বড়দিনে ক্রিসমাস ট্রির কি গুরুত্ব জেনে নিন

আজবাংলা বড়দিনে ক্রিসমাস ট্রি তো অনেকেই দেখেছেন। সবুজ গাছে হরেক রকম জিনিস ঝোলানোর পরে যখন লাইটগুলো জ্বলে আর নেভে, তখন পুরো গাছটাকে দেখতে অদ্ভুত সুন্দর লাগে। আপেল, পাখি, মোমবাতি, ঘুঘু, মাছ, ফুল, ফল আর স্বর্গদূত দিয়ে ক্রিসমাস ট্রি সাজানোর মজাটাই আলাদা।
নানা রঙের আলোয় সাজানো এই ক্রিসমাস ট্রির প্রচলন কিন্তু একদিনে হয়নি কিংবা বলা যায় শুরু থেকে ছিলও না। তবে কীভাবে হলো এর প্রচলন? চলুন জেনে আসি ক্রিসমাস ট্রির আদিকথা। ক্রিসমাসে যতটা মজা হয়, তার অনেকটাই কিন্তু জুড়ে থাকে এই ক্রিসমাস ট্রি সাজানো। ক্রিসমাস ট্রি হিসেবে যে গাছটি সবচেয়ে বেশি ব্যবহার করা হয়, সেটি হলো ফার গাছ।
এটি মূলত দেবদারুজাতীয় গাছ। এই গাছেই বিভিন্ন রঙের আলোকসজ্জা আর বিভিন্ন দ্রব্যে সাজিয়ে রাখা হয়। ক্রিসমাস ট্রি সত্যিকারের হতে পারে আবার সেটি কৃত্রিমও হতে পারে। প্রথমদিকে এটি কেবল রাজদরবারের বিষয় ছিল। পরে অবশ্য সবার মধ্যেই এই ট্রি সাজানোর প্রথাটি ছড়িয়ে পড়তে শুরু করে।
ক্রিসমাস ট্রিতে আলোর ব্যবহার ছাড়াও বিভিন্ন অর্নামেন্ট দিয়ে সাজানো হয়। এই গাছের ওপরে একটি তারা বা স্বর্গদূত বসানো হয়। এই স্বর্গদূতটি বেথেলহেমে জন্ম নেওয়া যিশুখ্রিস্টের প্রতীক। জানা যায়, ১৬ শতকে জার্মানিতে ক্রিসমাসের এই ট্রি সাজানোর প্রচলন হয়েছিল। তবে ক্রিসমাস ট্রিকে সাজানোর এই বিষয়টি কোথায় থেকে কেমন করে এলো সেটি কেউই স্পষ্ট বলতে পারে না।
ইউরোপের ঐতিহ্যের সঙ্গেই জড়িয়ে আছে ক্রিসমাস ট্রি সাজানোর শুরুটা। খ্রিস্টান লোক বিশ্বাস অনুসারে, ক্রিসমাস ট্রির ঐতিহ্য জড়িয়ে আছে জার্মানির গেইসমার শহরের এক সাধু বনিফেস এর সঙ্গে। সেইন্ট বনিফেস (৬৭২-৭৫৪ সালে) একটি প্রাচীন ওক গাছের মূলে একটি দেবদারু জাতীয় ফার গাছের বেড়ে ওঠা দেখতে পেয়েছিলেন। তিনি এটাকে যিশুখ্রিস্টের প্রতি বিশ্বাসের চিহ্ন হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেন।
তবে আপনারা যে প্রথায় ক্রিসমাস ট্রি সাজান, সেটি অবশ্য বেশি দিনের পুরোনো নয়। এই প্রথাটির প্রচলন করেছিলেন মার্টিন লুথার। স্বর্গোদ্যানের ট্রি অফ লাইফ-এর চিহ্ন হিসেবে এই প্রথার প্রচলন করেন তিনি। খ্রিস্টান ধর্ম প্রচলনের বেশ আগে গল দেশের (এখন ফ্রান্স) মানুষ বরফ পড়া শীতের দিনগুলোতে চিরহরিৎ (চিরসবুজ) গাছগুলো নানাভাবে সাজিয়ে ও গুছিয়ে রাখত।
শুধু তা-ই নয়, তাদের ঘরের দরজা-জানালায় ঝুলিয়ে রাখা হতো এসব গাছের ডালপালা। ইউরোপের অনেক দেশে প্রচলিত ধারণাই ছিল ডাইনি, ভূতপ্রেত, দুষ্ট আত্মা, রোগ-বালাইয়ের রক্ষাকবচ হিসেবে কাজ করে এসব চিরসবুজ গাছ। প্রাচীন রোমানরা কৃষিদেবতার সম্মানে একধরনের উৎসব করে থাকত।
তাতে তারা নিজের বাড়িঘর আর মন্দিরগুলোকে চিরসুবজ গাছের ডালপালা দিয়ে সাজাত। এমনকি ভাইকিংরাও তাদের সূর্যদেবতা ভালদার প্রিয় গাছ হিসেবে বিবেচ্য করত এসব গাছকে। বড়দিনে ক্রিসমাস ট্রির প্রচলনের কৃতিত্বটা দিতে হবে জার্মানদের।
১৬ শতকের দিকে শুরু হয়েছিল এই ধারা। তখন থেকে এই গাছগুলোকে পিরামিডের মতো করে সাজানো শুরু হয়। সে সময়ের এক প্রটেস্ট্যান্ট সংস্কারক মার্টিন লুথার প্রথমবারের মতো মোমবাতি দিয়ে গাছকে সুসজ্জিত করা শুরু করেন। তিনি এতে ছোট ছোট তাঁরাও সংযোজন করেন।
১৮৩০ সালের দিকে জার্মান বসতি স্থাপনকারীদের হাত ধরেই যুক্তরাষ্ট্রে ক্রিসমাস ট্রির প্রচলন হয়। যদিও শত বছর আগে থেকেই যুক্তরাষ্ট্রের জার্মান অভিবাসীরা নিজের ঘরে এই গাছ সাজিয়ে বড়দিন উদযাপন করত। ১৮৪০ সালের দিকে এসেও এটি পৌত্তলিক ধর্মের অংশ হিসেবেই দেখা হতো। অনেক আমেরিকানই এটিকে সেভাবে গ্রহণ করেননি।
তাহলে ক্রিসমাস ট্রি জনপ্রিয় হলো কবে? এর পুরো কৃতিত্ব যুক্তরাজ্যের রানি ভিক্টোরিয়ার। ১৮৪৮ সালের বড়দিনের আগে রানি তাঁর জার্মান স্বামী প্রিন্স অ্যালবার্টকে আবদার ধরে বলেন, ছেলেবেলায় বড়দিনে যেভাবে গাছ সাজানো হতো, সেভাবে যেন তিনি এবার একটা গাছকে সাজান।
প্রিন্স অ্যালবার্ট জার্মান স্টাইলে সবুজ একটা গাছকে বিভিন্ন ধরনের মিষ্টি, মোমবাতি ও অলংকার দিয়ে সাজালেন। সেই গাছের ছবি লন্ডনের বিভিন্ন পত্রিকায় ছাপা হলে যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্রের উচ্চবিত্তদের মধ্যে ক্রিসমাস ট্রি সাজানোর প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে যায়।
নিরাপদ আলোকসজ্জার জন্য ১৮৮২ সালে টমাস আলফা এডিসনের সহযোগী এডওয়ার্ড জনসন ক্রিসমাস ট্রিতে বৈদ্যুতিক বাতির ব্যবস্থা করেন। এর পর থেকে মোমবাতির পরিবর্তে বৈদ্যুতিক বাতির ব্যবহার শুরু হয়।
১৮৮৯ সালে যুক্তরাষ্ট্রের ২৩তম প্রেসিডেন্ট বেঞ্জামিন হ্যারিসনের আমলে প্রথমবারের মতো হোয়াইট হাউসে ক্রিসমাস ট্রি সাজানো হয়। এর পর থেকে যতই দিন গেছে ততই ক্রিসমাস ট্রি বড়দিনের মূল আকর্ষণ হয়ে উঠেছে।
ঐতিহ্য অনুসারে, ২৪ ডিসেম্বর ক্রিসমাস সন্ধার আগে ট্রি সাজানো যায় না। আর এটি সরিয়ে ফেলা হয় ১২তম রাতে অর্থাৎ ৬ জানুয়ারি আর অনেকেই মনে করেন এই নিয়ম না মানা হলে অমঙ্গল হতে পারে।
তবে প্রথাগতভাবে না হলেও এখন ক্রিসমাস ট্রি আরো আগে সাজানো হয়। জার্মানিতে এটা ঐতিহ্য অনুসারে ২৪ ডিসেম্বরে সাজানো হয় এবং ৭ জানুয়ারি খুলে ফেলা হয়। ক্যাথলিকদের রীতিতে এটি জানুয়ারির শেষ পর্যন্ত সাজিয়ে রাখা হয়। অস্ট্রেলিয়ায় এটি ডিসেম্বরের শুরুতে সাজিয়ে গ্রীষ্মের ছুটি পর্যন্ত রাখা হয়।
নানা দেশে নানা প্রজাতির গাছকে ক্রিস্টমাস ট্রি হিসেবে সাজানো হয়। তবে মূল ক্রিস্টমাস ট্রি হিসেবে বিবেচনা করা হয় Picea abies নামক গাছকে। এই গাছটির আদি নিবাস ইউরোপ। এই গাছটিকে সাধারণভাবে বলা হয় European spruce।
অনেক সময় একে Norway Spruce-ও বলা হয়। এর গণের নাম Picea, গ্রিক pissa শব্দ থেকে গৃহীত হয়েছে। কিন্তু শব্দটি সাধারণভাবে ইউরোপে Picea বলতে পাইন গাছকে বোঝায়। আর abies হলো ফার জাতীয় গাছের সাধারণ নাম।
এটি একটি দ্রুত বর্ধনশীল চিরসবুজ বৃক্ষ। লম্বায় প্রায় ৩৫-৫৫ মিটার (১১৫-১৮০ ফুট) লম্বা হয়ে থাকে। নরওয়েতে ৬৩ মিটার (২০৭ ফুট) লম্বা এই গাছ পাওয়া গেছে। পূর্ণবয়স্ক গাছের গুঁড়ির বেড় হয় প্রায় এক থেকে দেড় মিটার। এদের পাতা সুচের মতো। পাতার রং গাঢ় সবুজ।