ঝুলন গোস্বামী | বিশ্ব ক্রিকেটের সুপারস্টার Jhulan Goswami

ঝুলন গোস্বামী | বিশ্ব ক্রিকেটের সুপারস্টার Jhulan Goswami

দেশের অন্যতম সেরা মেয়ে ক্রিকেটার   ঝুলন গোস্বামী (Jhulan Goswami)। চাকদহের সাধারণ ঘরের মেয়ে থেকে বিশ্ব ক্রিকেটের সুপারস্টার, নিজের জীবনের গল্প। একজন ভারতীয় বাঙালি আন্তর্জাতিক খ্যাতি সম্পন্ন মহিলা ক্রিকেটার যিনি ভারতীয় মহিলা ক্রিকেট দলের প্রাক্তন অধিনায়ক। ক্রিকেটার হিসেবে ঝুলন ডান-হাতি ব‍্যাটসম‍্যান এবং তাঁর বোলিংয়ের ধরন ডান-হাতি মিডিয়াম ফাস্ট। ১৯৮২ সালের ২৫ নভেম্বর নদীয়া জেলার চাকদহ পৌরসভার ১৫নং ওয়ার্ডের লালপুরে ঝুলন গোস্বামীর জন্ম হয়। ঝুলনের ডাকনাম বাবুল। তাঁর বাবা নিশীথ গোস্বামী এয়ার ইন্ডিয়ার একজন ক্যান্টিন কর্মী। তাঁর মা ঝর্ণা গোস্বামী গৃহবধূ। ছোট থেকে ফুটবলের প্রতি আকর্ষন থাকলেও টেলিভিশনে ১৯৯২ বিশ্বকাপ ক্রিকেট দেখার পর ক্রিকেটের প্রতি ঝুলনের টান তৈরী হয়।

পরবর্তী সময়ে ১৯৯৭ সালে মহিলা ক্রিকেট বিশ্বকাপে অংশগ্রহনকারী অস্ট্রেলিয়ান ব্যাটসওম্যান বেলিন্ডা ক্লার্ক এর দ্বারা অনুপ্রানিত হন তিনি। এলাকার ফ্রেন্ডস ক্লাব ও নবারুন সমিতিতে তাঁর ক্রিকেট জীবনের সূত্রপাত হয়। চাকদহ থেকে সুদূর কলকাতার বিবেকানন্দের পার্কে শুরু করেন অনুশীলন। কোচ স্বপন সাধুর কাছ থেকে ঝুলন গোস্বামীর ক্রিকেটের প্রথাগত প্রশিক্ষণ শুরু হয় বিবেকানন্দ পার্কে। বোলার হিসেবে তাঁকে খেলা শুরু করার পরামর্শ দেন কোচ স্বপন সাধুই।

এরপর আর পিছন ফিরে তাকাতে হয়নি এই কিংবদন্তি খেলোয়াড়কে। একে একে বেঙ্গল উইমেন্স, ইস্ট জোন উইমেন্স, ভারতের জাতীয় মহিলা ক্রিকেট দল এমনকি এশিয়ান উইমেন্স ইলেভেন দলের হয়ে প্রতিনিধিত্ব করে এক অনন্য নজির সৃষ্টি করেছেন ঝুলন গোস্বামী। ২০০২ সালে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে অভিষেক হয় ঝুলন গোস্বামীর। পরবর্তীকালে অধিনায়কও হয়েছেন ভারতের জাতীয় মহিলা ক্রিকেট দলের।

৩০০ টির বেশি উইকেট রয়েছে তাঁর ঝুলিতে । মহিলা ক্রিকেটার হিসেবে ওয়ানডে ক্রিকেটে সর্বোচ্চ উইকেট অধিকারীর রেকর্ড তাঁর দখলে। এই রেকর্ড গড়ে তিনি পিছনে ফেলেছেন অস্ট্রেলিয়ার ক্যাথরিন ফিটজপ্যাট্রিককে। ফিটজপ্যাট্রিকের উইকেটসংখ্যা ছিল ১৮০। পোচেস্ট্রুমে দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে ঝুলন এই রেকর্ড গড়েন। ২০০২ সালের ১৪ই জানুয়ারী ইংল্যান্ডের বিপক্ষে একদিনের ক্রিকেটে ১৯ বছর বয়সী ঝুলনের আন্তর্জাতিক অভিষেক হয়েছিল লখনৌতে। মহিলাদের ক্রিকেটে অন্যতম দ্রুততম বোলার হিসেবে তাঁকে বিবেচনা করা হয়। কেরিয়ারে তাঁর সেরা বোলিং পরিসংখ্যান ৩১ রানে ৬ উইকেট। তাঁর সংগ্রহে এখন এখনও পর্যন্ত খেলেছেন ১৬৪টি ম্যাচ খেলে ১৯৫টি উইকেট রয়েছে। ২০০৫ এবং ২০১৭ এই দুইবছর মহিলা বিশ্বকাপ ক্রিকেটের ফাইনালে পৌঁছায় ভারতীয় মহিলা ক্রিকেট দল।

২০১৭ বিশ্বকাপ ফাইনালে ১০ ওভারে ৩টে মেডেন ওভার সহ ২৩ রান দিয়ে ৩ উইকেট পান ঝুলন। তবে দুইবার বিশ্বকাপ ফাইনালে পৌঁছালেও বিশ্বকাপ জয় এখনও অধরাই রয়ে গেছে ভারতীয় মহিলা ক্রিকেট দলের। একদিনের আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে ১৬৪টি ম্যাচ খেলে ঝুলনের ঝুলিতে ৯৯৫ রান। ২০০৬-০৭ মরসুমে তিনি ইংল্যান্ডে বিরুদ্ধ প্রথম টেস্ট সিরিজ জয়ে ভারতীয় দলের হয়ে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। ২০০৬ সালে ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে টেস্ট সিরিজে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেন ঝুলন। প্রথম টেস্ট ম্যাচে নাইটওয়াচম্যান হিসেবে ব্যাট করতে নেমে অর্ধশত রান করেন। দ্বিতীয় টেস্টে দুই ইনিংস মিলিয়ে ১০টি উইকেট দখল করেন তিনি।

প্রথম ইনিংসে ৩৩ রান দিয়ে ৫ উইকেট এবং দ্বিতীয় ইনিংসে ৪৫ রান দিয়ে ৫ উইকেট দখল করেন ঝুলন। ভারত এই টেস্ট সিরিজটি জয়লাভ করে। ১০টি টেস্টে ঝুলনের উইকেট সংখ্যা ৪০টি এবং মোট রান ২৮৩। টি-টোয়েন্টিতে ৬০টি ম্যাচ খেলে ঝুলনের সংগ্রহ ৫০টি উইকেট, মোট রান ৩৯১। সব ধরনের ক্রিকেট মিলিয়ে ৩৮ বছর বয়সী এই পেসারের সংগ্রহে রয়েছে ২৮৫টি আন্তর্জাতিক উইকেট। টেস্ট সিরিজে ঝুলন গোস্বামীর কৃতিত্বকে সম্মান জানিয়ে ঝুলনকে বিশেষ পুরস্কার হিসেবে মুম্বাইতে ক্যাস্ট্রল অ্যাওয়ার্ড প্রদান করা হয়। তিনি ২০০৭ সালের বর্ষসেরা আইসিসি মহিলা খেলোয়াড় হিসাবে পুরস্কার লাভ করেন। প্রথম ভারতীয় মহিলা ক্রিকেটার হিসেবে আইসিসি বর্ষসেরা মহিলা ক্রিকেটার পুরস্কার পান ঝুলন গোস্বামী। দক্ষিণ আফ্রিকার জোহেনসবার্গে এই পুরস্কারটি গ্রহণ করেন ঝুলন।

২০১১ সালের শ্রেষ্ঠ নারী ক্রিকেটার হিসেবে এম এ চিদাম্বরম ট্রফি পান তিনি। সাম্প্রতিক সময়ে তিনি ভারতীয় নারী ক্রিকেট দলের অধিনায়কত্ব থেকে সরে এসেছেন। ২০১০ সালের ২৯, আগস্ট অর্জুন পুরস্কারে ভূষিত হন ঝুলন গোস্বামী। তৎকালীন মাননীয়া রাষ্ট্রপতি প্রতিভা পাতিল দিল্লির রাষ্ট্রপতি ভবনে ঝুলনের হাতে এই সম্মান তুলে দেন। ক্রীড়া ক্ষেত্রের বিশেষ অবদানের জন্য ভারতের চতুর্থ সর্বোচ্চ নাগরিক সম্মান পদ্মশ্রী পুরস্কার লাভ করেন ঝুলন ২০১২ সালে।

২০১৭ সালে কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয় ডি. লিট সন্মান দিয়ে সন্মানিত করে প্রাক্তন ভারত অধিনায়ক এবং বর্তমানে একদিনের ম্যাচে বিশ্বে সর্বোচ্চ উইকেটের অধিকারী ঝুলন গোস্বামীকে। রাজ্যপাল কেশরীনাথ ত্রিপাঠী সান্মানিক ডি লিট তুলে দেন ঝুলন গোস্বামীর হাতে। বাংলা তো বটেই, ভারতে প্রথম কোনও মহিলা ক্রিকেটার এই ডি. লিট সন্মান পেয়েছেন। সম্প্রতি ঝুলন গোস্বামীর ওপর একটি বায়োপিক আসতে চলেছে সেলুলয়েডের পর্দায়। ছবিটি পরিচালনা করেছেন সুশান্ত দাস। নাম ভাবা হয়েছে ‘চাকদহ এক্সপ্রেস’।

নাম ভূমিকায় অভিনয় করতে দেখা যাবে অভিনেত্রী অনুষ্কা শর্মাকে। ভারতীয় নারীদের মধ্যে এক উজ্জ্বল নক্ষত্র ঝুলন গোস্বামী । সম্প্রতি ইডেনে গার্ডেন্সে সৌরভ গাঙ্গুলির মূর্তির পাশাপাশি সৌরভ নিজেই নাকি ঝুলন গোস্বামীর মূর্তি বসানোর প্রস্তাব দিয়েছেন। মহিলাদের একদিনের ক্রিকেটে সর্বোচ্চ উইকেট সংগ্রাহক ঝুলন গোস্বামী আজও ভারতের বোলিং লাইনআপের মূল চালিকাশক্তি।  ১৬ জুন এক অভিনব রেকর্ড গড়লেন ভারতের  দুই মহিলা ক্রিকেটার। তারকা ঝুলন গোস্বামী ও মিতালি রাজ পিছনে ফেললেন সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়, রাহুল দ্রাবিড় ও অনিল কুম্বলেদের। তাঁরা এমন রেকর্ড গড়লেন যা খুব কম ক্রিকেটারেই ভাবতে পারেন। মহিলা ক্রিকেটার হিসেবে ভারতের হয়ে সবচেয়ে বেশিদিন বাইশ গজে খেলার রেকর্ড গড়লেন তাঁরা। 

মহিলা বিশ্বকাপে ইতিহাস বাংলার ঝুলন গোস্বামীর (Jhulan Goswami)। ছুঁয়ে ফেললেন বিশ্বরেকর্ড। ৩৯টি উইকেট নিয়ে যুগ্মভাবে বিশ্বকাপে সব থেকে বেশি উইকেট নেওয়ার রেকর্ড স্পর্শ করলেন তিনি। চলতি বিশ্বকাপে নিউ জিল্যান্ডের বিরুদ্ধে উইকেট পাওয়ার পর যুগ্মভাবে সর্বোচ্চ উইকেট শিকারী হয়েছিলেন ঝুলন। নিউজিল্যান্ডের বিরুদ্ধে একেবারে শেষ ওভারে উইকেটকিপার কেটি মার্টিনকে আউট করে ৩৯টি উইকেট পেলেন ঝুলন (Jhulan Goswami's World Record)।  

যুগ্মভাবে মহিলা বিশ্বকাপে সব থেকে বেশি উইকেট নেওয়ার রেকর্ডে অস্ট্রেলিয়ার প্রাক্তন লিন ফুলস্টোনের সঙ্গে একই আসনে বসলেন ঝুলন (Jhulan Goswami)। ফুলস্টোন ১৯৮২ ও ১৯৮৮ দু'টি বিশ্বকাপের ২০টি ম্যাচে মাঠে নেমে ৩৯টি উইকেট নিয়েছিলেন। ঝুলন ২০০৫ থেকে ২০২২ পর্যন্ত মোট ৫টি বিশ্বকাপের ৩০টি ম্যাচে মাঠে নেমে এই নিয়ে ৩৯টি উইকেট দখল করতে সফল।

 এদিন ওয়েস্ট ইন্ডিজের ইনিংসের ৩৬ তম ওভারে আনিসা মহম্মদের উইকেট নিয়ে বিশ্বরেকর্ড করে ফেললেন চাকদহ এক্সপ্রেস। বিশ্বকাপে এখন তিনি ৪০টি উইকেট পাওয়া বোলার।  বিশ্বকাপের ৩১টি ম্যাচে ৪০টি উইকেট। ঝুলনের এমন রেকর্ড অসাধারণ বললেও হয়তো কম বলা হবে। আর এবার বিশ্বকাপে যেন কেরিয়ারের সেরা ফর্মে রয়েছেন বাংলার পেসার।  অস্ট্রেলিয়ার প্রাক্তন বোলার ফুলস্টোন ১৯৮২ ও ১৯৮৮ সালের দু'টি বিশ্বকাপে ২০টি ম্যাচে ৩৯টি উইকেট পেয়েছিলেন। এবার ঝুলন ২০০৫-২০২২ পর্যন্ত ৫টি বিশ্বকাপ খেলে ৩১টি ম্যাচে ৪০টি উইকেট পেলেন।