চন্দ্র মাধব ঘোষ এর জীবনী

চন্দ্র মাধব ঘোষ (Chandra Madhab Ghosh) কলকাতা হাইকোর্টের প্রথম ভারতীয় বাঙালি বিচারপতি ছিলেন। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর প্রথম প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ ছাত্রদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন তিনি। ১৮৩৮ সালে ২৬ ফেব্রুয়ারি অধুনা বাংলাদেশের শ্রীনগর উপজেলার ষোলঘর গ্রামে চন্দ্র মাধব ঘোষের জন্ম হয়।
তাঁর বাবার নাম দুর্গা প্রসাদ ঘোষ এবং মায়ের নাম চন্দ্রবালা ঘোষ। দুর্গা প্রসাদ ঢাকার ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট ছিলেন। পরবর্তীকালে ইংরেজ সরকার তাঁকে রায়বাহাদুর খেতাব ভূষিত করে। চন্দ্র মাধবদের জমিদারী না থাকলেও প্রচুর জমিজমা থাকায় তাঁদের পরিবারের বেশ নামডাক ছিল। মানুষের বিপদে-আপদে, বিদ্যালয়, দাতব্যালয় এবং ডাকঘর তৈরি করা, খাল খনন, রাস্তার উন্নয়ন সহ বহু সামাজিক কাজে তাঁরা অর্থ ব্যয় করতেন।
চন্দ্র মাধবের প্রাথমিক শিক্ষা শুরু হয় ঢাকার গৌরসুন্দর বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে। চন্দ্র মাধব এবং তাঁর খুড়তুতো ভাই নীলমাধব গৌরসুন্দরের কাছেই শিক্ষা গ্রহণ করতেন। ছোটবেলা থেকে চন্দ্র মাধবের মেধা এবং পড়াশোনার প্রতি তাঁর আগ্রহ সবাইকে বিস্মিত করত। চন্দ্র মাধবকে ঘোষের ব্যারিস্টারি পড়াতে তাঁর বাবা তাঁকে এক বন্ধুর বাড়িতে রেখে আসেন।
১৮৪৫ সালে ৮ মার্চ চন্দ্র মাধব হিন্দু কলেজের কলা বিভাগে ভর্তি হন। তিনি ১৮৫৪ সালে জুনিয়র স্কলারশিপ (Junior Scholarship) পরীক্ষায় প্রথম স্থান লাভ করেছিলেন। চন্দ্র মাধব ঘোষ অত্যন্ত মেধাবী ছাত্র হওয়ায় তিনি তাঁর শিক্ষক মিস্টার মন্ট্রিয়োর এবং মিস্টার ভনের খুব পছন্দের ছাত্র ছিলেন। মিস্টার ভন ইন্দো ইউরোপিয়ান স্কুলের প্রধান শিক্ষক থাকাকালীন চন্দ্র মাধবের সাথে তাঁর পরিচয় হয়েছিল। চন্দ্র মাধব প্রেসিডেন্সি কলেজের সিনিয়র স্কলারশিপ (Senior Scholarship) ক্লাসের জন্য পড়াশুনা শুরু করেন।
কিন্তু গণিতে দুর্বল হওয়ায় সেই স্কলারশিপ তিনি লাভ করতে সক্ষম হননি। ১৮৫৭ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর প্রথম প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ ছাত্রদের মধ্যে তিনি অন্যতম ছিলেন। তাঁর ছাত্র জীবনের বন্ধুদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন উমেশ চন্দ্র মিত্র, রমেশ চন্দ্র মিত্র, শ্রীশ ঘোষ, সাতকড়ি মিত্র, বলাইচাঁদ দত্ত, কালীকৃষ্ণ সেন, চণ্ডীচরণ বিশ্বাস এবং কেশবচন্দ্র সেন।
এঁরা প্রত্যেকেই নিজ নিজ ক্ষেত্রে স্বনামধন্য ব্যক্তিত্ব। ১৮৬০ সালে চন্দ্র মাধব আইনের পরীক্ষায় পাশ করেন এবং বর্ধমান জেলা কোর্টে প্র্যাকটিস শুরু করেন। তাঁর কাজের দক্ষতা দেখে ছয় মাসের মধ্যেই তাঁকে সরকারি প্লিডার (pleader) করে দেওয়া হয়। এরপর তিনি ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট পদে উন্নীত হন। কিন্তু কিছুদিন পরেই তিনি সেই কাজ ছেড়ে সদর আদালতে কাজ শুরু করেন। তিনি বেশ কিছুদিন প্রেসিডেন্সি কলেজে মিস্টার মন্ট্রিয়োর সুপারিশে আইনের লেকচারার হিসেবে কাজ করেন।
১৮৪৯ সালে মাত্র ১১ বছর বয়সে চন্দ্র মাধব ঘোষের সাথে ঢাকার প্রখ্যাত রায় পরিবারের মেয়ে হেমন্তকুমারী দেবীর বিবাহ হয়। হেমন্ত কুমারী দেবীর তখন মাত্র ৬ বছর বয়স ছিল। ১৮৫৮ সালে তাঁদের বড় ছেলে জ্ঞানেন্দ্রনাথ ঘোষের জন্ম হয়। কিন্তু ১৮৬৫ সালে মাত্র ৭ বয়সে জ্ঞানেন্দ্রনাথের অকাল মৃত্যু ঘটে। তাঁদের আরো তিন ছেলে এবং দুই মেয়ে ছিল।
ছেলে যোগেন্দ্র চন্দ্র ঘোষ পরবর্তীকালে কলকাতা হাইকোর্টের প্রখ্যাত উকিল হয়েছিলেন এবং বাংলার লেজিসলেটিভ কাউন্সিল (Bengal Legislative Council) এর সদস্য এবং অ্যাসোসিয়েশন ফর দ্য অ্যাডভান্সমেন্ট অফ সায়েন্টিফিক এন্ড ইন্ডাস্ট্রিয়াল এডুকেশন (Association for the advancement of scientific and industrial education) এর প্রতিষ্ঠাতা সদস্য ছিলেন। আরেক ছেলে সুরেন্দ্র চন্দ্র ঘোষ হাই কোর্টের অ্যাটর্নি ছিলেন। ১৮৮৩ সালে চন্দ্র মাধব বঙ্গীয় সভার সদস্য হিসেবে নির্বাচিত হন।
তিনি কায়স্থ সভার সভাপতিও ছিলেন। তিনি যখন হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতি পদে নিযুক্ত হন তখন এই সভার সদস্যরা প্রচুর অর্থ ব্যয় করে তাঁকে সংবর্ধনা দেন। তাঁর নাইটহুড উপাধি প্রাপ্তিতেও তাঁর সম্মানে হাইকোর্টে বিশেষ অনুষ্ঠানের আয়োজন হয়েছিল। ১৮৮৫ সালে ১২ জানুয়ারি তিনি কলকাতা হাইকোর্টের বিচারপতি হিসেবে নিযুক্ত হন। প্রধান বিচারপতি স্যার ফ্রান্সিস ম্যাকলিন ছুটিতে থাকায় তাঁর কাজের দায়িত্ব চন্দ্র মাধব কে দেওয়া হয়।
ভারতের তৎকালীন বড়লাট ডাফরিন চন্দ্র মাধবকে খুবই স্নেহ করতেন। তাঁর সুপারিশেই ১৯০৬ সালে চন্দ্র মাধব ঘোষ কলকাতা হাইকোর্টের প্রথম বাঙালি প্রধান বিচারপতির পদে উন্নীত হন। সেই বছরই তাঁকে নাইটহুড (Knighthood) উপাধি দেওয়া হয়। প্রধান বিচারপতি হওয়ার পর তিনি ভারতীয়দের প্রতি ইউরোপীয়দের বৈষম্যমুলক আচরণ দূর করার চেষ্টা করেন। এ বিষয়ে তিনি তৎকালীন বড়লাট লর্ড কার্জনের সাথে কথাও বলেন। কিন্তু লর্ড কার্জন এই ব্যাপারে বিশেষ আগ্রহ দেখাননি।
প্রতিবাদে এরপর থেকে চন্দ্র মাধব কোন বিষয়ে আলোচনার জন্য লর্ড কার্জন তাঁকে ডেকে পাঠালে তিনি কার্জনের সাথে দেখা করতে যাননি। ১৮৮৫ সালে তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফেলো হিসেবে মনোনীত হন এবং এর পরের বছর তিনি সেই বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের সভাপতি হিসেবে নির্বাচিত হন। ১৯১২ সালে তিনি স্বেচ্ছায় প্রধান বিচারপতির পদ থেকে অবসর গ্রহণ করেন।
যদিও সরকারিভাবে তাঁকে অনুরোধ করা হয় আরো কিছুদিন সেই পদে থাকার জন্য, কিন্তু তিনি সেই অনুরোধ রাখেননি। ১৯১৪ সালে কলকাতার কলেজ স্কোয়ারে হওয়া বিক্রমপুর সম্মেলনে তিনি সভাপতিত্ব করেন। তিনি এবং তাঁর বন্ধু ম্যাজিস্ট্রেট নবাব আব্দুল লতিফ একসাথে শ্রীনগর থেকে তালতলা পর্যন্ত একটি খাল খনন করার পরিকল্পনা করেন।
চন্দ্র মাধব ঘোষ খুবই বন্ধুবৎসল মানুষ ছিলেন। বন্ধুদের বিপদে আপদে তিনি সবসময় সাহায্য করার চেষ্টা করতেন। প্রতি বছর পুজোর সময় চন্দ্র মাধব তাঁর নিজের গ্রাম ষোলোঘরে ফিরে যেতেন। সেখানে তিনি মহা সমারোহে দুর্গাপুজো করতেন এবং সব গ্রামবাসীদের নিমন্ত্রন করে খাওয়াতেন। এই গ্রামে তিনি তাঁর স্ত্রী হেমন্তকুমারী দেবীর নামে চোদ্দ হাজার টাকা ব্যয় করে একটি বিশাল দীঘি খনন করান।
দীঘিটির নামকরণ করা হয় হেম সাগর। এছাড়াও তিনি তাঁর মায়ের নামে তাঁর গ্রামে একটি দাতব্য হাসপাতাল নির্মাণ করেন। সরকারি চাকরি করলেও তাঁর মধ্যে প্রবল স্বদেশ চেতনা ছিল। তিনি সর্বদা দেশের উন্নতির কথা ভাবতেন। এছাড়াও তিনি দেশীয় পদ্ধতিতে তৈরি করা দ্রব্য ব্যবহারের পক্ষপাতী ছিলেন। চন্দ্র মাধব ঘোষের ১৯১৮ সালে ১৯ জানুয়ারি মৃত্যু হয়। কলকাতা হাইকোর্টের সামনে তাঁর একটি মূর্তি স্থাপিত রয়েছে। এছাড়াও দক্ষিণ কলকাতার ভবানীপুর এলাকায় তাঁর নামে নামাঙ্কিত একটি রাস্তাও রয়েছে।