নদিয়া রাজপরিবার | Nadia Rajparibar

নদিয়া রাজপরিবার  |  Nadia Rajparibar

নদিয়া রাজপরিবারকে নবদ্বীপ রাজবংশ বলে অভিহিত করার কিছু কারণ আছে। মধ্যযুগের বাংলার ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, শিক্ষা-সংস্কৃতি, ব্যবসা-বাণিজ্য, স্বাস্থ্য প্রভৃতি ক্ষেত্রে নবদ্বীপ ছিল একটি প্রতিনিধি স্থানীয় জনপদ। এটি ছিল কৃষ্ণনগর রাজপরিবারের অধীনস্থ একটি অগ্রগণ্য নগর। এখানকার পণ্ডিতবর্গেরা তাদের তীক্ষ্ণ ধীশক্তির খ্যাতিতে গগন স্পর্শ করেছিল।

এই রাজপরিবার নবদ্বীপের পণ্ডিতবর্গকে আলাদা মর্যাদা দিত। নবদ্বীপের পণ্ডিত সমাজ রাজা রামকৃষ্ণকে নবদ্বীপাধিপতি উপাধি প্রদান করেন। তখন থেকেই এই বংশের রাজারা প্রাগুক্ত উপাধিটি সাদরে গ্রহণ করতেন। এই কারণে এই রাজপরিবারকে নবদ্বীপ রাজবংশ বলা হয়।নদিয়া রাজপরিবার বা নবদ্বীপ রাজবংশ ভট্টনারায়ণ নামক ব্রাহ্মণের বংশজাত, যিনি বাংলার রাজা আদিশূর কর্তৃক বিশুদ্ধতার (কৌলিক) আচরণে নির্বাচিত হয়েছিলেন। নদিয়া রাজপরিবার বাংলার অন্যতম হিন্দু রাজপরিবার, যারা ৩৫ প্রজন্ম ধরে এখানে বসবাস করছেন।

বাংলায় ব্রিটিশ রাজ শুরু হওয়ার পর থেকে নদিয়ার রাজারা বংশপরম্পরায় মহারাজা বাহাদুর উপাধি ধারণ করেন। নদিয়ার রাজবংশের শ্রেষ্ঠ রাজা কৃষ্ণচন্দ্র রায়। পিতা রঘুরাম রায়ের মৃত্যুর পর মাত্র ১৮ বছর বয়সে ১৭২৮ খ্রিস্টাব্দে তিনি রাজা হন। বিদ্বান, প্রজাপালক ও সংস্কৃতিবান ছিলেন। তাঁর গঙ্গাবাসের প্রাসাদ ছিল নদিয়ার এক ক্রোশ পূর্বে শ্রীনগরে। তাঁর রাজত্বকালে রাজ্যে বিস্তার ও বিপুল সমৃদ্ধি ঘটে। তাঁর রাজত্বকাল নানা ঘটনায় পূর্ণ। পলাশীর যুদ্ধ, ছিয়াত্তরের মন্বন্তর,বর্গী হামলা ইত্যাদি তারই আমলে হয়।

তার সময় বাংলায় শিক্ষা, সংস্কৃতি, সাহিত্য, সংগীতের বিকাশ ঘটেছিল। বিভিন্ন প্রতিভাবান মানুষ তার পৃষ্ঠপোষকতায় রাজসভা অলংকৃত করেন। রায়গুণাকর ভারতচন্দ্রকে তিনি মাসিক ৪০ টাকা বেতনে সভাকবি নিযুক্ত করেন। কৃষ্ণচন্দ্র প্রায় কুড়ি লক্ষ টাকা ব্যয় করে অগ্নিহোত্র ও বাজপেয় যজ্ঞ করেছিলেন৷ ১৭৬৮ খ্রিস্টাব্দে কাশীনাথের 'কালী সপর্যাবিধি' গ্রন্থে প্রথম কালীপূজার বিধি উল্লিখিত হওয়ার পর তাঁর আদেশে নদিয়ায় ব্যাপকভাবে দীপান্বিতা শ্যামাপূজার প্রচলন ঘটে৷ তাঁর আমলে নদিয়ায় প্রায় ১০,০০০ কালীমূর্তির পূজা হত।

জগদ্ধাত্রী পুজো মানে প্রথমেই যে নামগুলো মাথায় আসে তা হল কৃষ্ণনগর ও চন্দননগর। এ রাজ্যে কৃষ্ণনগরেই প্রথম জগদ্ধাত্রী পুজোর প্রচলন হয়। কথিত আছে দেবীর স্বপ্নাদেশ পেয়ে এই পুজোর প্রচলন করেন মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্র।  কৃষ্ণনগরের জগদ্ধাত্রী পুজোর ঐতিহ্য একটি নাম চাষাপাড়া 'বুড়িমা'। কৃষ্ণনগর রাজবাড়ির পুজোর প্রচলনের পরই চাষাপাড়া বারোয়ারি অর্থাৎ বুড়িমার পুজো শুরু হয়। কথিত আছে মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্র কোনও এক সময় এই পুজোর ব্যয়ভার নিয়ে দুশ্চিন্তায় পড়ে যান। তখন নাকি স্বয়ং জগদ্ধাত্রী রাজা কৃষ্ণচন্দ্রকে স্বপ্নাদেশ দেন যে চাষা পাড়ার লেঠেলরা দেবীর পুজোর আয়োজন করবেন।

রাজবাড়ির জগদ্ধাত্রী পুজো শুরুর কয়েক বছরের মধ্যেই এখানকার পুজো শুরু হয়েছিল বলে দাবি উদ্যোক্তাদের। তবে বুড়িমা নামটা ৭০ - ৭৫ বছর আগে দেওয়া হয়েছিল বলে প্রবীণদের মত। এই পুজোর নাম ছড়িয়েছে গোটা দেশে, এমনকি বিদেশের বাঙালি ভক্তদের মধ্যেও। বর্তমানে সাধারণ মানুষের দান এবং চাঁদাতেই বুড়িমার পুজো সম্পন্ন হয়। জগদ্ধাত্রী পুজোর আগের দিন থেকে অসংখ্য ভক্ত রাজ্য তথা দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে কৃষ্ণনগরে চলে আসে বুড়িমা দর্শনে। এই বুড়িমা অত্যন্ত জাগ্রত দেবী বলে প্রচলিত বিশ্বাস।

এই পুজোর ভিড় সামলাতে প্রশাসনকে হিমশিম খেতে হয়। দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে পুজোর দিন নগদ অর্থ, শাড়ি এবং সোনা-রূপোর গয়না নিয়ে অনেক মানুষ মনের ইচ্ছে পূরণ করার প্রার্থনা জানিয়ে পুজো দেন। অনেকের মনস্কামনা পূর্ণ হয় বলেই এখনও পর্যন্ত জাগ্রত দেবীকে সকলে মেনে চলে। কৃষ্ণনগরে বুড়িমাকে নিয়ে রয়েছে অনেক অলৌকিক কাহিনী। দেবীর আগমন থেকে বিসর্জন সবেতেই রয়েছে এক অনন্য সৃষ্টি। বিসর্জনের দিন কৃষ্ণনগরের সমস্ত প্রতিমা আগে বিসর্জন হবে, সবার শেষে বুড়িমাকে ভাসান দেওয়া হয়। বুড়িমার বিসর্জন না হওয়া পর্যন্ত রাস্তার দুই ধারে দাঁড়িয়ে থাকে ভক্তকুল। কড়া পুলিশ প্রহরায় নিরাপত্তারক্ষীরা দেবী জগদ্ধাত্রীকে নিয়ে যান জলঙ্গীর ঘাটে।

পরবর্তীকালে, তাঁর পৌত্র ঈশানচন্দ্র হাজার-হাজার মণ নৈবেদ্য, বস্ত্রখণ্ড ও উপাচারে মাতৃপূজার আড়ম্বর করেছিলেন। কৃষ্ণচন্দ্রের বৃদ্ধাবস্থায় কলকাতার বিখ্যাত রাজা নবকৃষ্ণ দেব নদিয়ার অগ্রদ্বীপের জাগ্রত গোপীনাথ বিগ্রহ অপহরণ করে নৌকাযোগে কলকাতার রাজবাড়িতে নিয়ে যান। লর্ড ক্লাইভের মধ্যস্থতার ফলে মূর্তিটি শেষে কৃষ্ণচন্দ্রের হস্তগত হয়। ১৭৮২ খ্রিস্টাব্দের ২২ আষাঢ় মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্র পরলোকগমন করেন।  সম্রাট দ্বিতীয় শাহ আলম কৃষ্ণচন্দ্রকে প্রথমে 'মহারাজা' ও পরে লর্ড ক্লাইভের সুপারিশে 'মহারাজেন্দ্র বাহাদুর' উপাধিতে ভূষিত করেন।

পলাশীর যুদ্ধের পর লর্ড ক্লাইভ তাঁকে পাঁচটি কামান উপহার দিয়েছিলেন। কৃষ্ণচন্দ্র ছিলেন রাজনৈতিক দূরদৃষ্টিসম্পন্ন একজন কূটকৌশলী ব্যক্তি। তাঁর শাসনকালে বাংলায় ইংরেজ শাসন কায়েম হয় এবং মুসলমান রাজত্বের অবসান ঘটে। এ রাজনৈতিক পট পরিবর্তনে তিনি ইংরেজদের সঙ্গে মিত্রতা করেন এবং ক্লাইভের পক্ষ নিয়ে নবাব সিরাজউদ্দৌলার পতন ত্বরান্বিত করেন। ইংরেজদের সঙ্গে সংঘর্ষের সময় নবাব  মীর কাশিম তাঁকে বন্দি করে মৃত্যুদন্ড দিলে ইংরেজদের সহায়তায় তিনি মুক্তিলাভ করেন।  

বলাবাহুল্য,রাজা কৃষ্ণচন্দ্র রায়ই সর্বপ্রথম সর্বসাধারণের মধ্যে দুর্গোৎসবের প্রচলন করেছিলেন যা আজ সমগ্র বাংলাব্যাপী 'সর্বজনীন' রূপে পরিচিতি লাভ করেছে।এই রাজবংশের আরাধ্য দেবতা হলেন 'বড়োনারায়ন'।দোলপূর্ণিমার পর দ্বিতীয় একাদশী তিথিতে কৃষ্ণনগর রাজবাড়ির প্রাঙ্গণে এক বিশাল মেলা বসে।মেলাটি 'বারোদোলের মেলা' নামে প্রখ্যাত।বরনারায়ণের সাথে বারোটি কৃষ্ণমূর্তি সমম্বিত রাজবাড়ির মন্দির প্রাঙ্গণ সকলের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হয় এই সময়।তাই এই মেলা 'বারোদোলের মেলা' নামে পরিচিত।

দোলযাত্রা ছাড়াও দুর্গাপূজা,ঝুলন উৎসব,জন্মাষ্টমী উৎসব সহ বিভিন্ন তিথি পূর্বরীতি অনুযায়ী রাজবাড়িতে আজও সাড়ম্বরে পালিত হয়।তখন রাজবাড়ির পুজোর ঠাঁটবাট ছিলই আলাদা৷ হাতিশালে হাতি, ঘোড়াশালে ঘোড়া৷ ছাগবলি, নানা আয়োজনে এলাহি ব্যাপার থাকত৷ ঠাঁটের বাইরে ছিল মানুষের মঙ্গল কামনা৷ যাত্রামঙ্গলে তারই প্রতিফলন ঘটেছে৷ কী ছিল সেই প্রথার বিশেষত্ব? দশমীর দিন পুজো শেষে মহারাজারা ঠাকুরদালান থেকে শুভদৃষ্টি সেরে রাজপ্রাসাদে ঢুকতেন৷ শুভদৃষ্টির তালিকায় ছিল মোষ, ঘোড়া, হাতি, জ্যান্ত মাছ, সদ্য কাটা মাংস, দক্ষিণাবর্ত অগ্নি, গণিকা, ঘি, দই, ধান, আরও কত কী৷ দেবীর সামনে দাঁড়িয়ে মহারাজকে দেখাতেন রাজপুরোহিত৷

বিশ্বাস ছিল, রাজপ্রাসাদে ঢোকার আগে এদের দর্শন রাজ্যের মঙ্গলবার্তা বয়ে আনবে৷ সেই যাত্রামঙ্গল এখনও টিকে আছে৷ কালের নিয়মে তার ভোলবদল হয়েছে৷ রাজতন্ত্র বহুদিনই অতীত।বহু প্রাচীন এই রাজবংশ বহু উত্থান-পতনের মধ্যদিয়ে আজ একবিংশ শতকের দ্বিতীয় দশকে এসে উপনীত হয়েছে।বর্তমানে এই রাজবংশের সিংহভাগ প্রতিনিধিই ব্যবসায়ীক কারণে দেশ-বিদেশের বিভিন্ন প্রান্তে থাকেন।দুর্গা পুজোয় ও দোলযাত্রা উৎসবে সকলে মিলিত হন। আজও রাজবাড়ির প্রতিটি কণায় লুকিয়ে আছে কতশত ইতিহাসের গল্প,আজও রাজবাটীর প্রবেশপথে স্বমহিমায় দণ্ডায়মান তোরণ শত শত বছরের কতশত ইতিহাসের সাক্ষ্য বহনকরে আসছে,আজও প্রবেশদ্বারের মুখে অবস্থিত সুগভীর গড় কিমবা রাজপ্রাসাদ সংলগ্ন আমবাগান ইতিহাস সচেতন মানুষের হৃদয়কে আচ্ছন্ন করে রেখেছে।আজও কৃষ্ণনগর রাজবাড়ির বুকে তৈরি হয় হাজারো নিত্যনতুন গল্প। 

নদীয়ার রাজাদের রাজত্বকাল ::----
ভবানন্দ মজুমদার -- 1606-1628
গোপাল রায় -- 1628-1632
রাঘব রায় -- 1632-1883
রুদ্র রায় -- 1683-1694
রামকৃষ্ণ -- 1694 ( অল্প সময়ের জন্য)
রামজীবন -- 1694-1715
রঘুরাম -- 1715-1728
কৃষ্ণচন্দ্র - 1728-1782
শিবচন্দ্র -1782-1788
ঈশ্বরচন্দ্র - 1788-1802
গিরীজচন্দ্র - 1802-1842
শ্রীশচন্দ্র -1842-1856
সতীশচন্দ্র -1856-1870

ভবানন্দের পূর্বপুরুষের পরিচয় :-- নদীয়ার রাজাগণ আদিশূর আনীত পঞ্চব্রাহ্মণের অন্যতম নেতা ভট্টনারায়ণের বংশজ | ভট্টনারায়ণ কান্যকুব্জ প্রদেশের ক্ষিতীশ নামে এক রাজার পুত্র ছিলেন | ভট্টনারায়ণের পুত্র নিপু হইতে অধঃস্তন একাদশ পুরুষে কামদেব জন্মগ্রহণ করেন | এই কামদেবের চার পুত্র ছিল তার মধ্যে জেষ্ঠ্য বিশ্বনাথ পিতার পিতৃগদী প্রাপ্ত হয়ে 1400 খ্রিস্টাব্দে দিল্লী যাত্রা করেন এবং স্বকীয় অসাধারণ বিদ্বাবত্ত্বাগুণে দিল্লির দরবার হতে রাজ উপাধি এবং পৈত্রিক সম্পত্তি ব্যতীত আরও অনেক গুলি গ্রামের অধিকার পান |

বিশ্বনাথের পরে উল্লেখযোগ্য রাজা হন কাশীনাথ | ইনি অসাধারণ বীর এবং বুদ্ধিমান হলেও শেষপর্যন্ত এক ঘাতকদের হাতে প্রাণদান করেন | এই সময় তাঁর গর্ভবতী স্ত্রী বাগোয়ান পরগনার জমিদার হরেকৃষ্ণ সমাদ্বারের বাড়িতে গিয়ে প্রাণে বাঁচেন | সেখানে অল্পদিনের মধ্যেই তিনি একটি পুত্র সন্তানের জন্ম দেন | এই পুত্রের নাম রামচন্দ্র | অন্যদিকে জমিদার হরেকৃষ্ণ সমাদ্বার ছিলেন নিঃসন্তান , তাই মৃত্যুকালে তিনি রামচন্দ্রকেই তাঁর ক্ষুদ্র জমিদারীর অধিকারী করে যান | আর এই রামচন্দ্রের দূর্গাদাস, জগদীশ, হরিবল্লভ এবং সুবুদ্ধি নামে চারটি পুত্র ছিল |

এই দূর্গাদাসই পরে " মহারাজা ভবানন্দ মজুমদার " নামে অভিহিত হন | জানা যায়, বঙ্গের শেষ স্বাধীন বাঙ্গালী রাজা প্রতাপের রাজধানীতে প্রবেশের গুপ্ত পথ দেখিয়ে এবং প্রয়োজনীয় রসদ দিয়ে তিনি দিল্লির শাসক জাহাঙ্গীর এর সেনাপতি মানসিংহকে সাহায্য করেছিলেন | তাই জাহাঙ্গীর তাঁর এই কাজে খুশি হয়ে 1606 খ্রিস্টাব্দে ভবানন্দকে 14 টি পরগনা সনদসূত্রে দেন | এছাড়াও 1608 খ্রিস্টাব্দে তৎকালীন বাংলার নবাব ইসমাইল খাঁ ভবানন্দের বুদ্ধি ও বিচক্ষণতার স্বীকৃতি স্বরুপ তাঁকে কানুনগুই পদে নিযুক্ত করেন |

এমনকি দিল্লীর সম্রাট জাহাঙ্গীরের কাছ থেকে তাঁর জন্য সনন্দ ও মজুমদার উপাধিও এনে দেন | ভবানন্দ নদীয়ার কৃষ্ণগঞ্জ থানার মাটিয়ারিতে নদীয়ারাজের রাজধানী স্থাপন করেন | পরবর্তীতে নদীয়ারাজ রুদ্র রায় তাঁর তৎকালীন নদীয়া রাজ্যের মধ্যবর্তী স্থানে নবদ্বীপ ও শান্তিপুরের নিকট জনপদ ' 'রেউই ' গ্রামে রাজধানী স্থানান্তরিত করেন এবং রেউই এর নামকরণ করেন ভগবান শ্রীকৃষ্ণের নামানুসারে ' কৃষ্ণনগর ' | রাজা রুদ্র রায় অনেক জনহিতকর কাজ করেছিলেন | দিল্লীর সম্রাট ঔরঙ্গজেব তাঁর প্রতি সন্তুষ্ট হয়ে, তাঁকে গয়েশপুর, হোসেনপুর, খাড়ি, জুড়ি ইত্যাদি কয়েকটি পরগনা দান করেন | তিনি সম্রাটের সহায়তায় সনিপুণ স্থপতিদের এনে কৃষ্ণনগর রাজবাড়ির কাছারি, কেল্লা, পূজোর দালান, নাচঘর, চক, নহবৎখানা প্রভৃতি নির্মাণ করেন |

রাঘব রায়    রাঘব দিগনগরে ২০,০০০ টাকা ব্যয়ে ১৪২৩ হাত × ৪২০ হাত ক্ষেত্রবিশিষ্ট দীঘি খনন করান। দীঘির পূর্বদিকে সুবৃহৎ ঘাট, সুন্দর অট্টালিকা ও দুটি মন্দির (চারচালা ও বাংলা মন্দিরের সাদৃশ্যে সুনিপুণ পোড়ামাটির কাজযুক্ত) নির্মান করান। মন্দিরের দেওয়ালে উৎকীর্ণ লিপি অনুসারে, ১৬৬৯ খ্রিস্টাব্দে তিনি মন্দিরে রাঘবেশ্বর শিবলিঙ্গ প্রতিষ্ঠা করেন। শিবনিবাসে তিনটি মন্দিরে তিনি রাজরাজেশ্বর, রাজ্ঞীশ্বর ও রামচন্দ্র নামে তিনটি দেবমূর্তি স্থাপন করেন।

 রুদ্র রায়   ভবানন্দ নদিয়ার কৃষ্ণগঞ্জ থানার মাটিয়ারিতে নদিয়ারাজের রাজধানী স্থাপন করেছিলেন। পরবর্তীতে রাঘবপুত্র নদিয়ারাজ রুদ্র রায় তাঁর তৎকালীন নদিয়া রাজ্যের মধ্যবর্তী স্থানে নবদ্বীপ ও শান্তিপুরের নিকট জনপদ 'রেউই ' গ্রামে রাজধানী স্থানান্তরিত করেন। রেউই-তে সেসময় অনেক গোপবসতি ছিল এবং তাদের আরাধ্য দেবতা ছিলেন ভগবান কৃষ্ণ। একারণে, রুদ্র রায় রেউই-এর নাম রাখেন কৃষ্ণনগর। রাজা রুদ্র রায় অনেক জনহিতকর কাজ করেছিলেন; দিল্লির সম্রাট ঔরঙ্গজেব তাঁর প্রতি সন্তুষ্ট হয়ে তাঁকে কয়েকটি পরগনা দান করেন। রুদ্র রায় বাদশা আলমগীরের কাছ থেকে গয়েশপুর, হোসেনপুর, বাগমারী প্রভৃতি বড় পরগনার জমিদারি পান এবং কৃষ্ণনগরের রাজভবনের ওপর 'কাঙরা' (যা সেসময় উচ্চ রাজকীয় সম্মানের প্রতিভূ ছিল) নির্মাণের অনুমতি পান।  তিনি প্রথম স্থপতিদের এনে কৃষ্ণনগর রাজবাড়ির কাছারি, কেল্লা, পূজোর দালান, নাচঘর, চক, নহবৎখানা প্রভৃতি নির্মাণ করান। মাটিয়ারিতে রুদ্রের পিতা রাঘব রায় পুত্রের নামে 'রুদ্রেশ্বর শিবমন্দির' স্থাপন করিয়েছিলেন।