বাংলাদেশের কুমিল্লার হিন্দু দের ব্যাংক ব্যবসার বিলুপ্তির ইতিহাস

প্রভাকর রায় বাংলাদেশের কুমিল্লা Comilla শব্দটি উক্ত অঞ্চলের আদিনাম কমলাঙ্ক এর ক্রমান্বয়ে পরিবর্তিত আঞ্চলিক অপভ্রংশ রূপ, যার অর্থ পদ্মফুলের দীঘি। কুমিল্লা অঞ্চলটি একসময় প্রাচীন সমতট অঞ্চলের অধীনে ছিল। পরবর্তীকালে এটি ত্রিপুরা রাজ্যের সাথে যোগ দেয়। খ্রিস্টীয় নবম শতাব্দীতে কুমিল্লা জেলা হরিকেল অঞ্চলের রাজাদের অধীনে আসে। অষ্টম শতাব্দীতে লালমাই ময়নামতি দেব বংশ এবং দশম থেকে একাদশ শতকের মাঝামাঝি পর্যন্ত চন্দ্র বংশের শাসনাধীনে ছিল। ১৭৬৫ সালে এ অঞ্চলটি ইংরেজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির অধীনে আসে।
১৭৬৯ সালে রাজস্ব আদায়ের সুবিধার্থে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী একজন তত্ত্বাবধায়ক নিয়োগ করে। তখন ঢাকা প্রদেশের অন্তর্গত ছিল কুমিল্লা। কুমিল্লাকে ১৭৭৬ সালে কালেক্টরের অধীনস্থ করা হয়। ১৭৯০ সালে কোম্পানী শাসনামলে ত্রিপুরা নামের জেলার সৃষ্টি হয় করা হয়। তৎকালে বর্তমান কুমিল্লা, চাঁদপুর, ব্রাহ্মনবাড়িয়া, নোয়াখালী, লক্ষ্মীপুর, ফেনী, শাহবাজপুর, হাতিয়া, ত্রিপুরার কিছু অংশ, চট্টগ্রামের সন্দ্বীপ ও মীরসরাই নিয়ে সমতল অঞ্চল নিয়ে ত্রিপুরা জেলা ও পার্বত্য অঞ্চল নিয়ে পার্বত্য ত্রিপুরা নামে ভাগ করা হয়, এই জেলার সদর দপ্তর স্থাপিত হয় কুমিল্লায়।
১৮২১ সালে ত্রিপুরা জেলাকে ভাগ করে বর্তমান নোয়াখালী, ফেনী, লক্ষীপুর নিয়ে ভূলুয়া জেলা গঠিত হয়, যা পরবর্তীতে নোয়াখালী নামকরন করা হয়। ১৯৬০ সালে সদর দপ্তরের নামানুসারে ত্রিপুরা জেলার নামকরণ করা হয় কুমিল্লা এবং তখন থেকে জেলা ম্যাজিস্ট্রেট ও কালেক্টর পদটির নামকরণ জেলা প্রশাসক করা হয়। ১৯৮৪ সালে কুমিল্লার দু'টি মহকুমা চাঁদপুর ও ব্রাহ্মণবাড়িয়াকে পৃথক জেলা হিসেবে পুনর্গঠন করা হয়। একসময় কুমিল্লাকে বলা হতো ‘ব্যাংক ও ট্যাংকের শহর’। এখন সেই ব্যাংকও নেই, ট্যাংকও নেই। সবই যেন কথার কথা। কালের অতলে হারিয়ে গেছে ব্যাংক। কোনো কোনো ‘ট্যাংক’-এর অস্তিত্ব নেই। অধিকাংশ হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজনের ব্যবসা আজ আর নেই। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের আগে পর্যন্ত রমরমা ব্যবসা ছিল হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজনের।
এবারে চলুন, বিলুপ্ত সেই হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজনের ব্যাংকের ইতিহাসে এবার চোখ রাখা যাক। কুমিল্লার মতো শহরগুলোতে ব্যবসায়-বাণিজ্যে অর্থের জোগান দিতে প্রয়োজন পড়ে ব্যাংকব্যবস্থার। ব্যবসায়-বাণিজ্যে অর্থের প্রবাহ বাড়াতে আজ থেকে ১০৭ বছর আগে কুমিল্লার উদ্যোক্তারা ব্যাংক বানিয়েছিলেন। ১৯১৪ সালে তাঁরা ‘দ্য কুমিল্লা ব্যাংকিং করপোরেশন’ নামে একটি ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করেন। নরেন্দ্র চন্দ্র দত্ত নামে একজন বিশিষ্ট ব্যবসায়ী ব্যাংকটি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। তাঁর আদি বাড়ি ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সরাইলের কালিকচ্ছ গ্রামে হলেও কুমিল্লা শহরেই তিনি ব্যবসা করতেন।
পেশায় আইনজীবী হলেও তাঁর নানা ধরনের ব্যবসা ছিল। মনতলা টি এস্টেট ও মনতলা ইস্পাত নামে দুটি প্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি কুমিল্লা শহরে বিদ্যুৎ সরবরাহের ব্যবসাও ছিল তাঁর। বর্তমানে কুমিল্লা শহরের প্রাণকেন্দ্র কান্দিরপাড়ের যে লাল দালানটি পূবালী ব্যাংকের কার্যালয়, সেটিই একসময় ছিল কুমিল্লা ব্যাংকিং করপোরেশনের প্রধান কার্যালয়। ব্যাংকটির জন্য তখন এই ভবনটি বানানো হয়।
ব্রাহ্মণবাড়িয়া ও ঢাকাসহ কলকাতা, দিল্লি, লখনৌ, কানপুর, মুম্বাইসহ ভারতবর্ষের বিভিন্ন স্থানে কুমিল্লা ব্যাংকিং করপোরেশনের শাখা ছিল। এমনকি সুদূর লন্ডনেও ব্যাংকটির একটি শাখা খোলা হয়েছিল বলে জানান কুমিল্লার ইতিহাসবিদেরা। ব্যাংকটির প্রতিষ্ঠাকালীন প্রধান ব্যবস্থাপক ছিলেন কুমিল্লার আরেক সন্তান সুকুমার সেন। তখন কুমিল্লায় ব্যবসায়-বাণিজ্য সম্প্রসারণের একটি উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে। যেমন ১৯১৪ সালে প্রতিষ্ঠাকালে ব্যাংকটির পরিশোধিত মূলধন ছিল ২ হাজার ৫০০ টাকা। ১৯৪০ সালে ব্যাংকটির পরিশোধিত মূলধন বেড়ে দাঁড়ায় ৪০ লাখ টাকা। এটি ব্যাংকটির বিস্তৃত কার্যক্রমেরই নির্দেশক। ১৯৪৭ সালে দেশ ভাগের পর কুমিল্লা ব্যাংকিং করপোরেশনের সার্বিক পরিস্থিতি বদলে যায়।
১৯৫০ সালের ১৮ ডিসেম্বর বাঙালিদের আরও তিনটি ব্যাংকের সঙ্গে কুমিল্লা ব্যাংকিং করপোরেশনকে নিয়ে ভারতে গঠিত হয় ইউনাইটেড ব্যাংক অব ইন্ডিয়া। কুমিল্লার ব্যাংকটির মূল প্রতিষ্ঠাতা নরেন্দ্র চন্দ্র দত্ত ইউনাইটেড ব্যাংক অব ইন্ডিয়ার পরিচালক নিযুক্ত হন। ১৯৭২ সালে ত্রিপুরা হিতসাধিনী সভার শতবার্ষিকী উপলক্ষে ‘শাশ্বত ত্রিপুরা’ নামে একটি স্মারক সংকলন প্রকাশ করা হয়। এর একটি প্রবন্ধে বলা হয়, ‘আইনজীবী নরেন্দ্র চন্দ্র দত্ত তাঁর দৃঢ় সংকল্প ও অদম্য অধ্যবসায়ে কুমিল্লা ব্যাংকিং করপোরেশনকে অল্পকালের মধ্যে দৃঢ়ভিত্তিসম্পন্ন করে তুলতে সমর্থ হন।
কুমিল্লা শহরের বুকে নিজের বৈঠকখানায় যে ব্যাংকের তিনি পত্তন করেছিলেন, সেটির খ্যাতি নানা শাখা-প্রশাখার মধ্য দিয়ে বাংলার বাইরেও পরিব্যাপ্ত হয়। শেষ অবধি ১৯৫০ সালের ১৮ ডিসেম্বর এই ব্যাংক বিশাল রূপ নিল আরও তিনটি বাঙালি ব্যাংকের সঙ্গে মিলে। এই সংযুক্ত ব্যাংকেরই নাম ‘ইউনাইটেড ব্যাংক অব ইন্ডিয়া’। কলকাতা মহানগরীর প্রাণকেন্দ্র বিনয়-বাদল-দীনেশবাগ (ডালহৌসি স্কয়ার) এলাকায় যার সদর কার্যালয় মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে।’ ১৯২২ সালে দ্য কুমিল্লা ইউনিয়ন ব্যাংক লিমিটেড নামে আরেকটি ব্যাংকের সৃষ্টি হয়। এই ব্যাংকের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন বাংলার আইনসভার সদস্য ও ব্রাহ্মণবাড়িয়ার মেড্ডার অধিবাসী ইন্দুভূষণ দত্ত।
ব্যাংকটির প্রধান কার্যালয় কুমিল্লায় হলেও এর শাখা কার্যালয় সারা বাংলায় ছড়িয়ে–ছিটিয়ে ছিল। বর্তমানে কুমিল্লা শহরের মনোহরপুরে সোনালী ব্যাংকের যে করপোরেট কার্যালয়, সেখানেই ছিল কুমিল্লা ইউনিয়ন ব্যাংকের প্রধান কার্যালয়। ইন্দুভূষণ দত্তের মৃত্যুর পর তাঁর ভাই শান্তিভূষণ দত্ত কুমিল্লা ইউনিয়ন ব্যাংকের কর্ণধার হন এবং এর অগ্রযাত্রা অব্যাহত রাখেন। শান্তিভূষণ দত্ত বঙ্গীয় জাতীয় বণিক সভার সভাপতি ছিলেন। এ ছাড়া কলকাতার দায়িত্বশীল শেরিফের আসনও অলংকৃত করেন তিনি। শান্তিভূষণ দত্তের প্রচেষ্টায় দেশ ভাগের পর ১৯৫০ সালে ইউনাইটেড ব্যাংক অব ইন্ডিয়ার সঙ্গে একীভূত হয় কুমিল্লা ইউনিয়ন ব্যাংক।
ইন্দুভূষণ ও শান্তিভূষণের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের একটি যোগসূত্র আছে। তাঁদের বাবা কৈলাস দত্তের কুমিল্লা শহরের কৈলাস ভবনে ১৯২২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রাতরাশ করেছিলেন বলে জানা যায়। এই উপমহাদেশের ব্যাংকিং জগতের খ্যাতিমান পুরুষ নরেন্দ্র চন্দ্র দত্তের ছেলে বটকৃষ্ণ দত্তও বাবার পথ অনুসরণ করে ১৯৩২ সালে কুমিল্লায় নিউ স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংক নামে আরেকটি ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করেন। কুমিল্লার মহেশ প্রাঙ্গণের ছোট মোটর গ্যারেজ থেকে ব্যাংকটির জন্ম। পরে ব্যাংকটির শাখা কুমিল্লার পাশাপাশি সিলেট, ময়মনসিংহ, ফরিদপুর, টাঙ্গাইল, খুলনা, ঢাকা এবং কলকাতা, শিলচর, শিলং ও আসানসোলে ছিল।
দেশ ভাগের বছরখানেক আগে ১৯৪৬ সালে বটকৃষ্ণ দত্ত নিজের নিউ স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংককে তাঁর বাবার প্রতিষ্ঠিত কুমিল্লা ব্যাংকিং করপোরেশনের সঙ্গে একীভূত করেন। এর ফলে এই উপমহাদেশে ব্যাংকে ব্যাংকে মিলনের সূত্রপাত ঘটে। কুমিল্লা ব্যাংকিং করপোরেশন ও নিউ স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংকের সেই মহামিলনের ধারাবাহিকতায় পরবর্তীকালে ইউনাইটেড ব্যাংক অব ইন্ডিয়ার আবির্ভাব ঘটে। এই মিলনকেই এখন মার্জার বা একীভূত হওয়া বলে। প্রথম মহাযুদ্ধের (১৯১৪–১৯) পর থেকে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের আগ পর্যন্ত কুমিল্লার ব্যবসায়ীরা একাধিক ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করেন। কুমিল্লার ইতিহাসবিদদের সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে, ১৯২৩ সালে বেঙ্গল অ্যাসেম্বলির ডেপুটি স্পিকার অখিল দত্ত ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় পাইওনিয়ার ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করেন।
পরে ১৯২৬ সালে কুমিল্লায় ব্যাংকটির প্রধান কার্যালয় স্থানান্তর করা হয়। এখন কুমিল্লা শিক্ষা বোর্ড যেখানে, সেখানেই ছিল পাইওনিয়ার ব্যাংকের প্রধান কার্যালয়। দেশ ভাগের সময় এই ব্যাংকও বিলুপ্ত হয়। স্থানীয় ইতিহাসবিদেরা জানান, ১৯২৯ সালে ত্রিপুরা রাজপরিবারের পৃষ্ঠপোষকতায় ত্রিপুরা মডার্ন ব্যাংক প্রতিষ্ঠিত হয়। দেশ ভাগের সময় সেটিও বিলুপ্ত হয়ে যায়। এ ছাড়া ত্রিশের দশকে কুমিল্লায় অন্তত আরও আটটি ব্যাংক প্রতিষ্ঠিত হয়। ব্যাংকগুলোর মধ্যে রয়েছে—কমলাংক ব্যাংক, গান্ধেশ্বরী ব্যাংক, নিউ ওরিয়েন্ট ব্যাংক, রেডিয়েন্ট ব্যাংক, অ্যাসোসিয়েট ব্যাংক অব ইন্ডিয়া, ভারতী সেন্ট্রাল ব্যাংক, পিপলস কো–অপারেটিভ ব্যাংক।
কুমিল্লার ইতিহাসবিদ দের মতে কুমিল্লা একসময় ব্যবসা-বাণিজ্যে সমৃদ্ধ ছিল। কুমিল্লার সঙ্গে সারা দেশের নৌপথ ও রেলপথকেন্দ্রিক যাতায়াতও বেশ সহজ ছিল। তখন ধান, পাট, লবণ ও কাপড়ের ব্যবসা ছিল বেশ চাঙা। তাই বিংশ শতাব্দীর শুরু থেকেই কুমিল্লায় অনেক ব্যাংক প্রতিষ্ঠিত হয়। কেন ব্যাংকগুলো হারিয়ে গেল—এমন প্রশ্নের জবাবে স্থানীয় ইতিহাসবিদেরা জানান রমরমা ব্যবসা ছিল হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজন দের। অধিকাংশ ব্যাংকের মালিক ছিলেন হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজন। দেশভাগের পরে তাঁদের বেশির ভাগই কলকাতায় চলে যান। ফলে ব্যাংকগুলো বিলুপ্ত হয়।