পশ্চিম মেদিনীপুর এর শহর দাসপুর

দাসপুর' Daspur নামটি আমাদের কাছে অনেকটা আবেগের মতো।পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার ঘাটাল মহকুমার দাসপুর থানার সদর(জে.এল.নং ৬০)এই দাসপুর। থানা,হাসপাতাল,হাই স্কুল,ব্যাঙ্ক,ডাকঘর,নানা সরকারি-বেসরকারি অফিস, দোকান-বাজার সবমিলে ঘাটাল-পাঁশকুড়া রোডের ওপর দাসপুর এক জনবহুল জনপদ। হাওড়া-খড়্গপুর রেলপথে হাওড়া থেকে পাঁশকুড়া এবং সেখান থেকে বাসে অথবা হাওড়া স্টেশন এলাকা থেকে বাসে সরাসরি দাসপুরে আসা যায় ঘন্টা তিনেকের মধ্যে।
শিলাবতী নদীর পূর্বতীরে,একসময়কার রেশম ও তাঁতশিল্প, শর্করাশিল্পের খ্যাতনামা বাণিজ্যকেন্দ্র দাসপুর স্বাধীনতা সংগ্রামের সন্ত্রাসবাদী অধ্যায়ে এক বিখ্যাত স্থান। ইতিহাসের পাতা উল্টাতে উল্টাতে দাসপুরের পুরোনো কিছু কথা তুলে ধরতে এলাম।একটু লম্বা হয়েছে তবে কথা দিলাম পড়লে নিরাশ হবেন না। বিস্তীর্ণ জলাভূমির নীচে দীর্ঘকাল সুপ্ত থাকা আজকের দাসপুর ভূখণ্ডের উদ্ভব কবে ঘটে বা মানুষজনের বাসের উপযোগী হয়ে ওঠে তা জানা যায় না।
তবে এটা বলা যায় যে, খ্রিস্টপূর্ব পঞ্চম শতকে রচিত 'আচারঙ্গসূত্রে' উল্লিখিত রাঢ়দেশের অন্যতম বিভাগ সূক্ষভূমি বা দক্ষিণরাঢ়ের অন্তর্গত ছিল আজকের দাসপুর। বিহারের মানভূম অঞ্চল থেকে উৎপন্ন এবং বাঁকুড়া হয়ে প্রবাহিত শিলাবতী নদীর পূর্বতীরে দাসপুর আর পশ্চিমতীরে গড়ে উঠেছিল গুপ্ত-পাল-সেনযুগের সভ্যতার অন্যতম কেন্দ্র পান্নাগ্রাম (বর্তমানে ঘাটাল থানা)।
দাসপুরের পূর্বপ্রান্তে রূপনারায়ণ তীরবর্তী ক্ষেপুত গ্রামে, পালযুগে (৯ম-১০ম শঃ) বৌদ্ধ ফিঙ্গারাজাদের আঞ্চলিক শাসন বলবৎ হয়। পান্না গ্রাম থেকে প্রাপ্ত পুরাবস্তু, নন্দনপুরের নিকটস্থ শৌলান থেকে প্রাপ্ত বিষ্ণুমূর্তি, রসিকগঞ্জ শীতলা মন্দিরে পূজিত দুটি বিষ্ণুমূর্তি, ক্ষেপুত গ্রামের কালিন্দীনারায়ণ শিবমন্দির প্রাঙ্গণে বিষ্ণুমূর্তি, ক্ষেপতেশ্বরী মন্দির প্রাঙ্গণের ভগ্ন বৌদ্ধমূর্তি ও স্থানীয় ফিঙ্গারাজার গড়ে প্রাপ্ত ধ্বংসপ্রাপ্ত বৌদ্ধবিহার বা রাজপ্রাসাদের খোদিত প্রস্তরখণ্ড এবং কিছুবছর আগে অনন্তপুর থেকে প্রাপ্ত সূর্যমূর্তি এটাই প্রমাণ করে যে,
গুপ্তযুগ থেকে শুরু করে শশাঙ্ক পাল-সেনযুগ পর্যন্ত প্রায় আটশো বছর সময়কালে দাসপুর অঞ্চলের সঙ্গে বাইরের যোগাযোগ বেশ নিবিড় ছিল-তা শিলাই-রূপনারায়ণ-কংসাবতীর নদীপথ ধরেই হোক বা স্থলপথে। একসময় দক্ষিণ ভারতের চোল রাজাদের অধিকারেও যায় দাসপুর অঞ্চল। শিলাবতী-রূপনারায়ণের বারংবার প্লাবন দাসপুরকে বারবার বিপর্যস্ত করলেও দাসপুর ফিরে এসেছে তার স্বমহিমায়। ১৫৬৮ খ্রিস্টাব্দে বাংলার আফগান সুলতান কররানী সমকালীন ওড়িশারাজ মুকুন্দদেবের অধিকার থেকে দাসপুর অঞ্চল ছিনিয়ে নিলে সেই প্রথম এই অঞ্চলে ইসলামি শাসন বলবৎ হয়।
চাঁদ খাঁ পীর বা বড়খান গাজীর মতো ধর্মপ্রচারকরা ১৫-১৬ শতকে এই অঞ্চলে ইসলাম ধর্ম প্রচার করেন। ১৫৭৫-এ মোগল সেনাপতি মুনিম খাঁ ,আফগানদের পরাস্ত করলে সুলেমানের পুত্র দাউদ খাঁ তার সঙ্গে সন্ধি করেন, কিন্তু ১৫৮১-তে আফগানরা পুনরায় বিদ্রোহী হয়। দাউদের সেনাপতি কতলু খাঁ কিছুদিন এই অঞ্চল নিজেদের অধিকারে রাখলেও ১৫৯৩-তে মোগল সেনাপতি মানসিংহ আফগানদের আধিপত্য খর্ব করেন।
মোগল রাজস্ব সচিব টোডরমল রাজস্ব সংগ্রহের সুবিধার জন্যে ১৭ শতকের প্রথমদিকে সুবা বাংলাকে ১৯টি সরকারে ও ৬৮২ টি মহালে বিভক্ত করেন। অন্যতম সরকার, মান্দারণে ছিল ১৬টি মহাল। চিতুয়া বা চেতুয়া মহাল ছিল আজকের দাসপুর থানার সমগ্র ও ঘাটাল থানার কিছুটা-নিয়ে। ব্লকম্যান তার ইংরেজি “আইন-ই-আকবরীতে' লিখেছেন, 'Chitwa is a Mahal lying between Bengal and Orissa.'।
সতের শতকের প্রথমভাগে সুবা বাংলার নানাস্থানে যেসব আঞ্চলিক রাজশক্তির আবির্ভাব ঘটে তারা প্রায় সকলেই বহির্বঙ্গ থেকে আগত। মোগল সম্রাটের আঞ্চলিক প্রতিনিধির হাতে নামমাত্র রাজস্ব দিয়ে এঁরা রাজসুখ ভোগ করতেন। ধান, ইক্ষু, পাট, তেঁতুল, সরিষা, ডালশস্য , হলুদ ইত্যাদি ছড়াও তুঁতচাষ ও রেশমশিল্পে সমৃদ্ধ চেতুয়ায় একসময় বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে উত্তরভারত থেকে এসেছিলেন জনৈক ক্ষত্রিয় পুরুষ রঘুনাথ সিংহ ও তৎপুত্র কানাই সিংহ। যেভাবেই হোক, কানাই চেতুয়া মহালের অধিকার হস্তগত করেন ১৭ শতকের প্রথমার্ধে।
রাজনগরের কাছে আনন্দগড়ে তিনি গড়বাড়ি বা রাজধানী তৈরি করেন। কিন্তু অল্পকিছুদিনের মধ্যেই, বোধহয় ঋণগ্রস্ত হয়ে তিনি পার্শবর্তী বরদা মহালের অধিপতি ফতেসিংহকে চেতুয়া বিক্রি করে দেন। পরে অবশ্য কানাইয়ের পুত্র দুর্জয় এবং তারপরে তৎপুত্র শোভা সিংহ চেতুয়া ও বরদা ফতেসিংহের হাত থেকে ছিনিয়ে নেন। ১৭শ শতকের সাতের দশক থেকে চেতুয়া ও বরদা শোভাসিংহের অধিকারভুক্ত জমিদারি।
১৭০৭ খ্রিঃ তে ঔরঙ্গজেবের মৃত্যুর পর সুবা বাংলায় স্বাধীন নবাবী যুগ শুরু হলে ১৭২২ খ্রিস্টাব্দে বাংলার সুবেদার মুর্শিদকুলি খাঁ বাংলার রাজস্ব আদায়ের সুবিধার জন্য ১৩টি চাকলি ও ১৬৬০ টি 'পরগনা'তে বিভক্ত করেন।বর্ধমান চাকলার মধ্যে ছিল চেতুয়া-দাসপুর অঞ্চলটি । তখন জমিদারদের অধিকার কিন্তু আদৌ খর্ব হয়নি, বরং বেড়েছে। মহালগুলি 'পরগণা' নামে পরিচিত হলে 'চেতুয়া মহাল' হল 'চেতুয়া পরগণা'।
আর চাকলা গুলোই মূল এলাকা একই রেখে জেলা হয়। ১৭৪০-৫৬ খ্রিঃ-এর সময় মারাঠা সদরি ভাক্কর পণ্ডিতের নেতৃত্বে এদেশে যে কুখ্যাত বর্গী আক্রমণ হয়, তাতে চেতুয়া দাসপুরের শিল্প, অর্থনীতি ও জনজীবন রীতিমত ক্ষতিগ্রস্ত হয়। সেই অনিবার্য ধ্বংসলীলার অনেক সাক্ষ্য এখনও দাসপুরের বিভিন্ন এলাকায় ছড়িয়ে রয়েছে। যেক'টি মন্দির রক্ষা পায় সেগুলো নয় শিবমন্দির বা শিবলিঙ্গের অবস্থানের কারণে।
বর্ধমানরাজ তেজশ্চন্দ্রের (১৭৭০-১৮৩২ খ্রিঃ) দেওয়ান বাবু প্রাণচন্দ্র রচিত 'হরিহরমঙ্গলে' বর্ধমান রাজাদের শাসনাধীন বরদার জমিদার/রাজা ও চেতুয়া পরগনার নাম পাওয়া যায়। এখন প্রশ্ন হল - তাহলে দাসপুর- এলো কবে থেকে আর কী ভাবে? শিল্প ও সংস্কৃতির দিক থেকে দাসপুর ছিল অনেক প্রাচীন কাল থেকেই উন্নত। তার নমুনা আমরা মারাঠাদের অবশিষ্ট রেখে যাওয়া দাসপুর এর পুরোনো মন্দির থেকে অনুভব করতে পারি।
সেই মন্দিরগুলি থেকেই দাসপুরে নাম ও সালও কিছু কিছু উদ্ধার করা যায়। যেমন- দাসপুর থানার চেচুয়া-গোবিন্দনগরে গোস্বামী পরিবারের রাধাগোবিন্দের পঞ্চরত্ন মন্দির লিপি (১৭৮১ খ্রিঃ), কাদিলপুরে দত্তপরিবারের রঘুনাথ ও গোপালের পঞ্চরত্ন মন্দিরের লিপি (১৭৯৯ খ্রিঃ), দাসপুর থানার জোতমুরী গ্রামে গঙ্গাধরশিবের আটচালা মন্দিরের লিপি (১৮২৮খ্রিঃ) সরবেড়িয়া গ্রামে পণ্ডিত পরিবারের সত্যনারায়ণের নবরত্ন মন্দিরের লিপি (১৮৩৭ খ্রিঃ), চাঁইপাট-বেলডাঙ্গা গ্রামে রাজপন্ডিত পরিবারের মদনগোপালের আটচালা ও মন্দিরের লিপি ১৮৩২ খ্রিঃ)- সহ অসংখ্য মন্দিরে 'দাসপুর','দাশপুর','দাষপুর' সবই পাওয়া যায়।
নবীনচন্দ্র মিশ্রের জন্যে লিপিকর মধুসূদন মিশ্র কবিবল্লভের 'চন্দ্রকেতুপালা'-পুঁথি অনুলিপি করে পুষ্পিকায় লিখেছেন 'সাংসাগরপুর পরগণে চেতুয়া জেলা মেদনীপুর তরফে দাশপুর দষ্টিকোট মোং ঘাটাল মেজেস্টারি ও শ্ববরেজেস্টারি...।' লিপিকাল ১২৮৬ বঙ্গাব্দ (১৮৭০ খ্রিঃ)। ১৮৬১ খ্রিস্টাব্দে লিপিকৃত 'নারদসংবাদ'- পুথির শেষংশে 'পরগণে চেতুয়া শরকার মান্দারণ মতালকে মেদনিপুর পাড়ি দাশপুর' লেখা।
উনিশ শতকের মাঝামাঝি সময়ের কিছু পুরোনো দলিলপত্রে কোথাও 'দাসপুর' কোথাও 'দাশপুর'। এছাড়াও ১৮৭৪ এ সার্ভেয়ার জেনারেলের আঁকা বর্ধমান বিভাগের মানচিত্রে 'দাসপুর' স্বমহিমায়বিরাজিত। দাসপুর থানার পুরোনো এনামেল বোর্ডে 'দাশপুর' বানান ছিল। ১৯৮৩ তে তার পরিবর্তে নতুন বোর্ড লাগানো হয়। কিন্তু ওই থানার সাহাচক গ্রামের নীলকণ্ঠ শিবের আটচালা মন্দিরের ১৮৮৯ খ্রিঃ) লিপিতে 'দাশপুর' বেশ দৃশ্যমান।
হয়তো আরও পুরোনো কাগজপত্রে 'দাসপুর'কে খুঁজে পাওয়া যেতো কিন্তু ১৯৭৮ এর ভয়াবহ বন্যায় দাসপুরের সমস্ত মাটির বাড়ি ধুয়ে মুছে যাওয়ায় আর কিছুই অবশিষ্ট নেই। যাই হোক, ১৮১০ খ্রিস্টাব্দে 'চেতুয়া দাসপুর'- ৭৭২টি গ্রাম সহ বর্ধমান জেলা থেকে মেদিনীপুর জেলার সঙ্গে যুক্ত হয়।পরে এটি ব্রিটিশ আমলে দাসপুর থানায় রূপান্তরিত হয়। আর একবিংশ শতাব্দীর প্রথম ভাগেই মেদিনীপুর দুটি ভাগে ভাগ হলে দাসপুর আসে পশ্চিম মেদিনীপুরে।
আরো পড়ুন জীবনী মন্দির দর্শন ইতিহাস ধর্ম জেলা শহর শেয়ার বাজার কালীপূজা যোগ ব্যায়াম আজকের রাশিফল পুজা পাঠ দুর্গাপুজো ব্রত কথা মিউচুয়াল ফান্ড বিনিয়োগ জ্যোতিষশাস্ত্র টোটকা লক্ষ্মী পূজা ভ্রমণ বার্ষিক রাশিফল মাসিক রাশিফল সাপ্তাহিক রাশিফল আজ বিশেষ রান্নাঘর প্রাপ্তবয়স্ক বাংলা পঞ্জিকা