হান্স উইল্‌সডর্ফ এর জীবনী

হান্স উইল্‌সডর্ফ এর জীবনী

বিখ্যাত জার্মান ব্যবসায়ী হান্স উইল্‌সডর্ফ (Hans Wilsdorf) ইতিহাসে বিখ্যাত হয়ে আছেন রোলেক্স এবং টিউডর ঘড়ি কোম্পানীর প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে। পকেটঘড়ি থেকে হাতঘড়ির বিবর্তনের পথিকৃৎ ছিলেন হান্স। তাঁর উদ্যোগ এবং আগ্রহেই একটি নির্ভরযোগ্য ঘড়ির ব্র্যাণ্ড তৈরি হয় যা কিনা পর্বতের চূড়ায় কিংবা সমুদ্রের গভীরে নির্ভুলভাবে সময় দেখাতে সক্ষম আর হান্সের প্রবর্তিত সেই রোলেক্স ঘড়ি ক্রমেই আভিজাত্যের প্রতীক হয়ে ওঠে। ১৮৮১ সালের ২২ মার্চ জার্মানির বাভারিয়ার কুল্মবাক্‌ শহরে একটি প্রোটেস্ট্যান্ট পরিবারে হান্স উইল্‌সডর্ফের জন্ম হয়।

তাঁর বাবার নাম জোহান ড্যানিয়েল ফার্দিনান্দ উইলস্‌ডর্ফ এবং মায়ের নাম অ্যানা ফার্দিনান্দ উইলসডর্ফ। তাঁদের তিন সন্তানের মধ্যে দ্বিতীয় পুত্র ছিলেন হান্স। হান্সের বালক বয়সেই তাঁর মা মারা যান এবং মাত্র বারোবছর বয়সে তাঁর বাবার মৃত্যু হলে হান্স একেবারে অনাথ হয়ে পড়েন। তাঁর কাকাদের কাছেই মানুষ হন হান্স এবং তাঁর কাকারা বংশপরম্পরায় বাহিত তাঁর বাবার যে সমৃদ্ধিশালী বিরাট ব্যবসা সেটিকে বিক্রি করে দেন। হান্স উইল্‌সডর্ফ কে তাঁর ভাই-বোনেদের সঙ্গে একত্রে একটি উচ্চমানের আবাসিক স্কুলে ভর্তি করে দেন তাঁর কাকারা।

সেই স্কুলে খুব ভালোভাবে পড়াশোনা করতে থাকেন হান্স এবং তাঁর ভাই-বোনেরা। পরবর্তীকালে প্রকাশিত হান্সের আত্মজীবনী থেকে জানা যায় যে, হান্স ও তাঁর ভাই-বোনেদের জীবন নিয়ে তাঁর কাকারা বিশেষ চিন্তিত ছিলেন না এবং এর ফলেই হয়তো হান্সের মধ্যে আত্মনির্ভরতার বোধ জাগ্রত হয় খুব ছোটো বয়স থেকেই। ক্রমেই হান্স নিজের সহায়-সম্পদ ইত্যাদি দেখভাল করতে দক্ষ হয়ে ওঠেন।

স্কুলে পড়াকালীন গণিত এবং ভাষার বিষয়ে অসাধারণ ফল করতেন হান্স। এই কারণেই বিদেশে গিয়ে পড়াশোনা করার উৎসাহ পেয়েছিলেন হান্স। একটি মুক্তো রপ্তানিকারক সংস্থায় শিক্ষানবিশ হিসেবে যোগ দিয়ে কর্মজীবন শুরু করেন হান্স উইলস্‌ডর্ফ। এই সংস্থায় কাজের সুবাদেই তিনি যে অভিজ্ঞতা লাভ করেছিলেন তা তাঁকে পরবর্তীকালে ব্যবসায়িক ক্ষেত্রে অনেক সহায়তা করেছিল। ১৯০০ সালে একটি সুইস ঘড়ি-নির্মাতা সংস্থায় কাজ শুরু করেন হান্স। তারপরে মেসার্স কুনো কর্টেনের প্রভাবশালী ঘড়ি নির্মাতা সংস্থায় সঙ্গে যুক্ত হয়ে মাসিক ৮০ সুইস ফ্রাঙ্কের বেতনে সুইজারল্যাণ্ডের লা-চক্স-ডি-ফণ্ডস শহরে থাকতে শুরু করেন হান্স।

এই সংস্থায় তাঁর কাজ ছিল মূলত একজন সংবাদদাতা এবং কেরানির। সেই সময় এই কুনো কর্টেন বছরে দশ লক্ষ ফ্রাঙ্ক মূল্যের পকেটঘড়ি রপ্তানি করতেন। বিভিন্ন মানের ঘড়ি তৈরি করতে পারলেও খুব কম সংখ্যক ঘড়িই বানাতেন কুনো কর্টেন আর সেটাই ছিল তাঁর সংস্থার বাজার-চাহিদার বৈশিষ্ট্য। হান্স উইলস্‌ডর্ফ এই সংস্থায় দিনে প্রায় একশো পকেটঘড়িকে দম দেওয়ার কাজ করতেন এবং তাঁর দায়িত্ব ছিল সমস্ত ঘড়ি সঠিক সময় দিচ্ছে কিনা তা পরীক্ষা করা। কুনো কর্টেনের সঙ্গে কাজ করতে করতে বিপুল জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা অর্জন করেন হান্স।

তিনি খুব কাছ থেকে দেখেছিলেন কীভাবে সমস্ত প্রকারের ঘড়ি তৈরি করা হয় যা তাঁকে ভবিষ্যতে একজন ঘড়ি-নির্মাতা হতে সহায়তা করেছিল। ১৯০৩ সালে হান্স উইল্‌সডর্ফ লণ্ডনে চলে যান এবং অন্য আরেকটি ঘড়ি-নির্মাতা সংস্থায় কাজ করতে শুরু করেন। ১৯০৫ সালে সামান্য কিছু টাকা নিয়ে হান্স নিজের উদ্যোগে অ্যালফ্রেড ডেভিসের সঙ্গে একত্রে ‘উইলস্‌ডর্ফ অ্যাণ্ড ডেভিস’ নামে একটি ছোটো ব্যবসা চালু করেন। লণ্ডনের ৮৩, হ্যাটন গার্ডেনে তাঁদের অফিস ছিল। তাঁরা অত্যন্ত সুলভ মূল্যে উচ্চমানের ঘড়ি বিক্রি করতেন।

১৯০০ সালের প্রথমার্ধে তখনো মানুষ পকেট-ঘড়িতেই স্বচ্ছন্দ ছিল। হাতঘড়ির ব্যবহার খুব একটা জনপ্রিয় হয়নি এবং ছোটো আকারের রিস্ট-ব্যাণ্ড হিসেবে অনেকে এই হাতঘড়ি পরতেন সে সময়। হান্স উইলস্‌ডর্ফই প্রথম অনুধাবন করেন যে একদিন এই হাতঘড়িই আবশ্যিক হয়ে উঠবে সবার কাছে। ‘উইলস্‌ডর্ফ অ্যাণ্ড ডেভিস’ নামে কোম্পানী খুললেও একটা ছোট কিন্তু আকর্ষণীয় নাম চাইছিলেন হান্স। নামকরণের জন্য নানারকমভাবে ইংরেজি বর্ণমালাগুলিকে সাজিয়ে একশোটিরও বেশি নাম তৈরি করেছিলেন তিনি।

কিন্তু কোনোটাই ঠিক মনমতো হচ্ছিল না তাঁর। একদিন সকালে, ঘোড়ায় টানা ডবল-ডেকার গাড়ির দোতলায় চড়ে হান্স যখন লণ্ডনের চিপ্সাইডের দিকে যাচ্ছিলেন ঠিক সেইসময় হঠাৎই এই ‘রোলেক্স’ নামটা তাঁর মাথায় আসে। কিছুদিনের মধ্যেই উইলস্‌ডর্ফ অ্যাণ্ড ডেভিস কোম্পানির তরফ থেকে সুইজারল্যাণ্ডে নতুন এই ঘড়ির ব্র্যাণ্ডটির রেজিস্ট্রেশন সম্পূর্ণ হয়। তাঁর জীবনের একমাত্র লক্ষ্য হয়ে ওঠে এই ‘রোলেক্স’কে জনপ্রিয় করে তোলা কারণ তখন সুইজারল্যাণ্ডে একমাত্র এই ‘রোলেক্স’ ব্র্যাণ্ডই হাতঘড়ি তৈরি করত।

১৯০২ সালে লা-চক্স-ডি-ফণ্ডসে থাকাকালীন সুইজারল্যাণ্ডের বিয়েনে হার্ম্যান এইগ্‌লার নামে এক ভদ্রলোকের সন্ধান পান যিনি ‘ইবাউচেস’ নামে একটি নতুন ধরনের উচ্চমানের ঘড়ি তৈরি করে সাড়া ফেলেছেন। তাঁর হাত ধরেই ছোটো ছোটো লিভার দিয়ে ঘড়ির যন্ত্রাংশ তৈরি করা শুরু হয়েছে যা একটি হাতঘড়ি তৈরির উপযোগী। ১৯০৫ সালে হার্ম্যান এইগ্‌লারের সঙ্গে চুক্তিতে হাতঘড়ির একটি বিরাট বড় অর্ডার দেন হান্স। সেই থেকেই এইগ্‌লার এবং রোলেক্সের এক দীর্ঘকালীন অংশীদারী সম্পর্কের সূত্রপাত ঘটে যদিও ভবিষ্যতে রোলেক্স ব্র্যাণ্ডটিই এইগ্‌লারের কোম্পানিকে কিনে নিয়েছিল। ১৯১৪ সালে হান্স লণ্ডনে আসার দশ বছরের মধ্যেই প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়ে যায়।

এই সময়েই হান্স তাঁর কোম্পানির নাম পরিবর্তন করে রাখেন ‘দ্য রোলেক্স ওয়াচ্‌ কোম্পানি লিমিটেড’। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরুর চোদ্দো দিন আগে, ১৯১৪ সালের ১৪ জুলাই তারিখে কিউ অবজারভেটরির পক্ষ থেকে হাতঘড়ির ইতিহাসে প্রথমবার ‘এ’ ক্লাস শংসাপত্র পায় রোলেক্স কোম্পানি। ঐ বছরই তাঁদের সংস্থায় প্রায় চল্লিশ জনেরও বেশি কর্মচারী কাজ করতেন। এই সময়েই হান্স একজায়গায় লিখেছিলেন যে একদিন এমন সময় আসবে যখন এই পকেট ঘড়ি একেবারেই বিলুপ্ত হয়ে যাবে, আর তার জায়গা নেবে এই হাতঘড়ি।

১৯১৫ সালে ব্রিটিশ সরকার তেত্রিশশতাংশ কাস্টম ডিউটি কর চাপানোর ফলে বাধ্য হয়ে হান্স রোলেক্স কোম্পানির আন্তর্জাতিক সদরদপ্তর লণ্ডন থেকে পরিবর্তন করে সুইজারল্যাণ্ডের বিয়েনে স্থানান্তরিত করেন। ১৯১৯ সালে আবার সুইজারল্যাণ্ডের বিয়েন থেকে জেনেভায় স্থানান্তরিত হয় রোলেক্স কোম্পানি। শেষদিন পর্যন্ত ঐ জেনেভাতেই ছিল রোলেক্সের আন্তর্জাতিক সদর দপ্তর। ১৯২৭ সালে বিশ্বের প্রথম জলনিরোধক ঘড়ি আবিষ্কার করার পেটেন্ট নেয় রোলেক্স যার নাম ছিল ‘রোলেক্স অয়স্টার’।

তাঁর রোলেক্স ব্র্যাণ্ডের প্রথম অ্যাম্বাসাডর হন মার্সিডিজ গ্লেইটজ্‌ নামের একজন মহিলা সাঁতারু যিনি রোলেক্স অয়স্টার ঘড়ি পরে ইংলিশ চ্যানেল পার হয়েছিলেন। বিখ্যাত দৌড়বিদ স্যার ম্যালকম ক্যাম্পবেলও পরে রোলেক্সের ব্র্যাণ্ড-আম্বাসাডর হয়েছিলেন। ১৯৩১ সালে ‘রোলেক্স পার্পেচুয়াল’ নামে একটি স্বয়ংক্রিয় ঘড়ি আবিষ্কার করেন হান্স যা পূর্বতন ঘড়িগুলির থেকে আরো উন্নত মানের ছিল। এতে একটি দ্বিমুখী ঘূর্ণায়কের সাহায্যে নিজে থেকেই ঘড়ির কাঁটাগুলি গতিশীল হতে পারতো।

ধীরে ধীরে তাঁর কোম্পানি আরো বড়ো হতে থাকে এবং সময়-পরিমাপের ইতিহাসে এক ব্যতিক্রমী স্থান অর্জন করেন হান্স উইলস্‌ডর্ফ। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলে রয়্যাল এয়ার ফোর্সের বিমানচালকেরা প্রায় প্রত্যেকেই রোলেক্স ঘড়ি কিনতে শুরু করেন। কিন্তু যুদ্ধে অপর পক্ষের কাছে ধরা পড়ার পর যুদ্ধবন্দী থাকাকালীন তাঁদের ঘড়িগুলি বন্ধ হতে শুরু করে। এই খবর পেয়ে হান্স নিজেই উদ্যোগ নিয়ে সমস্ত ঘড়ি ফেরত আনিয়ে সেগুলি বিনামূল্যে সারিয়ে দিতে থাকেন যুদ্ধ শেষ না হওয়া পর্যন্ত।

১৯৪৫ সালে হান্সের প্রথম স্ত্রী ফ্লোরেন্স ফ্রান্সিস মে উইলস্‌ডর্ফ মারা যাওয়ার পরে ‘হান্স উইলস্‌ডর্ফ ফাউণ্ডেশন’ নামে একটি সংস্থা গড়ে তোলেন তিনি যেখানে ১৯৬০ সালে তিনি রোলেক্সের ১০০ শতাংশ মালিকানার অংশীদারিত্ব দান করে যান। আইন অনুযায়ী ঐ ফাউণ্ডেশনের আওতাভুক্ত থাকার কারণে রোলেক্স কোম্পানিকে আজও কোনো কর্পোরেট কর দিতে হয় না এবং এই কোম্পানির লভ্যাংশের একটা বড়ো অংশ জেনেভার বিভিন্ন সামাজিক উন্নয়নের প্রয়োজনে কাজে লাগানো হয়।

১৯৪৫ সালেই রোলেক্স কোম্পানির পক্ষ থেকে ‘রোলেক্স ডেটজাস্ট’ নামে একটি নতুন মডেলের ঘড়ি তৈরি করে বাজারে আনেন হান্স যেখানে সময়-প্রদর্শক স্থানের মধ্যেই আলাদা একটি জানালার মতো অংশে তারিখও দেখা যেতো। ক্রমে ক্রমে ১৯৪৬ সালে ‘টিউডর’ নামে আরেকটি স্বল্পমূল্যের উচ্চমানের ঘড়ির ব্র্যাণ্ড তৈরি করেন হান্স আর তারপর ১৯৫৪ সালে বিশেষত সাঁতারের উপযোগী হিসেবে ‘দ্য রোলেক্স সাবমেরিনার’ নামের একটি নতুন মডেল প্রচলন করেন হান্স।

ঐ বছরই ‘দ্য রোলেক্স জিএমটি মাস্টার’, ১৯৫৫ সালে ‘দ্য রোলেক্স ডে-ডেট’ এবং ১৯৫৬ সালে ‘দ্য রোলেক্স মিলগেউস’ নামের নতুন নতুন মডেল চালু করতে থাকেন হান্স উইলস্‌ডর্ফ। রোলেক্স ঘড়ির ক্রম বিবর্তনের ইতিহাস সত্যই বিস্ময়কর আর এই ইতিহাসের স্রষ্টা হান্স উইলস্‌ডর্ফ। ১৯৪৬ সালে প্রকাশিত ‘রোলেক্স জুবিলি ভেড মেকুম’ নামের একটি চার খণ্ডের বই লেখেন হান্স উইলস্‌ডর্ফ যেখানে নিজের আত্মজীবনীও লিখেছেন তিনি। ১৯৬০ সালে ৬ জুলাই সুইজারল্যান্ডের জেনেভায় হান্স উইলস্‌ডর্ফের মৃত্যু হয়।