বাইসাইকেলের কে গতির ভারসাম্য

সাইকেল চড়া শিখতে গিয়ে ভারসাম্য হারিয়ে পড়ে যাওয়ার অভিজ্ঞতা প্রায় সকলেরই আছে। সাইকেল একটা অদ্ভুত দু’চাকার গাড়ি যে সাবলীলভাবে আপনাকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারে কিন্তু পা না ঠেকিয়ে চুপচাপ দাঁড়াতে পারে না। সাইকেলের ভারসাম্য রক্ষিত হয় কীভাবে সেই প্রশ্ন অনেকের মনেই জেগেছে কিন্তু এর সহজ সরল উত্তর এখনও সেইভাবে পাওয়া যায়নি।
সাইকেলের ভারসাম্য নিয়ে বিজ্ঞানী মহলে রয়েছে বিভিন্ন থিয়োরি – বিভিন্ন মতামত। এর মধ্যে সর্বজনগ্রাহ্য মতামত এখানে তুলে ধরার চেষ্টা করব। সারা পৃথিবীতে প্রতি বছর প্রায় ১৩০ মিলিয়ন সাইকেল প্রস্তুত করা হয়। এতো জনপ্রিয় এই মেশিন চালকের পেডালে দেওয়া শক্তির প্রায় ৯০%কেই গতিশক্তিতে রূপান্তরিত করে। এই যান্ত্রিক সুবিধা (efficiency) অন্যান্য অনেক উন্নত পেট্রোল বা ডিজেল চালিত গাড়ির থেকেও বেশি, তাই পরিবহন জগতে পরিবেশ বান্ধব, এফিসিয়েন্ট বাহন হিসেবে সাইকেলের এখনও অবধি কোন বিকল্প সেইভাবে পাওয়া যায়নি।
তবে আমরা এখানে আলোচনা করব গতিশীল সাইকেলের ভারসাম্য নিয়ে কেননা আমরা সকলেই দেখেছি সাইকেলকে স্থির রাখলে পড়ে যায় – অথচ বেশ জোরে ঠেলে দিলে সাইকেল বেশ কিছুটা সোজা এগিয়ে গিয়ে যখন বেগ কমে আসে তখন পড়ে যায়। আর চালক যখন গতিশীল রাখে তখন সাইকেল তার ভারসাম্য বজায় রাখে। সাইকেলের ভারসাম্যের জন্য কিছুদিন আগে অবধিও প্রচলিত দুটি মত ছিল।
এর মধ্যে সর্বাধিক প্রচলিত মতে সাইকেলের ভারসাম্যের জন্য চাকার ঘূর্ণনের জন্য তৈরি হওয়া জাইরোস্কোপিক প্রভাবই (gyroscopic effect) প্রধান কারণ। জাইরোস্কোপিক ক্রিয়ার অর্থ ঘূর্ণায়মান চাকা এর পূর্ববর্তী অবস্থান বজায় রাখার চেষ্টা করবে। একটা চুড়ি সোজা দাঁড় করানোর চেষ্টা করলে কিন্তু পড়ে যাবে। এবার এটাকে একটু গড়িয়ে দিলে এগিয়ে যাবে, গতি থাকাকালীন পড়বে না।
কিন্তু বর্তমান মতে জাইরোস্কোপিক ক্রিয়াই এক মাত্র নয় বরং সাইকেলকে ভারসাম্যে রাখতে এই ক্রিয়ার প্রভাব সামান্যই বলে মনে করা হয়। ট্রেইল (Trail) জাইরস্কোপিক প্রভাবের জন্য যে সাইকেলের ভারসাম্য রক্ষিত হয় না তা প্রমাণ করেছিলেন ডেভিড জোন্স (David Jones) ১৯৭০ সালে। তিনি এর বদলে ‘কাস্টার থিয়োরি’ (Caster Theory) দিয়ে সাইকেলের ভারসাম্য ব্যাখা করেছিলেন।
এই থিয়োরি অনুযায়ী ট্রেইল (Trail) এর মানের উপর ভারসাম্য নির্ভর করে। ট্রেইল বলতে বোঝায় সাইকেলের চাকা যে বিন্দুতে ভূমি স্পর্শ করেছে সেখান থেকে মূল অক্ষ যেখানে শেষ হয়েছে সেই দূরত্বটা। সহজে বললে, আমরা যে স্টিয়ারিং দিয়ে সাইকেলের সামনের চাকা ঘুরাই মানে স্টিয়ারিং বরাবর সোজাসুজি একটা দাগ টানুন (বাঁকানো অংশটা বাদ দিয়ে), ছবিতেই দেখুন লাল দাগ দিয়ে দেখানো হয়েছে।
এই দাগ টা টানা হয়ে গেলে আরো একটা দাগ টানুন চাকার কেন্দ্র থেকে অর্থাৎ যেখানে চাকার নাট লাগানো থাকে সেখান থেকে ভুমি বরাবর সোজাসুজি। দুইটি দাগের মাঝে একটি দূরত্ব পাবেন, এই অল্প দূরত্বই ট্রেইল। এই ট্রেইলই সাইকেলকে ভারসাম্য রক্ষা করতে সাহায্য করে। ট্রেইলের পরিমাণ কমলে ভারসাম্য কমবে।
সাইকেল চালানো শেখার সময় হ্যান্ডেল কাঁপে বলে এই ট্রেইল এর পরিমাপ কমেযায় ও ভারসাম্য রক্ষা করতে সমস্যা হয়। সাইকেলের হ্যান্ডেল সোজা করে রেখে চালালে ভারসাম্য সহজে রক্ষিত হয় এটা আমরা সকলেই দেখেছি। তবে এই কাস্টার থিয়োরিও ভুল বলে প্রমানিত হয় পরে। হ্যাঁ এ কথা ঠিক, জাইরোস্কোপিক ক্রিয়া সাইকেলকে কিছুটা ভারসাম্য দেয় ও কাস্টার ট্রেইলের পরিমাণ থেকে সাইকেল চালানো কতটা সহজে হবে তা নির্ণয় করা যায় তবে সাইকেলের নিজস্ব ভারসাম্য রক্ষায় অনেকগুলি বিষয়ের উপর নির্ভর করে।
২০০৭ সালে নটিংহাম বিশ্ববিদ্যালয়ের (Nottingham University) জে পি মেইজার্ড (J.P. Meijaard) ঘোষণা করেন যে সাইকেলের এই ভারসাম্য রক্ষার রহস্য উন্মোচন করেছেন তাঁরা – তবে তা বেশ কিছু জটিল গাণিতিক সমীকরণের মাধ্যমে। তাঁদের সেই থিসিস রয়্যাল সোসাইটির জার্নালে প্রকাশিত হয় – ‘Linearized dynamics equations for the balance and steer of a bicycle: a benchmark and review’ by J. P. Meijaard, J. M. Papadopoulos, A. Ruina, and A. L. Schwab. Proceedings of the Royal Society, 8 August 2007।
তাঁদের এই থিসিস অনুযায়ী কোন একটি সাধারণ ব্যাখ্যা দ্বারা সাইকেলের ভারসাম্য কীভাবে রক্ষিত হয় বলা সম্ভব নয়। তাঁরা ২৫ টি প্যারামিটার নিয়ে এই ভারসাম্য ব্যাখ্যা করেছেন যার মধ্যে জাইরোস্কোপিক প্রভাব, ট্রেইলিং এক্সিস, সাইকেলের চাকার উপর ভরের বিস্তার, চলন্ত অবস্থায় যে যে বল প্রযুক্ত হয় অর্থাৎ চালক সহ সাইকেলের ওজন, সাইকেলের টায়ার ও রাস্তার মধ্যে ঘর্ষণ বল, বাতাসের বিরুদ্ধ বল, প্যাডেলে প্রযুক্ত বল ইত্যাদির প্রভাব আছে। অর্থাৎ অনেকগুলো বলের সূক্ষ্ম নিয়ন্ত্রণের দ্বারাই সাইকেল চালককে নিয়ে নিরাপদে এগিয়ে যেতে পারে।