মহাভারতের প্রেক্ষাপটে ধৃতরাষ্ট্র, গান্ধারী ও কুন্তীর মৃত্যু

মহাভারতের প্রেক্ষাপটে ধৃতরাষ্ট্র, গান্ধারী ও কুন্তীর মৃত্যু

কুন্তিভোজ রাজার কন্যা কুন্তী। তরুণী সুন্দরী যিনি সহজাত কবচ-কুণ্ডল নিয়েই যেন তেজের প্রতীক। একবার রাজার অতিথি হয়ে এলেন দুর্বাসা ঋষি। রাজার নির্দেশে কুমারী কন্যা কুন্তী তাঁর সর্বান্ত পরিচর্যা করলেন। তাঁর যত্ন ও সেবায় তুষ্ট হয়ে ঋষি যাবার সময়ে তাঁকে বর দিলেন : একটি মন্ত্র, সেইটি উচ্চারণ করে কুন্তী যে দেবতাকে ডাকবেন তিনিই এসে উপস্থিত হবেন। মহাভারতের আশ্রমবাসিক পর্বে এই ঘটনার উল্লেখ পাওয়া যায়। যুধিষ্ঠির হস্তিনাপুরের সিংহাসনে বসার পর দেখতে দেখতে পনেরোটি বছর পেরিয়ে গেল। রাজা হওয়ার পর যুধিষ্ঠির ধৃতরাষ্ট্র ও গান্ধারীর সঙ্গে খুবই ভালো ব্যবহার করতেন এবং প্রাণপণে তাঁদের সেবা করতেন। তাঁর শাসনে অন্য পাণ্ডবরা কিংবা রাজ্যের অন্য কোনো লোক ধৃতরাষ্ট্র ও গান্ধারীর সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করতে সাহস পেতেন না।

যুধিষ্ঠিরের এই সেবায় ও সহানুভূতিতে তাঁরা দুজন তাঁদের একশোটি ছেলেকে হারানোর শোক ভুলে থাকতে পেরেছিলেন।  আজ জেনে নেব ধৃতরাষ্ট্র গান্ধারী ও কুন্তীর মৃত্যু হল কীভাবে। কিন্তু দাদার আদেশ সত্ত্বেও ভীম কখনোই ধৃতরাষ্ট্রের সঙ্গে ভালো ব্যবহার করতে পারতেন না। কারণ পাণ্ডবদের অতীতের দুর্দশার পিছনে ধৃতরাষ্ট্রের প্রচ্ছন্ন সম্মতি ও সাহায্যের কথা ভীম কোনো ভাবেই ভুলে থাকতে পারতেন না।

তাই যুধিষ্ঠিরের অগোচরে বারবার ভীম তাঁদের সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করতেন। দিনের পর দিন ভীমের ব্যঙ্গোক্তি শুনতে শুনতে দুঃখে ও হতাশায় জর্জরিত ধৃতরাষ্ট্র ও গান্ধারী ঠিক করলেন তাঁরা রাজপ্রাসাদ ছেড়ে বানপ্রস্থ জীবন গ্রহণ করবেন। যুধিষ্ঠির অনেক অনুনয়-বিনয় করার পরেও তাঁরা এই সিদ্ধান্ত থেকে পিছিয়ে এলেন না। কার্তিক মাসের পূর্ণিমার দিন রাজবেশ ছেড়ে হরিণের চামড়া পরে তাঁরা বনে যাওয়ার জন্য তৈরি হলেন।

যাওয়ার সময় পাণ্ডবদের মা কুন্তী, বিদুর ও সঞ্জয়ও তাঁদের সঙ্গী হলেন। যুধিষ্ঠির কিছুদূর পর্যন্ত তাঁদের পিছনে পিছনে গেলেন ও তাঁদের ফেরাতে চেষ্টা করলেন। কিন্তু তাঁরা ফিরলেন না। বিফল হয়ে যুধিষ্ঠির প্রাসাদে ফিরে এসে চোখের জল ফেলতে লাগলেন। এরপর একবছর পেরিয়ে যাওয়ার পর যুধিষ্ঠির সবাইকে নিয়ে কুরুক্ষেত্রের কাছে ধৃতরাষ্ট্রের আশ্রমে তাঁদের দেখতে গেলেন।

সেখানে যুধিষ্ঠিরের সামনেই বিদুর দেহত্যাগ করলেন। তাঁর মৃত্যুতে যুধিষ্ঠির খুব শোক পেলে ব্যাসদেব প্রভৃতি ঋষিরা তাঁকে সান্ত্বনা দিয়ে বললেন, “মহারাজ! মাণ্ডব্য নামক মুনির শাপে স্বয়ং ধর্ম বিদুর রূপে জন্ম নিয়েছিলেন। তাঁর মানুষ রূপে থাকার সময় শেষ হওয়াতে তিনি নিজের জায়গায় ফিরে গেছেন। আপনি বৃথাই তাঁর জন্য দুঃখ করছেন। শোক করবেন না, তিনি স্বর্গে গিয়ে অনেক সম্মান লাভ করবেন।” তিন মাস আশ্রমে থাকবার পর পাণ্ডবরা হস্তিনাপুরে ফিরে এলেন।

এই ঘটনার পর কেটে গেল আরও দুটি বছর। একদিন দেবর্ষি নারদ যুধিষ্ঠিরের সঙ্গে দেখা করতে এলেন। যুধিষ্ঠির উপযুক্ত সম্মান দিয়ে তাঁকে অভ্যর্থনা করলেন এবং তাঁর কুশল জিজ্ঞাসা করলেন। নারদ ধৃতরাষ্ট্রের আশ্রম থেকে আসছেন একথা জানতে পেরে যুধিষ্ঠির প্রশ্ন করলেন, “হে মুনিবর! আপনি কি আমার জ্যাঠামশাই, জ্যাঠাইমা, মা ও সঞ্জয়ের কোনো খবর জানেন? তাঁদের সঙ্গে কি আপনার দেখা হয়েছিল? তাঁরা সবাই ভালো আছেন তো?

আমার তাঁদের কথা শুনতে খুব ইচ্ছা করছে। আপনি যদি তাঁদের ব্যাপারে কিছু জানেন তাহলে দয়া করে আমাকে বলুন।”      যুধিষ্ঠিরের এই কথা শুনে নারদ বললেন, “মহারাজ! আমি সেই তপোবনে যেমন দেখেছি ও যা শুনেছি, আপনি স্থির হয়ে সেই সব ঘটনার কথা শুনুন। আপনারা আশ্রম থেকে চলে আসার পর মহারাজ ধৃতরাষ্ট্র, দেবী গান্ধারী, দেবী কুন্তী ও সঞ্জয় খুব কঠোর তপস্যা শুরু করেন।

সেই সময় ধৃতরাষ্ট্র ও গান্ধারী শুধু জল পান করতেন। কুন্তী দেবী মাসে মাত্র একবার আহার করতেন ও সঞ্জয় পাঁচদিনে একবার আহার করতেন। ধৃতরাষ্ট্র তখন ঘরের ভিতর থাকতেন না। তিনি বনের মধ্যে গিয়ে বাস করতেন এবং কুন্তী, গান্ধারী ও সঞ্জয় সবসময় তাঁকে অনুসরণ করতেন। এইভাবে তাঁদের দিন যেতে লাগল। তারপর কোনো এক দিন তাঁরা সবাই গঙ্গায় স্নান করে গঙ্গার তীর ধরে আশ্রমের দিকে যাচ্ছিলেন, এমন সময়ে সেই বনে বিশাল দাবানল জ্বলে উঠল।

দেখতে দেখতে সেই ভীষণ আগুনে সমস্ত বন পুড়তে থাকলে ভয়ানক বিপদ উপস্থিত হল। এদিকে অনেকদিন ধরে ঠিকমত না খাওয়ায় ধৃতরাষ্ট্র, গান্ধারী ও কুন্তীর শরীর এমনই দুর্বল হয়ে গেছিল যে তাঁরা কিছুতেই দৌড়ে সেই আগুন থেকে বেরিয়ে যেতে পারলেন না। তখন ধৃতরাষ্ট্র সঞ্জয়কে বললেন, “তুমি যত তাড়াতাড়ি পারো এই আগুন থেকে বেরিয়ে নিজের জীবন বাঁচাও। আমরা সবাই এই আগুনেই প্রাণ বিসর্জন দেব।”      ধৃতরাষ্ট্রের এই কথা শুনে সঞ্জয় কাঁদতে কাঁদতে বললেন, “মহারাজ! আপনাদের মত পুণ্যবান মানুষের মৃত্যু এই বৃথা আগুনে কীভাবে হতে পারে?

সঞ্জয়ের প্রশ্ন শুনে ধৃতরাষ্ট্র হেসে উত্তর দিলেন, “সঞ্জয়! আমরা সবাই নিজের ঘর ছেড়ে বাইরে বেরিয়ে এসেছি। এই অবস্থায় দাবানলে পুড়ে মৃত্যু আমাদের জন্য ক্ষতিকারক নয়। কারণ জল, আগুন, বায়ুর কারণে মৃত্যু অথবা যোগবলে দেহত্যাগ—একজন তপস্বীর মৃত্যুর জন্য এইগুলিই সবথেকে ভালো উপায়। তাই তুমি আমার কথা শোনো, এখান থেকে চলে যাও।”   

সঞ্জয়কে একথা বলে ধৃতরাষ্ট্র, গান্ধারী ও কুন্তী ধ্যানে বসলেন। সঞ্জয় আর অন্য উপায় না দেখে কাঁদতে কাঁদতে সেই বন ছেড়ে চলে গেলেন। দেখতে দেখতে সেই ভীষণ আগুন তাঁদের তিন জনের শরীর পুড়িয়ে ছাই করে দিল। সেখান থেকে বেরিয়ে এসে সঞ্জয় অন্যান্য তপস্বীদের এই খবর দিয়ে হিমালয়ে চলে গেলেন। আমি এই সব খবর সেই তপস্বীদের কাছেই শুনেছি। তাঁদের মৃত শরীরও আমি দেখে এসেছি।” 

 এই দারুন খবর শুনে যুধিষ্ঠির ও অন্যান্য পাণ্ডবরা এবং অন্তঃপুরের মহিলারা সবাই হাহাকার করে কেঁদে উঠলেন। তখন তাঁদের সান্ত্বনা দিয়ে নারদ বললেন, “মহারাজ! আপনি কাঁদবেন না। বৃথা আগুনে তাঁদের মৃত্যু হয়নি। গঙ্গাস্নানে যাওয়ার আগে মহারাজ ধৃতরাষ্ট্র অন্যান্য তপস্বীদের সঙ্গে নিয়ে যজ্ঞ করেছিলেন। যজ্ঞের পুরোহিতরা সেই আগুন নিয়ে গিয়ে ফেলেছিলেন ঐ বনের ভিতর।

বনের হাওয়ায় সেই যজ্ঞের আগুনই বেড়ে উঠে দাবানলের রূপ নেয় এবং ধৃতরাষ্ট্র, কুন্তী ও গান্ধারীকে ভস্ম করে। সুতরাং হে কুরুরাজ! আপনি তাঁদের জন্য দুঃখ করবেন না। তাঁরা নিজেদের ইচ্ছাতেই প্রাণত্যাগ করেছেন। তাঁদের অবশ্যই স্বর্গলাভ হবে। আপনি এখন নির্দিষ্ট নিয়ম মেনে তাঁদের শ্রাদ্ধাদি পারলৌকিক কাজ সম্পন্ন করুন।”    এইভাবে ধৃতরাষ্ট্র গান্ধারী ও কুন্তীর মৃত্যু হল। বিভিন্ন উপদেশ দিয়ে নারদ পাণ্ডবদের শান্ত করলে তাঁরা সবাই মিলে গঙ্গার তীরে গিয়ে ধৃতরাষ্ট্র, কুন্তী ও গান্ধারীর পারলৌকিক কাজ করলেন। সমস্ত কাজ হয়ে যাওয়ার পর অশৌচের সময়টুকু তাঁরা সবাই হস্তিনাপুরের বাইরেই কাটালেন।