ফ্রান্সিস বেকন এর জীবনী

ফ্রান্সিস বেকন  এর জীবনী

মধ্যযুগীয় ইউরোপের এক বিখ্যাত দার্শনিক এবং বস্তুবাদী বৈজ্ঞানিক ছিলেন ফ্রান্সিস বেকন (Francis Bacon)। তিনি পরবর্তীকালে অ্যাটর্নি জেনারেল এবং প্রথম জেমসের রাজত্বকালে ইংল্যাণ্ডের লর্ড চ্যান্সেলর হিসেবেও নির্বাচিত হয়েছিলেন। তাঁকে প্রয়োগবাদের জনক বলা হয়। তাঁর মতে কেবলমাত্র যুক্তি আর প্রাকৃতিক নানা ঘটনার পর্যবেক্ষণই বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারের মূলে রয়েছে। বিজ্ঞানকে একটি সংশয়বাদী পদ্ধতি হিসেবে ব্যাখায় করেছিলেন ফ্রান্সিস বেকন আর তাই ক্রমেই তিনি বিতর্কের কেন্দ্রে চলে আসেন। তৎকালীন ইউরোপে গ্রন্থাগারের প্রয়োজনীয়তার কথা বেকনই প্রথম বলেন এবং ইতিহাস, কবিতা ও দর্শন এই তিনটি শ্রেণির বই গ্রন্থাগারে আবশ্যিক রাখার কথা বলেন।

১৫৯৭ সালে ইংল্যাণ্ডের রানি প্রথম এলিজাবেথের আইনি উপদেষ্টার পদে উন্নীত হন বেকন। তাঁর লেখা ‘নোভাম অর্গানাম’ নামক বইতেই তাঁর বৈজ্ঞানিক ও দার্শনিক চিন্তা-ভাবনার সুসংবদ্ধ রূপ লক্ষ্য করা যায়। ১৫৬১ সালে ২২ জানুয়ারি লণ্ডনের স্ট্র্যাণ্ডের কাছে ইয়র্ক হাউসে ফ্রান্সিস বেকনের জন্ম হয়। তাঁর বাবা স্যার নিকোলাস বেকন ‘লর্ড কিপার অফ দ্য গ্রেট সিল’ নামে পরিচিত ছিলেন এবং তাঁর মা অ্যান বেকন ছিলেন মানবতাবাদী নবজাগরণের পথিকৃৎ অ্যান্থনি কুকের কন্যা। নিকোলাসের দ্বিতীয় স্ত্রী ছিলেন অ্যান।

দুর্বল স্বাস্থ্যের কারণে শৈশবে বাড়িতেই প্রাথমিক পাঠ গ্রহণ করেন বেকন। অক্সফোর্ডের একজন স্নাতক জন ওয়ালসেল তাঁকে পড়াতে আসতেন এবং তাঁর শিক্ষকতার সূত্রেই পিউরিটান মতবাদের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পড়েন বেকন। বারো বছর বয়সে ১৫৭৩ সালে কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে ট্রিনিটি কলেজে ভর্তি হন ফ্রান্সিস বেকন। সেখানে ড. জন হুইটগিফটের ব্যক্তিগত তত্ত্বাবধানে বেকন এবং তাঁর দাদা অ্যান্থনি বেকন তিন বছর পড়াশোনা করেন। মধ্যযুগীয় পন্থা অনুসরণ করে লাতিন ভাষাতেই শিক্ষাগ্রহণ করেছিলেন তিনি।

কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময়েই প্রথমবার রানি এলিজাবেথের সঙ্গে তাঁর দেখা হয় এবং রানি তাঁর বুদ্ধির প্রাখর্যে অত্যন্ত প্রীত হয়ে তাঁকে ‘তরুণ লর্ড কিপার’ অভিধায় ভূষিত করেন। দীর্ঘ পড়াশোনার পর তিনি বুঝতে পারছিলেন যে সেকালের বৈজ্ঞানিক গবেষণা পদ্ধতিতে ভ্রান্তি ছিল। অ্যারিস্টটলের দর্শনকে সম্পূর্ণ প্রত্যাখ্যান করেছিলেন বেকন। ১৫৭৬ সালের ২৭ জুন তিনি এবং অ্যান্থনি গ্রে’ ইন অঞ্চলে ‘ডি সোসাইট্রেট ম্যাজিস্ট্রোরাম’ নামে একটি প্রতিষ্ঠানে ভর্তি হন। এর কয়েক মাস পরেই স্যার অ্যামিয়াস পলেটের সঙ্গে বেকন বিদেশে পাড়ি দেন।

ফ্রান্সে তৃতীয় হেনরির শাসনকালে বেকন যথেষ্ট রাজনৈতিক ধারণা অর্জন করেন। এর পরবর্তী তিন বছর ব্লইস, পইটারস, ইতালি এবং স্পেনে ভ্রমণ করেন তিনি। এই সময়পর্বে তিনি ভাষা, রাষ্ট্র পরিচালনা এবং আইনবিধি সম্পর্কে প্রভূত জ্ঞান অর্জন করেন। ১৫৭৯ সালে বাবার মৃত্যুর পরে বেকন দ্রুত ইংল্যাণ্ডে ফিরে আসেন। স্যার নিকোলাস তাঁর পুত্র বেকনের জন্য ধীরে ধীরে পয়সা জমিয়ে একটি এস্টেট কেনার পরিকল্পনা করেছিলেন, কিন্তু তা সম্পূর্ণ হল না। ফলে অল্প সময়ের মধ্যেই ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়েন বেকন।

তখন তাঁর মায়ের কাছ থেকে মাসিক ৪৬ পাউণ্ড করে অর্থ সাহায্য পেতেন ফ্রান্সিস বেকন। বেকন চাইতেন সত্যকে অনুসন্ধান করতে, তাঁর দেশের সেবা করতে এবং গির্জার দায়িত্ব পালন করতে। ১৫৮০ সালে তাঁর কাকা বার্গলের সহায়তায় আদালতে একটি সম্মানীয় পদের জন্য আবেদন করেন তিনি। কিন্তু তাঁর আবেদন খারিজ হয়ে যায়। গ্রে’স ইনে টানা দুই বছর কাজ করেন ফ্রান্সিস বেকন। ১৫৮২ সালে একজন আউটার ব্যারিস্টারের পদে উন্নীত হন তিনি। এর আগে যদিও ১৫৮১ সালে কর্নওয়েলের বসনিতে একটি উপনির্বাচনে সংসদের সদস্য নির্বাচিত হন বেকন।

১৫৮৪ সালে ডরসেটের ম্যালকম্ব এবং ১৫৮৬ সালে টন্টনেও নির্বাচনে জিতে সংসদের সদস্য নির্বাচিত হন ফ্রান্সিস বেকন। এই সময়ে গির্জার বিভিন্ন দলগুলির সঙ্গে ইংল্যাণ্ডের ট্র্যাক্ট টেম্পরিস স্পার্টাস ম্যাক্সিমাসের দার্শনিক সংস্কারের বিষয়ে লেখাপত্র লিখতে শুরু করেন তিনি। বেকন প্রায়ই পিউরিটান চ্যাপলিনের ধর্মোপদেশ শুনতে উপস্থিত থাকতেন এবং ওয়াল্টার ট্র্যাভার্সের কথা শুনতে তাঁর মায়ের সঙ্গে টেম্পল গির্জায় যেতেন। ১৫৮৬ সালে সংসদে প্রকাশ্যে স্কটল্যাণ্ডের রানি মেরির মৃত্যুদণ্ডের দাবি জানান ফ্রান্সিস বেকন।

ঐ বছরই তিনি আদালতের একজন বেঞ্চারে পরিণত হন এবং পরের বছর ১৫৮৭ সালে রিডারের পদে উন্নীত হন তিনি। ১৫৮৯ সালে স্টার চেম্বারে কেরানির পদে চাকরি পান, কিন্তু ১৬০৮ সাল থেকেই বার্ষিক ১৬০০ পাউণ্ডের বিনিময়ে অফিসে কাজ করতে শুরু করেন বেকন। ১৫৮৮ সালে লিভারপুল এবং ১৫৯৩ সালে মিডলসেক্সের সংসদীয় সদস্য নির্বাচিত হন তিনি। ক্রমেই তিনি একজন উদারপন্থী সংস্কারক হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন। রাজতন্ত্রের অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ হওয়া সত্ত্বেও সামন্ততান্ত্রিক ব্যবস্থা ও স্বৈরাচারী ক্ষমতার বিরোধিতা করেছিলেন বেকন।

ধর্মীয় নিপীড়নের বিরুদ্ধেও সোচ্চার হয়েছিলেন তিনি। ইংল্যাণ্ড ও স্কটল্যাণ্ডের একত্রীকরণের সপক্ষে আদালতে কথা বলেন তিনি, পরে আয়ারল্যাণ্ডকেও এই সমাবেশে যুক্ত করার কথা বলেন বেকন। রানি এলিজাবেথের প্রিয় এসেক্সের দ্বিতীয় আর্লের সঙ্গে কাজ করতে শুরু করেন ফ্রান্সিস বেকন, ১৫৯১ সালে তিনি আর্লের গোপনীয় পরামর্শদাতার পদে কাজ পান। ১৫৯২ সালে জেসুইট রবার্ট পার্সনের সরকার-বিরোধী প্রতিক্রিয়ায় একটি প্রতিবেদন লেখেন বেকন ‘অবজারভেশনস মেড আপন এ লিবেল’ নামে যা এথেন্সের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার সপক্ষে মত প্রকাশ করে।

১৫৯৩ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে মিডলসেক্সের সংসদীয় সদস্য হিসেবে পুনর্নির্বাচিত হন ১৫৯৭ সালে বেকন প্রথমবারের জন্য রানির কাউন্সেলে মনোনীত হন এবং রানি এলিজাবেথের আইনি উপদেষ্টা হিসেবে কাজ করতে শুরু করেন। ক্রমে তিনি একজন প্রশিক্ষিত কাউন্সেলের পদে উন্নীত হন। রানির বিরুদ্ধে এসেক্সের এক বিদ্রোহমূলক পরিকল্পনার কথা সামনে আসায় সেই ব্যাপারে তদন্তে নিযুক্ত হন বেকন। পদাধিকার থাকা সত্ত্বেও সামাজিক অবস্থা পাল্টায়নি তাঁর। এই সময় প্রভাবশালী ধনী ঘরের বিধবা তরুণী কন্যা এলিজাবেথ হ্যাটনকে বিয়ে করেন ফ্রান্সিস বেকন।

কিন্তু স্যার এডওয়ার্ড কোকের সঙ্গে সম্পর্ক হওয়ার পরে বেকনকে ত্যাগ করে এলিজাবেথ তাঁকেই বিবাহ করেন, বেকনের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করেন। ১৫৯৮ সালে ঋণ না মেটানোর জন্য পুলিশ বেকনকে গ্রেপ্তার করে। এর আগে যদিও তিনি অ্যালিস বার্নহামকে বিবাহ করেছিলেন। অবশেষে ১৬১৩ সালে ফ্রান্সিস বেকন অ্যাটর্নি জেনারেলের পদে উন্নীত হন। ১৬১৮ সালে রাজা তাঁকে ‘ব্যারন ভেরুলাম’ হিসেবে নির্বাচিত করেন। ‘নোভাম অর্গানাম’ নামক বইতেই ফ্রান্সিস বেকনের দার্শনিক ও বৈজ্ঞানিক প্রতিভার পরিচয় পাওয়া যায়।

বস্তুবাদী বিজ্ঞানচর্চার উদ্গাতা ছিলেন তিনি। পর্যবেক্ষণ আর পরীক্ষা দ্বারা নিরন্তর এই বিশ্বপ্রকৃতির নানা ঘটনার কারণ অনুসন্ধান করাই বিজ্ঞানের মূল কাজ বলে মনে করতেন তিনি। ধর্ম কথিত বর্ণনাকে তিনি কখনোই সত্যকার জ্ঞানের পথ বলে মনে করতেন না। কুসংস্কারাচ্ছন্ন সমাজকে পাল্টাতে বেকন সমাজ থেকে কিছু অপদেবতাকে বিলুপ্ত করার কথা বলেন। জাতিগত অপদেবতা, অন্ধকারের অপদেবতা, বাজারের অপদেবতা এবং মঞ্চের অপদেবতা এই চার প্রকার অপদেবতার উল্লেখ করেছেন বেকন।

এছাড়াও বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধানের তিনটি সূত্র তথা পথের কথা উল্লেখ করেছেন বেকন তাঁর বইতে। প্রথমত, যে কোনো বৈজ্ঞানিক ঘটনার কারণ সম্বলিত ঘটনার উপস্থিতি এবং তার পর্যবেক্ষণ, দ্বিতীয়ত কারণগুলি না থাকার যাথার্থ্য বিচার ও বিশ্লেষণ এবং তৃতীয়ত উভয় পক্ষের আলোচনা করে তার পারস্পরিক সম্পর্ক নিরূপণ করার মধ্য দিয়েই বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধান সফল হতে পারে বলে মনে করতেন বেকন। বস্তুর প্রধান লক্ষণ যে তাঁর গতি সেকথা প্রথম স্বীকার করেন ফ্রান্সিস বেকন।

এই গতির ক্ষেত্রে শুধুমাত্র যান্ত্রিক গতিকে স্বীকার করতেন না তিনি, তার বদলে বস্তুর মধ্যেই নিহিত গতিকে প্রাধান্য দিয়েছেন বেকন। নোভাম অর্গানাম ছাড়াও তাঁর অন্যান্য বইগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল ‘নিউ আটলান্টিস’, ‘অ্যাডভান্সমেন্ট অফ লার্নিং’, ‘সায়েন্টিয়ারাম’ ইত্যাদি। ১৬০৩ সালে নাইটহুড উপাধি লাভ করেন ফ্রান্সিস বেকন। ১৬০৭ সালে সলিসিটর জেনারেলের অফিসে পুরস্কৃতও হন তিনি। ১৬২৬ সালের ৯ এপ্রিল লণ্ডনের বাইরে হাইগেটে থাকাকালীন নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হয়ে ফ্রান্সিস বেকনের মৃত্যু হয়।     

আরো পড়ুন      জীবনী  মন্দির দর্শন  ইতিহাস  ধর্ম  জেলা শহর   শেয়ার বাজার  কালীপূজা  যোগ ব্যায়াম  আজকের রাশিফল  পুজা পাঠ  দুর্গাপুজো ব্রত কথা   মিউচুয়াল ফান্ড  বিনিয়োগ  জ্যোতিষশাস্ত্র  টোটকা  লক্ষ্মী পূজা  ভ্রমণ  বার্ষিক রাশিফল  মাসিক রাশিফল  সাপ্তাহিক রাশিফল  আজ বিশেষ  রান্নাঘর  প্রাপ্তবয়স্ক  বাংলা পঞ্জিকা