আমরা স্পর্শ বুঝি কীভাবে

আমাদের পঞ্চেন্দ্রিয়ের একটি হল ত্বক। ত্বক আমাদের দেহের আভ্যন্তরীণ অংশ ও পরিবেশগত আঘাত থেকে দেহকে রক্ষা করে। ত্বকের স্পর্শ অনুভূতি উষ্ণতা, আর্দ্রতাসহ পরিবেশের সমস্ত তথ্য মস্তিষ্কে সরবরাহ করে। এই স্পর্শ অনুভুতি আমাদের ব্যথা অনুভব করিয়ে বিভিন্ন বিপদ থেকে দেহকে রক্ষা করে। ত্বকের সাহায্যে স্পর্শ অনুভূতি তো বুঝি কিন্তু আমরা এই স্পর্শ বুঝি কীভাবে?
এই নিবন্ধে আমরা স্পর্শ বুঝি কীভাবে সেই বিষয়ে আলোচনা করা হল। আমরা স্পর্শ বুঝি কীভাবে বোঝার আগে বুঝে নিতে হবে ত্বকের গঠন – ত্বক অনেকগুলি স্তর নিয়ে গঠিত (চিত্র -১), যথা – ১) এপিডার্মিস (Epidermis): এটি ত্বকের বহিঃস্তর। মৃত কোষ দিয়ে তৈরী জলরোধী, প্রতিরক্ষামূলক এই স্তরটি শরীরের অন্যান্য অংশগুলিকে বাইরের আঘাত থেকে রক্ষা করে।
এই স্তরে উপস্থিত মেলানিন সূর্যের ক্ষতিকারক অতিবেগুনী রশ্মি থেকে দেহকে রক্ষা করে। ত্বকের বর্ণের জন্য মেলানিন দায়ী। এপিডার্মিস স্তরে স্পর্শ সংবেদী কোষ থাকে। এই কোষগুলি দেহ যে পরিবেশে রয়েছে তার তথ্য মতিষ্কে প্রেরণ করে।২) ডার্মিস (Dermis): এটি ত্বকের দ্বিতীয় স্তর। এই স্তরে লোম রন্ধ্র (Hair Follicle), ঘর্ম গ্রন্থি (Sweat Gland), তৈল গ্রন্থি (Sebaceous Gland), রক্তবাহী নালী, স্নায়ু সমাপ্তি (Nerve endings) এবং বিভিন্ন স্পর্শ গ্রহণকারী কোষ থাকে।
এপিডার্মিস স্তরকে পুষ্টি জোগানো, এপিডার্মিস স্তরের মৃত ক্ষতিগ্রস্ত কোষগুলিকে এপিডার্মিস ও ডার্মিস মধ্যে অবস্থিত নতুন কোষ দিয়ে প্রতিস্থাপিত করা এর প্রধান কাজ। এছাড়াও ঘর্ম গ্রন্থি ও তৈল গ্রন্থিগুলির নিঃসরণের মাধ্যমে শরীরে উৎপন্ন বর্জ্য পদার্থগুলিকে এপিডার্মিসে অবস্থিত ছিদ্রের মাধ্যমে দেহ থেকে নির্গত করা। ৩) সাবকিউটেনিয়াস(Subcutaneous): এটি ত্বকের একদম ভিতরের স্তর যা মেদ (fat) ও সংযোজী কলা (connective tissue) দিয়ে তৈরি।
ফ্যাটের স্তরটি দেহের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ করতে সাহায্য করে ও একটি কুশনের কাজ করে দেহকে বাইরের আঘাত থেকে রক্ষা করে। সংযোজী কলা পেশী ও টেন্ডনের সাথে ত্বককে সংযুক্ত রাখতে সাহায্য করে। চিত্র -১ আমাদের স্পর্শ অনুভূতিটি ত্বকে উপস্থিত স্নায়ু সমাপ্তির (Nerve Ending) নেটওয়ার্ক ও স্পর্শ গ্রাহক (Touch Receptor) দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়। একে সোমাটোসেন্সরি সিস্টেম (Somatosensory System) বলে। এই সিস্টেমটি ঠান্ডা, গরম, মসৃণ, রুক্ষ, চাপ, ব্যথা প্রভৃতি অনুভূতিগুলি নিয়ন্ত্রণ করে।
সোমাটোসেন্সরি রিসেপ্টর চার প্রকার- মেকানোরিসেপ্টর, থার্মোরিসেপ্টর, পেন রিসেপ্টর, প্রপ্রিওসেপ্টর। স্পর্শ রিসেপ্টরটি উদ্দীপনা পরিবর্তনেই সাথে সাথে দ্রুত হারে অভিযোজিত হয়। অর্থাৎ কোন বস্তুকে কখন স্পর্শ করতে হবে আর কখন ছাড়তে হবে তা দ্রুত অনুভব করে এই রিসেপ্টরটি। তবে দ্রুত অভিযোজিত রিসেপ্টরগুলি ত্বকে স্পর্শকারী কোনো উদ্দীপনার ধারাবাহিকতা ও সময়কাল (অর্থাৎ ত্বক বস্তুটিকে কতক্ষন স্পর্শ করে আছে ) বুঝতে পারে না। এই রিসেপ্টরগুলি ত্বকের ভিতরে ও বাইরের কম্পনকে সবচেয়ে ভালো বুঝতে পারে।
স্পর্শ রিসেপ্টরগুলি যখন কোনো উদ্দীপনায় ধীরে সাড়া দেয় তখন বলা হয় সেটি ধীরে ধীরে অভিযোজিত হচ্ছে। ধীরে ধীরে অভিযোজিত হয় যে রিসেপ্টরগুলি সেগুলি ত্বকে প্রযুক্ত চাপ অনুভূতিটি ভাল বুঝতে পারে। কিন্তু কখন এই উদ্দীপনাটি শুরু বা শেষ হয় তা বুঝতে পারে না। ১. মেকানোরিসেপ্টর (Mechanoreceptor): এই রিসেপ্টরগুলি চাপ, কম্পন, বস্তুর গঠনের মতো সংবেদনগুলি উপলব্ধি করে।
চার ধরণের মেকানোরিসেপ্টর রয়েছে যাদের মুখ্য কাজ হল ক্ষত ও চাপের মতো সংবেদনগুলি উপলব্ধি করা। এগুলি হল – মার্কেলের ডিস্ক, মেসনারের কর্পাসল, রুফিনির কর্পাসল, প্যাসিনিয়ান কর্পাসল। সবচেয়ে সংবেদনশীল মেকানোরিসেপ্টর হলো মার্কেলের ডিস্ক ও মেসনারের কর্পাসল। এগুলি ডার্মিস ও এপিডার্মিসের একেবারে উপরের স্তরে অবস্থিত। হাতের তালু, ঠোঁট, জিহ্বা, পায়ের পাতা, অঙ্গুলীর উর্ধ্বাংশ, চোখের পাতা এবং মুখের মতো মসৃণ ও প্রায় রোমবিহীন অংশে মার্কেলের ডিস্ক ও মেসনারের কর্পাসল থাকে।
মার্কেলের ডিস্ক খুব ধীরে ধীরে ও মেসনারের কর্পাসল খুব দ্রুত অভিযোজিত হয়। আমরা কোনো বস্তুকে স্পর্শ করলে তার প্রকৃতি ও কতক্ষণ ধরে তা স্পর্শ করে আছি তা এই দুটি রিসেপ্টরের মাধ্যমে বোঝা যায়। আমাদের অঙ্গুলিতে প্রচুর পরিমানে এই দুটি উচ্চ সংবেদনশীল মেকানোরিসেপ্টর থাকে। তাই আমরা যখন কোনো বস্তুকে আঙুল দিয়ে স্পর্শ করি আমাদের মস্তিষ্কে ওই বস্তুটি সম্পর্কে একটি বিস্তারিত তথ্য প্রেরিত হয়। ডার্মিসের গভীর অংশে, সন্ধি, টেন্ডন, পেশিতে রুফিনির কর্পাসল ও প্যাসিনির কর্পাসল অবস্থিত।
এই মেকানোরিসেপ্টরগুলি অস্থি ও টেন্ডনের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত কম্পন, অঙ্গপ্রত্যঙ্গের চক্রাকার গতি, ত্বকের প্রসারণশীলতার মতো সংবেদগুলি অনুভব করতে পারে। এটি আমাদের হাঁটা চলা, বল খেলার মতো শারীরিক ক্রিয়াকলাপগুলিতে সহায়তা করে। ২. থার্মোরিসেপ্টর (Thermoreceptor): ত্বকের ডার্মিস স্তরে অবস্থিত এই রিসেপ্টরগুলির মাধ্যমে বস্তুর তাপমাত্রা অনুভুত হয়।
থার্মোরিসেপ্টর দুই প্রকার – উষ্ণ (Hot) ও শীতল(cold) রিসেপ্টর। ত্বকের উপরিভাগের তাপমাত্রা যখন ৯৫ ডিগ্রী ফারেনহাইটের নিচে নেমে যায়, শীতল রিসেপ্টরগুলি শীতল সংবেদন অনুভব করতে শুরু করে। ত্বকের উপরিতলের তাপমাত্রা যখন ৭৭°F থাকে তখন শীতল রিসেপ্টরগুলি সবচেয়ে বেশি উদ্দীপ্ত হয় আর ৪১°F এর নিচে নেমে গেলে এই রিসেপ্টরগুলি উদ্দীপ্ত হতে পারে না।
এই কারণেই দীর্ঘ সময় বরফের মধ্যে হাত বা পা অসাড় হয়ে যায়। ত্বকের উপরিতলের তাপমাত্রা যখন ৮৬°F এর বেশি থাকে তখন উষ্ণ রিসেপ্টরগুলি উদ্দীপ্ত হতে শুরু করে ১১৩°F-এ সবচেয়ে বেশি উদ্দীপ্ত হয়। ১১৩°F-এর উর্দ্ধে যখন তাপমাত্রা চলে যায় তখন ব্যাথা রিসেপ্টরগুলি এই উদ্দীপনা গ্রহণ করে ও ত্বকের অন্তর্বর্তী কলাগুলিকে ক্ষতি হওয়া থেকে বাঁচায়। থার্মোরিসেপ্টরগুলি সারা দেহেই ছড়িয়ে থাকে। শীতল রিসেপ্টরগুলির ঘনত্ব উষ্ণ রিসেপ্টরের থেকে বেশি হয়।
তবে থার্মোরিসেপ্টরগুলি সারা শরীরে ছড়িয়ে থাকলেও মুখমন্ডল ও কানে সবচেয়ে বেশি ঘনত্বে থাকে। তাই খুব ঠান্ডায় আমাদের নাক ও কান আগে ঠান্ডা হয়ে যায়। ৩. পেন রিসেপ্টর (Pain receptor): এই রিসেপ্টরের বিজ্ঞানসম্মত নাম হল নসিরিসেপ্টর(Nocireceptor)। এই রিসেপ্টরগুলি ত্বকের ব্যথা উদ্দীপনাগুলি সনাক্ত করে ত্বক ও অন্য কলাগুলিকে ক্ষতির হাত থেকে বাঁচায়। শরীরের বিভিন্ন অংশ জুড়ে যেমন ত্বক, পেশী, হাড়, রক্তনালী ইত্যাদি অংশে ত্রিশ মিলিয়নেরও বেশি পেন রিসেপ্টর থাকে।
বিভিন্ন যান্ত্রিক উদ্দীপনা (কেটে যাওয়া বা Scrap), তাপীয় উদ্দীপনা(পোড়া), রাসায়নিক উদ্দীপনা (পোকার হুলের বিষ) দ্বারা সৃষ্ট ব্যথা সনাক্ত করতে পারে। এই রিসেপ্টরগুলি তীব্র ব্যাথা অনুভূতি সৃষ্টির মাধ্যমে ক্ষতিকারক উদ্দীপনা যেমন ভাঙা কাঁচের টুকরো, গরম স্টোভের উত্তাপ থেকে দ্রুত সরে যাবার নির্দেশ দেয়। দেহের কোনো অংশে যদি আঘাত লাগে পেন রিসেপ্টরগুলি সেই স্থানে মৃদু ব্যাথার অনুভূতি সৃষ্টি করে যাতে ওই স্থানটি সেরে যাওয়া অব্দি আমরা ব্যবহার না করি। ব্যাথার সংকেত মস্তিষ্কে পাঠিয়ে এই রিসেপ্টরগুলি দেহের প্রতিরক্ষায় এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেয়।
৪. প্রোপ্রিওসেপ্টর (Proprioceptor): ল্যাটিন ভাষায় ‘প্রোপ্রিয়াস’ শব্দের অর্থ হলো “একান্ত নিজস্ব” এই রিসেপ্টরের মাধ্যমে শরীরের অঙ্গপ্রত্যঙ্গগুলি একে অন্যের সাপেক্ষে ও পার্শ্ববর্তী পরিবেশের সাপেক্ষে শরীরের অবস্থান নিয়ন্ত্রণ করে। টেন্ডন, পেশী, পেশীসন্ধিতে এই রিসেপ্টরগুলি পাওয়া যায়। প্রোপ্রিওসেপ্টরগুলি প্রয়োজনে উদ্দীপ্ত হলে টেন্ডন, পেশী, পেশীসন্ধি সংকুচিত প্রসারিত হয়ে আমাদের নিত্যপ্রয়োজনীয় কাজগুলি করতে সাহায্য করে। যেমন জামা পড়া, খাওয়াদাওয়া করা ইত্যাদি।
এই প্রোপ্রিওসেপশন এর মাধ্যমে পায়ের দিকে না তাকিয়ে হাঁটতে পারি বা অন্যান্য কাজ করতে পারি। এরপর আমরা জেনে নেবো স্পর্শ অনুভূতিটি কোন পথে মস্তিষ্কে যায় এবং তার উত্তর পাওয়া যায়।প্রতিটি সেন্সরি রিসেপ্টর বিশেষ প্রকারের স্পর্শে সাড়া দিলেও তাদের সাড়া দেওয়ার পদ্ধতিটি কিন্তু একই প্রকার। রিসেপ্টরগুলি প্রথমে একটি অ্যাকশন পোটেনশিয়াল তৈরী করে। অ্যাকশন পোটেনশিয়াল হলো যখন নিউরোন বা স্নায়ুকোষগুলি কোনো সংকেত নার্ভাস সিস্টেমে প্রেরণ করে।
মস্তিষ্ক ও সুষুম্নাকান্ড উভয় স্থানে নিউরোনগুলি সংকেত প্রেরণ করে। আমরা যখন কোনো বস্তুকে স্পর্শ করি তখন ত্বকের মেকানোরিসেপ্টরগুলি উদ্দীপ্ত হয়। পরপর কতগুলি প্রক্রিয়া চলতে থাকে। আমরা বস্তুর যে অংশটি স্পর্শ করে থাকি সেই অংশের সাথে সংলগ্ন নিউরোনগুলিতে প্রথমে সংকেত যায়। ওই সংকেত পরবর্তী নিউরোনে স্থানান্তরিত হয়।
যতক্ষণ না ওই সিগন্যাল মস্তিষ্কে পৌঁছায় ততক্ষণ পর্যন্ত এই স্থানান্তকরণ প্রক্রিয়াটি চলতে থাকে। মস্তিষ্কে এবার ওই সংকেতের বিশ্লেষণ শুরু হয়। বিশ্লেষণ সম্পূর্ণ হলে মস্তিষ্ক উক্ত স্পর্শস্থলকে নির্দেশ দেয় পরবর্তী কাজ করার জন্য। তখনই আমরা স্পর্শ অনুভূতিটির স্বরূপ ও প্রকৃতি বুঝতে পারি। পঞ্চেন্দ্রিয় অর্থাৎ চোখ, কান ইত্যাদি দিয়ে দেখা, শোনা ইত্যাদি কীভাবে হয় সেই সম্পর্কে আমরা এই লিঙ্কে জেনেছি, এই নিবন্ধে স্পর্শ বুঝি কীভাবে তা জানা গেল।