দক্ষিণেশ্বর মন্দির

দক্ষিণেশ্বর মন্দির

দক্ষিণেশ্বর মন্দির Dakshineswar Temples কলকাতার অদূরে হুগলি নদীর তীরে অবস্থিত একটি কালীমন্দির। এটি উত্তর চব্বিশ পরগনা জেলার কামারহাটি শহরের অন্তঃপাতী দক্ষিণেশ্বরে অবস্থিত। ১৮৫৫ সালে প্রসিদ্ধ মানবদরদি জমিদার রানি রাসমণি এই মন্দিরটি প্রতিষ্ঠা করেন।  এই মন্দিরে দেবী কালীকে "ভবতারিণী" নামে পূজা করা হয়। ঊনবিংশ শতাব্দীর বিশিষ্ট যোগী রামকৃষ্ণ পরমহংস এই মন্দিরে কালীসাধনা করতেন।

গঙ্গা থেকে দক্ষিণেশ্বর মন্দির। ছবি ইন্টারনেট ভারতবর্ষে যে ক’টি কালী সাধনা স্থল আছে, দক্ষিণেশ্বর মন্দির তাদের মধ্যে অন্যতম। এখানে যদেবী কালীকে “ভবতারিণী” রূপে পূজা করা হয়। এই মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন রানি রাসমণিদেবী। রামকৃষ্ণ তাঁর মৃত্যুর আগে অবধি এই মন্দিরের প্রধান পুরোহিত ছিলেন। হুগলী নদীর তীরে উত্তর ২৪ পরগণার কামারহাটি অঞ্চলে দক্ষিণেশ্বর মন্দির অবস্থিত।

প্রচলিত জনশ্রুতি অনুসারে ১৮৪৭ সালে কলকাতার জানবাজারের রানী রাসমণিদেবী কাশীতে তীর্থযাত্রার ঠিক আগের দিন রাতে দেবী কালীর স্বপ্নাদেশ পান যে তাঁর কাশী যাওয়ার প্রয়োজন নেই। গঙ্গাতীরেই একটি মন্দিরে কালী মূর্তি প্রতিষ্ঠা করে পূজা করলে দেবী সেই মূর্তিতে আবির্ভূত হয়েই পূজা গ্রহণ করবেন। তখন রানী দক্ষিণেশ্বর মন্দিরের ২০ একরের প্লটটি জন হেস্টি নামে এক ইংরেজের কাছ থেকে কেনেন। জায়গাটিকে সবাই বলত ‘সাহেবান বাগিচা’। এর একটি অংশ ছিল মুসলমানদের কবরখানা। জমিটি দেখতে কচ্ছপের পিঠের মত তাই তন্ত্রমতে স্থানটি শক্তি উপাসনার জন্য উপযুক্ত বলে বিবেচিত হয়।

১৮৪৭ সালে এই বিরাট মন্দিরের নির্মাণকাজ শুরু হয় এবং শেষ হয় ১৮৫৫ সালে। তবে রানী জাতিতে শূদ্র হওয়ায় সামাজিক প্রথা অনুযায়ী কোন ব্রাহ্মণই মন্দির প্রতিষ্ঠা ও দেবীকে ভোগ দিতে রাজি হলেন না। অবশেষে কলকাতার ঝামাপুকুর চতুষ্পাঠীর পণ্ডিত রামকুমার চট্টোপাধ্যায় রাজি হলেন এবং তাঁর ভাই রামকৃষ্ণকে নিয়ে দক্ষিণেশ্বরে উপস্থিত হলেন। ১৮৫৫ সালের ৩১ মে জগন্নাথের স্নানযাত্রার দিনে রামকুমারের হাতেই মূর্তির প্রতিষ্ঠা হয় এবং তিনি মারা গেলে তাঁর ভাই রামকৃষ্ণের ওপর পূজা করার দায়িত্ব এসে পড়ে।

তবে চাকরিতে ঠাকুর রামকৃষ্ণের আগ্রহ কখনওই ছিল না। কিন্তু রানীর জামাই মথুরবাবু একপ্রকার জোর করেই তাঁকে পূজার দায়িত্ব দিলেন এবং ভাগ্নে হৃদয়কে দুই ভাইয়ের সাহায্যকারী হিসেবে নিযুক্ত করলেন। কিছুকাল বাদে ঠাকুরের পুজো দেখে মথুরবাবু শাশুড়ি রাসমণিকে বলেছিলেন, “অদ্ভুত পূজারী পাওয়া গিয়েছে, দেবী বোধহয় শীঘ্রই জাগ্রতা হয়ে উঠবেন।” মা ভবতারিণীর মূর্তি। ছবি ইন্টারনেট দক্ষিণেশ্বর মন্দির হিন্দুদের বিশেষ করে শাক্ত সম্প্রদায়ের কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি মন্দির।

সারা ভারতে গঙ্গার পাড়ে যত মন্দির রয়েছে, দক্ষিণেশ্বর মন্দির তাদের মধ্যে অন্যতম। শুধু ধর্মের দিক থেকেই না, ভাস্কর্যের দিক থেকেও বঙ্গীয় স্থাপত্যশৈলীর নবরত্ন স্থাপত্যধারায় নির্মিত এই মন্দিরের আলাদা গুরুত্ব রয়েছে । সপ্তাহের প্রতিটা দিনই বিশেষ করে শনিবারে এখানে প্রচুর ভিড় হয়। কালীপূজা এখানের প্রধান উৎসব। প্রতি বছরই কালীপূজার দিন ভোর থেকে কয়েক হাজার ভক্তদের ভিড়ে ভরে যায় মন্দির চত্বর। চতুর্থ প্রহরে পূজা শেষ হওয়ার পরে সকালে প্রসাদ নিয়ে মন্দির থেকে বাড়ি ফেরেন তাঁরা।

কালীপূজা ছাড়াও অন্যান্য ছুটির দিন বিশেষ করে পয়লা বৈশাখ, পয়লা জানুয়ারিতে প্রচুর মানুষ ঘুরতে এবং পূজা দিতে আসে এখানে। হাওড়া থেকে বাস বা অটো করে বালি, তারপর সিঁড়ি বেয়ে ওপরের রাস্তায় এলে সেখান থেকে দক্ষিণেশ্বর মন্দির যাওয়ার অটো পাওয়া যায়। ট্রেনে করে আসলে শিয়ালদহ স্টেশন থেকে ডানকুনি গামী ট্রেনে আসতে হবে দক্ষিণেশ্বর স্টেশন। সেখান থেকে মন্দির পায়ে হাঁটা পথ। মেট্রো করে এলে কলকাতার বিভিন্ন মেট্রো স্টেশন থেকে দক্ষিণেশ্বর মেট্রো স্টেশন আসা যায়।

নিজের বা ভাড়ার গাড়ি করে এলে মন্দিরের পার্কিং-এ গাড়ি রাখার সুব্যবস্থা আছে। থাকার জন্য এখানে বেশ কয়েকটি লজ আছে। তবে সাধারণত কলকাতা, হাওড়া, হুগলী এবং পার্শ্ববর্তী অঞ্চল থেকে লোকেরা একদিনের জন্যই এখানে ঘুরতে এবং পূজা দিতে আসে। সন্ধ্যাবেলায় দক্ষিণেশ্বর মন্দির দক্ষিণেশ্বর মন্দির বলতে অবশ্যই মা ভবতারিণীর মন্দির বোঝায়। গঠনের দিক থেকে দেখলে নবরত্ন স্থাপত্যধারায় নির্মিত মূল মন্দিরটি তিন তলা। উপরের দুটি তলে এর নয়টি চূড়া রয়েছে। ৪৬ বর্গফুট প্রসারিত ও ১০০ ফুট উঁচু দালানের উপর গর্ভগৃহটি স্থাপিত। গর্ভগৃহে রুপোর তৈরি হাজার পাপড়ির পদ্মের উপর রাখা আছে শায়িত শিবের বুকে মা কালীর মূর্তি।

এখানে কালীর রূপ মা ভবতারিণী। অনেকে আবার দক্ষিণাকালীও বলে থাকে। একটি পাথর থেকেই তৈরি হয়েছে সম্পূর্ণ মূর্তি। এর দক্ষিণদিকে রয়েছে নাটমন্দির। এছাড়াও মন্দির চত্বরে আরও একাধিক মন্দির রয়েছে। মন্দির চত্বরের উত্তর-পূর্বদিকে রয়েছে রাধাকৃষ্ণ মন্দির বা রাধাকান্ত মন্দির এবং গঙ্গার ধারে রয়েছে দ্বাদশ শিবমন্দির। দ্বাদশ শিবমন্দির হল আটচালা স্থাপত্যরীতিতে নির্মিত বারোটি শিবমন্দির। মন্দিরগুলো সবকটা পূর্বমুখী এবং গঙ্গাঘাটের দুইদিকে অবস্থিত।

মন্দির চত্বরের উত্তর-পশ্চিম কোণে রয়েছে রামকৃষ্ণ পরমহংসের বাসগৃহ। মন্দির চত্বরের বাইরে রয়েছে পঞ্চবটী উদ্যান, নহবতখানা। জুতো পড়ে বা ক্যামেরা, মোবাইল বা বড় ব্যাগ নিয়ে মন্দিরের ভিতরে প্রবেশ নিষেধ। সবকিছু বাইরে রাখবার ব্যবস্থা আছে। পূজা দিতে চাইলে মন্দিরের বাইরে পূজা মার্কেটের দোকান থেকে পূজার সামগ্রী কিনতে পারেন। নিজেও আলাদাভাবে পূজার সামগ্রী নিয়েই যেতে পারেন। মন্দিরে পুরোহিত বা পাণ্ডাদের কোন উৎপাত নেই। দোকান থেকে কিনলে, সেখানেই জুতো রাখতে পারেন।

তবে আগে থেকে তাঁদের সাথে ভালোভাবে কথা বলে নিন। দক্ষিণেশ্বর মন্দির থেকে পায়ে হাঁটা পথে রয়েছে আদ্যাপীঠ মন্দির। বয়স্ক মানুষ থাকলে টোটো ধরেও যেতে পারেন সেখানে। এছাড়াও সাড়ে চার কিলোমিটারের মধ্যেই রয়েছে বেলুড় মঠ। ভক্তেরা মেট্রো করে একদিনেই কালীঘাট মন্দির এবং দক্ষিণেশ্বর মন্দির দুটোই ঘুরে থাকেন। কেনাকাটির জন্য “পণ্য বীথিকা” বিল্ডিং সারা বছর দক্ষিণেশ্বর মন্দির খোলা থাকে। অমাবস্যার তিথি, শনি-রবিবার, অন্যান্য ছুটির দিন বা বিভিন্ন পূজার দিনগুলোয় এখানে প্রচুর ভিড় হয়।

পূজার ব্যাপার না থাকলে এবং ভিড় এড়িয়ে শুধুমাত্র ঘুরতে চাইলে এই দিনগুলো এড়িয়ে যেতে পারেন। মন্দিরের সময়সূচি দেখে নেবেন। বিশেষ দিনে যেমন কালীপূজায় মন্দির সারা রাতও খোলা থাকে। মন্দির চত্বরের ঠিক বাইরেই হিং-এর কচুরির দোকান আছে। এছাড়াও রয়েছে মিষ্টি। তবে দোকানের জল না খাওয়া ভালো। নিজের জল সঙ্গে রাখুন। মন্দির চত্বরের মধ্যে রয়েছে অফিস, যেখান থেকে মন্দিরের ম্যাগাজিন বা অন্য বই কিনতে পারেন। মন্দির চত্বরের ঠিক বাইরেই বিভিন্ন জিনিস কেনাকাটির অনেক দোকান নিয়ে রয়েছে “পণ্য বীথিকা” বিল্ডিং।

সেখান থেকে মন্দির বা মন্দিরের বিগ্রহের ছবি, হাতের কাজের জিনিস, পাথরের ওপর কাজ, শিবলিঙ্গ বা অন্যান্য পাথরের মূর্তি,ধাতুর মূর্তি বা থালা বাসন কিনতে পারেন। ট্রিপ টিপস কিভাবে যাবেন – হাওড়া থেকে বাস বা অটো করে বালি, তারপর সিঁড়ি বেয়ে ওপরের রাস্তায় এলে সেখান থেকে দক্ষিণেশ্বর মন্দির যাওয়ার অটো পাওয়া যায়। ট্রেনে করে আসলে শিয়ালদহ স্টেশন থেকে ডানকুনি গামী ট্রেনে আসতে হবে দক্ষিণেশ্বর স্টেশন।

সেখান থেকে মন্দির পায়ে হাঁটা পথ। মেট্রো করে এলে কলকাতার বিভিন্ন মেট্রো স্টেশন থেকে দক্ষিণেশ্বর মেট্রো স্টেশন আসা যায়। নিজের বা ভাড়ার গাড়ি করে এলে মন্দিরের পার্কিং-এ গাড়ি রাখার সুব্যবস্থা আছে। কোথায় থাকবেন- এখানে বেশ কয়েকটি লজ আছে। কি দেখবেন – দক্ষিণেশ্বর মন্দির বলতে মা ভবতারিণীর মন্দির। এছাড়াও মন্দির চত্বরে রয়েছে রাধাকৃষ্ণ মন্দির, দ্বাদশ শিবমন্দির এবং রামকৃষ্ণ পরমহংসের বাসগৃহ। দক্ষিণেশ্বর মন্দির থেকে পায়ে হাঁটা পথে রয়েছে আদ্যাপীঠ মন্দির এবং সাড়ে চার কিলোমিটারের মধ্যেই রয়েছে বেলুড় মঠ।

কখন যাবেন – সারা বছর দক্ষিণেশ্বর মন্দির খোলা থাকে। অমাবস্যার তিথি, শনি-রবিবার, অন্যান্য ছুটির দিন বা বিভিন্ন পূজার দিনগুলোয় এখানে প্রচুর ভিড় হয়। সতর্কতা –মন্দিরের সময়সূচি দেখে নেবেন। করোনার সময় বেশ কিছু পরিবর্তন এসেছে। আবার বিশেষ দিনে যেমন কালীপূজায় মন্দির সারা রাতও খোলা থাকে। জুতো পরে বা ক্যামেরা, মোবাইল বা বড় ব্যাগ নিয়ে মন্দিরের ভিতরে প্রবেশ নিষেধ। সবকিছু বাইরে রাখবার ব্যবস্থা আছে। দোকানের জল না খাওয়াই ভালো। নিজের জল সঙ্গে রাখুন। বিশেষ পরামর্শ – পূজা দিতে গেলে যে দোকান থেকে পূজার সামগ্রী কিনছেন, সেখানেই জুতো রাখতে পারেন। তবে আগে থেকে তাঁদের সাথে ভালোভাবে কথা বলে নিন। মেট্রো করে একদিনেই দক্ষিণেশ্বর মন্দির এবং কালীঘাট মন্দির ঘুরে ও পূজা দিয়ে আসতে পারেন। 

মূল মন্দিরের কাছে যে বারোটি একই প্রকার দেখতে পূর্বমুখী শিবমন্দির রয়েছে সেগুলি আটচালা স্থাপত্যরীতিতে নির্মিত। গঙ্গার একটি ঘাটে দুই ধারে এই মন্দিরগুলি দণ্ডায়মান। মন্দির চত্বরের উত্তর-পূর্বে রয়েছে রাধাকান্ত মন্দির। এই মন্দিরে একটি রুপোর সিংহাসনে সাড়ে একুশ ইঞ্চির কৃষ্ণ ও ষোলো ইঞ্চির রাধামূর্তি প্রতিষ্ঠিত। এবং রানী রাসমণির গৃহদেবতা(রঘুুবীর, জনার্দন(কৃষ্ণ) , নাড়ু- গোপাল) বর্তমানে দক্ষিণেশ্বরে অধিষ্ঠান করছেন।