ফাটাকেষ্টর কালীপুজো

কলকাতার অন্যতম বিখ্যাত কালীপুজোগুলির মধ্যে একটি ফাটাকেষ্টর কালীপুজো । উত্তর কলকাতার সীতারাম ঘোষ স্ট্রীটে নবযুবক সংঘের পুজোই ফাটাকেষ্টর পুজো নামে বিখ্যাত। শুধু উত্তর কলকাতাই নয়, পশ্চিমবঙ্গের সর্বত্র ছাড়িয়ে আপামর ভারত জুড়েই ছড়িয়ে আছে ফাটাকেষ্টর নাম। বহু বড় মাপের সঙ্গীতশিল্পী, অভিনেতা সহ অন্যান্য তারকারা তাঁর এই পুজোয় এসেছেন এমনকি প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায়ও একবার পুজো উদ্বোধনে এসেছিলেন।
ফাটাকেষ্টর বর্ণময় জীবনের মতোই এই পুজোর ইতিহাসও বহুবর্ণময়। সত্তর দশকের কলকাতায় ফাটাকেষ্টর কালীপুজো একটি বিরাট ব্যাপার হয়ে উঠেছিল বলা চলে। নকশাল আমলের আতঙ্কে মধ্যবিত্ত গৃহস্থ একপ্রকার কোণঠাসা হয়ে পড়েছিল উত্তর কলকাতায়। সেখানে ফাটাকেষ্টর উত্থান এক নির্ভীক রক্ষাকর্তার মতো। জনশ্রুতিতে একদিকে যেমন তাঁকে নিয়ে ছড়িয়েছিল ভয়ের আতঙ্ক, আবার অন্যদিকে তিনিই পাড়া-পড়শিদের বাঁচাতে সময়ে-অসময়ে সর্বদা ঢাল হয়েছিলেন। শোনা যায় মাঠে-ময়দানে বোমাবাজি, গুলি ছোঁড়া তাঁর কাছে জলভাত ছিল।
আবার এই ফাটাকেষ্টই রাতের সিনেমার শো দেখে বাড়ি ফেরা পাড়ার মেয়েদের রক্ষা করতে ছুটে যেতেন, নিজের লোকেদের সবসময় কড়া পাহারা দিতে বলতেন। সব মিলিয়ে সত্তর দশকের কলকাতায় এক ‘হিরো’র মতো আবির্ভাব ঘটছিল ফাটাকেষ্টর। কিন্তু কে এই ফাটাকেষ্ট? ফাটাকেষ্টর আসল নাম কৃষ্ণচন্দ্র দত্ত। ডাকনাম কেষ্ট। ১৯৫০-এর দশকের শেষ দিকে সীতারাম ঘোষ স্ট্রিটের কাছে বাবার পানের দোকান সামলাতেন তিনি। পড়াশোনা বিশেষ জানতেন না, শখ ছিল শরীরচর্চার আর তার পাশাপাশি প্রবলভাবে কালীর ভক্ত ছিলেন তিনি।
একবার শত্রুর আক্রমণে ছুরির আঘাতে গুরুতরভাবে আহত হলেও মেডিক্যাল কলেজে চিকিৎসার পরে সুস্থ হয়ে ওঠেন তিনি। ছুরিবিদ্ধ হওয়ার পর থেকেই কেস্ট থেকে তাঁর নাম হয়ে যায় ফাটাকেষ্ট। কলকাতা থেকে নকশালদের সরিয়ে ফেলতে তাঁর কৃতিত্বও কম কিছু ছিল না। পরে সিদ্ধার্থশঙ্কর রায়ের আমলে তাঁকে নাকি সরকারি ডেয়ারির রিজার্ভ ড্রাইভারের চাকরিতে বহাল করা হয়েছিল। কিন্তু শোনা যায়, তিনি নাকি কাজে না গিয়ে ঘরে বসে বেতন নিতেন। আবার নিলামের কারবারিতেও বহু অর্থ উপার্জন করেছিলেন তিনি।
এই ফাটাকেষ্টই পরবর্তীকালে শুরু করেন তাঁর বিখ্যাত কালীপুজো। নরেন সেন স্কোয়ারের কাছে তিনি গড়ে তোলেন নবযুবক সংঘ ক্লাব। সত্তর দশকের গোড়াতেই এই ক্লাবের পক্ষ থেকেই পুজো শুরু হয়। ফাটাকেষ্টর কালীপুজোর সবথেকে বড় আকর্ষণের দিক ছিল বড়ো বড়ো তারকা শিল্পীদের যাতায়াত। উত্তমকুমার, সুচিত্রা সেন, রাজেশ খান্না, লেভ ইয়াসিন, বিনোদ খান্না, জিতেন্দ্র, মালা সিন্হা, আশা ভোঁসলে প্রমুখদের মতো অবিস্মরণীয় সব শিল্পীরা এখানে এসেছেন এবং তাঁদের জন্য জলসাও বসতো কালীপুজোকে কেন্দ্র করে।
১৯৭৪-৭৫ সাল নাগাদ পুজোর শুরুর দিকেই কলেজ স্ট্রিট বাটা থেকে আর্মহার্স্ট স্ট্রিট পর্যন্ত সমগ্র এলাকা আলোয় মুড়ে ফেলা হতো। মাথার উপর বড়ো বড়ো ঝাড়বাতি থাকতো, থাকতো পাখাও। পুজোর ভাসান আর ভাসানের আগে প্রতিমা মণ্ডপে রাখা নিয়ে পার্শ্ববর্তী আরেক রাজনৈতিক নেতা সোমেন মিত্রের পুজোর সঙ্গে প্রচণ্ড প্রতিযোগিতা হতো ফাটাকেষ্টর পুজোর। সর্বনিম্ন পনেরো দিন সে সময় কালীমূর্তিকে মণ্ডপে রাখা হতো ফাটাকেষ্টর পুজোয়। ভাসানের সময় ৬০-৬৫টি গেট তথা তোরণ নিয়ে যাওয়া হতো, সঙ্গে থাকতো তাসা পার্টি, ব্যাণ্ড পার্টি।
এর পাশাপাশি ছিল শোভাযাত্রার বিপুল আড়ম্বর। নিমতলা ঘাটে বিসর্জন হওয়ার আগে সীতারাম ঘোষ স্ট্রিট থেকে ঠাকুর বেরিয়ে সূর্য সেন স্ট্রিট, আর্মহার্স্ট স্ট্রিট হয়ে মানিকতলা বাজার এবং সেখান থেকে বিডন স্ট্রিট হয়ে ঘুরে আসতো বিরাট সেই শোভযাত্রা। সবথেকে বড়ো আকর্ষণ ছিল প্রতি বছর পুজোয় উত্তমকুমারের আগমন। এলাকার মানুষদের কাছে এই পুজোর খ্যাতির এটাও একটা বড়ো কারণ। তবে ব্যক্তিজীবনেও উত্তমকুমারের সঙ্গে ফাটাকেষ্টর বেশ হৃদ্যতা ছিল।
কাশী থেকে সীতারামদাস ওঙ্কারনাথ ঠাকুর আসার সময় তাঁকে একেবারে কাঁধে তুলে নিয়ে মানুষের ভিড়ের মধ্য দিয়ে ঢুকে পড়েছিলেন ফাটাকেষ্ট আর তাই নিয়ে মানুষও উত্তেজনায় ফেটে পড়েছিল। ফাটাকেষ্টর কালীপুজো নিয়ে অনেক জনশ্রুতি রয়েছে। লোকে বলে একবার নাকি পুজোর মণ্ডপে এক মহিলার ভর হয়েছিল এবং সে কালীর ভরে লালপেড়ে শাড়ি পরতে চেয়েছিল। আবার একবার একইভাবে ভর হয়ে এক মহিলার মুখ দিয়ে মা কালী নাকি বলেছিলেন বড়ো গ্লাসে জল নিবেদন করতে।
তবে অনেকে আবার এইসবের মধ্যে ফাটাকেষ্টর পরিকল্পনার কথা বলেন যা পুজোকে বিখ্যাত হতে সাহায্য করেছিল। শোনা যায়, একবার নকশালরা ফাটাকেষ্টর উপর রাগ মেটাতে বি.কে পাল অ্যাভিনিউয়ের কাছে রাস্তা আটকে প্রতিমা যেতে দিচ্ছিল না। ফাটাকেষ্টর বুদ্ধিতে ঠাকুর মণ্ডপে ঠিকই চলে আসে, তবে অসম্পূর্ণ অবস্থায়। মণ্ডপে এসে ঠাকুর গড়ার কাজ সম্পূর্ণ হয়। ভাসানের সময়েও এরকম বিরোধিতা দেখা দিলে সোমেন মিত্রের পুজো বেশ সমস্যার সম্মুখীন হয়।
কিন্তু ফাটাকেষ্টর প্রখর বুদ্ধির জন্য তার পুজোর ভাসান সঠিকভাবেই হয় নিমতলা ঘাটে, তবে কাকভোরে যাতে কেউ জানতেই না পারে। অমিতাভ বচ্চন কালীপূজায় এসে একবার একটা হিরে বসানো সোনার নাকছাবি মা কালীকে উপহার দিয়েছিলেন বলে জানা যায়। এই নাকছাবি পরে চুরি হয়ে যায়। চোর ধরাও পড়ে, কিন্তু ততক্ষণে সোনার দোকানে তা গলানো হয়ে গিয়েছিল বলে বচ্চনের দেওয়া সেই উপহারটি আজ আর রক্ষিত নেই। বারোয়ারি পুজো হলেও শুধুমাত্র ব্যক্তিগত পরিচিতি আর প্রচারের কারণে ধীরে ধীরে নবযুবক সঙ্ঘের কালীপূজা থেকে এই পূজা হয়ে দাঁড়ায় ফাটাকেষ্টর কালীপুজো । ফাটাকেষ্টর কালীপুজোর এই যাত্রাপথটা তাই সত্যই বিস্ময়কর।
আরো পড়ুন জীবনী মন্দির দর্শন ইতিহাস ধর্ম জেলা শহর শেয়ার বাজার কালীপূজা যোগ ব্যায়াম আজকের রাশিফল পুজা পাঠ দুর্গাপুজো ব্রত কথা মিউচুয়াল ফান্ড বিনিয়োগ জ্যোতিষশাস্ত্র টোটকা লক্ষ্মী পূজা ভ্রমণ বার্ষিক রাশিফল মাসিক রাশিফল সাপ্তাহিক রাশিফল আজ বিশেষ রান্নাঘর প্রাপ্তবয়স্ক বাংলা পঞ্জিকা