ইতালির নতুন প্রধানমন্ত্রী জর্জিয়া মেলোনি

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ইতালির সবচেয়ে কট্টর ডানপন্থী সরকারের নেতৃত্ব জর্জিয়া মেলোনি। জর্জিয়া মেলোনির জন্ম ১৯৭৭ সালে। রোমে জন্মগ্রহণ করা জর্জিয়ার বয়স যখন মাত্র এক বছর তখন তার বাবা ফ্রান্সেসকো পরিবার ছেড়ে ক্যানারি দ্বীপপুঞ্জে চলে যান। ফ্রান্সেসকো ছিলেন বামপন্থী আর জর্জিয়ার মা আনা ডানপন্থী ছিলেন। অনেকে মনে করেন, বাবার অনুপস্থিতিতে প্রতিশোধ পরায়ণ হয়ে তিনি তার রাজনীতির পথ বেছে নিয়েছেন।
তার পরিবার গারবাতেল্লায় চলে যায়। সেখানেই ১৫ বছর বয়সে ইতালিয়ান সোস্যাল মুভমেন্টের যুব ফ্রন্টে যোগ দেন তিনি। পরে দলটির উত্তরসূরি ন্যাশনাল অ্যালায়েন্সের ছাত্র শাখার সভাপতি হন জর্জিয়া। মার্কো মার্সিলিও গারবাতেল্লার এমএসআই অফিসে একটি সভা করছিলেন। ঠিক তখন ১৯৯২ সালে জর্জিয়া তার দরজায় কড়া নেড়েছিলেন। বয়সে ১০ বছরের বড় মার্সিলিও তার একজন ঘনিষ্ঠ বন্ধু এবং রাজনৈতিক মিত্র হয়ে ওঠেন।
মার্সিলিও আজ আবরুজো অঞ্চলের প্রেসিডেন্ট। জর্জিয়া সম্পর্কে তিনি বলেন, হালকা পাতলা একটা মেয়ে ছিল সে। কিন্তু সবসময় খুব গুরুগম্ভীর এবং দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ছিল। ছাত্র সভাগুলোতে সে নজর কাড়তো। তার হাত থেকে মাইক্রোফোন নিয়ে নিতে চাইলে যে কাউকে সে থামিয়ে দিত। ২০০৮ সালে জর্জিয়া মেলোনি ইতালির সর্বকনিষ্ঠ মন্ত্রী হন। তিনি সিলভিও বারলুসকোনির যুব ও ক্রীড়ামন্ত্রী নিযুক্ত হন। ২০১২ সালে নিজের দল গঠন করার পর ২০১৮ সালের নির্বাচনে তিনি মাত্র চার শতাংশ ভোট পেয়েছিলেন।
জর্জিয়া মেলোনি যদিও ইতালির পশ্চিমা মিত্রদের আশ্বস্ত করার চেষ্টা করছেন। যেমন দ্রাঘি সরকারের ইউক্রেনপন্থাকে জোরালোভাবে সমর্থন করেছেন, কিন্তু তার কঠোর রক্ষণশীল সামাজিক নীতিগুলো অনেককে উদ্বিগ্ন করছে। স্পেনের অতি ডানপন্থী ভক্স পার্টির সাম্প্রতিক সমাবেশে তিনি জোরালো কণ্ঠে বলেছিলেন, প্রাকৃতিক নিয়মের পরিবারের প্রতি হ্যাঁ আর এলজিবিটি লবিদের জন্য না।
লিবিয়া থেকে আসা অভিবাসীদের নৌকা বন্ধ করতে তিনি নৌ অবরোধের আহ্বান জানিয়েছেন। অনেক বিশেষজ্ঞ বলছেন, মেলোনি গণতন্ত্রের জন্য একটা বিপদ নয়, কিন্তু ইউরোপীয় ইউনিয়নের জন্য বিপদ। জর্জিয়া মেলোনিকে হাঙ্গেরি এবং ফ্রান্সের জাতীয়তাবাদী নেতাদের কাতারে ফেলা হয়েছে। তিনি মেরিন ল্য পেন বা ভিক্টর অরবানের মতো একই দিকে আছেন এবং তিনি ‘এক জাতির ইউরোপ চান’।
ইতালি পুতিনের ট্রোজান হর্স হয়ে উঠতে পারে। সে ইউরোপকে দুর্বল করতে কাজ করে যাবে। রোমের সাপিয়েঞ্জা ইউনিভার্সিটির রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক জিয়ানলুকা প্যাসারেলি বলেন, ইতালির প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী হওয়ার জন্য জর্জিয়া মেলোনি তার নারী পরিচয় ব্যবহার করেছেন। কিন্তু তিনি তা করেছেন পুরুষালি রাজনৈতিক ধাঁচে। প্যাসারেলি বলেন, ইতালীয় পরিবারের আধিপত্য থাকে মায়েদের হাতে।
যা একটি পুরুষালি ব্যক্তিত্ব। যিনি রান্নাঘর নিয়ন্ত্রণ করেন। জর্জিয়া চমৎকারভাবে এই ইমেজটি ব্যবহার করেছেন। যা সরাসরি আমাদের জীবনের কেন্দ্রে রয়েছে। ইতালির দীর্ঘ অর্থনৈতিক স্থবিরতা এবং প্রবীণদের রাজনীতির সমাজের পরিপ্রেক্ষিতে তিনি তার মিত্রদের জন্য আমূল রাজনৈতিক পরিবর্তনের প্রতিনিধিত্ব করবেন। ১৯৬৮ সালে পরিস্থিতিবাদী দার্শনিক গাই ডেবোর্ড লিখেছিলেন, ‘ইতালি হচ্ছে গোটা বিশ্বের সামাজিক বৈপরীত্যগুলোর সারসংক্ষেপ।’
এ কারণে ইতালিকে একসময়, ‘আন্তর্জাতিক প্রতিবিপ্লবের পরীক্ষাগার বলা হতো’। বিশ্বজুড়ে রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা এখন ইতালির নতুন প্রধানমন্ত্রী জর্জিয়া মেলোনির বক্তব্য-বিবৃতি পুঙ্খানুপুঙ্খ বিশ্লেষণ করে দেখছেন, তিনি কি একজন ফ্যাসিস্ট নাকি নব্য ফ্যাসিস্ট। তাঁদের প্রশ্ন হলো, কেন ইতালির জনগণ এখন স্বেচ্ছায় তাদের অন্ধকারতম ইতিহাসে প্রত্যাবর্তন করল? এখন প্রশ্ন হলো, ইতালির মানুষেরা সত্যিই কি তাদের ফ্যাসিস্ট অতীতের পুনর্জীবন ঘটাল? আরও গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হলো, ইতালি কি সত্যিই এমন একটা গবেষণাগার যেখানকার অভিজ্ঞতা বাকি বিশ্ব অনুসরণ করবে? প্রথম প্রশ্নের উত্তর না, দ্বিতীয় প্রশ্নের উত্তর হ্যাঁ।
মেলোনির এই আকাঙ্ক্ষা তাঁর নির্বাচনী প্রচারণাকালে স্পষ্ট হয়ে গেছে। যুক্তরাষ্ট্র প্রশাসনের সমর্থন নিশ্চিতের জন্য যা যা করণীয়, তার সবটাই তিনি করেছেন। ন্যাটোর প্রতি পূর্ণ সমর্থন ব্যক্ত করার পাশাপাশি রাশিয়াবিরোধী ও চীনবিরোধী অবস্থান জানিয়ে দিয়েছেন তিনি। একইভাবে বাজার অর্থনীতি ও ইউরোপীয় ইউনিয়নকে আশ্বস্ত করেছে যে তার সরকার সরকারি ঋণ নিয়ন্ত্রণে আনবে। মেলোনির এ দুটি পদক্ষেপই তার জোটসঙ্গী বেরলুসকোনি ও সালভানিকে হতাশ করেছে। তাঁরা দুজনেই রাশিয়ার প্রতি সহানুভূতিশীল। পররাষ্ট্র ও অর্থনৈতিক নীতির ক্ষেত্রে ওয়াশিংটন ও ব্রাসেলসকে আশ্বস্ত করেছেন মেলোনি। এই নীতি পুরোপুরি সঠিক। কেননা, এর মধ্য দিয়ে তুলনামূলক শান্তিতে তিনি তার ক্ষমতাকে সংহত করতে পারবেন এবং নিজের অ্যাজেন্ডা বাস্তবায়ন করতে পারবেন। নিরাপত্তা, জ্বালানি ও জনজীবনের সংকটের এ সময়ে ইতালির সরকারকে নাজুক অবস্থায় ফেলার ঝুঁকি এড়ালেন তিনি।
মেলোনির এই অবস্থান ইউরোপে অতিডানপন্থীদের জন্য নতুন ধরনের একটি সরকার গঠনের সুযোগ এনে দিয়েছে। আগ্রাসী পররাষ্ট্রনীতি, অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে রক্ষণশীলতা, অতীত-স্মৃতিকাতরতা, জাতীয়তাবাদ, নাগরিক স্বাধীনতার প্রতি বৈরিতা—এসব কারণে ডানপন্থী রাজনীতি সংকীর্ণ হৃদয়ের। কিন্তু প্রাতিষ্ঠানিকতার প্রতি যদি ডানপন্থীদের শ্রদ্ধা থাকে, আইনের শাসনকে যদি তারা অবজ্ঞা না করে, তাহলে ভিন্ন কিছু ঘটতে পারে।
এটা ঠিক যে মেলোনি ফ্যাসিস্ট ঐতিহ্য থেকে আসেননি এবং তার কর্মকাণ্ড সারা বিশ্বে না হলেও ইউরোপের জন্য একটা রূপরেখা হাজির করছে। অতিডানপন্থী জনতুষ্টিবাদী কিংবা উগ্রপন্থীরা নির্বাচনে জিততে পারবে না—সম্ভবত এমন দিনের অবসান হয়েছে। এখন আমাদের স্বধর্মচ্যুত নতুন ধরনের ডানপন্থাকে গণতান্ত্রিক পরিসরে জায়গা করে দিতে হবে।
জ্যাক শিরাক, মার্গারেট থ্যাচার বা আঙ্গেলা ম্যার্কেলের মতো নেতাদের বদলে এখন ট্রাম্প কিংবা মেলোনির মতো নেতারা সেখানে আসতে থাকবেন। ইতালির জাতীয় স্বার্থ এখন চলমান ভূরাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সংকট থেকে ইউরোপীয় ইউনিয়ন কীভাবে তাদের নাগরিকদের রক্ষা করছে, তার ওপর খুব শক্তভাবে নির্ভর করছে। মেলোনি যদি সত্যি সত্যি ইতিহাস নির্মাণ করতে পারেন তাহলে তিনিই হবেন প্রথম ইউরোপপন্থী ও অতিডানপন্থী নেতা, যিনি একই সঙ্গে ইতালীয় ও ইউরোপীয় জাতীয়তাবাদ ধারণ করেন।
মেলোনি এমন এক ইউরোপের কথা বলছেন যে ইউরোপ তার নাগরিকদের সুরক্ষা দিতে পারে। তিনি এমন এক ইউরোপের কথা বলছেন যে ইউরোপ অধিকার ও মূল্যবোধের পেছনে অযথা সময় অপচয় করবে না। এর বদলে সমরাস্ত্র, জ্বালানি ও পররাষ্ট্রনীতির মতো কার্যকর ক্ষমতার দিকে মনোযোগ দেবে। অভিবাসীসহ আরও কিছু ক্ষেত্রে মেলোনি পুরোনো ও উগ্র জনতুষ্টিবাদী নীতি চালু রাখতে পারেন—এ সম্ভাবনা এখনো আছে।
তিনি যদি সেটা করেন, তাহলে সেটা হবে আধুনিক ইতালির রাজনীতিতে আরেকটি অগ্নিস্ফুলিঙ্গ। ইতালির রাজনীতিতে চরমপন্থা ও টেকনোক্রেসি (বিভিন্ন ক্ষেত্রের বিশেষজ্ঞদের নিয়ে গঠিত সরকার) অনন্তকাল ধরে একটার বিকল্প হিসেবে আরেকটি হাজির হচ্ছে। মেলোনি যদি তাঁর দীর্ঘমেয়াদি আকাঙ্ক্ষায় অনমনীয় থাকতে পারেন, তাহলে তিনি ইউরোপের মূলধারার ডানপন্থীদের আকৃষ্ট করতে সক্ষম হবেন।
এদওয়ার্দো নোভেলি একজন সমাজবিজ্ঞানী ও রোম থ্রি বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনৈতিক যোগাযোগ বিষয়ের অধ্যাপক। তিনি বলেন, মেলোনির যে দর্শন সেটি ‘ঈশ্বর, পরিবার ও স্বদেশ’ নীতিকে অনুসরণ করে। এই নীতির ভিত্তি খ্রিষ্টান পরিচয়, ঐতিহ্যগত পারিবারিক কাঠামো এবং ইতালীয় দেশপ্রেমিকদের নিয়ে গড়ে ওঠা একটি জাতি।