চাতুর্মাস্য ব্রত মাহাত্ম্য

শ্রাবণ-ভাদ্র-আশ্বিন ও কার্তিক। শ্রীভগবান বিষ্ণু ক্ষীর সাগরে শ্বেতদ্বীপে অনন্ত শয্যায় নিদ্রিত হন। বলা হয় শয়নী একাদশী (জগন্নাথ রথযাত্রার পর আষাঢ়ী শুক্লা একাদশী) তিথিতে ভগবান শয়ন গ্রহণ করেন। পার্শ্ব একাদশী (ভাদ্র শুক্লা একাদশী)তে পার্শ্ব পরিবর্তন করেন, এবং উত্থান একাদশী (কার্তিক শুক্লা একাদশী)তে উত্থিত হন।
বছরের এই চারি মাস প্রাকৃতিক কারণে মানুষের দেহ ও মনে রজো ও তমোগুণী প্রভাব অধিক দেখা যায়। অঘটন বেশী ঘটে। তাই কায়মনোবাক্যে সংযত থাকা বাঞ্ছনীয়। কোনও কোনও বিষয়ে কিছু বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়। ভক্তগণ কৃষ্ণভক্তি বৃদ্ধির উদ্দেশ্যে চাতুর্মাস্য ব্রত নিয়ম করেন। চতুর্মাসেষু কর্তব্যং কৃষ্ণভক্তি বিবৃদ্ধয়ে ॥ ভষ্য পুরাণে বলা হয়েছে,
ভষ্য পুরাণে বলা হয়েছে,
যো বিনা নিয়মং মর্ত্যো
ব্রতং বা জপ্যমেব বা।
চাতুর্মাস্য নয়েন্ মূর্খো
জীবন্নপি মৃতো হি সঃ ॥
যে ব্যক্তি নিয়ম, ব্রত বা জপ ব্যতীত চাতুর্মাস্য যাপন করে, সেই ব্যক্তি অজ্ঞ ও জীবন্মৃত।
ব্রত নিয়মগুলি হলো :-
১) বেশী বেশী করে হরিনাম জপ করতে হবে। যারা হরেকৃষ্ণ মহামন্ত্র জপ করেন না, তাঁরা শুরু করে দেবেন। যারা নিয়মিত মন্ত্র জপ করেন, তাঁরা জপসংখ্যা বৃদ্ধি করবেন। কলিবদ্ধ জীবের সদ্গতি লাভের একমাত্র উপায় হরিনাম। আমাদের মনকে সুরক্ষা দান করে মন্ত্র হরিনাম।
২) প্রতিদিন গীতা-ভাগবত শ্রবণ বা পাঠ করতে হবে। ভগবানের কথা, ভক্তের কথা আলোচনাই আমাদের অসার হৃদয়ে আশা ও আনন্দ সঞ্চার করে থাকে। যারা ভগবৎ কথায় সময় দিতে পারে না, তারা আজেবাজে কথায় সময় পেয়ে বসে।
৩) তর্ক, গালগল্প এড়িয়ে চলতে হবে। কলিযুগের মানুষ আমরা তর্ক করতে, ঝগড়া বাধাতে, গালগল্পে খুবই উন্মুখ হয়ে থাকি। টিভি দেখা, নভেল পড়াও এর অন্তর্ভুক্ত। এসব অসৎসঙ্গ দোষ ছাড়া অন্য কিছু নয়।
৪) প্রত্যূষে স্নান সারতে হবে। ভক্তগণ তো ভোর চারটায় স্নান সেরে মঙ্গল আরতিতে যোগ দেন। যত্ন নেন কোনও দিন যেন ফাঁকি না যায়। মঙ্গলময় শ্রীহরির কৃপাকটাক্ষ লাভের উপযুক্ত ব্রাহ্মমুহূর্তে শুচিশুদ্ধ হয়ে জেগে থাকা বাঞ্ছনীয়।
৫) শ্রাবণে শাক, ভাদ্রে দই, আশ্বিনে দুধ এবং কার্তিকে মাষকলাই ডাল খাওয়া চলবে না। এই সময়ে এই দ্রব্যগুলি রোগ সৃষ্টি করে। মন বিক্ষিপ্ত করে। স্কন্দ পুরাণে বলা হয়েছে-
শ্রাবণে বর্জয়েৎ শাকং
দধি ভাদ্রপদে তথা।
দুগ্ধম্ আশ্বযুজে মাসি
কার্তিকে চামিষং ত্যজেৎ ॥
বিশেষতঃ, কার্তিক মাসে বেগুন, বরবটি, শিম আহার নিষিদ্ধ।
৬) শ্রীহরি অর্চন কিংবা শ্রীহরিভক্তিমূলক অন্য কোনও সেবায় নিজেকে নিয়োজিত রাখতে হবে। সবসময় জানতে হবে অলস মস্তিষ্ক শয়তানের কারখানা। আচারে হোক, প্রচারে হোক যেকোনও সেবায় সবসময় সংযুক্ত থাকতে হবে, তাহলেই আমরা ভালো থাকবো। এই চাতুর্মাস্য ব্রতের ব্রতকারীরা কেউ শয়ন একাদশী থেকে উত্থান একাদশী পর্যন্ত, কেউ আষাঢ় মাসের গুরু পূর্ণিমা থেকে কার্তিক মাসের হৈমন্তী রাস পূর্ণিমা পর্যন্ত, আবার কেউ কর্কট সংক্রান্তি থেকে মকর সংক্রান্তি পর্যন্ত- এইভাবে পালন করে থাকেন। মোটামুটি যে দিন শুরু করবেন তার চার মাস পরে সমাপন করবেন।
এই ব্রত ফলে মন সুন্দর হয়, শরীর ও প্রাণ সুন্দর হয়। বলা হয়, চার মাস বিষ্ণু শায়িত থাকেন। মানুষ এই ব্রত করলে বিষ্ণুর সুখনিদ্রা হয়। বিষ্ণুর পাদপদ্ম সেবায় রতা লক্ষ্মীদেবী তখন ব্রতকারীদের প্রতি প্রসন্না হন। তখন লক্ষ্মীর তুষ্ট দৃষ্টিপাতের ফলে ব্রতকারী লক্ষ্মীমন্ত হয়। নিয়ম শিষ্টাচার হীন হলে বিষ্ণুর নিদ্রা বিঘ্নিত হয়। বিষ্ণুর পাদপদ্ম সেবায় রতা লক্ষ্মীদেবী তখন অনুভব করেন যে, লোকেরা ব্রতহীন ও উচ্ছৃঙ্খল হওয়ার ফলে প্রভুর নিদ্রা বিঘ্নিত হচ্ছে। তখন লক্ষ্মীদেবী ব্রতহীনদের প্রতি রুষ্টা হন। তাঁর রুষ্ট দৃষ্টিপাতের ফলে লোকে লক্ষ্মীছাড়া হয়। তখন জীবনে নানা রকমের দুর্বিপাক লেগে থাকে।
এবং চ কুর্বতো মাসাং
শ্চতুরো যান্তি বৈ সুখম্।
অন্যথা প্রভবেদ্ দুঃখম্
অনাবৃষ্টিশ্চ জায়তে ॥
“এভাবে চারি মাস ব্রত পালন করলে সুখে যাপন হবে। নতুবা দুঃখের প্রভাব বৃদ্ধি হবে, অনাবৃষ্টি ও অন্যান্য দুর্বিপাক লেগে থাকবে।”
সার্বিক ব্রতনিয়ম থাকা সত্ত্বেও ব্যক্তিগত কিছু কিছু ব্রতসংকল্প করে থাকেন কোনও কোনও ব্রতকারী। সেই আচরণগুলিও শাস্ত্রসম্মত। যেমন-
১) সারাদিনে একবার মাত্র হবিষ্যান্ন গ্রহণ করা,
২) বিছানা না পাতিয়ে মাটিতে ঘুমানো, ৩) থালা-বাটি ব্যবহার না করে কলাপাতা বা পদ্মপাতা ব্যবহার করা,
৪) শরীরে তেল না মাখা,
৫) নখ, চুল না কাটা,
৬) মৌনী থাকা।
বিভিন্ন প্রকার ব্রত আচরণেও ভিন্ন ভিন্ন পুরস্কার বিহিত রয়েছে। কেউ কেউ লবণ খাবে না, কেউ কেউ মিষ্টি জিনিস খাবে না, কেউ কেউ দুধজাতীয় কোনও খাবার গ্রহণ করবে না। কেউ কেউ মাটিতে মুখ দিয়ে খাবার গ্রহণ করেন। আমাদের দেশে অনেকেই আমিষপ্রিয় ও নেশাপ্রিয় মানুষ রয়েছেন। সেক্ষেত্রে বলা হয়েছে, যদি কেউ চাতুর্মাস্যে মদ ও মাছ-মাংস বর্জন করতে পারে, তবে সে এক সুন্দর যোগী হতে পারবে, ওজস্বী ব্যক্তিত্ব হতে পারবে। পরিশেষে, উল্লেখ্য এই যে, শ্রীহরির প্রতি একটু একটু ভক্তি অনুশীলন, বার ব্রত পালন, আমাদের জীবনকে পবিত্র ও মহান করে তোলে।