হলদিয়া | পূর্ব মেদিনীপুরের বৃহত্তম পৌরসভা , পশ্চিমবঙ্গের অন্যতম শিল্প শহর

হুগলি নদী মোহনার কাছে হুগলি ও হলদি নদীর মিলনস্থলে অবস্থিত পশ্চিমবঙ্গের ২৪তম জনবহুল শহর হলদিয়া। হলদিয়া মহকুমার সদর কার্যালয় এই হলদিয়া। হলদিয়া পশ্চিমবঙ্গের একটি গুরুত্বপূর্ণ সমুদ্র-বন্দর ও শিল্পনগরী। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ৮ মিটার উচ্চতায় হলদিয়া শহরটি অবস্থিত। জনসংখ্যার ভিত্তিতে ভারতের শহরগুলির মধ্যে এটি ২৩১তম এবং পূর্ব মেদিনীপুর জেলার সর্বাধিক জনবহুল শহর হলদিয়া ।এটি জনসংখ্যার ভিত্তিতে পূর্ব মেদিনীপুর জেলার বৃহত্তম পৌরসভা ও মহানগর।
২০১১ সালের জনগণনার পরে শহরটির জনসংখ্যা বেড়েছে এবং জুলাই ২০০১ সালের মার্চ মাস থেকে ২০১১ সালের মার্চ মাস পর্যন্ত জনসংখ্যা ৩০,১৪৫ জন বৃদ্ধি পেয়ে ২,০০,৮২৭ জন হয়। ২০১১ সালের জনগণনা অনুযায়ী জনসংখ্যার ভিত্তিতে পশ্চিমবঙ্গের শহর গুলির মধ্যে ২৪ তম স্থানে রয়েছে।২০১১ সালের হিসেব অনুযায়ী, হালদিয়া পৌর এলাকার জনসংখ্যা ২,০০,৮২৭ এবং হালদিয়া শহর অঞ্চলের মোট জনসংখ্যা ২,০৭,৬৯৫। লিঙ্গানুপাত প্রতি ১০০০ জন পুরুষে ৯১৬ জন নারী। হালদিয়ায় সাক্ষরতার হার ৮৯.০৬ শতাংশ যা জাতীয় সাক্ষরতার হার ৭৪.০৪ শতাংশের তুলনায় বেশি।
হলদি নদীর তীরে অবস্থিত হলদিয়া টাউনশিপ ও দুর্গাচক শহরের প্রধান বসতাঞ্চল। কলকাতা শহরের ৫০ কিলোমিটার দক্ষিণ-পশ্চিমে ভারী পণ্য আনা-নেওয়ার উদ্দেশ্যে কলকাতার একটি গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্যিক বন্দর হিসেবে হলদিয়া বন্দর- গড়ে তোলা হয়েছে। এই শিল্পনগরীতে একাধিক ফ্যাক্টরি রয়েছে। এগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য ইন্ডিয়ান ওয়েল কর্পোরেশন লিমিটেড, শ ওয়ালেস, টাটা কেমিক্যালস, হলদিয়া পেট্রোকেমিক্যালস ও হিন্দুস্তান ইউনিলিভার সাউথ এশিয়ান পেট্রোকেমিক্যালস লিমিটেড, এক্সাইড ।
এছাড়াও হলদিয়াতে একাধিক মাঝারি ও ক্ষুদ্র শিল্প গড়ে উঠেছে। হলদিয়া বন্দরে মিৎসুবিসি কেমিক্যাল কোম্পানির মতো জাপানভিত্তিক শিল্পগোষ্ঠীর ফ্যাক্টরিও গড়ে উঠেছে।বর্তমানে এই কারখানাটি চ্যাটার্জি গোষ্ঠী অধিগ্রহণ করেছে। স্থাপিত হয়েছে ড্রেজিং কর্পোরেশন অফ ইন্ডিয়া লিমিটেডের মতো কোম্পানিও। হলদিয়া পেট্রোকেমিক্যালস ভারতে এই ধরনের দ্বিতীয় বৃহত্তম প্রকল্প।তেল, প্রাকৃতিক গ্যাস, পেট্রোলিয়াম পণ্য সম্পর্কিত শিল্পগুলি গাঙ্গেয় সমভূমি অঞ্চলে অবস্থিত শহরটির অর্থনীতির এক বৃহত্তম জায়গা ।
হলদিয়া পেট্রোকেমিক্যালস - হলদিয়া পেট্রোকেমিক্যালস হল হলদিয়ায় অবস্থিত একটি বৃহত্তম পেট্রোকেমিক্যালস কমপ্লেক্স , যেটি ভারতের দ্বিতীয় বৃহত্তম পেট্রোকেমিক্যালস কারখানা।১৯৯৪ সালে টাটা গোষ্ঠী ,চ্যাটার্জি গোষ্ঠী,ইন্ডিয়ান ওয়েল ও পশ্চিমবঙ্গ সরকারের মধ্যে চুক্তি হয় এবং হলদিয়া পেট্রোকেমিক্যালসের নির্মাণ শুরু হয়।
২০০১ সালে হলদিয়া পেট্রোকেমিক্যালস প্রথম উৎপাদন শুরু হয়। এই কারখানাটিতে ৭,০০,০০০ টিপিএ পলিইথিলিন উৎপাদিত হয় যা পূর্ব ভারত এর ৭০% ও সমগ্র ভারত এর ৩০% চাহিদা পূর্ন করে।এছাড়া এখানে প্রায় ৩,৫০,০০০ টিপিএ পলিথিন উৎপাদিত হয়। এখানে উৎপাদিত প্রধান দ্রব্যগুলি হল পলিইথিলিন , বেঞ্জিন , পলিথিন , সি৪ (C4) হাইড্রোকার্বন। হলদিয়া পেট্রোকেমিক্যালসে উৎপাদিত দ্রব্যে ইউরোপ,দক্ষিণ পূর্ব এশিয়া,যুক্তরাষ্ট্র,চিন এ পণ্য রপ্তানি করা হয়।
ইন্ডিয়ান ওয়েল কর্পোরেশন লিমিটেড : ১৯৭৫ সালে ইন্ডিয়ান ওয়েল কর্পোরেশন লিমিটেড পশ্চিমবঙ্গ এর হলদিয়াতে ২.৫০ এমএমটিপি তৈল শোধন ক্ষমতা সম্পূর্ণ হলদিয়া তৈল শোধনাগার গড়ে তোলে মধ্যপাচ্য থেকে আনা খনিজতেল এই তৈল শোধনাগারে শোধন করা হয়।হলদিয়া তৈল শোধনাগারে খনিজ তেল শোধন ও প্রেট্রোলিয়াম দ্রব উৎপাদনের দুটি ইউনিট রয়েছে। একটি ইউনিট জ্বালানি তেল উৎপাদন করে যা ফ্রান্স এর সহযোগিতায় নির্মিত হয়েছে এবং দ্বিতীয় ইউনিটে পিচ্ছিলকারক দ্রব্য উৎপাদিত হয় যা রোমানিয়ার সহোযোগিতায় নির্মিত হয়েছে। হলদিয়া শোধনাগারে বছরে ৭৫ লক্ষ টন পরিশোধিত তেল উৎপাদিত হত। তা বেড়ে এখন ৮০ লক্ষ টন।
হলদিয়া বন্দর : হলদিয়া বন্দর বর্তমানে পশ্চিমবঙ্গের একক বৃহত্তম বন্দর। এই বন্দর পূর্ব মেদিনীপুর জেলার তমলুক মহকুমায় অবস্থিত।কলকাতা বন্দর সহযোগে হলদিয়া বন্দর হল ভারতের পঞ্চম বৃহত্তম পণ্যবাহী বন্দর এবং তৃতীয় বৃহত্তম কন্টেইনার বন্দর।বন্দরটির পণ্য খালাসের ক্ষমতা বছরে ৪৬ মিলিয়ন টন। হলদিয়া বন্দরের সর্বোচ্চ গভীরতা হল ৮.৫ মিটার এবং বন্দরটিতে সর্বোচ্চ ২৩০ মিটার দীর্ঘ জাহাজ নোঙর করতে পাড়ে। ভারতের বাইরে নেপাল ও ভূটানের পণ্য কলকাতা বন্দর ছাড়াও হলদিয়া বন্দরের মধ্যমে পরিবহন করা হয়।
হলদিয়া বন্দরের ডকে ১৪ টি বার্থ ও হুগলি নদীর তীরে ৩ টি তেল জেটি ও ৩ টি বার্জ জেটি রয়েছে। এই বন্দরটির প্রধান আমদানি দ্রব্য হল পেট্রোলিয়াম, রাসায়নিক দ্রব্য, যন্ত্রাংশ। রপ্তানি দ্রব্য হল কয়লা, আকরিক লোহা, ইস্পাত প্রভৃতি। হলদিয়া বন্দরের ডকে ১৪ টি বার্থ ও হুগলি নদীর তীরে ৩ টি তেল জেটি ও ৩ টি বার্জ জেটি রয়েছে। বন্দরের ডকটি একটি লক গেট দ্বারা হুগলী নদী থেকে পৃথক। ডকটিতে ৩০ হাজার মেট্রিক টন পন্য বোঝাই জাহাজ নোঙর করতে পাড়ে। হুগলি নদীর তীরে বন্দরের তেল জেটিসমূহে ৩০ হাজার মেট্রিক টনের অধিক পণ্যবাহী জাহাজের নোঙরের সক্ষমতা রয়েছে।
শুধু শিল্পের দিক থেকেই শহরটি উন্নত নয় , শিক্ষার দিক থেকেও বেশ উন্নত এই শহর। সরকারি , বেসরকারি মিলিয়ে বেশ কয়েকটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে। হলদিয়ায় রয়েছে ল কলেজ , এই কলেজের পাশেই গড়ে উঠেছে গ্লোবাল ইনস্টিটিউট অফ্ সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি কলেজ নামে পলিটেকনিক কলেজ। হলদিয়াতে রয়েছে পশ্চিমবঙ্গের অন্যতম নামকরা বেসরকারী ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ হলদিয়া ইনস্টিটিউট অফ্ টেকনোলজি। ইঞ্জিনিয়ারিং এর নানা বিষয়ে এ ব্যাচেলর ডিগ্রি এবং কিছু বিষয়ে মাস্টার্স পড়ানো হয় এই কলেজে।কলেজটি রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব লক্ষণ শেঠ কর্তৃক নির্মিত।
হলদিয়া বর্তমানে শুধু শিল্প বা শিক্ষার দিক থেকেই নয় খেলাধূলার দিক থেকেও হলদিয়া নগরীর যথেষ্ট সুনাম রয়েছে।হলদিয়া আন্তর্জাতিক স্পোর্টস সিটি পশ্চিমবঙ্গের একটি ক্রীড়া শহর হিসাবে গড়ে উঠছে। হলদিয়া ইন্টারন্যাশনাল স্পোর্টস সিটি দুবাই স্পোর্টস সিটি এর প্রতিরূপ তৈরি হচ্ছে। হলদিয়া আন্তর্জাতিক ক্রীড়া সিটিতে গঠিত হবে ৪০০০০ আসন বিশিষ্ট ক্রিকেট স্টেডিয়াম, থাকবে ৪০,০০০ জন মানুষের বসার ব্যবস্থা, এবং অভ্যন্তরীণ স্টেডিয়ামটি হবে ৫,০০০ আসন বিশিষ্ট। এছাড়াও সেখানে থাকবে আধুনিক জীবনযাত্রার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থাও।