চার ধাম যাত্রা দর্শন

বদ্রীনাথ, দ্বারকা, পুরী ও রামেশ্বরম- এই চার তীর্থক্ষেত্রকে একত্রে 'চারধাম' বলে। বিশ্বাস করা হয় যে, এই চার তীর্থ দর্শনে মোক্ষ অর্জন করা সম্ভব। আদি শঙ্করাচার্য এই চারধামের কথা বলে গিয়েছেন। এই চারটি তীর্থস্থলের অবস্থান ভারতের চারটি ভিন্ন অঞ্চলে। বদ্রীনাথ উত্তরের উত্তরাখণ্ডে, দ্বারকা পশ্চিমের গুজরাটে, পুরী পূর্বের ওড়িষায় এবং রামেশ্বরম দক্ষিণের তামিলনাডুতে অবস্থিত। আদি শঙ্করাচার্য এই চার ধামেই মন্দির স্থাপনা করেছিলেন।
রামেশ্বরম ধাম Rameshwaram Dham হিন্দুতীর্থের চার ধাম হিসেবে উত্তরাখণ্ডে ধরা হয়- গঙ্গোত্রী, যমুনোত্রী, কেদারনাথ আর বদ্রীনাথকে। আর গোটা ভারতে ধরা হয়- জগন্নাথধাম, রামেশ্বরম, দ্বারকা আর বদ্রীনাথ ধামকে। তীর্থের জন্য এই চার ধাম জীবনে অন্তত একবার যাওয়ার চেষ্টা করেন সব হিন্দুই। এই চার ধামের মধ্যে রামেশ্বরম তামিলনাড়ুর রামনাথপুরম জেলায় অবস্থিত। রামেশ্বরম নামটি এসেছে রামের ঈশ্বর কথাটি থেকে। চেন্নাই থেকে ৪২৫ কিলোমিটার দক্ষিণ-পূর্বে একটি শঙ্খ আকৃতির দ্বীপ রামেশ্বরম।
যার চারদিকে ভারত মহাসাগর আর বঙ্গোপসাগর। এই দ্বীপের পূর্ব প্রান্তে রয়েছে শিবমন্দির। যা দ্বাদশ জ্যোতির্লিঙ্গের অন্যতম বলেই ভক্তদের বিশ্বাস। রামেশ্বরম জ্যোতির্লিঙ্গ মন্দির ৮৬৫ ফুট লম্বা এবং ৬৫৭ ফুট চওড়া। এখানকার মন্দিরের চত্বরে আরও কয়েকটি ছোট মন্দির রয়েছে। তার মধ্যে দক্ষিণ দিকে রয়েছে দেবী পার্বতী বা রামেশ্বরীর মন্দির।
প্রতি শুক্রবার এই পার্বতী মন্দিরের মূর্তিকে নবরত্নে সাজিয়ে সোনার পালঙ্কে বসিয়ে মন্দিরের সামনে থেকে শোভাযাত্রা বের হয়। সঙ্গে চলে বেদপাঠ। এখানে ১২ ফুট লম্বা চুন-বালিতে তৈরি একটি নন্দীমূর্তি রয়েছে। সেই নন্দীমূর্তির পাশ দিয়ে গিয়েই গর্ভমন্দিরে প্রবেশ করতে হয়। এই গর্ভমন্দিরেই রয়েছে রামেশ্বরম শিবের লিঙ্গমূর্তি। এই মন্দিরের প্রধান বৈশিষ্ট্য হল, মন্দির চত্বরের মধ্যে থাকা ২২টি কূপ। যাকে কুণ্ড বলা হয়। যেগুলোর জলের তাপমাত্রা পরস্পরের থেকে আলাদা।
ভক্তদের বিশ্বাস, এই কূপের জলে স্নান করলে রোগ-ব্যাধি দূর হয়। ভক্তদের বিশ্বাস যে এই কূপের জলে ওষুধের গুণ রয়েছে। এই সব কূপ থেকে জল তুলে মন্দিরে রোগীদের স্নান করালে, রোগ নিরাময় হয়। এই সব কূপ বা কুণ্ডগুলোর একটি হল রুদ্র কুণ্ড। কথিত আছে, মাতুল কংসকে হত্যার পর সেই পাপ থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য শ্রীকৃষ্ণ এখানে এসেছিলেন। রুদ্র কুণ্ডতে স্নান করেছিলেন। আর, কংস হত্যার পাপ থেকে মুক্তি পেয়েছিলেন। এই মন্দির চত্বরে রয়েছে বিষ্ণুমন্দিরও।
সেখানে শ্বেতপাথরের বিষ্ণু মূর্তি রয়েছে। মন্দিরের কাছেই আছে নাটমন্দির। সেই নাটমন্দিরের সামনে সোনার তালগাছ আছে। তার পরেই আছে সোনার বেষ্টনী দেওয়া বেদী। সেখানে বেদ পাঠ করা হয়। নাটমন্দিরের পর বারান্দা পেরিয়ে মন্দির। যেখানে সোনার বেদীর ওপর প্রতিষ্ঠিত রয়েছে জ্যোতির্লিঙ্গ। যাকে ঢেকে রেখেছে সোনার তৈরি পঞ্চমুখ। এর মাথার ওপরে পঞ্চফণা নিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে কালনাগ। রামেশ্বরের দক্ষিণ দিকে রয়েছে ভগবান শ্রীরামচন্দ্র, সীতা দেবীর মূর্তি।
বদ্রীনাথ ধাম Badrinath Dham অষ্টম দিনে আপনার যাত্রা শুরু হবে বদ্রীনাথের উদ্দেশ্যে। শোনপ্রয়াগ থেকে বদ্রীনাথের দূরত্ব ২৩০-২৪০ কি.মি। সময় ভালই লেগে যাবে ৭-৮ ঘন্টার মত। সেই জন্য আপনাকে খুব সকালেই বেরোতে হবে শোনপ্রয়াগ থেকে। বদ্রীনাথে পৌঁছে আপনাকে থাকার কোনো অসুবিধা হবে না। প্রচুর হোটেল, আশ্রম, ধর্মশালা আপনারা পেয়ে যাবেন। সেদিন বদ্রীনাথে পৌঁছে পুরো রেস্ট নিন। নবম দিন সকালে উঠেই সকাল সকাল সকাল বদ্রী-বিশালের দর্শন করুন। কারণ ভিড় খুব হয়।
বদ্রীনাথে মন্দির দর্শন করা ছাড়াও আরো অনেক কিছু আছে তার মধ্যে বসুধারা ফলস্, এবং ভারতের শেষ গ্রাম -'মানা'। বসুধারা ফলস্ আপনাকে ট্রেক করে যেতে হবে তারজন্য আরো একটা এক্সট্রা দিন লেগে যাবে। মানা গ্রাম ঘোরার জন্য মোটামুটি ৩ ঘন্টা যথেষ্ট। মানা গ্রামে দেখার মত প্রচুর জায়গা আছে, মহাভারত কাহিনী সম্বন্ধিও বিভিন্ন জায়গা ভারতের শেষ চায়ের দোকান, সরস্বতী নদীর উদগমস্থল প্রভৃতি । নিজেদের ভাড়া করা গাড়ি থাকলে তো ভালোই, নাহলে ওখানে লোকাল গাড়ি ভাড়া করতে হবে আমাদের সময়ে 500 টাকা ভাড়া নিয়েছিলো।
যাইহোক মানা গ্রাম ঘুরে এসে বদ্রীনাথে কিছু একটা খেয়ে বেরিয়ে পড়ুন যোসিযঠের উদ্দেশ্যে। দূরত্ব ৪৬ কি.মি। সময় লাগবে প্রায় ২ ঘন্টা। নবম দিন আপনাকে যোসিযঠেই থাকতে হবে, আর হাতে যদি আরো সময়ে থাকে তাহলে আরো একটু এগিয়ে পিপলকোটি বলে একটা জায়গা আছে। ওখানে থাকার ব্যবস্থা করতে পারেন। কারণ পরের দিন আপনাকে হরিদ্বার পৌঁছতে কম সময় লাগবে। পরেরদিন সকালে উঠে ব্রেকফাস্ট করে সন্ধের মধ্যে পৌছে যান হরিদ্বার। রাস্তায় পঞ্চপ্রয়াগের সব গুলোই দেখতে পাবেন। হরিদ্বার পৌঁছে সেদিন ওখানেই রাত্রিবাস। এভাবেই আপনার ৯ রাত ১০ দিনের চারধাম যাত্রার সমাপ্তি ঘটবে।পরের দিন বাড়ি ফেরার পালা। সকলেই চারধাম যাত্রার মধুর স্মৃতি নিয়ে ফিরে চলুন আপনাদের নিজ নিজ বাড়ির উদ্দেশে।
দ্বারকা ধাম Dwarka Dham সৌরাষ্ট্রের উপকূলে আজও বেঁচে প্রাচীন শহর দ্বারকা। কৃষ্ণের শহর। বিশ্বাস করেন ভক্তরা। এই শহরের অনেক রহস্যই এখন হারিয়ে গিয়েছে সমুদ্রে। তবু আজও ভক্তদের ভিড়ে গমগম করে দ্বারকা।গোমতী নদী ও আরবসাগরের মুখে আজও মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে এই প্রাচীন নগরী। এক সময়ে গমগম করত এই বন্দর শহর। তার অধিকাংশই এখন হারিয়ে গিয়েছে আরব সাগরের জলে। তবু এখনও এর আনাচে-কানাচে ছড়িয়ে রয়েছে মহাভারতের গল্প। ভক্তদের বিশ্বাস, মথুরা থেকে এসে এখানেই ছিলেন কৃষ্ণ।
দ্বারকাকে পবিত্র নগর। বিশ্বাস ভক্তদের। এখানকার জগৎ মন্দিরে পূজিত হয় বিষ্ণু অবতার। মন্দিরের গায়ে খোদাই করা স্থাপত্য। রথের আদলে তৈরি মন্দিরের ইতিহাসও বহু মানুষকে আকৃষ্ট করে। বিশ্বাস আর ইতিহাস - এই দুইকে যুক্ত করে দ্বারকা।জগৎ মন্দিরের বিগ্রহকে রাজা বলেই মানেন ভক্তরা। বিশ্বাস, মন্দিরের ধ্বজা তোলার সময় কেউ কোনও মনষ্কামণা করলে তা পূরণ হয়। ... প্রতি বছর জন্মাষ্টমী উপলক্ষে মন্দিরে উপচে পড়া ভিড় হয়। মন্দিরের ছন্দের সঙ্গে মিশে যায় দ্বারকার ছন্দ।
পুরী জগন্নাথ ধাম Jagannath Darshan ভগবান বিষ্ণুর এক অবতার। ভারতের অন্যতম প্রাচীন ও প্রসিদ্ধ জগন্নাথ মন্দির ওড়িশার পুরী শহরে অবস্থিত। জগন্নাথ পুরী নামে সমধিক পরিচিত এই শহরে প্রতি বছর বিখ্যাত রথযাত্রা উৎসব পালিত হয়। পুরীর জগন্নাথ মন্দির চারধাম অর্থাৎ ভারতের চারটি পবিত্রতম তীর্থক্ষেত্রের অন্যতম। তবে ভারতের অনেক অঞ্চলেই জগন্নাথ মন্দিরের অস্তিত্ব আছে।
পশ্চিমবঙ্গের কলকাতা, মাহেশ, মহিষাদল প্রভৃতি অঞ্চলে একাধিক জগন্নাথ মন্দিরের দেখা মেলে। জগন্নাথদেবকে কেন্দ্র করে একটি জনপ্রিয় কাহিনি প্রচলিত আছে। এই কাহিনি অনুসারে, কৃষ্ণ তাঁর ভক্ত রাজা ইন্দ্রদ্যুম্নের সম্মুখে আবিভূর্ত হয়ে পুরীর সমুদ্রতটে ভেসে আসা একটি কাষ্ঠখণ্ড দিয়ে তাঁর মূর্তি নির্মাণের আদেশ দেন। মূর্তিনির্মাণের জন্য রাজা একজন উপযুক্ত কাষ্ঠশিল্পীর সন্ধান করতে থাকেন। তখন এক রহস্যময় বৃদ্ধ ব্রাহ্মণ কাষ্ঠশিল্পী তাঁর সম্মুখে উপস্থিত হন এবং মূর্তি নির্মাণের জন্য কয়েকদিন সময় চেয়ে নেন।
সেই কাষ্ঠশিল্পী রাজাকে জানিয়ে দেন মূর্তি নির্মাণকালে কেউ যেন তাঁর কাজে বাধা না দেন। বন্ধ দরজার আড়ালে শুরু হয় কাজ। রাজা ও রানি সহ সকলেই নির্মাণকাজের ব্যাপারে অত্যন্ত আগ্রহী হয়ে ওঠেন। প্রতিদিন তাঁরা বন্ধ দরজার কাছে যেতেন এবং শুনতে পেতেন ভিতর থেকে খোদাইয়ের আওয়াজ ভেসে আসছে। ৬-৭ দিন বাদে যখন রাজা বাইরে দাঁড়িয়েছিলেন এমন সময় আওয়াজ বন্ধ হয়ে যায়। অত্যুৎসাহী রানি কৌতুহল সংবরণ করতে না পেরে দরজা খুলে ভিতরে প্রবেশ করেন।
দেখেন মূর্তি তখনও অর্ধসমাপ্ত এবং কাষ্ঠশিল্পী অন্তর্ধিত। এই রহস্যময় কাষ্ঠশিল্পী ছিলেন দেবশিল্পী বিশ্বকর্মা। মূর্তির হস্তপদ নির্মিত হয়নি বলে রাজা বিমর্ষ হয়ে পড়েন। কাজে বাধাদানের জন্য অনুতাপ করতে থাকেন। তখন দেবর্ষি নারদ তাঁর সম্মুখে আবির্ভূত হন। নারদ রাজাকে সান্ত্বনা দিয়ে বলেন এই অর্ধসমাপ্ত মূর্তি পরমেশ্বরের এক স্বীকৃত স্বরূপ। জগন্নাথ-আরাধনার ইতিবৃত্ত এতই প্রাচীন যে এর কোনো ঐতিহাসিক রেকর্ড পাওয়া সম্ভব নয়। জগন্নাথ মন্দিরে অহিন্দুদের প্রবেশ কঠোরভাবে নিষিদ্ধ।
কলিঙ্গ স্থাপত্যশৈলীতে নির্মিত এই মন্দিরটি শ্রীমন্দির নামে সমধিক পরিচিত। গর্ভগৃহের মাথায় রয়েছে একটি সুউচ্চ শিখর বা চূড়া। প্রদীপ উৎসর্গের জন্য রয়েছে ফসিল হয়ে যাওয়া কাঠের একটি স্তম্ভ। মন্দিরের প্রধান দ্বার সিংহদ্বারের রক্ষক দেবতা জয়া ও বিজয়া। মূল প্রবেশপথের সামনে রয়েছে অরুণস্তম্ভ নামে একটি স্মৃতিস্তম্ভ। খুরদার রাজা কোনার্কের সূর্যমন্দির থেকে এটি নিয়ে আসেন। তিন দেবতাকে সাধারণত মন্দিরের অভ্যন্তরেই পূজা করা হয়। তবে প্রতি বছর আষাঢ় মাসে তাঁদের রাজপথে বের করে রথারূহ করে তিন কিলোমিটার দূরে মৌসিমা মন্দিরে নিয়ে যাওয়া হয়। এই সময় ভক্তরা দেবতাকে গণদর্শনের সুযোগ পান। রথযাত্রার সময় সারা পৃথিবী থেকে এখানে ভক্ত সমাগম হয়।