গৌরীপ্রসন্ন মজুমদার| বাংলা গানের সুরের জাদু কর Gauri Prasanna Mazumder

গৌরীপ্রসন্ন মজুমদার| বাংলা গানের সুরের জাদু কর  Gauri Prasanna Mazumder

বাংলা গানের সুরের ভুবনে কথার জাদুতে একসময় আপামর বাঙালিকে মোহিত করে রেখেছিলেন যে মানুষটি, তিনি গৌরীপ্রসন্ন মজুমদার (Gauri Prasanna Mazumder)। আধুনিক বাংলা গানের এক উজ্জ্বলতম জ্যোতিষ্ক তিনি।মান্না দে, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের মতো শিল্পীর গলায় যাঁর লেখা গান জনপ্রিয়তার সমস্ত সীমা অতিক্রম করেছে, সেই গীতিকার বাংলা গানের স্বর্ণযুগের অদ্বিতীয় গৌরীপ্রসন্ন মজুমদার। বাংলা চলচ্চিত্রের জন্য তাঁর কলম থেকেই বেরিয়েছে ‘আমার গানের স্বরলিপি লেখা রবে’, ‘যদি কাগজে লেখো নাম’, ‘জীবন খাতার প্রতি পাতায়’ ইত্যাদি আরো বহু কালজয়ী গান।

১৯২৪ সালের ৫ ডিসেম্বর পাবনার গোপালনগর গ্রামে এক উচ্চশিক্ষিত পরিবারে গৌরীপ্রসন্ন মজুমদারের জন্ম হয়। তাঁর বাবার নাম গিরিজাপ্রসন্ন মজুমদার এবং মায়ের নাম সুধা মজুমদার। গৌরীপ্রসন্ন’র বাবা ছিলেন একজন ভারতবিখ্যাত উদ্ভিদবিজ্ঞানী এবং একাধারে প্রেসিডেন্সি কলেজের খ্যাতনামা অধ্যাপক।তাঁর মা কবিতা আর প্রবন্ধ লিখতে ভালোবাসতেন, সেকালে মেয়ে হয়েও স্নাতক উত্তীর্ণ হয়েছিলেন তিনি। তাঁর বাবার সঙ্গে প্রেসিডেন্সি কলেজে অধ্যাপনা করতেন পদার্থবিজ্ঞানী সি.ভি রমন, শিক্ষাবিদ সর্বপল্লী ড. রাধাকৃষ্ণান প্রমুখ। ছোটোবেলা থেকেই বাংলা, ইংরেজি ও সংস্কৃত ভাষা-সাহিত্যের চর্চা ছিল গৌরীপ্রসন্ন’র বাড়িতে।

শোনা যায় ছাত্রজীবনেই তিনি কালিদাসের ‘মেঘদূতম্’ কাব্যের অনুবাদ করেছিলেন। তাঁর চার-পাঁচ বছর বয়সে তাঁর কাকা তাঁর মাকে একটি গ্রামোফোন উপহার দিয়েছিলেন আর সেই গ্রামাফোন রেকর্ডের গান শুনে শুনেই বালক গৌরীপ্রসন্ন’র মনে সঙ্গীতের প্রতি এক গভীর অনুরাগ জন্মেছিল।গৌরীপ্রসন্ন মজুমদারের প্রাথমিক পড়াশোনা সম্পন্ন হয় জগবন্ধু ইনস্টিটিউশনে। স্কুলে পড়াকালীনই এগারো-বারো বছর বয়সে তিনি বাংলা কবিতা লিখতে শুরু করেন, এমনকি একটি মাসিক পত্রিকায় কবিতা ছাপা না হওয়ায় অভিমানে বাংলার বদলে ইংরেজিতে কবিতা লিখতে থাকেন তিনি।

যদিও এর পিছনে তাঁর ছোটো মেসোমশাই তারাদাস বাগচীর প্রভাব ছিল। ১৫ বছর বয়সে এই স্কুল থেকেই ম্যাট্রিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন তিনি। তারপর উচ্চশিক্ষার জন্য প্রেসিডেন্সি কলেজে ভর্তি হন ১৯৪০ সালে। ইংরেজি এবং বাংলা উভয় বিষয়েই স্নাতকোত্তর উত্তীর্ণ হয়েও বাবার ইচ্ছে সত্ত্বেও সিভিল সার্ভিস পড়তে ইংল্যান্ড যাননি। বাংলা গানের প্রতি অগাধ ভালোবাসায় বিপুল সৃষ্টিসম্ভারে সমৃদ্ধ করে গেছেন বাংলা গানের ভুবন।কলেজে পড়াকালীন পার্ক স্ট্রিটের সঙ্গীত সম্মিলনীতে গৌরীপ্রসন্ন গিরিজাশংকর চক্রবর্তীর কাছে গান এবং মিহিরকিরণ ভট্টাচার্যের কাছে বেহালা শেখেন। প্রেসিডেন্সি কলেজে পড়ার সময়েই তাঁর পরিচয় হয় সঙ্গীতশিল্পী বিমলভূষণের সঙ্গে।

গৌরীপ্রসন্নর দুটি গান ‘আমি বুঝতে পারি না কি আছে তোমার মনে’ আর ‘শুধু পত্র ঝরায় অলস চৈত্রবেলা’ বিমলভূষণ নিজের কণ্ঠে গেয়ে রেকর্ড করেছিলেন ১৯৪৬ সালে। আবার এই কলেজে পড়াকালীনই একটি গান লিখে নির্দ্বিধায় চলে গিয়েছিলেন শচীন দেববর্মণের বাড়িতে।ইংরেজির ছাত্র গৌরীপ্রসন্নকে একটি ইংরেজি কবিতার বই বের করে দুটি লাইন দেখিয়ে তা থেকে বাংলায় গান লিখতে বলেন শচীন দেববর্মণ এবং অভাবিতভাবে সেই গান আকাশবাণীতে তিনি নিজেই গেয়েছিলেন। সেই থেকেই শচীন দেববর্মণের সঙ্গে সখ্যতা তৈরি হয়ে যায় গৌরীপ্রসন্নের এবং বাংলা গানের গীতিকার হিসেবে তাঁর একটি স্থায়ী আসন গড়ে ওঠে।

বাংলা গানের জগতে কিংবদন্তী সঙ্গীতশিল্পী, সুরকার মান্না দে, নচিকেতা ঘোষ, হেমন্ত মুখোপাধ্যায় প্রমুখদের সঙ্গে তাঁর গভীর সম্পর্ক তৈরি হয়। স্বর্ণযুগে গৌরীপ্রসন্নর লেখা গান তখন বিখ্যাত মানুষদের কণ্ঠের মায়াজালে বাঙালিকে মোহিত করছে। এভাবেই কর্মজীবন শুরু হয় তাঁর। শচীন দেববর্মণের সুরে আর গৌরীপ্রসন্নর কথায় ‘মেঘ কালো আঁধার কালো’, ‘প্রেম একবারই এসেছিল নীরবে’, ‘বাঁশি শুনে আর কাজ নাই’ ইত্যাদি সব জনপ্রিয় গান সৃষ্টি হয়েছে।

শচীন দেববর্মণ তাঁকে কলকাতার ‘মজরুহ্‌ সুলতানপুরী’ বলে পরিচয় দিতেন। । এরপরে নচিকেতা ঘোষের সঙ্গে কিংবদন্তী জুটি গড়ে ওঠে তাঁর। ‘আমার গানের স্বরলিপি লেখা রবে’ কিংবা ‘নিশিপদ্ম’ ছবির জন্য ‘হাজার টাকার ঝাড়বাতিটা’ ইত্যাদি সব কালজয়ী গান নচিকেতা-গৌরীপ্রসন্নর কৃতিত্বে তৈরি হয়েছে আর সমৃদ্ধ হয়েছে বাংলা চলচ্চিত্রের গানের ডালি। 

নচিকেতা ঘোষের পুত্র সুপর্ণকান্তি ঘোষের সঙ্গে কথোপকথনের মাঝেই হাওড়া স্টেশনে সিগারেটের প্যাকেটের রাংতায় লেখেন কালজয়ী গান ‘কফি হাউসের সেই আড্ডাটা আজ আর নেই’। মান্না দে’র কণ্ঠে সেই গান চিরস্থায়িত্ব পেল। হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের গাওয়া বহু গানের কথাও গৌরীপ্রসন্ন লেখেন। সেগুলির মধ্যে ‘ও নদীরে একটি কথা শুধাই শুধু তোমারে’, ‘নীল আকাশের নীচে এই পৃথিবী’, ‘আজ দু’জনার দু’টি পথ’, ‘ওগো তুমি যে আমার’, ‘মুছে যাওয়া দিনগুলি’, ‘এই পথ যদি না শেষ হয়’-এর মতো অসংখ্য জনপ্রিয় গান।

বাংলা চলচ্চিত্রে সুচিত্রা সেনের মুখে সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের গাওয়া গান আজও  মানুষের মনে ‘এভারগ্রিন মেলোডি’ (Evergreen Melody)। ‘গানে মোর ইন্দ্রধনু’, ‘ঘুম ঘুম চাঁদ’, ‘আকাশের অস্তরাগে’ ইত্যাদি গানগুলি তাঁরই কলমে রচিত। শুধু যে তাঁর লেখা কথায় সুর বসিয়ে গান তৈরি হয়েছে, তা নয়। কিছু গানের সুরেও কথা বসিয়েছেন গৌরীপ্রসন্ন। শক্তি সামন্তের ছবি ‘আরাধনা-র সেই বিখ্যাত ‘মেরে সপনো কি রানি’ কিংবা ‘গুনগুনা রহা হ্যায় ভবরেঁ’ গানদুটির বাংলা করেছেন ‘মোর স্বপ্নের সাথী তুমি’ আর ‘গুঞ্জনে দোলে যে ভ্রমর’।

চলচ্চিত্রে রাজেশ খান্না, শর্মিলা ঠাকুরের মুখে আর হিন্দি কথার সাথে সামঞ্জস্য রেখে তৈরি করেন এই গানদুটি। সেকালে হিন্দি চলচ্চিত্রে প্লে-ব্যাক গায়ক ছিলেন মান্না দে। তাঁর প্রথম গাওয়া বাংলা গানটিই গৌরীপ্রসন্নর লেখা। বাংলা চলচ্চিত্রে তাঁর গান লেখার সুযোগ প্রথম এসেছিল পশুপতি চট্টোপাধ্যায়ের ‘অরক্ষণীয়া’ এবং ‘প্রিয়তমা’ ছবিতে। তারপর সারাজীবন ধরে অসংখ্য চলচ্চিত্রে গীতিকারের ভূমিকায় সুনাম-খ্যাতি অর্জন করেছেন তিনি।‘জিঘাংসা’, ‘শুভদা’, ‘মায়াকানন’, ‘বিভাস’, ‘নতুন তীর্থ’, ‘তৃষ্ণা’, ‘আলোর পিপাসা’, ‘সূর্যতপা’, ‘রাজকন্যা’, ‘বালিকা বধূ’, ‘খেয়া’ ইত্যাদি কত না বিখ্যাত ছবির গীতিকার গৌরীপ্রসন্ন। বাংলা চলচ্চিত্রে কিংবদন্তী ছবি ‘অ্যান্টনি ফিরিঙ্গি’-র ‘আমি যামিনী তুমি শশী হে’ তাঁরই লেখা।   বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানকে নিয়ে একটি গান লিখে ফেলেন গৌরীপ্রসন্ন।

রামগড়ের কাছে পদ্মশ্রী সিনেমা হলের সামনে চা-দোকানে নিয়মিত আড্ডা বসতো অংশুমান রায়, শিবদাস বন্দ্যোপাধ্যায়, গৌরীপ্রসন্ন, দীনেন্দ্র চৌধুরী প্রমুখদের। এঁদের প্রত্যেকেই নামী সুরকার, গীতিকার। ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ ঐ আড্ডায় রেডিওতে মুক্তিযুদ্ধে জয়লাভের পরে বঙ্গবন্ধুর বিখ্যাত ভাষণ শুনেই সিগারেটের প্যাকেটের কাগজে লিখে ফেলেন ‘শোনো একটি মুজিবরের থেকে’ গানটি।আকাশবাণীতে ১৩ তারিখ ‘সংবাদ পরিক্রমা’ অনুষ্ঠানে বঙ্গবন্ধুর ভাষণের মাঝে মাঝে বাজানো হয়েছিল এই গানটি। গানটি সুর করেছেন এবং গেয়েছেন অংশুমান রায়। পরে হিন্দুস্তান রেকর্ড থেকে গানের রেকর্ড মুক্তি পায় ইংরেজি অনুবাদ ‘A million Mujibars singing’ সহ। সেই সময় একাত্তরের অগ্নিবর্ষী দিনগুলিতে এই গান লক্ষ প্রাণে শিহরণ জাগাতো।

বাংলাদেশ স্বাধীন হলে বঙ্গবন্ধুর আমন্ত্রণে রাষ্ট্রীয় অতিথি হিসেবে ১৯৭২ সালের ডিসেম্বর মাসে গৌরীপ্রসন্ন বাংলাদেশে যান। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার ২০১২ সালে তাঁকে মরণোত্তর ‘মুক্তিযুদ্ধ মৈত্রী সম্মাননা’ জ্ঞাপন করে। এছাড়াও গীতিকার হিসেবে আজীবন বহু পুরস্কারে সম্মানিত হয়েছেন তিনি। সাহিত্যের ছাত্র হিসেবে গীতিকবিতার গুরুত্ব বুঝতেন গৌরীপ্রসন্ন আর তাই কাব্যসাহিত্যে গীতিকবিতার অবহেলা নিয়ে তাঁর আক্ষেপ ছিল বিস্তর।কবি সম্মেলনে কোন গীতিকবিকে ডাকা হয় না বলে অনুযোগ করেছিলেন ১৯৮৫ সালে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে। তিনি বিশ্বাস করতেন যে কবিতায় সুর দিলেই গান হয় না, গানের ভাষা সম্পূর্ণ আলাদা। অজান্তেই ক্যানসারে আক্রান্ত হয়ে পড়েন গৌরীপ্রসন্ন। চিকিৎসার জন্য ১৯৮৬ সালের ২৫ জুন তাঁকে বম্বেতে হাসপাতালে ভর্তি করতে নিয়ে যাওয়ার আগে এই মহান গীতিকার লেখেন ‘যেতে দাও আমায় ডেকো না’।

পরে গানটি আশা ভোঁসলের কণ্ঠে রেকর্ড করা হয়। ১৯৮৬ সালের ২০ আগস্ট মাত্র ৬২ বছর বয়সে দুরারোগ্য ক্যানসারে আক্রান্ত হয়ে বাংলা গানের স্বর্ণযুগের গীতিকার গৌরীপ্রসন্ন মজুমদারের মৃত্যু হয়। তাঁর মৃত্যু সম্পর্কে সন্ধ্যা মুখােপাধ্যায় বলেছিলেন- “গৌরীদা ক্যানসারে মারা যান।তাঁর মতাে এত বড়াে একজন গীতিকার বম্বের অতিসাধারণ এক হাসপাতালে প্রায় মাটিতে শুয়েই শেষের দিনগুলাে এক দুঃসহ যন্ত্রণার মধ্যে দিয়ে কাটান। এ কথা ভাবতে পারা যায়?