মহাভারতের প্রেক্ষাপটে দুঃশাসন বধ

মহাভারতের প্রেক্ষাপটে দুঃশাসন বধ

মহাভারতের কর্ণপর্বের ৮৪তম অধ্যায়ে দুঃশাসন বধ – এর কথা বর্ণিত আছে। দুঃশাসন দ্যূতসভায় দ্রৌপদীকে বিবস্ত্র করার চেষ্টা করেছিলেন। এই অপমানের প্রতিশোধ নিতে ভীম প্রতিজ্ঞা করেছিলেন তিনি যুদ্ধের সময় দুঃশাসনের বুক চিরে রক্ত পান করবেন। এই প্রতিজ্ঞার ফলেই কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের সতেরোতম দিনে ভীমের হাতে দুঃশাসন বধ হয়। যুদ্ধের পনেরোতম দিনে দ্রোণের মৃত্যু হওয়ার পরে কৌরবপক্ষের সেনাপতি হয়েছিলেন কর্ণ।

সতেরোতম দিনে কর্ণ ভীষণ তেজের সঙ্গে যুদ্ধ শুরু করেন। তাঁর হাতে পান্ডবদের অসংখ্য সৈন্য মারা যাচ্ছে দেখে কৃষ্ণের উপদেশে অর্জুন কর্ণকে আক্রমণ করলেন। দুজনের মধ্যে প্রবল যুদ্ধ আরম্ভ হয়েছে দেখে অর্জুনকে সাহায্য করতে এগিয়ে এলেন ভীম। অন্যদিকে দুর্যোধনের আদেশে কর্ণকে সাহায্য করতে এলেন দুঃশাসন। তিনি এসেই ভীমকে আক্রমণ করলেন।

একটি স্ত্রী হাতিকে সঙ্গিনী বানানোর জন্য দুটি ভীষণ বলবান পুরুষ হাতি যেভাবে একে অন্যকে আক্রমণ করে, ঠিক সেইভাবেই ভীম ও দুঃশাসন একে অপরকে আক্রমণ করলেন। ভীমের বাণের আঘাতে দুঃশাসনের ধনুক ও ধ্বজ কাটা গেল। তাঁর সারথীকেও ভীম বধ করলেন। দুঃশাসন তখন নিজেই রশি ধরে রথের গতিবেগ নিয়ন্ত্রণ করতে লাগলেন এবং একটি নতুন ধনুক নিয়ে ভীমের বুক লক্ষ্য করে বাণ চালাতে লাগলেন। ভীমের বুকে বাণ লাগায় ভীম রথের উপরে অজ্ঞান হয়ে পড়ে গেলেন। কিছুক্ষণ পরে ভীমের জ্ঞান ফিরে এল।

তা দেখে দুঃশাসন আবার একের পর এক বাণ মারতে লাগলেন। তিনি ভীমের ধনুক কেটে তাঁর সারথীকে নয়টি এবং ভীমকে অসংখ্য বাণ মারলেন। ভীম তখন রেগে গিয়ে দুঃশাসনের দিকে জ্বলন্ত উল্কার মত একটি শক্তি ছুঁড়ে মারলেন। দুঃশাসন আকর্ণ (কান পর্যন্ত) ধনুকের গুণ টেনে ধরে দশ বাণে সেই শক্তিকে টুকরো টুকরো করে ফেললেন। তারপর তিনি বাণে বাণে ভীমকে ক্ষতবিক্ষত করতে থাকলে ভীম দুঃশাসনকে বললেন, “তোমার প্রহার তো আমি সহ্য করে নিলাম।

তুমি আমার এই গদার আঘাত সামলাও তো দেখি!” এই বলে ভীম এক বিশাল মহাগদা দুঃশাসনকে ছুঁড়ে মারলেন। সেই গদাকে আটকাতে দুঃশাসনও একটি শক্তি ছুঁড়ে মারলেন, কিন্তু মাঝরাস্তায় তা গদায় লেগে খণ্ডবিখণ্ড হয়ে গেল। তারপর সেই ভীষণ গদা দুঃশাসনের রথ আর রথের ঘোড়াগুলিকে ধ্বংস করে তাঁর মাথায় পড়লে তার আঘাতে দুঃশাসন ছিটকে গিয়ে দশ ধনু (চল্লিশ হাত) দূরে পড়লেন। তাঁর আর ওঠার ক্ষমতা রইল না। যন্ত্রণায় দুঃশাসনকে ছটফট করতে দেখে ভীমের মনে পড়ল তাঁর পুরোনো প্রতিজ্ঞার কথা।

এই দুঃশাসনই দ্যূতসভায় রজঃস্বলা দ্রৌপদীকে চুল ধরে টেনে এনে তাঁকে বিবস্ত্র করার চেষ্টা করেছিল—এই কথা মনে করে ভীম রাগে জ্বলে উঠলেন। তিনি দুর্যোধন, কৃপ, অশ্বত্থামা, কর্ণ প্রভৃতি কৌরবপক্ষের মহাযোদ্ধাদের ডেকে বললেন, “আজ আমি এই পাপীকে হত্যা করে এর বুক চিরে রক্ত পান করব। তোমাদের যদি ক্ষমতা থাকে তবে আমাকে হারিয়ে দুঃশাসনকে রক্ষা করো।” এই বলে ভীম ঝড়ের বেগে দুঃশাসনের দিকে ছুটে চললেন।

কৌরবরা হাজার হাজার অস্ত্র ছুঁড়ে তাঁকে আটকানোর অনেক চেষ্টা করল, কিন্তু কেউই ভীমকে আটকাতে পারল না। ভীম দুঃশাসনের কাছে গিয়ে তাঁর বুকে লাথি মারলেন। তারপর সিংহ যেমন হাতিকে ধরে, তেমন করে তাঁকে পায়ের নিচে চেপে ধরে তাঁর বুকে তলোয়ার বসিয়ে দিলেন। তলোয়ারের আঘাতে দুঃশাসনের বুক থেকে রক্ত বেরিয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গে ভীম অঞ্জলি ভরে সেই রক্ত তুলে নিয়ে পান করলেন।

তারপর দুঃশাসনের মাথা কেটে ফেলে সেই রক্ত পান করতে করতে ভীম বললেন, “আহা! কী মিষ্টি! মায়ের স্তনের দুধ, মধু, ঘি, মাধ্বী, পবিত্র জল ইত্যাদি জগতের সমস্ত শ্রেষ্ঠ পানীয়ের তুলনায় এই শত্রুরক্ত আমার বেশি সুস্বাদু মনে হচ্ছে।” রক্তপানরত অবস্থায় ভীমকে যারা দেখল তারা ভয়ে আকুল হয়ে মাটিতে পড়ে গেল। তাদের হাত থেকে অস্ত্র খসে পড়ল।

কৌরবপক্ষের সৈন্যরা সারা গায়ে রক্ত মাখা ভীমকে দেখে তাঁকে রাক্ষস মনে করে ঊর্ধ্বশ্বাসে যুদ্ধক্ষেত্র থেকে পালাতে লাগল। তারপর ভীম লাথি মেরে দুঃশাসনের মৃতদেহ দূরে সরিয়ে দিয়ে কৃষ্ণ ও অর্জুনকে ডেকে বললেন, “আমি দুঃশাসনের সম্পর্কে যে প্রতিজ্ঞা করেছিলাম, তা পালন করলাম। এরপর দ্বিতীয় পাপী দুর্যোধনকেও এইভাবেই হত্যা করব এবং তার মাথায় লাথি মেরে শান্তি লাভ করব।” দৈত্যরাজ বৃত্রকে বধ করে দেবরাজ ইন্দ্র যেভাবে সিংহনাদ করেছিলেন, এই কথা বলে ভীমও সেইভাবে সিংহনাদ করতে লাগলেন।