চিন্তামণি কর অভয়ারণ্য ভ্রমণ

পশ্চিমবঙ্গের অভয়ারণ্য এর মধ্যে একটু ব্যতিক্রমি পাখিরালয় চিন্তামণি কর Chintamani Kar Bird Sanctuary। কলকাতা শহরের মধ্যেই নাগরিক কোলাহলের থেকে শান্তি দিতে প্রায় সতের একর জমির উপর চিন্তামণি কর পাখিরালয়টি গড়ে উঠেছে। এই পাখিরালয়টি ‘কয়ালের বাগান’ নামেও পরিচিত। এই পাখিরালয় , যেটুকু সবুজ গিলে খেয়েছে এই শহর কলকাতার কংক্রিট-মেলা, তার বিপরীতে এই পাখিরালয় যেন এক বুক অক্সিজেনের ভাণ্ডার।
প্রকৃতিপ্রেমী কিংবা সবুজপ্রেমী হওয়ার পাশাপাশি কারও যদি পাখি দেখার নেশা থাকে, কিংবা পাখির ছবি তোলার আগ্রহ থাকে তাহলে সপ্তাহান্তের ছুটিতে বেরিয়ে পড়াই যায় চিন্তামণি কর পাখিরালয় ভ্রমণে। চিন্তামণি কর পাখিরালয়। চিত্র ইন্টারনেট। পশ্চিমবঙ্গের মধ্যে দক্ষিণ কলকাতার নরেন্দ্রপুর অঞ্চলে এই চিন্তামণি কর পাখিরালয়টি অবস্থিত। সড়কপথে গড়িয়া ও ই এম বাইপাসের সঙ্গে সংযুক্ত রয়েছে এই পাখিরালয়টি।
শিয়ালদা রেলস্টেশন থেকে ১৫ কিমি এবং হাওড়া রেলস্টেশন থেকে ২০ কিমি দূরত্বে অবস্থিত চিন্তামণি কর পাখিরালয় পাখিপ্রেমীদের কাছে এক আদর্শ পর্যটন স্থান। বহু আগে এই পাখিরালয় ‘কয়ালের বাগান’ নামে পরিচিত ছিল। ১৯৮২ সালে একে অভয়ারণ্যের মর্যাদা দেওয়া হয়। এর আগে যদিও বিশাল বিশাল আমগাছের সম্ভার ছিল এই অঞ্চলে।
পশ্চিমবঙ্গ সরকারের উদ্যোগে সাধারণ মানুষের জন্য এই বনাঞ্চল খুলে দেওয়া হয় এবং ২০০৫ সালের অক্টোবর মাসে ব্যক্তিগত মালিকানা থেকে এই বনাঞ্চলকে সরকারি সম্পত্তি হিসেবে ঘোষণা করা হয়। ২০০৪ সালের ৮ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত এই বনভূমি নরেন্দ্রপুর বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য নামে পরিচিত ছিল এবং ২০০৫ সালের ২১ অক্টোবর এর নতুন নামকরণ হয় ‘চিন্তামণি কর পাখিরালয়’।
বিখ্যাত ভারতীয় ভাস্কর চিন্তামণি করের নাম জড়িয়ে রয়েছে এই পাখিরালয়ের সঙ্গে। খড়গপুরে ১৯১৫ সালের ১৯ এপ্রিল জন্মেছিলেন চিন্তামণি কর। অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর, গিরিধারী মহাপাত্র এবং ভিক্টর জিওভানেলির কাছে ভাস্কর্য ও ছবি আঁকা শিখেছিলেন তিনি। পরবর্তীকালে তিনি প্যারিসে চলে যান ভাস্কর্য শিল্প চর্চার জন্য, কয়েক বছর সেখানে কাটিয়ে আবার ভারতে ফিরে আসেন তিনি।
পদ্মভূষণ সম্মানে ভূষিত চিন্তামণি কর এবং অন্যান্য স্থানীয় মানুষেরা এই বনাঞ্চলকে অভয়ারণ্যের মর্যাদা দেওয়া এবং তা সংরক্ষণের জন্য বহু সংগ্রাম করেছেন। পরবর্তীকালে তাই তাঁর স্মৃতিতে এই বনভূমির নামকরণ হয় চিন্তামণি কর পাখিরালয়। সাধারণ মানুষের মধ্যে খুব একটা পরিচিতি নেই এই অভয়ারণ্যের। তবে কলকাতার পাখিপ্রেমীদের কাছে পাখি দেখা কিংবা ছবি তোলার এ এক আদর্শ জায়গা। পাখিরালয়ের ভিতরে ঢুকলেই অনেকগুলি পায়ে চলার পথ দেখতে পাওয়া যায়।
এর যে কোনও একটি ধরে এগিয়ে যেতে যেতে ক্রমেই নাগরিক কোলাহল সব শান্ত হয়ে নির্জনতা ভেঙে পাখির মিষ্টি কূজন শুনতে পাওয়া যায়। সমস্ত বন জোড়া নিস্তব্ধতার মধ্যে কেবল পায়ের নীচে দলিত শুকনো পাতার খসখস আওয়াজই যেন বীর-বিক্রমে আমাদের অস্তিত্বকে জানান দিয়ে যাবে সমস্ত বন জুড়ে। পাখিরালয়ের ভিতরে প্রচুর বড় বড় গাছ, কোনও কোনও গাছের ডাল থেকে আবার লতানে গাছও ঝুলতে দেখা যায় কিংবা চোখে পড়ে সুদৃশ্য অর্কিড। রঙিন প্রজাপতি, লেবুরঙা ফড়িং কিংবা ল্যাজ-দোলানো ফিঙে পাখি প্রথমেই চোখ কেড়ে নেবে আপনার।
চিন্তামণি কর পাখিরালয়টি প্রায় সতের একর জমির উপর গড়ে উঠেছে। বিভিন্ন জাতের পাখির পাশাপাশি বনবেড়াল, গোসাপ, সিভেট বেড়াল, বেজি ইত্যাদিও রয়েছে এই বনভূমিতে। পাখিদের জল পিপাসা মেটানোর জন্য এখানে জঙ্গলের মাঝে মাঝেই জলাধারের ব্যবস্থা করা আছে। জল খেতে আসা পাখিদের ক্যামেরাবন্দী করে নেওয়ার সুযোগ তাই হাতছাড়া করা উচিত নয়।
তবে যথেষ্ট দুরত্ব বজায় রেখে ছবি তুলুন যাবে ক্যামেরার শব্দে তাদের বিরক্তি না হয়। সমগ্র জঙ্গলটি বড় বড় গাছের পাশাপাশি কাঁটা ও লতা ঝোপে পরিপূর্ণ। কাঁটাগাছগুলির জন্য জঙ্গলে প্রবেশ করা একটু দুষ্কর হতে পারে। পাখিদের বাসস্থান গাছ, আর সেই গাছের মধ্যে এই পাখিরালয়ে অধিকাংশই ফলের গাছ যা কিনা একশ বছরেরও বেশি পুরনো। আম, কাঁঠাল, নারকেল, সবেদা, তেঁতুল, পেয়ারা, ডুমুর ইত্যাদি বিভিন্ন গাছ রয়েছে এই পাখিরালয়ে।
ট্রেনে করে চিন্তামণি কর পাখিরালয় আসতে গেলে শিয়ালদা স্টেশনের দক্ষিণ শাখা থেকে বালিগঞ্জ জংশন কিংবা সোনারপুর জংশনগামী ট্রেনে উঠে নরেন্দ্রপুর স্টেশনে নামতে হবে। তারপর সেখান থেকে নরেন্দ্রপুর রথতলার দিকে সামান্য একটু হেঁটে গেলেই রাস্তার উপরেই পড়বে এই পাখিরালয়। হাওড়া থেকে বাসে করে গড়িয়া কিংবা নরেন্দ্রপুরগামী বাসে চেপে নরেন্দ্রপুর বাস স্টপে নেমে একইভাবে রথতলার দিকে হেঁটে যেতে হবে। আর যাদবপুরগামী বাসে উঠলে যাদবপুরের ৮বি স্ট্যান্ডে নেমে সেখান থেকে অটো করে গড়িয়া মোড় এবং তারপরে আবার অটো করে নরেন্দ্রপুর বাসস্ট্যান্ডে নেমে পড়া যায়।
আশেপাশে থাকার জায়গা বলতে নরেন্দ্রপুরে সামান্য কয়েকটি অনামী হোটেল রয়েছে। তবে যেহেতু বেশিরভাগ পর্যটকই একদিনের ট্রিপেই এই পাখিরালয় ঘুরে দেখেন, তাই হোটেল বা হোম-স্টে বিশেষ সহজলভ্য নয় এখানে। তবে বাইরে থেকে ঘুরতে এলে কলকাতাতে থেকেই একদিনে চিন্তামণি কর পাখিরালয় ঘুরে আসতে পারেন। কলকাতায় থাকার জন্য প্রচুর হোটেল রয়েছে। এখানে একমাত্র বিশেষ দ্রষ্টব্য বলতে পাখিরালয়ের হাজার হাজার প্রজাতির পাখি আর কয়েক ধরনের পশু।
দোয়েল, হরিয়াল, নীলকণ্ঠ, টুনটুনি, বাঁশপাতি, দুধরাজ, কাঠঠোকরা, নানারকম প্যাঁচা, বেনে বউ, মাছরাঙা, মৌটুসি, বসন্তবৌরি ইত্যাদি প্রজাতির পাখি দেখাই যায় চিন্তামণি কর পাখিরালয়ে। তাছাড়া ভাগ্য ভাল থাকলে ওয়াট-ব্রো-ফ্রনটেল, অরেঞ্জ হেডেড থ্রাশ বা দামা পাখি, ব্রাউন ফিস আউল, লং টেল নাইট জার, স্ট্রেক ব্রেস্টেড উডপেকার ইত্যাদি দুর্লভ পাখির দেখাও মিলতে পারে। চার রকমের কাঠঠোকরা পাখি রয়েছে এই বনভূমিতে, রয়েছে এমারেল ডাভ বা রাজঘুঘু, কমন হব টাক্কু বা চোখ গেল পাখি ইত্যাদি। তবে পাখি দেখার জন্য সতর্ক দৃষ্টি দিয়ে জঙ্গলের পাতার খাঁজে-খাঁজে নজর রাখতে হবে। সাধারণত এই পাখিরালয়ে দুপুরবেলাই পাখি দেখার আদর্শ সময়।
কারণ এই সময়েই তৃষ্ণার্ত পাখিরা জলাধারে জল খেতে আসে। গরমকালে এলে ঠিক এই দুপুরবেলাই পাখিদেরকে স্নান করতে দেখা যায়। গরমকালে সাধারণত জল খেতে আর স্নানের প্রয়োজনেই পাখিরা গভীর জঙ্গল থেকে বাইরে বেরিয়ে আসে। চিন্তামণি কর পাখিরালয়। চিত্র ইন্টারনেট। চিন্তামণি কর পাখিরালয়ে ঢোকার জন্য আগে থেকে অনুমতি নেওয়ার প্রয়োজন না হলেও গেটে টিকিটের ব্যবস্থা রয়েছে। ৫০ টাকা দিয়ে টিকিট কেটে পাখিরালয়ে প্রবেশ করা যায়।
তবে জঙ্গলে ঘোরার জন্য উপযুক্ত পোশাক ও জুতো পরা আবশ্যক। গরমকালে এলে সাপের ভয় থাকে, তাই ভাল জুতো একটি আত্মরক্ষার উপকরণ হতে পারে। অভয়ারণ্যের ভিতরে জোরে জোরে চিৎকার করা, উঁচু স্বরে কথা বলা কিংবা গান বাজানো একেবারেই অনুচিত। এখানকার পাখিদের কোনওভাবেই বিরক্ত করা উচিত নয়। পাখি দেখা বা ছবি তোলাতে কোনও নিষেধাজ্ঞা নেই ঠিকই, কিন্তু পাখি শিকার একেবারেই নিষিদ্ধ এবং অপরাধ হিসেবে গণ্য। জঙ্গলের পরিবেশ যাতে কোনওভাবে নোংরা না হয়, সেদিকে সতর্ক থাকতে হবে। শিশুদেরও সঙ্গে নিয়ে আসা যায় এই পাখিরালয়ে, তবে জঙ্গলের ভিতরে তাঁদের নিয়ে পিকনিক করতে বসে যাবেন না।
পাখিরালয়ের ভিতরে গাড়ি, সাইকেল কিংবা বাইক নিয়ে ঢোকা নিষেধ। সবশেষে পাখিরালয়ের ভিতরে প্লাস্টিকের বোতল বা অন্যান্য জিনিস নিয়ে প্রবেশ করা যায় না। তাই সঙ্গে প্লাস্টিকের জলের বোতল বা অন্য কিছু থাকলে তা গেটের বাইরেই জমা রেখে আসতে হবে। বছরের যে কোনও সময়ই চিন্তামণি কর পাখিরালয় ভ্রমণে আসা যায়। কিন্তু গরমকাল আর শীতকাল পাখি দেখার আদর্শ সময়। যদিও গরমকালে যেহেতু পাখিরা গভীর জঙ্গল ছেড়ে প্রায়ই জল খেতে ও স্নান করতে বাইরে আসে, তাই ঐ সময় পাখিদের নজর করার সুযোগ আরও বেড়ে যায়।
বর্ষাকাল এড়িয়ে চলাই ভাল। গরমকালে প্রতিদিন সকাল ৬টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত এবং শীতকালে সকাল ৭টা থেকে বিকেল ৪টে ৩০ পর্যন্ত এই পাখিরালয় খোলা থাকে। ট্রিপ টিপস কীভাবে যাবেন – শিয়ালদা স্টেশনের দক্ষিণ শাখা থেকে বালিগঞ্জ জংশন কিংবা সোনারপুর জংশনগামী ট্রেনে উঠে নরেন্দ্রপুর স্টেশনে নামতে হবে। তারপর সেখান থেকে নরেন্দ্রপুর রথতলার দিকে সামান্য একটু হেঁটে গেলেই রাস্তার উপরেই পড়বে এই পাখিরালয়। হাওড়া থেকে বাসে করে গড়িয়া কিংবা নরেন্দ্রপুরগামী বাসে চেপে নরেন্দ্রপুর বাস স্টপে নেমে একইভাবে রথতলার দিকে হেঁটে যেতে হবে।
কোথায় থাকবেন – নরেন্দ্রপুরের আশেপাশে থাকার জায়গা দু-চারটে রয়েছে, তবে তা তেমন বিখ্যাত নয়। থাকার জন্য কলকাতা ভালো হবে। কী দেখবেন – কয়েক হাজার প্রজাতির পাখি, গোসাপ, বনবেড়াল, সিভেট বেড়াল, বেজি এবং বিভিন্ন ফলের গাছ। পাখিদের মধ্যে দোয়েল, হরিয়াল, নীলকণ্ঠ, টুনটুনি, বাঁশপাতি, দুধরাজ, কাঠঠোকরা, নানারকম প্যাঁচা, বেনে বউ, মাছরাঙা, মৌটুসি, বসন্তবৌরি, চার রকমের কাঠঠোকরা, দামা পাখি, রাজঘুঘু ইত্যাদি প্রায়ই চোখে পড়ে।
কখন যাবেন – বছরের যে কোনও সময়ই চিন্তামণি কর পাখিরালয় ভ্রমণে আসা যায়। গরমকাল আর শীতকাল পাখি দেখার আদর্শ সময়। সতর্কতা – গরমকালে প্রতিদিন সকাল ৬টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত এবং শীতকালে সকাল ৭টা থেকে বিকেল ৪টে ৩০ পর্যন্ত এই পাখিরালয় খোলা থাকে। জঙ্গলে ঘোরার জন্য উপযুক্ত পোশাক ও জুতো পরা আবশ্যক।
অভয়ারণ্যের ভিতরে জোরে জোরে চিৎকার করা, উঁচু স্বরে কথা বলা কিংবা গান বাজান একেবারেই অনুচিত। এখানকার পাখিদের কোনওভাবেই বিরক্ত করা উচিত নয়। পাখি শিকার একেবারেই নিষিদ্ধ এবং অপরাধ হিসেবে গণ্য। জঙ্গলের পরিবেশ যাতে কোনওভাবে নোংরা না হয়, সেদিকে সতর্ক থাকতে হবে। জঙ্গলের ভিতরে পিকনিক করতে বসে যাবেন না।
পাখিরালয়ের ভিতরে গাড়ি, সাইকেল কিংবা বাইক নিয়ে ঢোকা নিষেধ। পাখিরালয়ের ভিতরে প্লাস্টিকের বোতল বা অন্যান্য জিনিস নিয়ে প্রবেশ করা যায় না। এখানে খাবার দোকান নেই। তাই খেয়েদেয়ে বেরলে ভালো হবে। বিশেষ পরামর্শ – পাখিরালয়ের ভিতরে প্রবেশের সঙ্গে সঙ্গে সতর্ক দৃষ্টি রাখতে হবে পাখি দেখার জন্য। ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করলে পাখিদের ফ্রেমবন্দি করার অনেক সুযোগ পাবেন।