দীনেশ গুপ্ত এর জীবনী

দীনেশ গুপ্ত এর জীবনী

ইতিহাসে অলিন্দ যুদ্ধ বা রাইটার্স বিল্ডিং হামলার সঙ্গে জড়িত বাংলার এক দামাল বিপ্লবী দীনেশ গুপ্ত (Dinesh Gupta)। ইতিহাসে তিনি বিখ্যাত হয়ে আছেন বিপ্লবী বিনয় বসু এবং বাদল গুপ্তের সঙ্গে একযোগে রাইটার্স বিল্ডিং- আক্রমণ করার জন্য। ১৯১১ সালের ৬ ডিসেম্বর বর্তমান মুন্সিগঞ্জ জেলার যশোলঙে দীনেশ গুপ্তের জন্ম হয়। তাঁর বাবা সতীশচন্দ্র গুপ্ত পেশায় ছিলেন ডাক বিভাগের কর্মচারী। দীনেশ গুপ্তের মায়ের নাম বিনোদিনী দেবী। বাল্যকালে দীনেশ গুপ্তের ডাকনাম ছিল নসু।

বাবা মায়ের আট সন্তানের মধ্যে দীনেশ ছিলেন তৃতীয় সন্তান। শৈশব থেকেই দীনেশ নির্ভীক ও দুরন্ত প্রকৃতির ছিলেন এবং পড়াশোনার পাশাপাশি খেলাধুলাতেও সমান পারদর্শিতা ছিল তাঁর। তাঁর বাবার বদলির চাকরি হওয়ার কারণে গৌরীপুরে থাকতে হয় তাঁকে এবং এই গৌরীপুরেই একটি পাঠশালায় দীনেশ গুপ্তের প্রাথমিক শিক্ষালাভ শুরু হয়। এরপর তাঁর বাবার চাকরিতে পুনরায় বদলির কারণে ঢাকায় চলে আসেন দীনেশ। নয় বছর বয়সে ঢাকা কলেজিয়েট স্কুলে ভর্তি হন দীনেশ।

এসময় তিনি ঢাকার গেন্ডারিয়া অঞ্চলে দাদার বাড়িতে থাকতেন। যদিও তাঁর পৈতৃক নিবাস ছিল ঢাকার ওয়ারিতে। স্কুলে পড়ার সময় থেকেই দীনেশ গুপ্ত এক তীব্র স্বাদেশিকতাবোধে দৃপ্ত হয়ে ওঠেন এবং সেকালের সারা ভারতব্যাপী ব্রিটিশ-বিরোধী আন্দোলনের কারণে দীনেশের রাজনীতি-সচেতনতা আরও প্রখর হয়ে ওঠে। সেই সময় পাড়ায় পাড়ায় এই ব্রিটিশ-বিরোধিতা এবং স্বাদেশিকতার ব্যাপারে আলোচনা চলত যেখানে প্রায়ই ক্ষুদিরাম, প্রফুল্ল চাকী, বাঘা যতীনের মতো আরও বহু বিপ্লবীদের নিয়ে চর্চা হত।

দীনেশ গুপ্ত ছিলেন সেইসব তরুণদের একজন যাঁদের কৈশোরকাল কেটেছে এই সব মহান বিপ্লবীর জীবনী পড়ে এবং স্বদেশিয়ানায় দীক্ষিত হয়ে। দশম শ্রেণিতে পড়াকানীনই তিনি ‘বেঙ্গল ভলান্টিয়ার্স’ নামে একটি গুপ্ত বিপ্লবী সংগঠনের সংস্পর্শে আসেন। ১৯২৬ সালে ঢাকা কলেজিয়েট স্কুল থেকে ম্যাট্রিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন তিনি। এই ম্যাট্রিক পরীক্ষার পর তিনি মেদিনীপুরে তাঁর দাদা জ্যোতিশচন্দ্র গুপ্তের কাছে চলে আসেন। বাংলার বিপ্লবী আন্দোলনের অন্যতম পীঠস্থান ছিল এই মেদিনীপুর।

দীনেশ গুপ্ত এই সময় মেদিনীপুরের বৈপ্লবিক কাজকর্মের সঙ্গে যুক্ত হন। কিন্তু পরে বেঙ্গল ভলান্টিয়ার্স দলের ঢাকা শাখা তাঁকে ফিরে আসতে অনুরোধ করলে দীনেশ গুপ্ত ঢাকা কলেজে আই.এস.সি পড়তে ভর্তি হন। ১৯২৮ সালে তিনি ঢাকা কলেজ থেকে আই.এস.সি. পরীক্ষা দেন ঠিকই কিন্তু বৈপ্লবিক কাজকর্মে বেশি মেতে থাকার কারণে আই.এস.সি. পরীক্ষায় কৃতকার্য হতে পারেননি দীনেশ। ১৯২৮ সালেই সুভাষচন্দ্র বসু নিজ উদ্যোগে এই ‘বেঙ্গল ভলান্টিয়ার্স’ বাহিনীকে নতুনভাবে সামরিক প্রশিক্ষণ দিয়ে গড়ে তোলেন।

এই বাহিনীর নারী ও পুরুষ সদস্য সকলেই একযোগে স্বদেশের স্বাধীনতা আনয়নে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ হয়ে ওঠেন এবং স্বাধীনতার জন্য আত্মবলিদান দিতেও প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হন। সেই সময় অত্যাচারী ইংরেজ শাসকের স্বাধীনতা আন্দোলনকারীদের উপর দমন-পীড়নের প্রতিবাদ করতে বেঙ্গল ভলান্টিয়ার্স দলকে উদ্বুদ্ধ করেন সুভাষচন্দ্র বসু এবং তাঁরই প্রেরণায় সক্রিয় ও সশস্ত্র আন্দোলনের প্রস্তুতি নিতে শুরু করেন এই সংগঠনের বিপ্লবীরা। আগ্নেয়াস্ত্র চালানোর প্রশিক্ষণও দেওয়া শুরু হয় বিপ্লবীদের।

দীনেশ গুপ্ত নিজে বিপ্লবীদের আগ্নেয়াস্ত্র চালানোর প্রশিক্ষণ দিতেন। নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসুর পরিকল্পনা অনুযায়ী বিপ্লবীরা অত্যাচারী ব্রিটিশ পুলিশ অফিসারদেরকে গোপনে হত্যা করার সিদ্ধান্ত নেন। ডগলাস, বার্জ ও পেডি নামের তিনজন কুখ্যাত পুলিশ অফিসারকে হত্যা করে বেঙ্গল ভলান্টিয়ার্স দলের বিপ্লবীরা। বাংলার অগ্নিযুগে ব্রিটিশ নিধন যজ্ঞ এবং বোমা নিক্ষেপ পরিকল্পনাই একমাত্র হাতিয়ার হয়ে উঠেছিল সশস্ত্র বিপ্লবীদের কাছে।

১৯৩০ সাল নাগাদ ব্রিটিশ সরকার বিপ্লবী আন্দোলন ও ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রাম দমনের উদ্দেশ্যে সুভাষচন্দ্র বসু, যতীন্দ্রমোহন সেনগুপ্ত, সত্য বকসী প্রমুখদের গ্রেপ্তার করে আলিপুর সেন্ট্রাল জেলে বন্দি করে এবং অসংখ্য সশস্ত্র বিপ্লবী, অহিংস আন্দোলনের স্বেচ্ছাসেবকে আলিপুর জেল ভরে ওঠে। ফলে জেলের মধ্যে সৃষ্টি হওয়া অসহনীয় অবস্থা থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য রাজবন্দীরা ঐক্যবদ্ধ হয়ে প্রতিবাদ করতে শুরু করেন।

কয়েকটি দাবি নিয়ে জেলের মধ্যেই শুরু হয় আন্দোলন আর এই আন্দোলন স্তব্ধ করার জন্য ব্রিটিশ পুলিশ ইন্সপেক্টর জেনারেল কর্নেল এনএস সিম্পসনের নির্দেশে নির্মমভাবে বন্দী বিপ্লবীদের উপর লাঠিচার্জ শুরু করে। এই ঘটনা জানার পরে বেঙ্গল ভলান্টিয়ার্সের সকল বিপ্লবী একযোগে সিদ্ধান্ত নেন কর্নেল সিম্পসনকে হত্যার। আর এই পরিকল্পনারই বাস্তুবায়ন ঘটে বিখ্যাত ঐতিহাসিক অলিন্দ যুদ্ধের মধ্য দিয়ে। কলকাতার ডালহৌসি স্কোয়ারে ব্রিটিশ শাসকদের সচিবালয় ছিল ‘রাইটার্স বিল্ডিং’-এ।

পুলিশ প্রহরীবেষ্টিত এই দূর্গসম দুর্ভেদ্য রাইটার্স বিল্ডিং অভিযানে সামিল হয়েছিলেন সেদিন তিন বীর বাঙালি সন্তান – বিনয় বসু, বাদল গুপ্ত এবং তাঁদের সঙ্গে যোগ্য সহকারী হিসেবে উপস্থিত ছিলেন দীনেশ গুপ্তও। তাঁদের প্রত্যেকেই আগে থেকে বন্ধু ছিলেন এবং ঢাকাতেই তাঁদের সকলের জন্ম হওয়ায় একযোগে দেশের জন্য আত্মবলিদান দিতে একবারও পিছুপা হননি তাঁরা। ১৯৩০ সালের ৮ ডিসেম্বর দুপুর বারোটা নাগাদ সামরিক পোশাক পরে বাদল গুপ্ত, বিনয় বসু এবং দীনেশ গুপ্ত রাইটার্স বিল্ডিংয়ে ঢুকে পড়েন।

রাইটার্স বিল্ডিংয়ের একটি ঘরে কারাবিভাগের সর্বময় কর্তা ইনপেক্টর জেনারেল কর্নেল সিম্পসন কর্মরত ছিলেন। সিম্পসনের ব্যক্তিগত সহকারীকে ঠেলে ঘরের ভিতরে প্রবেশ করে বাদল গুপ্ত, বিনয় বসু এবং দীনেশ গুপ্ত সিম্পসনের দিকে তিনটি রিভলবার তাক করে পরপর ছয়টি গুলি চালান। এই সময় বিনয় বসু সিম্পসনকে উদ্দেশ্য করে বলেছিলেন, “প্রে টু গড কর্নেল। ইওর লাষ্ট আওয়ার ইজ কামিং।” সিম্পসনের পাশাপাশি গুলির আঘাতে আহত হন জুডিশিয়াল সেক্রেটারি মি. নেলসন।

এরপর ঘর থেকে বেরিয়ে এলোপাথাড়ি গুলিবর্ষণ করতে করতে তাঁরা তিনজনে রাইটার্স বিল্ডিং-এর বারান্দায় বারান্দায় ছুটে বেড়াতে থাকেন। পুলিশ ইন্সপেক্টর জেনারেল মি. ক্র্যাগ ও সহকারী ইন্সপেক্টর জেনারেল মি. জোনস এই আক্রমণ প্রতিরোধ করার জন্য ছুটে আসেন এবং কয়েক রাউণ্ড গুলিও ছোঁড়েন তাঁরা কিন্তু বিনয়, বাদল, দীনেশের এলোপাথাড়ি গুলির মুখে দাঁড়াতে না পেরে পালিয়ে যান। রাইটার্স বিল্ডিং আক্রমণের এই খবর পেয়ে পুলিশ কমিশনার চার্লস টেগার্ট ছুটে আসেন এবং ডেপুটি কমিশনার গার্ডন সাহেব সশস্ত্র বাহিনী নিয়ে পৌঁছন রাইটার্সে।

উভয়পক্ষের গুলিবর্ষণে বহু ইংরেজ কর্মচারী নিহত হন। বিনয়, বাদল ও দীনেশ ক্রমে অপ্রতিরোধ্য হয়ে ওঠেন। ব্রিটিশ পুলিশ তাঁদের সঙ্গে না পেরে না উঠলে গোর্খা বাহিনীর সাহায্য নেয়। গোর্খা বাহিনীর সঙ্গেবিনয় বাদলদের প্রত্যক্ষ যুদ্ধ অনেকক্ষণ চলে। তারপর একসময় বিনয়, বাদল এবং দীনেশের রিভলবারের গুলি শেষ হয়ে যাওয়ায় তিনজনে মিলে একটি ফাঁকা ঘরে ঢুকে তাঁদের সঙ্গে থাকা সায়ানাইড মুখে দিয়ে আত্মহত্যার চেষ্টা করেন। মৃত্যু নিশ্চিত করতে তাঁরা প্রত্যেকেই নিজের কপালে বন্দুক তাক করে গুলি চালিয়ে দেন।

গুলিতে সেই মুহূর্তেই বাদল গুপ্তের মৃত্যু হয়। বিনয়-বাদল এবং দীনেশের এই সংগ্রামকে ঐতিহাসিকরা ‘অলিন্দ যুদ্ধ’ বলে আখ্যা দিয়েছেন। বিনয় বসু এবং দীনেশ গুপ্তকে ব্রিটিশ পুলিশ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যায় চিকিৎসার জন্য। ডাক্তারদের আপ্রাণ চেষ্টায়, সেবায় দীনেশ ক্রমশ সুস্থ হয়ে উঠলে তাঁকে হাসপাতাল থেকে ‘কনডেমড’ সেলে নেওয়া হয়। দীনেশ গুপ্তের বিচার করার জন্য আলিপুরের সেশন বিচারপতি মি. গ্রালিকের সভাপতিত্বে ব্রিটিশ সরকার এক ট্রাইবুনাল গঠন করে তাঁর ফাঁসির আদেশ দেয়।

বিপ্লবী দীনেশ ফাঁসি হওয়ার সাত দিন আগে তাঁর মাকে যে চিঠি লিখেছিলেন তা থেকে জানা যায়, মৃত্যুভয় ছিল না তাঁর মধ্যে। মৃত্যুকে খেলা মনে করতেন দীনেশ এবং তাঁর মায়ের সঙ্গে মৃত্যুর পরপারে আবার দেখা হওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করেছিলেন দীনেশ গুপ্ত সেই চিঠিতে। মৃত্যুর আগে শেষের কয়েকদিন তাঁর সঙ্গী ছিল রবীন্দ্রনাথের বই আর গীতা। তাঁর বিপ্লবী জীবনকে খুব কাছ থেকে দেখেছেন সাম্যময় বন্দ্যোপাধ্যায় ওরফে ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়।

ঢাকার সদরঘাটে দীনেশ গুপ্তের আদেশেই ভানু গুপ্তচরের কাজ করতেন এবং কখন কোন জাহাজ থেকে কোন সাহেব নামছেন সেই সব তথ্য ভানু দীনেশকে জানাতেন। এমনকি দীনেশ গুপ্তের সঙ্গে চলচ্চিত্র দেখতেও গিয়েছেন ভানু, সেকথাও জানা যায়। ভূপেন্দ্রনাথ দত্ত অর্থাৎ স্বামীজির ভাইয়ের মুখে ভানু শুনেছিলেন এক অদ্ভুত কিংবদন্তী।

পাঞ্জাবে এক জনসভায় যাওয়ার জন্য মাঝপথে সাইকেল খারাপ হয়ে গেলে সেই সাইকেল কাঁধে নিয়েই দীনেশ গুপ্ত নাকি সঠিক সময়ে চার মাইল রাস্তা হেঁটে সেই সভায় উপস্থিত হয়েছিলেন। ভারতের স্বাধীনতার পরে বীর বাঙালি বিপ্লবী বিনয়-বাদল-দীনেশের নামানুসারে কলকাতার রাইটার্স বিল্ডিং সংলগ্ন ডালহৌসি স্কোয়ারের নাম পাল্টে রাখা হয় বি-বা-দী বাগ অর্থাৎ বিনয়-বাদল-দীনেশ বাগ। ১৯৩১ সালের ৭ জুলাই মাত্র ২০ বছর বয়সে দীনেশের ফাঁসি কার্যকর করা হয়।