দুর্গাবতী দেবী এর জীবনী

দুর্গাবতী দেবী এর জীবনী

ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে এক অন্যতম বীরাঙ্গনা দুর্গাবতী দেবী (Durgawati Devi) যিনি দুর্গাবতী ভাবী নামেই তিনি অধিক পরিচিত। ভগত সিং, আসফাকউল্লা খান, চন্দ্রশেখর আজাদ প্রমুখদের পাশাপাশি ‘হিন্দুস্তান রিপাবলিকান আর্মি’র সদস্য হিসেবে প্রায় সমস্ত বিপ্লবী আন্দোলনে সামিল হয়েছিলেন তিনি। পুলিশ কমিশনার সন্ডার্স হত্যার পরে ছদ্মবেশে ট্রেনে করে পালানোর সময় পুলিশের হাত থেকে ভগত সিংকে বাঁচাতে দুর্গাবতী দেবী নিজেকে তাঁর স্ত্রী হিসেবে পরিচয় দিয়েছিলেন।

ভারতের অগ্নিকন্যা তথা ‘দ্য অগ্নি অফ ইণ্ডিয়া’ আখ্যা দেওয়া হয় তাঁকে। নওয়াজউদ্দিন ভারতসভার সদস্য ছিলেন দুর্গাবতী দেবী এবং অন্যান্য বাঙালি বিপ্লবীদের সঙ্গে একত্রে বোমা তৈরির ঝুঁকিপূর্ণ কৌশল শিখেছিলেন তিনি। ব্রিটিশ সরকার ভগৎ সিং, শুকদেব ও রাজগুরুর ফাঁসি ঘোষণা করলে দুর্গাবতী দেবী প্রকাশ্যে এই সিদ্ধান্তের তীব্র প্রতিবাদ করেন এবং এই ফাঁসির প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য তৎকালীন পাঞ্জাবের রাজ্যপাল লর্ড হেইলিকে হত্যার পরিকল্পনা করেন।

১৯০৭ সালের ৭ অক্টোবর এলাহাবাদের এক গুজরাতি ব্রাহ্মণ পরিবারে দুর্গাবতী দেবীর জন্ম হয়। শৈশবেই তাঁর মা মারা যান এবং তাঁর বাবা সন্ন্যাসধর্মে দীক্ষিত হন। ফলে শৈশব থেকেই অনাথিনী দুর্গাবতী বড় হয়েছেন তাঁর কাকিমার কাছে। পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনা করেছিলেন তিনি। তারপরেই মাত্র এগারো বছর বয়সেই এক সম্পন্ন প্রতিপত্তিশালী গুজরাতি শিব চরণ দাসের পুত্র ভগবতীচরণ বোহ্‌রার সঙ্গে দুর্গাবতী দেবীর বিবাহ হয়। স্বামী ভগবতীচরণের হাত ধরেই ভারতের ‘হিন্দুস্তান সোশ্যালিস্ট রিপাবলিকান আর্মি’র সঙ্গে তাঁর পরিচয় হয়।

ভগবতীচরণ ছাত্র রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন লাহোরের ন্যাশনাল কলেজে পড়ার সময় থেকেই। তাঁর সম্পন্ন অবস্থার কারণে খুব তরুণ বয়স থেকেই সামাজিক ও রাজনৈতিক নানা কর্মকাণ্ডে অর্থ দান করতেন। তাঁর বাড়িতেও এ নিয়ে বিশেষ অসম্মতি ছিল না। এইভাবেই ভগবতীচরণ জড়িয়ে পড়েছিলেন হিন্দুস্তান সোশ্যালিস্ট রিপাবলিকান আর্মির সঙ্গে। ১৯২৫ সালে শচীনন্দ নামে দুর্গাবতী দেবীর একটি পুত্র সন্তানের জন্ম হয়। দুর্গাবতী দেবী ছিলেন ‘নওয়াজউদ্দিন ভারতসভা’র সক্রিয় সদস্য।

১৯২৬ সালের ১৬ নভেম্বর লাহোরে কর্তার সিং সরাভা’র ১১তম বার্ষিক শহীদ দিবস পালনের সময় দুর্গাবতী দেবী একেবারে সামনের সারিতে থেকে এই শহীদ দিবস পালনে অগ্রণী হয়েছিলেন। ভারতীয় বিপ্লবী আন্দোলনে সর্বকনিষ্ঠ শহীদ ছিলেন কর্তার সিং যিনি ১১ বছর জেলে থাকার পর মাত্র ১৯ বছর বয়সে তাঁর ফাঁসি হয়। ১৯২৮ সালের শেষ দিকে দুর্গাবতী এবং ভগবতীচরণ ভগত সিং, আসফাকউল্লা খানের সঙ্গে হিন্দুস্তান সোশ্যালিস্ট রিপাবলিকান আর্মির সদস্য হন এবং প্রচার সম্পাদক হিসেবে কাজ করতে শুরু করেন।

তাঁরা দুজনে মিলে ‘দ্য ফিলোজফি অফ বম্ব’ নামে একটি বইতে ভারতের বিপ্লবী আন্দোলন সম্পর্কে বিস্তারিত লেখেন। মহাত্মা গান্ধীর লেখা ভারতীয় বিপ্লবীদের নিয়ে একটি সমালোচনামূলক প্রবন্ধ ‘দ্য কাল্ট অফ দ্য বম্ব’-এই বইটির খসড়া হিসেবে কাজ করেছিল। ১৯২৯ সালের ডিসেম্বর মাসের শুরু দিকে কলকাতায় ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের বার্ষিক অধিবেশনে যোগ দেওয়ার জন্য  রওনা দেন ভগবতীচরণ এবং তাঁর স্ত্রী দুর্গাবতী দেবীর কাছে আপদকালীন পরিস্থিতির জন্য চার-পাঁচ হাজার টাকা রেখে যান।

এই বছরই সণ্ডার্স হত্যার পরে শুকদেব ও ভগত সিং রাজগুরুকে সঙ্গে নিয়ে দুর্গাবতী দেবীর কাছে আসেন সাহায্যের জন্য। ইতিমধ্যেই সণ্ডার্স হত্যার সংবাদ তিনি শুনেছেন, সমগ্র লাহোর জুড়ে এ নিয়ে শোরগোল দেখা দিয়েছিল। এছাড়া হিন্দুস্তান রিপাবলিকান আর্মির দেওয়া পোস্টারগুলিই মূলত মানুষের মধ্যে উত্তেজনার সঞ্চার করেছিল।

এই হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে ভগত সিং জড়িত একথা তিনি বুঝতে পেরেছিলেন, কিন্তু দলের নিয়মবিধি মেনে তিনি কোন প্রশ্ন করেননি। তাঁদের সাহায্যের জন্য তিনি ভগবতীচরণের রেখে যাওয়া টাকা পুরোটাই দিয়ে দেন এবং ভগত সিংকে লাহোরে পালিয়ে যাওয়ার জন্য সাহায্যের প্রতিশ্রুতি দেন। এরপরে পুত্র শচীনন্দকে সঙ্গে নিয়ে ভগত সিং-এর সঙ্গে একটি ফার্স্ট ক্লাস লক্ষ্ণৌগামী ট্রেনে চেপে বসেন সকলে। তাঁদের সঙ্গে রাজগুরু ছিল পরিবারের এক ভৃত্যের ছদ্মবেশে। দুর্গাবতী নিজেকে ভগত সিং-এর স্ত্রী বলে পরিচয় দিয়েছিলেন এই যাত্রায়।

লক্ষ্ণৌ পৌঁছে কলকাতায় যাওয়ার জন্য ট্রেন পরিবর্তন করেন তাঁরা। চন্দ্রশেখর আজাদ একটি মহিলাদের দলের সঙ্গে নামাবলী গায়ে চাপিয়ে পাণ্ডার ছদ্মবেশে লাহোরে পালিয়ে যান। তাঁর সঙ্গে ছিল শুকদেবের মা ও বোন, যেন মনে হচ্ছিল আজাদই তাঁদের সকলকে তীর্থযাত্রায় নিয়ে যাচ্ছেন। লক্ষ্ণৌ থেকে ভগবতীচরণকে একটি টেলিগ্রাম করে জানান যে তিনি দুর্গাবতীকে সঙ্গে নিয়ে কলকাতায় আসছেন। প্রথমে ভগবতীচরণ এই দুর্গাবতী ঠিক কে তা চিনতে পারেননি, কিন্তু কলকাতায় পৌঁছানোর পরে তাঁর নিজের স্ত্রীকে দেখে চমকে উঠেছিলেন তিনি।

ভগবতীচরণ ভাবতেই পারেননি যে দুর্গাবতী এত সক্রিয়ভাবে বৈপ্লবিক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়বেন। কলকাতায় তখন ভগবতীচরণ তাঁর বোন সুশীলার সঙ্গে থাকতেন, সুশীলাও একজন উল্লেখযোগ্য বিপ্লবী ছিলেন। ভারতীয় জাতীয় কংগ্রসের কতকগুলি অধিবেশন শেষ করে দুর্গাবতী লাহোরে চলে যান তাঁর পুত্রকে নিয়ে। এদিকে ভগবতীচরণ কলকাতার বিপ্লবীদের থেকে বোমা বানানো শিখে আইনসভায় বোমা বিস্ফোরণ কর্মসূচিতে জড়িয়ে পড়েছিলেন।

১৯২৯ সালের এপ্রিল মাসের শুরুর দিকে দিল্লিতে ভগত সিংকে অভ্যর্থনা জানাতে উপস্থিত ছিলেন দুর্গাবতী দেবী এবং তাঁর স্বামী ভগবতীচরণ। সুশীলার সঙ্গে তিনি দিল্লিতে ভগত সিং, ভগবতীচরণ এবং চন্দ্রশেখর আজাদের সঙ্গে দেখা করেন এবং কার্সিয়া পার্কে তাঁরা সকলে একটি বনভোজন করেন। সুশীলা নিজের বুড়ো আঙুল সামান্য কেটে ভগৎ সিং-এর কপালে রক্ততিলক পরিয়ে দিয়েছিলেন।

বনভোজনের সময় ভগত সিং-এর প্রিয় পদ সমস্ত রান্না করে খাইয়েছিলেন সুশীলা এবং দুর্গাবতী দেবী। ভগত সিং এবং তাঁর সহকারীরা আইনসভার ভিতরে চলে যাওয়ার পরে একটা টাঙাগাড়িতে চেপে আইনসভার বাইরেই ঘুরছিলেন সুশীলা এবং দুর্গাবতী, সঙ্গে ছিল তাঁর পুত্র শচীও। আইনসভায় বোমা বিস্ফোরণের পরেই পুলিশের হাতে ধরা পড়েন ভগত সিং। সেই সঙ্গে তাঁর দলবলের লোকেদেরও খুঁজতে শুরু করে পুলিশ।

ইতিমধ্যে ভগবতীচরণের নিজের নামে ‘কাশ্মীর হাউজ’ নামের একটি বাড়িতে হিন্দুস্তান সোশ্যালিস্ট রিপাবলিকান আর্মির একটি বোমা কারখানা আবিষ্কার করে ব্রিটিশ পুলিশ। ফলে পুলিশ জয়গোপাল, শুকদেব, কিশোরীলালকে গ্রেপ্তার করে কিন্তু ভগবতীচরণ সেই সময় আত্মগোপন করে থাকায় তাঁকে ধরতে পারেনি তারা। এই ঘটনার ফলে বাধ্য হয়ে দুর্গাবতী দেবী নিজেদের পারিবারিক সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত হওয়া থেকে বাঁচাতে একজন আইনজীবীকে নিযুক্ত করেন।

লাহোর ষড়যন্ত্র মামলাতেও অভিযুক্ত হয়েছিলেন ভগবতীচরণ, ফলে তাঁদের সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত হওয়ার সম্ভাবনা ছিল বেশি। এই সময় দুর্গাবতী সমস্ত বিপ্লবীদের পরিবারকে সাহায্য করতেন, সকলের সঙ্গে চিঠিপত্র আদানপ্রদানের মাধ্যমে একটি জীবন্ত ডাকবাক্স হয়ে উঠেছিলেন তিনি। আর এই সময়েই দলের জন্য অস্ত্র সংরক্ষণের কাজটিও করতে শুরু করেন দুর্গাবতী দেবী। ১৯৩০ সালের শুরুর দিকে ‘হিন্দুস্তান টাইমস’-এর সম্পাদক জে. এন. সাহানী দিল্লিতে এক গোপন বৈঠকে দুর্গাবতী দেবীর সঙ্গে একটি পিস্তল লক্ষ্য করেছিলেন যা সম্ভবত ভারতের উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত থেকে নিয়ে আসা হয়েছিল।

ভগত সিংকে জেল থেকে ছাড়ানোর জন্য দুর্গাবতী দেবী প্রভূত দায়িত্ব পালন করেছিলেন। বরস্টাল থেকে লাহোরের সেন্ট্রাল জেলে ভগত সিংকে নিয়ে যাওয়ার সময় সেই পুলিশ ভ্যানে আক্রমণ চালিয়েছিলেন দুর্গাবতী দেবী, তাঁর সঙ্গে ছিলেন বৈশম্পায়ন, শুকদেবরাজ, সুশীলা এবং আজাদ। ১৯৩০ সালের ২৮ মে একটি বোমা পরীক্ষা করার সময় ভগবতীচরণের মৃত্যু হলে প্রথমে কিছুদিন দুর্গাবতী কিওয়াল কিষান ইঞ্জিনিয়ারের কাছে থাকতেন, পরে লাহোরে রানা জং বাহাদুর সিং-এর বাড়িতে সুশীলার সঙ্গে থাকতে শুরু করেন তিনি।

কিন্তু কিছুদিনের মধ্যেই বোরখা পড়ে লাহোর ছেড়ে চলে যান দুর্গাবতী। ইতিমধ্যে কারাবন্দি বিপ্লবী যতীন্দ্রনাথ দাস দীর্ঘ ৬৩ দিন অনশনে থাকার পরে মৃত্যুবরণ করলে তাঁর মৃত্যুমিছিলের একেবারে সামনের সারিতে প্ল্যাকার্ড হাতে মিছিল পরিচালনা করেছিলেন দুর্গাবতী দেবী। ১৯৩০ সালের ৮ অক্টোবর মধ্য রাত্রে বম্বের ল্যামিংটন রোডে পুলিশ স্টেশনের বাইরে দাঁড়িয়ে থাকা এক ইউরোপীয় দম্পতিকে গুলি করেছিলেন দুর্গাবতী দেবী। তাঁরা আদপে ছিলেন একজন পুলিশ সার্জেন্ট ও তাঁর স্ত্রী।

কিন্তু অদ্ভুতভাবে তাঁরা দুজনেই বেঁচে গিয়েছিলেন। প্রত্যক্ষদর্শীদের কারও কারও মতে, একটি চলন্ত গাড়ি থেকে একাধিক আগ্নেয়াস্ত্র দিয়ে গুলি চালানো হয়েছিল এবং গাড়িতে একজন গুজরাতি মহিলা পুরুষের ছদ্মবেশে উপস্থিত ছিলেন। এই কাজটি হিন্দুস্তান সোশ্যালিস্ট রিপাবলিকান আর্মির নীতির পরিপন্থী হলেও ভগত সিং-এর গ্রেপ্তার ও ফাঁসির স্বতন্ত্র প্রতিক্রিয়া হিসেবে এই কাজ করেছিলেন তাঁরা।

এক্ষেত্রে চন্দ্রশেখর আজাদের অনুমতি নেওয়া হয়নি। ব্রিটিশ সরকার ভগৎ সিং, শুকদেব ও রাজগুরুর ফাঁসি ঘোষণা করলে দুর্গাবতী দেবী প্রকাশ্যে এই সিদ্ধান্তের তীব্র প্রতিবাদ করেন এবং এই ফাঁসির প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য পাঞ্জাবের প্রাক্তন রাজ্যপাল লর্ড হেইলিকে হত্যার পরিকল্পনা করেছিলেন তিনি। কিন্তু রাজ্যপাল হেইলি পালিয়ে যাওয়ায় ধরা পড়ে যান দুর্গাবতী। বিচারে তাঁর তিন বছরের কারাদণ্ড ঘোষিত হয়। ১৯৯৯ সালের ১৫ অক্টোবর ৯২ বছর বয়সে দুর্গাবতী দেবীর মৃত্যু হয়।