গুপ্ত সাম্রাজ্য পতনের ইতিহাস

ভারতের প্রাচীন সাম্রাজ্য গুলির মধ্যে শ্রীগুপ্তের প্রতিষ্ঠিত গুপ্ত সাম্রাজ্য ছিল অন্যতম। শ্রী গুপ্ত ভারতের মৌর্য সাম্রাজ্যের পতনের কিছুকাল পরে বাংলা এবং বিহারের বেশ কিছু অংশ নিয়ে গুপ্ত সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। কিন্তু দীর্ঘ সময় পর্যন্ত গুপ্ত সাম্রাজ্যের অস্তিত্ব থাকার পর জীবিত গুপ্তের মৃত্যুর পর আনুমানিক ৫০০ খ্রীষ্টপূর্বাব্দে গুপ্ত সাম্রাজ্যের পতন ঘটেছিল।
গুপ্ত সাম্রাজ্যের এই পতনের পেছনে মূলত একাধিক কারণ ছিল। তাহলে জেনে নেওয়া যাক এই কারণগুলো সম্পর্কে। আঞ্চলিক সমস্যা- সাধারণভাবেই অন্যান্য গুপ্ত সাম্রাজ্যের মত গুপ্ত সাম্রাজ্যের আয়তন বিরাট ছিল। এবং সেই বিরাট আয়তনের সাম্রাজ্যকে সঠিকভাবে পরিচালনা করার জন্য গুপ্ত সাম্রাজ্যের সম্রাটরা বিভিন্ন প্রদেশে একজন করে শাসনকর্তা অথবা সামন্তপ্রভু নিয়োগ করতেন।
অনেক সময় গুপ্ত সাম্রাজ্যের সম্রাটরা রাজ্য জয় করে সেটা দখলের বদলে রাজাকে নিয়মিত কর প্রদানের বিনিময় ফিরিয়ে দিতেন। কিন্তু সমুদ্রগুপ্তের পরবর্তীকালে গুপ্ত সাম্রাজ্যের অন্যান্য সম্রাটের আমলে সেই সমস্ত প্রাদেশিক শাসনকর্তা যথেষ্ট শক্তিশালী হয়ে ওঠে। এবং তাদের নিয়ন্ত্রণে থাকা রাজ্যগুলিও অনেক ক্ষেত্রেই তাদের শর্ত বাতিল করে স্বাধীনভাবে অবস্থান করে গুপ্ত সাম্রাজ্য থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়।
অযোগ্য উত্তরাধিকার- যেকোনো সাম্রাজের পতনের পিছনে যোগ্য সম্রাট বা শাসনকর্তার অভাব বিশেষ লক্ষণীয়। গুপ্ত সাম্রাজ্যের ক্ষেত্রেও দুর্বল এবং অযোগ্য উত্তরাধিকার সাম্রাজ্যের পতনের পিছনে ভীষণভাবে দায়ী ছিল। গুপ্ত সাম্রাজ্যের শ্রেষ্ঠ সম্রাটদের মধ্যে স্কন্দগুপ্ত ছিলেন শেষ সম্রাট। তার পরবর্তী কালে যে সমস্ত সম্রাটরা গুপ্ত সাম্রাজ্যের হাল ধরেছিলেন,তারা মূলত কোনো দিক থেকেই সাম্রাজ্যের যোগ্য শাসক ছিলেন না।
যার ফলে গুপ্ত সাম্রাজ্যের প্রাদেশিক বিচ্ছিন্নতা যখন মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে, তখন তারা তা নিয়ন্ত্রণে রাখার ক্ষেত্রে সক্ষম ছিলেন ন। এছাড়াও বিভিন্ন বৈদেশিক আক্রমণও তারা প্রতিহিত করতে পারেননি। ফলে এসব কারণে গুপ্ত সাম্রাজ্যের পতন ঘটেছিল। আর্থিক সংকট- আর্থিক সংকট গুপ্ত সাম্রাজ্যের পতনের আর একটি কারণ। খ্রিস্টীয় চতুর্থ ও পঞ্চম শতকে বর্বর হুন আক্রমণে রােম ছন্নছাড়া হলে ভারত-রােম রেশমবাণিজ্য বন্ধ হয়। ভূমি ও অন্যান্য। রাজস্বের হারও কমেছিল।
সঠিক ভূমিদান ব্যবস্থা না থাকা- গুপ্ত সাম্রাজ্যের সম্রাটরা মূলত যে সমস্ত জমি কোনো ব্রাহ্মণ, পণ্ডিতকে বা কোনো মন্দিরকে অগ্রহার ব্যবস্থার মাধ্যমে জমি দান করতেন? তার উপর থেকে তাদের সমস্ত কর্তৃত্ব উঠে যেত। এছাড়াও যেসব প্রাদেশিক শাসনকর্তাকে জমি দান করা হতো, সেখানেও তারা নিজেদের কর্তৃত্ব স্থাপন করে। এভাবে সাম্রাজ্যের সম্পদের পরিমাণ কমতে থাকে এবং এটাও গুপ্ত সাম্রাজ্যের পতনের একটি কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
হূন আক্রমণ- গুপ্ত সাম্রাজ্যের শ্রেষ্ঠ সম্রাট স্কন্দ গুপ্তের আমলে গুপ্ত সাম্রাজ্যে বারংবার বৈদেশিক হূনদের আক্রমণ দেখা যায়। স্কন্দগুপ্ত বারবার হূনদের আক্রমণ প্রতিহত করতে করতে বিপুল পরিমাণ অর্থ সম্পদের ক্ষয় করে ফেলেন। স্কন্দগুপ্ত একজন যোগ্য বীর হওয়ায় হূনরা প্রত্যক্ষভাবে গুপ্ত সাম্রাজ্যের কোনো ক্ষতি না করতে পারলেও পরোক্ষভাবে গুপ্ত সাম্রাজ্যের ক্ষতি করে গিয়েছিল।
কারণ তাদের আক্রমণ প্রতিহত করতে করতে গুপ্ত সাম্রাজ্যের যে পরিমাণ অর্থ সম্পদের হয়েছিল, তা অনেকাংশেই গুপ্ত সাম্রাজ্যের পতন ডেকে এনেছিল। অযোগ্য মন্ত্রীদের নিয়োগ- গুপ্ত সাম্রাজ্যের শাসন ব্যবস্থায় মন্ত্রীদের একটি বিশেষ ভূমিকা ছিল। গুপ্ত সাম্রাজ্যের মন্ত্রী নিয়োগের প্রক্রিয়াটি ছোট বংশানুক্রমিক। অর্থাৎ মন্ত্রীর পূত্র মন্ত্রী পদেই নিয়োগ হবে। এই প্রথা প্রচলিত থাকায় গুপ্ত সাম্রাজ্যের রাজকার্যে বা সাম্রাজ্য পরিচালনার ক্ষেত্রে যে সমস্ত মন্ত্রী ছিলেন, পরবর্তীকালে তাদের অযোগ্য সন্তানরাও সেই একই পদে নিয়োগ হয়ে যেত।