জৈন ধর্মে দীপাবলি | Diwali Jainism

জৈন ধর্মে  দীপাবলি | Diwali Jainism

আলোর উৎসব দীপাবলি। সারা দেশ আলোর রোশনাইয়ে সাজে এ দিন। প্রদীপ, মোমবাতি আর আতসবাজির রঙিন আলোয় এই দিন সেজে ওঠে ঘর-বাড়ি আর রাতের আকাশ। কার্তিক মাসের অমাবস্যায় যখন চারপাশ ঘন অন্ধকারে ঢাকা, সেই সময় আলোর নিশান জ্বালিয়ে অন্ধকাররূপী অশুভ শক্তিকে দূর করা হয় দীপাবলি উৎসবে। শুধু হিন্দুরাই এই দীপাবলি পালন করে, তা কিন্তু নয়।

শিখ এবং জৈন ধর্মের মানুষেরাও এই দিনটিকে উদ্‌যাপন করে থাকেন। শিখরা দীপাবলির দিনটিকে ‘বন্দি ছোড় দিবস‘ হিসেবে পালন করে গুরু হরগোবিন্দের স্মরণে আর জৈনদের কাছে এই দিনটি পালিত হয় জৈন দীপাবলি Diwali Jainism  তথা ‘দীপালিকা’ নামে। হিন্দুরা মনে করেন ১৪ বছর বনবাসে কাটিয়ে এই দীপাবলির দিনেই রামচন্দ্র অযোধ্যায় ফিরে এসেছিলেন। আবার শিখরা মনে করেন এই দিনেই সম্রাট জাহাঙ্গীরের গোয়ালিয়র দূর্গ থেকে মুক্তি পেয়েছিলেন গুরু হরগোবিন্দ। জৈনরা বিশ্বাস করেন, তাদের ২৪তম তীর্থঙ্কর এবং শেষ তীর্থঙ্কর মহাবীর জৈন এই দিনেই নির্বাণ লাভ করেছিলেন। নির্বাণ মানে ইহজাগতিক সমস্ত বন্ধন, জন্ম-মৃত্যুর চক্র থেকে আত্মার মুক্তি। নির্বাণ লাভের পরে বলা হয় স্বর্গীয় আশীর্বাদ প্রাপ্ত হয় মানুষের আত্মা। অসীম আশীর্বাদ, অসীম জ্ঞান এবং অসীম ধারণার অধিকারী হয় নির্বাণ প্রাপ্ত মানুষ।

খ্রিস্টপূর্ব পঞ্চম শতাব্দীতে অধুনা বিহার মগধ মহাজনপদের অন্তর্ভূক্ত ছিল এবং সেখানে হর্যঙ্ক বংশের শাসন চলত। মহাবীর মগধের রাজগৃহে ১৪ বছর ধরে ধর্মপ্রচার করেছিলেন। রাজা অজাতশত্রুর রাজ্য রাজগৃহ থেকে ১৫ কিমি দূরে পবনপুরীতে (অধুনা রাজগির) মহাবীর এসেছিলেন। অধুনা বিহারের নালন্দা জেলায় অবস্থিত পবনপুরীতে ৭২ বছর বয়সে একই স্থানে পদ্মাসনে বসে নির্বাণ লাভ করেছিলেন মহাবীর। আজও এই পবনপুরীতে গেলে ‘জল মন্দির’ নামে একটি জৈন মন্দির দেখা যাবে।

মনে করা হয়, এখানেই মহাবীর জৈনের পায়ের ছাপ রয়েছে। মহাবীরের নির্বাণ লাভের সেই বিশেষ দিনটিকে জৈনরা দীপাবলি রূপে পালন করে থাকেন। বিভিন্ন জৈন সাহিত্যে দীপাবলিকে ‘দীপালিকায়া’ রূপে বর্ণনা করা হয়েছে যার অর্থ হল শরীর থেকে আলোর নির্গমণ। অনেকেই বিশ্বাস করেন এই দিনে মহাবীরের নির্বাণ লাভের কারণে পৃথিবীতে এবং স্বর্গলোকে প্রদীপ জ্বেলে আলোকিত করে তোলা হয়েছিল। শ্বেতাম্বরদের সাহিত্যিক নিদর্শন ‘কল্পসূত্র’তে এই বর্ণনা পাওয়া যায়। ‘কল্পসূত্র’-এ বলা আছে এই আলো আসলে জ্ঞানকে জাগরিত রাখার প্রতীক মাত্র।

খ্রিস্টপূর্ব অষ্টম শতাব্দীতে আচার্য জিনসেনের লেখা ‘হরিবংশ পুরাণ’-এ প্রথম দীপাবলির উল্লেখ পাওয়া যায়। এই বইতে রয়েছে যে, দেবতারা মহাবীরের মোক্ষ লাভের পরে, নির্বাণ লাভের পরে সমগ্র পবনপুরীকে আলোকিত করে তুলেছিলেন। মনে করা হয় সেই দিন থেকেই এই গ্রন্থের সূত্র ধরে মহাবীরের নির্বাণপ্রাপ্তির দিনে জৈনরা দীপাবলি পালন করেন। এই দিনে মহাবীরের প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন করেন জৈন ধর্মাবলম্বীরা। দীপাবলির তিন দিন ধরে শ্বেতাম্বর জৈনরা উপবাসে থাকেন। ভক্তরা গান করেন এবং স্তোত্র আবৃত্তি করে থাকেন। মহাবীরের জীবনের শেষ বক্তব্য সম্বলিত গ্রন্থ ‘উত্তরাধ্যয়ন সূত্র’ থেকে এই দিন ভক্তরা শ্লোক পাঠ করে থাকেন।

দীপাবলির ঠিক পরের দিনটি আবার জৈন নববর্ষের সূচক। জৈনদের ধর্ম ও সংস্কৃতি অনুযায়ী মহাবীরের নির্বাণ লাভের পরের দিন থেকেই একটি নবযুগের সূচনা ঘটে যার নাম ‘বীর নির্বাণ সম্ভাত’ বা সংক্ষেপে ‘বীর সম্ভাত’। নির্বাণ দিবসের পরের দিন প্রতিপদ ধরা হয় এবং এই দিন থেকেই নতুন জৈন বছর শুরু হয়। যদিও শ্বেতাম্বর ও দিগম্বরদের মধ্যে এই নতুন বছরের সূচনা নিয়ে দ্বিমত রয়েছে। শ্বেতাম্বরদের সাহিত্যিক নিদর্শন অনুসারে, মহাবীর খ্রিস্টপূর্ব ৫২৭ অব্দে নির্বাণ লাভ করেছিলেন। আবার দিগম্বরদের মতে, মহাবীরের নির্বাণ লাভের সময়কাল খ্রিস্টপূর্ব ৫১০ অব্দ। প্রতি বছরই জৈনরা এই দীপাবলি পালন করে থাকেন এবং ১৯৭৪ সালে দীপাবলির একটি বিশেষ বর্ষপূর্তিও পালন করেছিলেন আপামর জৈন ধর্মাবলম্বীরা।

১৯৭৪ সালের ১৩ নভেম্বর পুরো দেশ জুড়ে মহাবীরের নির্বাণ লাভের আড়াই হাজার বছর পূর্তি উৎসব পালিত হয়। এই উৎসবের নাম ছিল ‘ভগবান মহাবীর নির্বাণ মহোৎসব’। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী এই উৎসবে সভাপতিত্ব করেছিলেন। দীপাবলির দিন সকালে প্রতিটি জৈন মন্দিরে মহাবীরকে নির্বাণ লাড্ডু খাওয়ানো হয়। যেহেতু জৈনরা অহিংসাপন্থী, তাই জৈনরা এই দিন কোনো আতসবাজি পোড়ায় না। মহাবীর জৈনের নির্বাণ তত্ত্ব, অসীম জ্ঞানের আধার হয়ে ওঠার কাহিনিকে কেন্দ্র করেই জৈন দীপাবলির উৎপত্তি। জৈন সন্ন্যাসীদের বিশ্রাম কালের সূচনা হয় এই উত্সবের মাধ্যমে। শ্বেতাম্বর সম্প্রদায় এই উত্সব আট দিন ধরে পালন করেন। আর দিগম্বর সম্প্রদায় এই উত্সব পালন করেন দশ দিন ধরে। উত্সব চলাকালীন সময়ে জৈন ধর্মাবলম্বীরা দশটি আবশ্যিক গুণ যাতে তাঁদের জীবনযাপনে প্রতিফলিত হয় নিষ্ঠার সঙ্গে তার প্রচেষ্টা করেন।