধ হয়েছে! এসব দিয়ে পণ্ডিত জগন্নাথের পুজো করেছেন!” তিনি আরও বলেন, “মন্দিরে জগন্নাথদেব এবং গৌর গোপালের নিত্যপুজো হয়। প্রতিবছর এখানে দু’টো করে অনুষ্ঠান হয়। জগন্নাথের স্নানযাত্রা এবং পৌষমাসের শুক্ল তৃতীয় তিথিতে জগদীশ পণ্ডিতের তিরোধান দিবস।

জগন্নাথের ইচ্ছা ছিল না! তাই এখানে রথ হয় না।”  ষোড়শ,সপ্তদশ এবং অষ্টাদশ শতকে সুখসাগর এবং বর্তমান পালপাড়া অত‍্যন্ত সমৃদ্ধিশালী গ্রাম ছিল।চাকদহের পালপাড়ায় রাজা গান্ধর্ব রায়  ষোড়শ/সপ্তদশ শতকে একটি চারচালা পুরাতন মন্দির তৈরী করেছিলেন যা  আজ ও বিস্ময়ের সৃষ্টি করে।মন্দিরটি ক্ষুদ্রাকৃতি ,ইট নির্মিত এবং দরজার উপরে রামায়ণের কাহিনী চিত্রাকারে খোদাই করা আছে।মন্দিরটিতে কোনো বিগ্রহ নেই এবং বর্তমানে এই মন্দির টি Archelogical Survey of India র তত্ত্বাবধানে রয়েছে।  

চাকদহের একটি সাধারণ ডিগ্রি মহাবিদ্যালয়। এটি ১৯৬৩ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়। মহাবিদ্যালয়টি কলা, বিজ্ঞান ও বাণিজ্য এই তিনটি ধারার বিভিন্ন বিষয়ে স্নাতক কোর্স সরবরাহ করে। এটি কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনস্থ মহাবিদ্যালয়।কলেজটি ১৯৯৯ সাল থেকে কল্যানী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত এবং ইউজিসি অনুমোদিত। এটি ২০১৭ সালের ন্যাক সমীক্ষায় বি-গ্রেড কলেজ হিসাবে স্বীকৃতি লাভ করে।

চাকদহের গঙ্গার পারে এশিয়ার বৃহত্তম পেপার মিল "সুপ্রিম পেপার মিল" অবস্থিত। চাকদহ ব্লক ১০ টি গ্রাম পঞ্চায়েত নিয়ে গঠিত। এগুলি হল- চান্দুরিয়া ১, শিলিন্দা ১, শিলিন্দা ২, হিংনাড়া, দেউলি, দুবরা, ঘেটুগাছি, তাতলা ১, তাতলা ২ এবং রাউতাড়ি। চাকদহ স্টেট জেনারেল হাসপাতাল, চাকদহ রাজ্য জেনারেল হাসপাতাল পশ্চিমবঙ্গের অন্যতম সেরা সরকারী সাধারণ হাসপাতাল এবং এর ৫০০ শয্যা রয়েছে। ভারতের সীমানা পুনর্নির্ধারণ কমিশনের নির্দেশিকা অনুসারে, ৯০ নং চাকদহ বিধানসভা কেন্দ্রটি চাকদহ পৌরসভা, চান্দুরিয়া-১, দুবরা, ঘেটুগাছি, রাউতারি, শিলিন্দা-১, শিলিন্দা-২, তাতলা-১ এবং তাতলা-২ গ্রাম পঞ্চায়েত গুলি চাকদহ সমষ্টি উন্নয়ন ব্লক এর অন্তর্গত। 

সাংস্কৃতিক প্রোগ্রাম বেশিরভাগই অনুষ্ঠিত হয় সম্প্রীতি মঞ্চ এবং চাকদহ পৌরো মুক্তো মঞ্চ। প্রতি শীতে, একটি বড় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান (মেলা নামে পরিচিত) চকদহায় অনুষ্ঠিত হয়। ২০১৪ সাল থেকে 'চাকদহ বইমেলা' প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। ফুল শহরে এই প্রদর্শনীর অন্যতম জনপ্রিয় অনুষ্ঠান। ক্রিকেট এবং ফুটবল সর্বাধিক জনপ্রিয় খেলা। চাকদহায় একটি স্টেডিয়াম রয়েছে। ভারতীয় মহিলা ক্রিকেটার এবং ওয়ানডে ক্রিকেটে শীর্ষস্থানীয় উইকেট শিকারী ঝুলন গোস্বামী চকদাহের বাসিন্দা। 

চাকদহ বিধানসভা কেন্দ্রটি ১৩ নং রানাঘাট লোকসভা কেন্দ্র (এসসি) এর অন্তর্গত।এই কেন্দ্রটি পূর্বে নবদ্বীপ লোকসভা কেন্দ্রের অন্তর্গত ছিল। চাকদহ বিধানসভা কেন্দ্রটি রানাঘাট লোকসভা কেন্দ্রের অন্তর্গত। চাকদহ শহরটি কলকাতা ও জেলা সদর শহর কৃষ্ণনগরের সাথে রেল পথে সুসংযুক্ত। শেয়ালদহ বিভাগের লোকাল ও প্যাসেঞ্জার ট্রেন চলাচল করে চাকদহ রেলওয়ে স্টেশন দিয়ে। এছাড়া ৩৪ নং জাতীয় সড়ক চাকদহকে কলকাতা ও উত্তরবঙ্গের সঙ্গে যুক্ত করেছে। চাকদহ বনগা রোড দ্বারাও এই শহরের সাথে উত্তর ২৪ পরগনা জেলার সাথে যোগাযোগ আছে।

এটি মূলত বনগাঁয়ের সাথে বাস সংযোগ রয়েছে এবং এটি বারাসাত, রানাঘাট, তেহট্ট, আইশমালী, নিমতলা এবং নদিয়া এবং উত্তর ২৪ পৃষ্ঠার জেলার অন্যান্য অংশের সাথেও সংযোগ স্থাপন করছে। উত্তরবঙ্গ যাওয়ার জন্য কলকাতা থেকে সিএসটিসি, এসবিএসটি বাস চলাচল করে এনএইচ -৪৪-এর চকদহে। কৃষ্ণনগর, হংসখালী, পলাশী, বেথুয়াডহরী , বহরমপুর এবং রাজ্যের অন্যান্য অংশে বাস চলাচল করে। উত্তরবঙ্গ যাওয়ার জন্য কিছু দূর-দূরান্তের রাতের বাসও পাওয়া যায়। সাধারণ লোকেরা, যদিও সহজলভ্যতা এবং আরও সুবিধার কারণে ট্রেনগুলি পছন্দ করে। শহরটির নিকটতম বিমানবন্দরটি শহর থেকে ৫৮ কিলোমিটার দূরে দম দমের নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসু আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর।