ঠাকুরবাড়ির দুর্গাপুজো

কলকাতার বনেদি পুজোগুলির ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যায় একেক জমিদারের একেকরকম খেয়ালের কথা। কোথাও দশমীতে নীলকন্ঠ পাখি ওড়ানো, কোথাও বাহারি ভোগের আয়োজন, কোথাও আবার দেবী প্রতিমার বিশেষত্বই প্রধান। এইসবের মধ্যে জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়ির দুর্গাপুজোরও এক আলাদা ঐতিহ্য আছে। ঠাকুর পরিবারের সদস্য দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের সময় থেকে প্রায় সকলেই ব্রাহ্ম ধর্মে দীক্ষিত হওয়ার কারণে ধীরে ধীরে প্রাচীন ঐতিহ্য সম্পন্ন এই দুর্গাপুজো বন্ধ হয়ে যায়।
ফলে অন্যান্য বনেদি পুজোগুলির মতো আজ আর কলকাতার পুজোর গন্ধে মেশে না ঠাকুরবাড়ির আড়ম্বরের ঘ্রাণ। সবই আজ ইতিহাস, সবই শুধু স্মৃতি। ঠাকুরবাড়ির বংশপরম্পরা অনেক দীর্ঘ। নীলমণি ঠাকুরের উদ্যোগেই প্রথম ঠাকুরবাড়িতে দুর্গাপুজো শুরু হয়। সময়টা তখন ১৭৮৪ সাল। তখনো ঠাকুর পরিবারের পুজো বলতে বোঝাতো পাথুরিয়াঘাটার দর্পনারায়ণ ঠাকুরের পুজোকে।
সেই পুজোরও জাঁকজমক ছিল দেখার মতো। জয়রাম ঠাকুরের তিন পুত্রের মধ্যে নীলমণি ঠাকুর আর দর্পনারায়ণ ঠাকুরের বনিবনা হতো না। দর্পনারায়ণের পুজো দেখতেই তখন সাহেব-সুবোরা ভিড় করতো, কিন্তু তা ছিল পাথুরিয়াঘাটায়। ১৭৮৪ সালেই পারিবারিক সম্পত্তির ভাগাভাগি নিয়ে বিবাদ হওয়ায় নীলমণি আর দর্পনারায়ণ দুজনেই পৃথকভাবে থাকা শুরু করেন এবং সেই থেকেই নীলমণি ঠাকুর দুর্গাপুজো শুরু করেন জোড়াসাঁকোর বাড়িতে।
তখনও জোড়াসাঁকোয় বিশাল বাড়ি বা ঠাকুরদালান সেভাবে তৈরি হয়নি। নীলমণি ঠাকুরের পরে তাঁর পৌত্র প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুরের আমলে এই জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়ির দুর্গাপুজো আলাদা মাত্রা পায় এবং দর্পনারায়ণের পুজোর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে আড়ম্বরপূর্ণ হয়ে ওঠে। দ্বারকানাথ সেকালের অত্যন্ত ধনী বিত্তশালী বাবু ছিলেন, ব্যবসায় প্রভূত লাভের মুখ দেখেছিলেন তিনি আর ছিল ইংরেজ সাহেবদের সঙ্গে সুসম্পর্ক।
ফলে ধনে-মানে বাড়তে লাগলো দ্বারকানাথ ঠাকুরের দুর্গাপুজো। প্রতিদ্বন্দ্বিতা চলতো কাছেই শিবকৃষ্ণ দাঁর পুজোর সঙ্গে। একবার এই বাড়ি সাজ চড়িয়ে করে, তো পরেরবার ঠাকুরবাড়িতে জাঁক বেড়ে যায়। বিসর্জনের সময়েও দুই বাড়ির পুজো নিয়ে প্রতিযোগিতা চলতো। দ্বারকানাথ ঠাকুরের আমলে ঠাকুরবাড়ির সকলেই ঠাকুরদালানে উপস্থিত থাকতেন।
একান্ন রকম ভোগ নিবেদনের পাশাপাশি তখন নাকি পুজোর আগেই আকাশে শঙ্খচিল ওড়ানোর রেওয়াজ ছিল ঠাকুরবাড়িতে, সেইসঙ্গে বিজয়া দশমীতে আকাশে ওড়ানো হতো নীলকণ্ঠ পাখি। দ্বারকানাথ ঠাকুরের আমলে লোকবিশ্বাস ছিল শঙ্খচিল পাখি আগে উড়ে গিয়ে দেবীকে ডেকে নিয়ে আসতো এই মর্ত্যে আর নীলকন্ঠ পাখি দেবীর বিদায়বার্তা জানিয়ে আসতো কৈলাসে। জানা যায় যে, দেবী দুর্গার মুখের সঙ্গে দ্বারকানাথের স্ত্রী দিগম্বরীর মিল পাওয়া যায়।
গরদের শাড়ি পরিহিত বহুমূল্য অলঙ্কারে সুসজ্জিতা জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ির দেবী প্রতিমা নাকি দ্বারকানাথ অলঙ্কার সমেতই বিসর্জন দিতেন। প্রতিমা বিসর্জন দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই মাঝি-মাল্লা আর বাড়ির চাকরেরা জলে ঝাঁপ দিতো অলঙ্কার সংগ্রহের জন্য। এতো বিশাল বৈভব প্রদর্শনই এই প্রথার উদ্দেশ্য ছিল বলে মনে করা হয়। দ্বারকানাথের বাবা রামমণি ঠাকুরের নামে পুজোর আমন্ত্রণপত্র লেখা হতো সে সময়।
পর্দানসীন ঠাকুরবাড়ির মেয়েরা বিজয়ার দিন উপলক্ষে কেবল তেতলার ছাদে ওঠার অনুমতি পেতেন। এ নিয়ে একটা গল্প প্রচলিত আছে। দ্বারকানাথের পুজোর সময়েই তাঁর পুত্র ছোট্ট দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর ঠাকুরদাদা রামমণি ঠাকুরের নামে লেখা সেই আমন্ত্রণপত্র নিয়ে গিয়েছিলেন স্বয়ং রামমোহন রায়ের কাছে। তিনি যে ব্রাহ্ম, মূর্তিপুজো মানেন না তা তাঁর তখন জানা ছিল না।
আমন্ত্রণ রক্ষা করতে তখন রামমোহন তাঁর পুত্র রাধাপ্রসাদ এসেছিলেন জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ির দুর্গাপুজোয়। পরে এই রামমোহনের আদর্শেই ব্রাহ্মধর্মে দীক্ষিত হবেন দেবেন্দ্রনাথ। চিকের আড়াল থেকে মেয়েদের আরতি দেখা, ঘিয়ের প্রদীপ জ্বালানো, ঘন্টাধ্বনি দিয়ে পুজোর প্রারম্ভ, কুমড়ো বলি আর বিজয়ার কোলাকুলির স্মৃতি বিনয়িনী দেবীর লেখায় পাওয়া যায়।
ঠাকুরবাড়ির দ্বিজেন্দ্রনাথ, সত্যেন্দ্রনাথ প্রত্যেকেই দুর্গাপুজো নিয়ে খুবই আনন্দিত থাকতেন বছরের এই সময়টায়। ঠাকুরবাড়িতেই তৈরি হতো দেবী প্রতিমা আর সেই প্রতিমা নির্মাণের প্রতিটি পর্যায় খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতেন জ্যোতিরিন্দ্রনাথ, মৃৎশিল্পীদের পানের খিলি পৌঁছে দিতেন তিনিই। এই দুর্গাপূজাকে কেন্দ্র করে ঠাকুরবাড়িতে বসতো গানের আসর, সং, যাত্রা কত কি! তাই নিয়ে বালক জ্যোতিরিন্দ্রনাথ বা সত্যেন্দ্রনাথ প্রত্যেকেই আগ্রহী হয়ে থাকতেন।
কিন্তু দ্বারকানাথের পর দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর এই পুজো বেশিদিন চালিয়ে নিয়ে যাননি। এমনকি দ্বারকানাথ বেঁচে থাকতেও এই পুজোয় অন্য সকলে যোগ দিলেও তিনি সেই সময় অন্যত্র চলে যেতেন। সকলে যখন নত হয়ে প্রণাম করতেন দেবীমূর্তিকে, তখন তিনি আর তাঁর ভাইদের একটি দল দাঁড়িয়ে থাকতেন সোজা হয়ে। পৌত্তলিকতাবিরোধী দেবেন্দ্রনাথের মনে দুর্গাপূজার মাহাত্ম্য সেভাবে প্রাধান্য পায়নি কখনোই।
পূজার ভার দেওয়া থাকতো দেবেন্দ্রনাথের ভাই গিরীন্দ্রনাথ এবং নগেন্দ্রনাথ ঠাকুরের উপর। নগেন্দ্রনাথ ঠাকুরের মৃত্যু হয় ১৮৫৮ সালে আর তারপরই জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়িতে আর দুর্গাপুজো হয়নি। চিরতরে এই ঐতিহ্যবাহী প্রথা বন্ধ হয়ে যায়। ঠাকুরবাড়িতে রবীন্দ্রনাথও মন থেকে এই দুর্গার মূর্তিপুজো মেনে নিতে পারনেনি।
তবে ঠাকুরবাড়ির পুজো বন্ধ হলেও ঠাকুর-পরিবারের পুজোর রীতি কিন্তু বন্ধ হয়নি। দর্পনারায়ণ ঠাকুরের পর প্রসন্নকুমার ঠাকুরের হাতে সেই পাথুরিয়াঘাটার পুজোর পাশাপাশি কয়লাঘাটার রমানাথ ঠাকুরের পুজোও বেশ জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। রমানাথ ছিলেন দ্বারকানাথের ছোটোভাই আর জোড়াসাঁকোর গুণেন্দ্রনাথ ঠাকুরের বাড়িতে বিজয়া সম্মিলনীর আসর বসতো। এভাবেই ১৭৮৪ সালে শুরু হয়ে ১৮৫৮তে বন্ধ হয়ে যায় ঠাকুরবাড়ির দুর্গাপুজো। মাত্র চুয়াত্তর বছরের পুজর জাঁকজমকের আর বিশাল বৈভবের স্মৃতি আজও কলকাতার জোড়াসাঁকোয় ছড়িয়ে রয়েছে, কলকাতার ইতিহাসের এ এক অনালোচিত অধ্যায়।