জেনে নিন ইতু সংক্রান্তি ও নবান্নের তাৎপর্য ! আজ সেই বিশেষ দিন

বাঙালির তেরো পার্বনেরই অন্যতম এই ইতু পুজো। অগ্রহায়ণ মাসের রবিবার অর্থাৎ সূর্যবারে অনেক বাড়িতেই ইতু পুজোর প্রচলন রয়েছে। কাজেই গ্রামবাংলায় তো বটেই, শহরেও অনেকেই পরিচিত এই পুজোর সঙ্গে।
কিন্তু কে এই ইতু? কেনই বা করা হয় ইতুর পুজো? চলুন জেনে নেওয়া যাক ইতুর ইতিকথা।ইতু শব্দটির সঙ্গে মিথু শব্দটির মিল রয়েছে। মিথু-ও প্রাচীন পারস্যের এক দেবতা।
এই মিথু আবার এসেছেন বৈদিক মিত্র শব্দটি থেকে। বৈদিক সাহিত্যে মিত্র মানে মূলত সূর্যদেব। কাজেই মনে করা হয় ইতু পুজো আসলে সূর্য পুজো। প্রাচীনকালে কুমারীরা পতিলাভ এবং সাংসারিক মঙ্গলকামনায় সূর্য পুজো শুরু করেন। আর এরপরেই সূর্য পুজোর প্রচলন ঘটে মহিলামহলে।
তবে রাঢ় বাংলায় ইতুকে শষ্যদেবী লক্ষ্মীরূপেও পুজো করা হয়। কারও মতে আবার ইতু প্রাচীন ইন্দ্রপুজোর দৃষ্টান্ত। বিশেষজ্ঞরা বলেন, ইতুর ব্রতগল্পে ইন্দো-ইউরোপীয় লোকগল্পের ছোঁয়াও রয়েছে।
সবমিলিয়ে নানান মত রয়েছে এই ইতু পুজোকে কেন্দ্র করেই। কার্তিক সংক্রান্তির দিন পাতা হয় ইতুর ঘট। তুলসিতলায় অথবা ঠাকুরের কাছে একটি মাটির সরা বা মালসায় মাটি দিয়ে ছড়ানো হয় পাঁচ কলাই।
অঙ্কুরোদ্গম হয়ে তা থেকে বেরোয় ছোট ছোট গাছ। এরপর প্রতি রবিবার সকালে ইতু গাছে জল দিয়ে ব্রত পালন করেন বাড়ির মহিলারা, পুজো শেষে ব্রত কথা। এরপর অগ্রহায়ণ সংক্রান্তির দিন সমাপ্ত হয় পুজো। গঙ্গায় ইতুর ঘট বিসর্জন করেন মহিলারা।
আজ অগ্রহায়ন মাসের শেষ অর্থাৎ ইতু সংক্রান্তি । এই মাসের প্রথম রবিবার থেকে স্বগৃহে ঘটে গঙ্গা জল স্থাপন করে ও ধান দূর্বা , ছোলা - মটর সহ বিভিন্ন প্রকার পুষ্প দ্বারা সু সজ্জিত করে ইতুপুজার আরাধনা করে থাকেন বাড়ির গৃহিণীরা । আজ তারই সমাপনের দিন ।
অর্থাৎ আজ সংক্রান্তি তিথিতে ওই ঘট পুজো করে গঙ্গায় বা পুকুরে ভাসিয়ে দেবার রীতি রয়েছে অনেকের পরিবারেরই । মূলত এই পূজার মাধ্যমে নারায়ণ ও সূর্য দেবতার আরাধনা করে গৃহস্থের মঙ্গল কামনা করা হয় । অন্যদিকে বাংলার অপর আর এক গুরুত্বপূর্ণ উৎসব " নবান্ন " এই একই দিনে অনুষ্ঠিত হবার রীতি রয়েছে অনেকের পরিবারে ।
অর্থাৎ অগ্রহায়ন মাসে যে নতুন আমন ধান কাটা হয় সেই চালের ভাত রান্না করে পূর্ব পুরুষকে উৎসর্গ করার প্রথা রয়েছে আমাদের সমাজে । এছাড়াও এই অন্ন দেবতা এবং কাকের উদ্দেশ্যেও নিবেদন করার বিশেষ রীতি বিরাজমান । লোক বিশ্বাস অনুযায়ী কাকের মাধ্যমে ওই খাদ্য মৃত আত্মার নিকট প্রেরণ করা হয় ।
কাকের উদ্দেশ্যে উৎসর্গীকৃত এই নৈবেদ্য "কাকবলী " নামেও পরিচিত । শাস্ত্রমতে নবান্ন শ্রাদ্ধ না করে নতুন অন্ন গ্রহণ করলে পাপের ভাগী হতে হয়। আর সেই কারণেই পিতৃ পুরুষের উদ্দেশ্যে এই ভাবে নতুন অন্ন উৎসর্গ প্রদানের রীতি বিরাজমান । প্রাচীন কালে এই নবান্ন উৎসব যথেষ্ট আড়ম্বরের সাথেই পালিত হবার ইতিহাস রয়েছে ।
বিশেষ করে প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চল মুর্শিদাবাদ , বর্ধমান , বাঁকুড়া , মেদিনীপুর এই সমস্ত অঞ্চলে ব্যাপক ভাবে এই উৎসবের রেওয়াজ ছিল । কিন্তু কালের বিবর্তনে এই উৎসব এখন লুপ্ততার পথে । কিন্তু এই রীতি অনুসরণ করে বর্তমানে অনেকেই তাদের গৃহদেবতার উদ্দেশ্যে পরমান্ন নিবেদন করেন ।
প্রতি দিনের পাত্রে ভাত না খেয়ে কলার পাতায় নতুন চালের অন্ন , মটর ডাল ও আলু সিদ্ধ , ঘৃত ও লবণ সহ মধ্যাহ্নের আহার সেরে প্রথমে সূর্য্য দেব ও তারপরেই গৃহ দেবতাকে প্রণাম করার রীতি রয়েছে অনেকের পরিবারে । আবার অনেকে বাড়িতে কলাইয়ের ডাল ও আতপ চালের গুঁড়ো মিশিয়ে বড়ি দিয়ে থাকেন বিশেষ এই দিনে ,
আবার এই একই দিনে অনেকের বাড়িতে মোট নয় রকমের ফল এবং তার সাথে খেজুরের গুড় ও গোদুগ্ধ মিশিয়ে নবান্ন নামক বিশেষ ফলের নৈবেদ্য উৎসর্গ করার প্রথাও রয়েছে । অনেক পরিবারে আবার পৌষ সংক্রান্তির দিনেও পালনের নিয়ম আছে। তবে নতুন আতপ চালদিয়ে নতুন গুড়ের পায়েস আজকের দিনের আর এক বৈশিষ্ট্য।