কালনা | মন্দির ময় বাংলার সুপ্রাচীন শহর অম্বিকা Kalna

কালনা পশ্চিমবঙ্গের পূর্ব বর্ধমান জেলার একটি পৌর অঞ্চল তথা জেলার কালনা Kalna মহকুমার সদর। পাঁচটি ব্লকে ৪৭টি গ্রাম পঞ্চায়েত এবং ছয়টি জনগণনা নগর বা সেন্সাস টাউন কালনা। এই মহকুমাটিতে কালনা মিউনিসিপালিটি সহ পাঁচটি ব্লক যথাঃ কালনা ১, কালনা ২, মন্তেশ্বর, পূর্বাস্থলী ১ ও পূর্বাস্থলী ২।২০০১ সালের জনগণনা অনুসারে, কালনার জনসংখ্যা ৫২,১৩৬। এর মধ্যে পুরুষ ৫১% ও মহিলা ৪৯%। কালনার সার্বিক সাক্ষরতার হার ৭৭% ; যা জাতীয় গড় ৫৯.৫%-এর চেয়ে অনেকটাই বেশি।
পুরুষ সাক্ষরতার হার ৮২% ও মহিলা সাক্ষরতা ৭২%। কালনার জনসংখ্যার ৯%-এর বয়স ৬ বছরের নিচে। কালনা মহকুমায় চিকিৎসার প্রধান কেন্দ্র কালনা মহকুমা হাসপাতাল। হাসপাতালটি প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯৭১ সালে। এসটিকেকে রোডের ধারে ১৩.৫৩ একর জমির উপর অবস্থিত এই হাসপাতালে মোট ৩০০টি বেড আছে। বর্ধমান জেলার যে সকল অঞ্চলের ভূগর্ভস্থ জলে আর্সেনিক দূষণ পাওয়া গেছে কালনা তার মধ্যে অন্যতম।
পঞ্চাশের দশকে পূর্ব পাকিস্তান থেকে আগত শরণার্থীদের জনস্রোত এই অঞ্চলের জনসংখ্যার বৃদ্ধি ঘটাতে সাহায্য করেছিল। ভাগীরথীর পশ্চিম তীরে অবস্থিত এই শহরটি অম্বিকা কালনা নামে জনপ্রিয়। পঞ্চদশ-ষোড়শ শতকে এই স্থানটি উল্লিখিত হয়েছে আম্বুয়া বা অম্বুয়া মুলুক নামে। স্থানীয় দেবী অম্বিকার নামানুসারেই শহরের এই নামকরণ।জেলাসদর বর্ধমান শহরের থেকে প্রায় ৬০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত কালনায় একাধিক দর্শনীয় স্থান রয়েছে। এগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল কালনার রাজবাড়ি, প্রতাপেশ্বর মন্দির, কৃষ্ণচন্দ্রজি মন্দির, লালজি মন্দির ও ১০৮ শিবমন্দির। ঐশ্বর্যপূর্ণ পোড়ামাটির মন্দির দ্বারা সমৃদ্ধ অম্বিকা কালনাকে আসলে “মন্দিরের শহর” বলা হয়।
সুপ্রাচীন শহর কালনা। ভাগিরথী নদীর এক পাশে রয়েছে কালনা আর তেমনই অপর পাশে রয়েছে নদীয়া জেলার শান্তিপুর। ইতিহাসের পাতায় আঁবুয়া, অম্বুয়া, অম্বিকা নামে পরিচিত লাভ করেছিল এই কালনা শহর। বর্তমানে পশ্চিমবঙ্গের পূর্ব বর্ধমান জেলার অন্তর্গত ১৮৬৯ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় কালনা পৌরসভা।বৈষ্ণব, শাক্তপীঠ ও ইতিহাসের অন্যতম নিদর্শন হল কালনা । প্রাচীন এই কালনা শহর ছিল বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির এক অপরূপ মেলবন্ধন । মধ্যযুগের স্থাপত্য ও ভাস্কর্য শিল্পের বহুনিদর্শনও এখানে দেখতে পাওয়া যায় । একই সঙ্গে হিন্দু , মুসলিম , বৌদ্ধ এবং জৈনসংস্কৃতির প্রভাব ও লক্ষ্য করা যায়।
অনেকে বিশ্বাস করেন যে , অম্বিকা দেবীর মন্দির আদিতে জৈন মন্দির ও এখানে জৈন দেবতা ছিলেন। আবার একই সময় কালনা সংস্কৃতির প্রাণকেন্দ্র হয়ে ওঠে শ্রীচৈতন্য ও নিত্যানন্দের প্রভাবে। কালনা শহরের সংস্কৃত সাহিত্যের পন্ডিত তারানাথ তর্কবাচষ্পতি মহাশয়কে কলকাতার সংস্কৃত কলেজে নিয়োগের জন্য কালনায় আসেন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর ১৮১২ সালে ।শাক্ত কবি কমলাকান্তের জন্ম কালনার বিদ্যাবাগীশ পাড়ায় ১৭৭১সালে। অতীতে এক সুবিশাল বন্দরনগরী ছিল কালনা। একসময় বর্ধমান রাজাদের গ্ৰীষ্মাবাও ছিল এই কালনা নগরী। অম্বিকা কালনার অম্বিকা জৈনদেবী ছিলেন। পরে তিনি হিন্দু শক্তি পূজায় স্বাতন্ত্র্য বিসর্জন দিয়েছেন । বৌদ্ধতন্ত্রের প্রভাবের যুগেই বাংলাদেশে অম্বিকা পূজার প্রচলন ছিল মনে হয় । অর্থাৎ পাল যুগে । অম্বিকা কালনার ইতিহাস হিন্দু পাল যুগ পর্যন্ত বিস্তৃত নাহলে ” অম্বিকা ” কথার ব্যাখ্যা করা যায় না ” ।
বৃন্দাবন দাস তাঁর চৈতন্য ভগবতে অম্বিকা কালনা কে উল্লেখ করেছেন– “সপ্তগ্ৰামের অম্বয়া মুলুক বলে উল্লেখ করেছেন। পশ্চিমবাংলার পোড়াইটের তৈরি দেউলরীতি প্রসিদ্ধ টেরাকোটার কাজের শ্রেষ্ঠ নিদর্শন হলো বাঁকুড়া জেলার বিষ্ণুপুর শহর। কিন্তু তারপর যার কথা বলতেই হবে সে হল বর্ধমানের কালনা, যার আরেক নাম মন্দির নগরী । কালনাতে রয়েছে টেরাকোটার অপরূপ মন্দিরসমূহ। আর এই মন্দিরগুলোতে সপ্তদশ, অষ্টাদশ ও উনবিংশ শতকের শিল্পীরা দেউলরীতি সমৃদ্ধ তাদের অপরূপ টেরাকোটার কাজ দিয়ে রামায়ণ, মহাভারত, কৃষ্ণলীলা, পৌরাণিক গল্প কথা সহ বিভিন্ন গাছপালা , মানুষের সামাজিক জীবন ও জীবজন্তুর ছবি অলংকৃত করেছেন।
অম্বিকা কালনার ” জোড়বাংলা” শৈলীর একমাত্র মন্দিরটি হলো অম্বিকা সিদ্ধেশ্বরী মহামায়ার। এই দেবীকে অনেকেই মনে করেন যে ইনি জৈন দেবী। আর তাঁরই নামানুসারে হয় শহরের নামকরণ। পূর্বে” অম্বিকা”ও “নিজ কালনা” নামে দুটি আলাদা অঞ্চল ছিল। পরবর্তীকালে স্থান দুটি একীকরণ করে নাম হয় ” অম্বিকা কালনা” । সাধারণের কাছে এই দেবী ” সিদ্ধেশ্বরী কালী” নামে পরিচিত হলেও মন্দিরের প্রবেশদ্বারের উপরে যে শ্বেত পাথরের ফলক লাগানো আছে তাতে দেবীকে ওই পূর্বোক্ত নামেই অভিহিত করা হয়েছে। অতীতের কথা থেকে জানা যায় বর্ধমান রাজ কীর্তি চন্দ্রের পুত্র ছিলেন চিত্রসেন রায়।
দক্ষ প্রশাসক ও প্রশাসন গুণে বাংলা সুবাদার নবাব ও দিল্লীশ্বরের অত্যন্ত প্রিয় ছিলেন তিনি । চিত্রসেনই সর্বপ্রথম দিল্লির বাদশাহ মোঘল সম্রাট মহম্মদ শাহ কর্তৃক “রাজা” উপাধি লাভ করেন ১৭৪১ খ্রিস্টাব্দে। তখনকার সময় গভীর জঙ্গলে ভরা ছিল আজকের ব্যাণ্ডেল- নবদ্বীপ রেলপথের অম্বিকা কালনা।একদিন রাজা চিত্রসেন রায় ঘোড়ায় চেপে যাচ্ছিলেন। হঠাৎ করেই তার কানে এল ঘন্টা বাদ্যের ধ্বনি। রাজা তা লক্ষ্য করেই জঙ্গলের গভীরে ঢুকে পড়লেন । দেখলেন জনহীন একটি প্রাচীন ভাঙ্গা মন্দির ।
গর্ভ মন্দিরে বিগ্রহের সামনে সাজানো রয়েছে পুজোর নানা উপকরণ । সেই দেখেই রাজা প্রাসাদে ফিরে চলে এলেন । ১৭৩৯ সালে প্রাচীন ধ্বংসপ্রাপ্ত মন্দির ক্ষেত্রেই নতুন মন্দির নির্মাণ করে নিত্য পূজার ব্যবস্থা করেছিলেন রাজা চিত্রসেন রায় । কালনায় যতগুলো মন্দির আছে তার মধ্যে সিদ্ধেশ্বরী মন্দিরের স্থাপত্যরীতির একেবারেই অনন্য সাধারণ । কালী বা কালিকা হলেন একজন হিন্দু দেবী ।তাঁর অন্য নাম শ্যামা বা আদ্যা শক্তি। প্রধানত শাক্ত ধর্মাবলম্বীরা কালীর পূজা করেন। তন্ত্র শাস্ত্রের মতে , তিনি দশমহাবিদ্যা নামে পরিচিত তন্ত্র মতে পূজিত প্রধান দশজন দেবীর মধ্যে প্রথম দেবী। বাঙালি হিন্দু সমাজে দেবী কালীর মাতৃরূপের পূজা বিশেষ জনপ্রিয়।
পুরাণ ও তন্ত্র গ্রন্থগুলোতে বিভিন্ন রূপের বর্ণনা পাওয়া যায় । বাণেশ্বর শিব মন্দিরের মত একই উচ্চতাবিশিষ্ট গম্বুজাকৃতি আরেকটি যে মন্দির সহজেই নজর কাড়ে তা হল সিদ্ধেশ্বরী মন্দির ।খুব জাগ্ৰত এই দেবী কালের বিবর্তনে হিন্দু ধর্মের দেবী কালীতে রূপান্তরিত হয়ে সিদ্ধেশ্বরী মাতা নামে পরিচিত হয়েছেন । ভাদুড়ী পাড়ায় অবস্থিত মন্দিরের বিগ্রহ নিম কাঠ দিয়ে তৈরি করে সাধনায় বসেন সাধক অম্বরীশ ,৬৮৮ সনে সিদ্ধিও লাভ করেন এই সাধক । কিন্তু তখন কোন মূর্তি ছিল না। মন্দিরটি উঁচু ভিত্তি-বেদির ওপর প্রতিষ্ঠিত। মন্দিরটিতে উঠবার জন্য আটটি ইটের ঢেউখেলানো সিঁড়ি ও একটি পাথর বসানো সিঁড়ি আছে ।
গায়ে পোড়ামাটির কাজ । দরজাটি আকারে বিশাল নয়। প্রাচীন মন্দিরের গর্ভগৃহ একেবারে জমজমাট। বসনে ভূষনে সুসজ্জিতা দেবী। মাথায় মুকুট , নাকে নথ । করুণাঘন ফালা ফালা চোখ। মাধুর্যে ভরা মুখমন্ডল । উচ্চতায় চার থেকে পাঁচ ফুট। দেখলে মনে হয় কষ্টিপাথরের। দক্ষিণ দুই হস্তে বরাভয় মুদ্রা। বামের ঊদ্ধহস্তে খর্পর,নিম্নহস্তে নরমুন্ড। দেবী দারু নির্মিত হলেও শিবের মূর্তিটি কিন্তু দারু নির্মিত নয়। যোগী অম্ব্ঋষি প্রতিষ্ঠিত পঞ্চমুন্ডের আসনে প্রাচীন ঘটটি ডানদিকে অবস্থিত।মা সিদ্ধেশ্বরীর প্রতিবছর কার্তিকী দীপান্বিতা কালীপুজোয় দেবীর পুজো হয় বিশেষ জাঁকজমকে ।
কালনার আরেক অনন্য কীর্তি তার নবকৈলাস বা ১০৮ শিব মন্দির। ১৮০৯ সালে বর্ধমানরাজ তেজবাহাদুরের গড়া শিল্প সুষমামন্ডিত মন্দিররাজির স্থাপত্য ও গঠনশৈলী অনবদ্য। প্রাচীরে বেষ্টিত বৃত্তাকারে দুই সারিতে মন্দির তৈরী হয়েছে। একটি কালোপাথরের লিঙ্গে শিবঠাকুর। মন্দির চত্বরের কেন্দস্থলে দাঁড়লে প্রতিটা লিঙ্গমূর্তিই একসঙ্গে দেখা যায়। বিপরীত দিকে রাজবাড়ি চত্বরে বর্ধমানরাজদের গড়া টেরাকোটায় সমৃদ্ধ পঁচিশ চুড়োর লালজীর বাটি, প্রতাপেশ্বর মন্দির আর কিছুদূরেই রাসমঞ্চ।
এখানে দেবতা রূপে পূজিত হন রাধাকৃষ্ণ। পাশেই টেরাকোটায় সমৃদ্ধ পঁচিশ চুড়োর কৃষ্ণচন্দ্রের মন্দির। মহালয়ার সময় সাজি উৎসবে শ্রীকৃষ্ণচরিত প্রদর্শিত হয়। প্রাচীরে বেষ্টিত মন্দির ত্রয়ীর স্থাপত্য ও ভাস্কর্যে অভিনবত্ব আছে। নানান পৌরানিক আখ্যান রূপ পেয়েছে টেরাকোটায়। রাজবাড়ির ভিতরে প্রতাপেশ্বর শিব মন্দিরটিও টেরাকোটায় সমৃদ্ধ। নানা পৌরাণিক আখ্যানের সঙ্গে অন্তঃপুরিকারদের রোজনামচা রূপ পেয়েছে টেরাকোটায়।
তেমনই গঙ্গাতীরের শ্রীশ্রীজগন্নাথ মন্দির, রাম-সীতার মন্দির দুটিও দ্রষ্টব্য। আর চকবাজারে আছে সাধক ভগবানদাস বাবাজীর আশ্রম, কালীনগর পাড়ায় বুদ্ধ মন্দির, স্বামী নিগমানন্দ সরস্বতী প্রতিষ্ঠিত জ্ঞানানন্দ মঠ, নিত্যানন্দ প্রভুর শ্বশুরবাড়ি কুলতলায়, সিদ্ধেশ্বরী মোড়ের কাছে গোপালবাড়ি, জগন্নাথ ঘাটের কাছে জোড়া শিব মন্দির। নেপালের রাজকুমারীর প্রতিষ্ঠিত আনন্দ আশ্রম।
কালনার আরও এক বৈশিষ্ট্য শ্রাবনী শুক্লা সপ্তমী তিথিতে দুর্গাপুজো। কালনার নবতম আকর্ষণ শীতে পরিযায়ী পাখিরা উড়ে এসে বসে গঙ্গার বুকের বিশাল চড়ে। পক্ষী আবাসও গড়ে তুলতে চলেছে জেলা পরিষদ। কালনার আগের স্টেশন হুগলি জেলার গুপ্তিপাড়া। গুপ্তিপাড়াতেও আকবরের কালে দশনামী সন্ন্যাসীদের বৃন্দাবন চন্দ্র ছাড়াও নানান মন্দির গড়ে ওঠে। টেরাকোটায় সমৃদ্ধ এই মন্দিররাজি গুপ্তিপাড়ার মঠ নামে খ্যাত। ৪০০ বছরের নয়চালার রথেরও প্রশস্তি আছে। এছাড়াও দেশ কালীমাতা, চৈতন্য ছাড়াও নানা মন্দির আছে গুপ্তিপাড়ায়।
সড়ক, রেল ও জলপথে ৮২ কিলোমিটার দূরের কলকাতার সঙ্গেও সংযোগ গড়েছে কালনা। কলকাতা থেকে কাটোয়ার প্রতিটি ট্রেন ঘন্টা দুয়েকে কালনা পৌঁছচ্ছে। ৮০ থেকে ১০০ টাকা খরচ করে রিকশায় ঘন্টা চারেকে কালনা ঘুরে নেওয়া যায়। দিনের শেষে অম্বিকা কালনা থেকে লোকাল ট্রেনে চেপে ঘন্টা আড়াইয়ে কলকাতা ফিরুন। হাওড়া অথবা শিয়ালদহ থেকে কাটোয়া লোকাল এ অম্বিকা কালনা পৌঁছে সেখান থেকে টোটো বা রিকসা নিয়ে আপনি পুরো মন্দির নগরী ঘুরে আসতে পারবেন এক বেলাতেই। অথবা গাড়ি নিয়ে প্রথমে ভি আই পি রোড দিয়ে এয়ারপোর্ট হয়ে বিরাটি মোড়ে বাম দিকে ঢুকে কল্যাণী এক্সপ্রেস হয়ে ঈশ্বর গুপ্ত সেতু পার করে সোজা আসাম লিংক রোড এবং এই রাস্তা ধরে কালনা।